আজকের দেশব্রতী : ১০ মার্চ ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
ajker_deshabrati_10_march_22

Protests in Siliguri demanding punishment for Anis Khan murderers

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ও প্রতিবাদের মুখ আনিস খানের হত্যা, পৌর নির্বাচনে সন্ত্রাস, বর্ধমান শহরে তুহিনা খাতুনকে তৃণমূল কাউন্সিলর কর্তৃক হত্যা, নরেন্দ্রপুর থানায় এআইএসএ-এআইপিডব্লিউএ কর্মীদের উপর নারকীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, আনিস খান হত্যার জন্য দায়ী আমতার তৃণমূল বিধায়ক ও আমতা থানার ওসিকে গ্রেপ্তার এবং পরিবেশ বিরোধী দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প বাতিলের দাবিতে ৪ মার্চ শিলিগুড়ি শহরে এক প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। মিছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয়ে হিলকার্ট রোড পরিক্রমা করে এয়ারভিউ মোড়ে সমাপ্ত হয়। মিছিলের শেষে বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য বাসুদেব বসু। মিছিলে নেতৃত্ব দেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, শরৎ সিংহ, নেমু সিংহ, মোজাম্মেল হক, মুক্তি সরকার, মীরা চতুর্বেদী, শাশ্বতী সেনগুপ্ত, সুমন্তি এক্কা, কৃষ্ণপদ সিংহ প্রমুখ।

Celebration of Women's Day

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কলকাতা সহ বিভিন্ন জেলায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে কর্মসূচি পালিত হয়। নারীদের মর্যাদা, স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে এবং হিংসা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্য-ভগ্নীত্ব ও মৈত্রীর সপক্ষে নারীকণ্ঠ সোচ্চার হয়। একই সাথে মহিলারা আওয়াজ তোলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির সপক্ষে।

কলকাতায় বিভিন্ন নারী সংগঠন, লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী ফোরাম-কালেকটিভ, ট্রান্স-জেন্ডার ও প্রান্তিক যৌনতার নারীদের সংগঠন যৌথ ভাবে আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন করে। মৌলালী থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য — ব্যানার-প্ল্যাকার্ড, পোস্টারে সুসজ্জিত মিছিল পথ হাঁটে। প্রায় সাতশো মহিলা তেজোদীপ্ত এই মিছিলে পায়ে পা মেলান। বেখুপ আজাদীর স্লোগান থেকে শুরু করে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে, নারীর উপর হিংসার বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দাবিতে এবং ইউক্রেনে রুশ হানার বিরুদ্ধে ও ন্যাটোর সম্প্রসারণবাদী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে শ্লোগানে নারীরা কলকাতার রাজপথে মুখরিত হন।

একইসাথে দেউচা পাচামি কয়লা খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে, আনিস খানের হত্যার ন্যায় বিচারের দাবিতে এবং এরাজ্যে পুলিশের ও শাসকের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে। হাত ধরাধরি করে করে হাঁটলেন বহু শ্রমজীবী নারী এবং কুইয়ার মানুষ। মিছিলে অংশগ্রহণ করে এআইপিডব্লিউএ, এআইআরডব্লিউও, শ্রমজীবী নারী মঞ্চ, দুর্বার, ক্ষেতমজুর সমিতি, দশ থেকে দশ হাজার নেট ওয়ার্ক এবং মৈত্রী নেটওয়ার্ক।

মিছিল শেষে ধর্মতলায় করপোরেশনের অফিসের পাশে এক সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নারীদিবস পালনকে আরও তাৎপর্যময় ও সামগ্রিকভাবে তুলে ধরে। বক্তব্য রাখেন আইপোয়ার পক্ষ থেকে ইন্দ্রাণী দত্ত, দশ থেকে দশ হাজারের পক্ষ থেকে মৈত্রেয়ী, শ্রমজীবী নারী মঞ্চ থেকে মুনমুন, সমভাবনা থেকে ট্রান্স আন্দোলন কর্মী রায়না, এআইআরডব্লিউও থেকে দীপা সেন রায়, ক্যুইয়ার ও ট্রান্স ফাউন্ডেশন থেকে উদীপ্ত রায়, ভাঙ্গরের অসংগঠিত শ্রমিক জাহানারা, ফেমিনিস্ট ইন রেজিস্ট্যান্স থেকে স্বপ্না, দুর্বার থেকে মিনতি শ্রমজীবী নারী সংঘের ইন্দ্রাণী ও সাথী, ঝুম্পা করোতোয়ার একক সঙ্গীত, যাদবপুরের পড়ুয়া বর্ষা বড়াল ও তার বন্ধুদের, গণ বিষাণের সঙ্গীত সভাকে আরো উৎসাহিত ও আকর্ষণীয় করে। আর্কড, ও তুষনির নাচ অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করে।

উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরে শাখা সমিতির শাখা দুদিনব্যাপী প্রচার কর্মসূচি নেয়। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নারী দিবসের দাবি সম্বলিত পোস্টার লাগানো হয়। এক ঘরোয়া আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় বিভিন্ন পেশার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মহিলারা অংশ নেন। সভা থেকে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্দেশ্যে কয়েক দফা দাবি সম্বলিত গণস্বাক্ষর সহ ডেপুটেশনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। হাওড়া জেলায় কামারডাঙ্গা, আমতা ও বাগনান এই তিনটি অঞ্চলে নারী দিবসের কর্মসূচি পালন করা হয় কৃষকদের সমিতির নিজস্ব উদ্যোগে। হুগলি জেলার হিন্দমোটর, গুপ্তিপাড়া ও বলাগড়ে নারিদিবসের কর্মসূচি পালন করেন সমিতির সাথীরা। বরুনান পাড়ায় ৬ মার্চ উৎসাহ সহকারে প্রায় ৫৫ জন মহিলাদের উপস্থিতিতে নারী দিবসের আলোচনা ও কর্মসূচি পালন হয়। আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও শ্রমজীবী মহিলারা নিজেদের কথাবার্তা তুলে ধরেন। হিজাব নিয়ে বলেন সাবিরা খাতুন। কবিতা, বক্তব্য ও আদিবাসী নৃত্য কর্মসূচিকে করে তোলে আকর্ষনীয়। বেথুয়াডহরি শাখার উদ্যোগে মহিলারা জমায়েত হন এবং নারী দিবসের তাৎপর্য আলোচনা করেন। নবদ্বীপ শহরে সমিতির কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। অংশ পুরসভার ভোটের দুই প্রার্থী পূজা ও কৃষ্ণা কর্মকার এবং এলাকার অন্য মহিলারা। উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ির হাসমিচকে ও শক্তিগড়ে শ্লোগান, বক্তৃতা, আবৃত্তি ও আলোচনার মধ্য দিয়ে দিবসের তাৎপর্য উপলব্ধি করা হয়। পরিচালনায় ছিলেন মহিলা সমিতির জেলা নেত্রীবৃন্দ।

the pension

কলকাতা কর্পোরেশন থেকে শুরু করে রাজ্যের জেলায় জেলায় ৯৯ শতাংশ পৌরসভায় ক্ষমতাসীন তৃণমূল। পরিষেবা সংস্কারের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ভাবমূর্তির দৌলতে, আবার এইসব প্রশ্নেই দুর্নীতি-দলতন্ত্রের শিকার হওয়া হয়রানি-বৈষম্য-বঞ্চনার প্রচুর প্রতিক্রিয়া সত্বেও যে সুকৌশলে অসম্ভব ‘জনপ্রিয়তাবাদ’কে সম্ভব করে তোলা হয়েছে তার নজির মেলা ভার। তবু তাড়া করে চলছে বকেয়া প্রশ্ন। মহানগরীর কর্পোরেশন নির্বাচন হওয়ার পরদিনই প্রভাতী দৈনিকে প্রকাশ হয়েছিল এক অদ্ভুত খবর। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারিদের গরিষ্ঠাংশের পেনশন বন্দোবস্ত পড়ে রয়েছে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার আবর্তে। বিশেষ করে ২০২১-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে যারা অবসর গ্রহণ করে আসছেন তাদের। কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের সূত্রের তথ্য হল, রাজ্যের কোষাগারের অবস্থা খুব খারাপ। রাজ্য সরকার যে পরিমাণ অর্থ দিচ্ছে তা অতি অল্পাংশের অবসরকালীন প্রাপ্য মেটাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রতি মাসেই কয়েকশো করে কর্মচারি অবসর নেবেন। তাদের আশি শতাংশের অবসরকালীন মোট প্রাপ্য মিলছে না। তার ওপর পেনশন চালু করা আরও অনির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। কবে এসব সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে শুরু হবে কোনও খবর নেই। নিয়মবশত আগে মেটানো দরকার অবসরকালীন প্রাপ্য, তার পেছন পেছন চালু হওয়া প্রয়োজন পেনশন। মেয়র আশ্বস্ত করতে বলছেন, যতই কোষাগারের টান পড়ুক, দরকার হলে ঠেকিয়ে রাখা হবে ঠিকাদারদের পাওনা, আগে চালু করা হবে পেনশন। এটা নাকি তাঁদের অগ্রাধিকারের নীতি! তা এতই যখন ঢাক পেটানো তাহলে তাঁদের রাজ্য সরকার কি এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না? নাহলে মোট যে পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা তার মাত্র পনেরো-বিশ শতাংশ ঠেকিয়ে হাত গুটিয়ে থাকছে কেন? মেয়র সাহেব তো দলনেত্রীর ঘনিষ্ট বলয়ে থাকা এবং মন্ত্রীসভায়ও মুখ্যমন্ত্রীর খুব কাছের, তো উপরোক্ত সমস্যার সমাধানে কোন কাজের কাজটা করছেন?

কর্পোরেশন সূত্রে অন্যরকম অশনি সংকেত নাকি পাওয়া যাচ্ছে! সেটা হল, অবসরকালীন প্রাপ্যর বড় অংশ আটকে রেখে পেনশন চালু করে দেওয়া হবে। চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার কবলে পড়া দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রিতার ফন্দি আঁটা হচ্ছে! এরকম শ্রমিক-কর্মচারিদের পাওনা টাকা আটকে রাখা, হিসাবে তালগোল পাকিয়ে দেওয়া — কারচুপি করা, টাকা মেরে দেওয়ার মতো বেআইনি ও ক্ষমাহীন অপরাধ করার রেওয়াজ আছে চটকল বা চা বাগান মালিকদের। কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকার বা কর্পোরেশন এসব করে কী করে? সংবিধানের পরোয়া না করে! আরও অভিযোগ আছে। কলকাতা কর্পোরেশনে যে হারে অবসর হচ্ছে সেই তুলনায় পদ ভরাট বা নিয়োগ হচ্ছে না। একেবারে কর্পোরেট মডেলে কাজ উধাও নীতি অনুসৃত হচ্ছে। যার অনিবার্য পরিণাম নিরন্তর কর্মসংকোচন। আর কাজের লোক ক্রমাগত কমে যাওয়ার অবাঞ্ছিত পরিণতি গড়াবে দুরকম। একদিকে যে শ্রমিক-কর্মচারিরা বহাল তাদের ওপর কাজের বোঝা আরও বাড়বে এবং পরিষেবা প্রদান আরও বিলম্বিত দীর্ঘসূত্রী হবে। কারও জানতে বাকি নেই, কলকাতা কর্পোরেশনে তৃণমূল আমলে হাজার হাজার অবসর গ্রহণ হয়ে আসছে। কিন্তু সহজে শূন্যপদ ভরানো হচ্ছে না। নিয়োগ নেই, অবসরকালীন প্রাপ্য মিটছে না, পেনশনও অনিশ্চিত।

Stop-Russia's-War-on-Ukraine

ইউক্রেন রাশিয়ার বৃহত্তম প্রতিবেশী এবং পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশ। সেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এক বড় রকমের আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি করেছে। রাশিয়ার বোমাবর্ষণে সাধারণ নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান প্রাণহানির এবং নিরাপত্তার জন্য বিপুলসংখ্যক ইউক্রেনীয়দের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ আসছে। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ-এ রাশিয়ার বোমাবর্ষণে অন্তত একজন ভারতীয় ছাত্র প্রাণ হারিয়েছেন, আর দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার ছাত্রদের, ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করলে বা সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ডে ঢোকার চেষ্টা করলে, বর্ণবিদ্বেষী আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে। পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্ক ও ডোনেস্ককে স্বাধীন গণ প্রজাতন্ত্র হিসাবে রাশিয়ার কূটনৈতিক স্বীকৃতির ঘোষণা এবং ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ হিসাবে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের পরপরই ইউক্রেনের উপর এই হামলা হল।

যুদ্ধ শুরু হতেই গোটা বিশ্ব প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণভাবে, রাশিয়ার মধ্যেও প্রতিবাদ চলছে, এমনকি মূলত রুশ-ভাষাভাষী লুহানস্ক ও ডোনেস্কের স্বীকৃতিকে আগে যারা সমর্থন জানিয়েছিলেন, তারাও সামিল হয়েছেন এই বিক্ষোভে। রাশিয়ার ও ইউক্রেনের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বন্ধন রয়েছে, পুলিশি দমন পীড়ন আর ব্যাপক ধরপাকড় সত্ত্বেও রাশিয়ার মানুষ অবিলম্বে যুদ্ধ থামানোর দাবি জানাতে রাস্তায় নেমেছেন। রাশিয়ার বহু বিশিষ্ট মানুষ প্রকাশ্যে যুদ্ধ বিরোধিতায় নেমেছেন। ৪০০০-এরও বেশি রুশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-সাংবাদিক যুদ্ধবিরোধী এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।

মাত্র এক শতাব্দী আগে, এই ভূখণ্ড এক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিপ্লবে পরিণত করেছিল! দুনিয়া কাঁপানো রুশ বিপ্লবের দশ দিন সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের দুর্বলতম জোড়ে আঘাত হেনে জারের রাশিয়াকে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশে পরিণত করেছিল! বিজয়ী বিপ্লব জারের সাম্রাজ্য যা প্রকৃত অর্থেই ছিল জাতিসত্তাগুলির কারাগার, তাকে পরিণত করছিল এক সমাজতান্ত্রিক সংঘে — গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ইউনিয়ন। জাতিসত্তা প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণও একটি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি ভাগ করে নিয়েছিল — প্রত্যেকটি জাতিসত্তার সদস্যপদে ইস্তফা দেওয়ার অধিকারসহ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছিল বহুজাতিক ঐক্যের এক আদর্শ। এটা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র নভেম্বর বিপ্লব জারের স্বৈরতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল বলেই নয়, ভীষণ উগ্র জাতীয়তাবাদ/ উৎকট স্বাদেশিকতাকেও অতিক্রম করতে পেরেছিল বলেও।

বেশ কয়েক বছর হল, সোভিয়েত সমাজবাদ তার পথ হারিয়েছে।আজ সমাজবাদের আমলাতান্ত্রিক অধঃপতন এবং জাতিসত্তাগুলোর সমাজতান্ত্রিক সংঘের ঐক্যের ক্ষয় সম্পূর্ণ পতন ডেকে নিয়ে এলো আর সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ইউক্রেন ১৯৯১-তে সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। বেশ কয়েক বছর ইউক্রেন একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছিল। সেই ভারসাম্য টলে গেল ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে ইয়ানুকোভিচ সরকারের পতন এবং তারপর রাশিয়ার বিরুদ্ধে রণকৌশলগত মিত্রতার খোঁজে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর।

২০১৪-র সংকট ও সংঘাতের সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানে মধ্যস্থতায় এগিয়ে এসেছিল ফ্রান্স ও জার্মানি। তার ফলশ্রুতিতে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে এক শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়া, ইউক্রেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং লুহানস্ক ও ডোনেস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা মিনস্ক-১ মিনস্ক-২ চুক্তি (সেপ্টেম্বর ২০১৪ ও ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ) নামে পরিচিত। এর ফলে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা হয় ও বৈরিতা খানিকটা কমে। কিন্তু রাশিয়ার হস্তক্ষেপে তৈরি হওয়া শক্তির ভারসাম্যহীনতার প্রতিফলন ঘটল চুক্তিতে, তাছাড়া চুক্তিগুলো কখনোই সম্পূর্ণ রূপায়িত হয়নি। ফলে আবার রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছালো। পুতিন ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে, “লেনিনের ইউক্রেন” বলে অভিহিত করলেন এবং লেনিনের উত্তরাধিকার ধ্বংসের জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন। আর ইউক্রেন ইইউ ও ন্যাটোর মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজতে লাগলো।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সমাধান এখনও হতে পারতো সুষ্ঠু বোঝাপড়ার মাধ্যমে এমন কোন চুক্তিতে যা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের বিষয়টির সঙ্গে আভ্যন্তরীণ বিকেন্দ্রীকরণ ও রুশ জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকারের নিশ্চয়তার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু ন্যাটোর বিরামহীন পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ও ইউক্রেনের রণকৌশলকগত জোটের জন্য ই ইউ এবং ন্যাটোর সঙ্গে থাকার জেদও এ পথে একটা অন্তরায়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর্বে এক সামরিক জোট সঙ্গী হিসেবে ন্যাটোর উপস্থিতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া এবং ওয়ারশ প্যাক্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর নিরর্থক হয়েছে। ন্যাটো শুধু একটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধই শুরু করেনি, প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৪৯-য়ে বারো থেকে ২০২০-তে ত্রিশ করার মাধমে ইউরোপে গভীরতর অনুপ্রবেশ চালিয়ে যাচ্ছে।

যদিও ন্যাটো এখনও ইউক্রেনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেয়নি আর সেই কারণে ইউক্রেনের সমর্থনে প্রকাশ্য সামরিক প্রতিশ্রুতি থামিয়ে রেখেছে, কিন্তু ই ইউ, যা আদতে একটি ব্যবসায়িক ব্লক, ইউক্রেনকে অস্ত্র কেনায় টাকা যোগানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে যথার্থ সামরিক জোটসঙ্গীতে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। যেহেতু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্য কথা শুরু হয়েছে, এখন দেখার সত্যিই দু’টি দেশ সমরাভিযান বন্ধ করে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে পারে কিনা।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেকার সংঘর্ষের বিশ্বব্যাপী তাৎপর্য ও প্রভাব নিয়ে ভীষণ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নতুন করে গোটা পৃথিবী জুড়ে সংঘাত এবং ন্যাটো ও রাশিয়া-চীন জোটের অস্ত্র-দৌড়ের অভ্রান্ত ইঙ্গিত রয়েছে। ইউরোপে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ রাশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের সম্ভাব্য সহযোগের মূল্যে মার্কিন সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স-এর স্বার্থকেও এগিয়ে নিয়ে যাবে। রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন ইতিমধ্যেই একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা বিশ্ব এখনও কোভিড-১৯ অতিমারীর ভয়াবহ ধ্বংসের যন্ত্রণা, বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা এবং লাফিয়ে বেড়ে চলা জলবায়ু পরিবর্তনের কষ্টের মধ্যে রয়েছে; এখন আবার আমরা এক ভয়ানক যুদ্ধের ভ্রূকুটিরও সম্মুখীন হয়েছি।

on-Ukraine-End-US-NATO-Expansionism

রাশিয়া এবং গোটা বিশ্বের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান-অভিযান এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ইতিহাস এক কঠিন শিক্ষা তুলে ধরে। আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ভেঙে পড়াকে পথ করে দিয়ে ত্বরান্বিত করেছিল। আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা সেখানে কয়েক দশক ধরে সন্ত্রাস এবং দখল ও লুঠের যুদ্ধকে স্থায়ী করেছিল। আর সে যুদ্ধ চালিয়েছিল আমেরিকা। ইউক্রেনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমী দেশগুলোর প্রকাশ্যে ফ্যাসিস্ট আধা সামরিক দলগুলোকে অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মদত দেওয়ার সংবাদ যথেষ্ট অশুভ ইঙ্গিতবাহী। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, ইউক্রেনের জন্য রাশিয়া ও পশ্চিমী দেশগুলোর কপট জোর-গলার সমর্থন অন্য সংঘর্ষগুলোর ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের একেবারে উল্টো। সে সব ক্ষেত্রে পশ্চিমী প্রচারে প্রতিরোধগুলিকে গৎ বাঁধা ছকে ‘শয়তানি চক্রান্ত’ বলে উল্লেখ করা হয়, যেমন প্যালেস্টিনীয়দের সংগ্রাম; আর যুদ্ধ-দীর্ণ দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হওয়া ভীত সন্ত্রস্ত শরণার্থীদের, যেমন সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের মানুষদের ‘মানুষ’ বলেই গ্রাহ্য করা হয়নি, হয় না। এগুলো কারও নজর এড়াতে পারে না! আমরা এটাও ভুলতে পারি না যে পুতিন নিজে ‘পরম মিত্র’ হিসেবে বুশ এবং ব্লেয়ারের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছিলেন, আদতে চেচনিয়ায় বর্বর হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে ! এই সমস্ত ভণ্ডামির পিছনে শুধু উগ্র বর্ণবাদ নয়, তার সঙ্গে আছে পশ্চিমী স্বার্থের ইউক্রেনকে ব্যবহার করে গোটা অঞ্চলে আধিপত্য কায়েমের সূক্ষ্ম চাতুরী।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ব মানবতার কারণে ইউক্রেন এবং রাশিয়া একযোগে হিটলারের ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের মোকাবিলা করে তাকে পরাস্ত করেছিল। আজ সেই অঞ্চল জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি নিজের জায়গা করে নিচ্ছে, শক্তি বাড়াচ্ছে, এই সংকটে এবং তার মানুষজনের আরও দীর্ঘকালীন যন্ত্রণাভোগের হুমকির মধ্যেই। সময়ের কী বিচিত্র পরিহাস! আমেরিকায় ট্রাম্প আগাগোড়াই পুতিনের ‘'স্মার্টনেসের'’ প্রশংসা করে গেছেন। আর ভারতে? আমরা দেখতে পাচ্ছি — কীভাবে ভারতের নিজস্ব উগ্র জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা পুতিনকে একজন ‘রোল মডেল’ হিসেবে দেখছে! সেইসঙ্গে কীভাবে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত, ইউক্রেন যুদ্ধের নিরিখে তা শিখে নিতে চাইছে! অর্থাৎ এই যুদ্ধ এই প্রশ্নে এক আদর্শ মানদণ্ড হয়ে উঠেছে তাদের কাছে! শুধু তা-ই নয়, মোদী এবং অন্যান্য বিজেপি নেতারা এখন ইউক্রেন যুদ্ধের আবাহনে ব্যস্ত কারণ উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপি’র ভোটের ঝুলি ভরা চাই! তাই একই ফাটা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে — একটা শক্তিশালী সরকারের কত দরকার আর মোদী কত বড় বিশ্বমাপের নেতা! ওদিকে ইউক্রেনে আটক ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা যে চরম নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা নিয়ে সরকারের মাথা ঘামানোর সময় নেই। ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের ইউক্রেন থেকে সময়মত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে মোদী সরকার কার্যত কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। বরং সীমান্ত পার হতে গিয়ে ভারতীয় পড়ুয়ারা যে বর্ণবাদী আক্রমণের মুখে পড়েছে সেটা নিয়ে বাজার গরম করছে।

পৃথিবী জুড়ে শান্তিকামী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে দাবি জানাতে হবে — অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করো! ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও সেখানকার জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকারগুলিকে সম্মান জানিয়ে এবং ঐ অঞ্চলে শান্তি ও সুস্থিতিকে সুনিশ্চিত করে সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধান করো! প্রকৃত এবং স্থায়ী শান্তির জন্য মার্কিন-ন্যাটো সম্প্রসারণবাদও বন্ধ হোক! ন্যাটোকে ভেঙে দেওয়া হোক!

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ১ মার্চ, ২০২২)

Women's Day on March 8

হিংসা নয়, জীবিকা চাই!
বৈষম্য নয়, সমতা চাই!
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই!
হিংসা, নিপীড়ন ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান!
স্বাধীনতা, ভালোবাসা, মিতালী, সমতা ও সম্মানের দাবিকে শক্তিশালী করুন!
রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করো, ন্যাটো সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করো!

বোনেরা,

৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করার বিপ্লবী উত্তরাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং আমাদের জীবনের সমস্যাগুলির মৌলিক কারণগুলি অনুসন্ধান করার শক্তি ও সাহস দেয়। এই দিনটি নারীর অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। শ্রমজীবী নারীদের সংগ্রাম থেকে শক্তি নিয়ে এই দিনে বিশ্বজুড়ে নারীরা শান্তি, সমৃদ্ধি ও জীবিকার জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন করেছে এবং বহু বিজয় অর্জন করেছে।

কিন্তু, আজকের নারীবিরোধী লুটতরাজে, দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা যে অধিকার পেয়েছি তা সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। তাই সারা বিশ্বের নারীরা তাদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করছে। পুঁজি-ধর্ম-ক্ষমতা-সামন্তবাদের যোগসাজশ সর্বশক্তি দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মৌলিক চেতনাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের দেশের কথা বললে, কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বলপূর্বক পাশ করা শ্রমিক ও নারী বিরোধী শ্রম আইনের বিরুদ্ধে লড়ছেন শ্রমজীবী নারীরা। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের কর্মীরা সরকারি কর্মচারির মর্যাদা এবং ন্যূনতম মজুরির জন্য লড়াই করছেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি থেকে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণকারী মহিলারা ঋণ মকুব, সুদের হার হ্রাস, জীবিকার প্রশিক্ষণ এবং ব্যবসার সুযোগের পাশাপাশি অন্যান্য ত্রাণ দাবি করছেন।

কিন্তু আজ যখন দেশের নারীরা জীবিকা বা অন্যান্য অধিকার চায়, যখন তারা তাদের নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী জীবন যাপন করতে চায়, তখন ধর্মান্ধ শাসক শক্তি, যারা নারীকে মা বলে পূজা করার ভান করে তারা সংস্কৃতির নামে নারীর উপর জাতিগত নিপীড়ন, হিংসা ও বৈষম্যকে বৈধ করে তুলতে চায়। স্কুল, কলেজ, অফিস, কলকারখানা বা কর্মক্ষেত্রে নারীদের বৈষম্য, যৌন হয়রানি এবং প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার বিরুদ্ধে নারীর কণ্ঠস্বরকে দমন করার জন্য নানা চাতুরি ও কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। আজ নিপীড়ক ও অপরাধীদের যে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কীভাবে নারীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংগ্রামী চেতনাকে প্রতিনিয়ত দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

এই সরকার কত নির্লজ্জভাবে নারী নির্যাতনকারীদের সুরক্ষা দিচ্ছে তার সাম্প্রতিক উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখলাম কীভাবে ধর্ষক-খুনী ‘বাবা’ রাম রহিমকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হল। উপরন্তু জেড প্লাস নিরাপত্তা দিয়ে এক ধর্ষক-খুনীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হল যাতে সে উত্তরপ্রেদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র হয়ে ভোট কুড়াতে পারে।

সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের স্কুল-কলেজে মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হিজাব পরা এক ছাত্রীকে কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গেরুয়া চাদর জড়িয়ে কিছু গোঁড়া ছাত্র ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিতে দিতে মেয়েটিকে ঘিরে ধরে হয়রানি করে। এই বর্বরতা গণতন্ত্র ও সংবিধান বিরোধী। আমাদের দেশের হিন্দু ছাত্ররা মাথায় টিকি বেঁধে, তিলক কেটে, তাগা পরে বা হিন্দু মেয়েরা বিন্দি, সিঁদুর, চুড়ি পরে, বা শিখ ছাত্ররা পাগড়ি পরে-অর্থাৎ নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারে। তাহলে শুধুমাত্র মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব (মাথা ঢেকে) পরে গেলেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিপদ তৈরি হয় কীভাবে? বরং হিজাব পরতে বাধা দেওয়া আসলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং ঘৃণামূলক অপরাধ। কর্ণাটক সরকারের মন্ত্রী ও বিধায়করাই শুধু নয়, দেশের অনেক জায়গায় বিজেপি-আরএসএস নেতারাও এই ঘৃণামূলক অপরাধের আগুনে ঘি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা মেয়েদের ও সাধারণ মানুষদের সমর্থন পায়নি। কারণ আজ মানুষ বুঝতে শুরু করেছেন যে, সাম্প্রদায়িক মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক শক্তিগুলি অস্পৃশ্যতা ও পৃথকীকরণের ধারায় মুসলিম নারীদের ‘অপর’ করে রাখার জন্য হিজাবকে শুধুমাত্র একটি নতুন অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে।

বোন, আজ সবাই মূদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধিতে ভুগছে, সে কৃষক হোক, শ্রমিক হোক, নারী হোক বা গৃহিণী হোক। গ্যাস সিলিন্ডারের দাম দিন দিন বাড়ছে। বেকারত্ব চরমে। অপরাধ ও দুর্নীতি সর্বত্র বিরাজ করছে। সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ এবং সরকার ভীত এই ভেবে যে তাদের জনগণের প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে। তাই মুসলমান মানুষদের শত্রু হিসাবে খাড়া করে জীবন-জীবিকার সংকট থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চলছে। সাধারণ মানুষের দুর্দশার বিনিময়ে মোদী সরকার প্রকাশ্যে আম্বানি এবং আদানির মতো মুষ্টিমেয় ধনী পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা ও দালালি করছে। অতএব, বোনেরা, আসুন আমরা ঘৃণা, হিংসা এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, ভালবাসা, মিতালী, সম্মান এবং স্বাধীনতার জন্য ফ্যাসিবাদী সরকারের বৈষম্য ও বিভেদকামী রাজনীতিকে পরাস্ত করি।

বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের জনগণকে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। আসুন আমরা দাবি করি যে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর অবিলম্বে যুদ্ধ ও হামলা বন্ধ করুক। আমরা এটাও দাবি করি যে আমেরিকা অবিলম্বে ন্যাটোর সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করুক। কারণ যুদ্ধের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ধ্বংস ব্যতীত কিছুই অর্জিত হয় না। ভারত সরকার ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয় ছাত্রদের যথাসময়ে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অপরাধমূলক অবহেলা করেছে। যার ফলস্বরূপ, রুশ হামলায় একজন ভারতীয় ছাত্র নিহত হয়েছে এবং অনেক ছাত্র নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা দাবি করছি যে, ভারত সরকার যেন প্রতিটি ভারতীয় নাগরিককে দ্রুত নিরাপদে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে।

 28-29 March 2022 All India Strike

দেশ বাঁচাও, দেশবাসী বাঁচাও!
শ্রমিকদের বাঁচাও, কর্মসংস্থান বাঁচাও, অধিকার বাঁচাও!
দেশের সম্পদ সংরক্ষণ করো, পাবলিক সেক্টর বাঁচাও!
কৃষি বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও!
শ্রমিক-কৃষক ঐক্য বজায় রাখ! মোদী সরকারের বিভেদমূলক, সাম্প্রদায়িক পরিকল্পনা ব্যর্থ কর!
মোদীর নেতৃত্বাধীন কোম্পানি রাজকে পরাজিত কর! মোদী-শাহ’র কবল থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত কর!
সব হাতে কাজ চাই! সমকাজে সমমজুরি চাই!৪টি শ্রমকোড বাতিল করার জন্য, রেকর্ডভাঙা বেকারত্বের বিরুদ্ধে, আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি, বেসরকারীকরণ এবং দেশের সম্পদের বিক্রয়ের বিরুদ্ধে লড়াই কর!সংবিধান ও গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ প্রতিরোধ কর!

মোদী সরকার দেশের শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার, জীবন ও জীবিকার উপর অবিরাম আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক নীতিগুলিই মোদী শাসনের বৈশিষ্ট্য। গণতন্ত্র ও সংবিধানকে বুলডোজ করা হচ্ছে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামো ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এর জবাবে, শ্রমজীবী জনগণ নির্ধারিত প্রতিরোধের সাথে আক্রমণকে প্রতিহত করছে। এক বছরের দীর্ঘ ঐতিহাসিক কৃষকদের সংগ্রাম অহংকারী মোদী সরকারকে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে বাধ্য করেছে, যা সমগ্র কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এবং কৃষকদের ধ্বংস করার জন্য প্রণীত হয়েছিল। তাদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা গত ৩১ জানুয়ারী (সরকারিভাবে কৃষি-আইনগুলি বাতিল না করায়) মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতার দিন’ পালন করেছে অসম্পূর্ণ দাবিগুলি আদায় করার জন্য। গত বছরটা (২০২১) ১৬-১৭ ডিসেম্বর ব্যাংকের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে দশলক্ষ ব্যাংক কর্মচারি দ্বারা এক বিশাল, সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল, যা মোদী সরকারকে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে ব্যাংক বেসরকারিকরণ বিল পেশ স্থগিত করতে বাধ্য করেছিল। সাম্মানিক থেকে শুরু করে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের বিভিন্ন অংশ ধর্মঘটসহ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সংগ্রামের পথে রয়েছে। এখন দেশের সমগ্র শ্রমিক শ্রেণী ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের প্ল্যাটফর্মের ডাকে ২৮-২৯ মার্চ ২ দিনের সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মোদী সরকারের আমলে শ্রমিক শ্রেণীর ওপর হামলা

মোদী সরকারের শ্লোগান ও প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি — ‘আচ্ছে দিন’, ‘সবকা সাথ-সবকা বিকাশ’ ইত্যাদি ইতিমধ্যেই বিদ্রুপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং মোদী সরকার ধ্বংস ও ধ্বংসের সমার্থক হয়ে উঠেছে। মোদী আমলে, যখন কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ দারিদ্র্য ও ক্ষুধায় নিমজ্জিত হয়েছে, তখন অল্প কয়েকজন অতি ধনী তাদের সম্পদ বিলিয়ন ডলার হারে বৃদ্ধি করেছে, যার মধ্যে ১ শতাংশ দেশের ৭৭ শতাংশ সম্পত্তির অধিকারী। মুকেশ আম্বানি, ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, এই সময়ে মুনাফার নয়া শিখরে পৌঁছেছেন, লকডাউনের সময়েও তাঁর সম্পদ গড়ে ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা বেড়েছে। তবুও, লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক এখনও কোভিডের প্রথম তরঙ্গের সময় নিষ্ঠুর ও আকস্মিক লকডাউনের কারণে তাদের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসের স্থায়ী প্রভাবের মধ্যে রয়েছেন। কোভিডের বিরুদ্ধে ফ্রন্টলাইন কর্মীরা, বিশেষ করে লক্ষ লক্ষ আশা কর্মী, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের হাতে প্রতারিত হয়েছেন। শ্রমজীবী মানুষকে দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়ে মোদী সরকার করোনার সময়ে তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য কিছুই করেনি, এমনকি তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টাও করেনি। দেশ যখন মৃত্যুর মিছিল দেখছিল, বিশেষ করে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়, মূলত অক্সিজেন ও চিকিৎসা সুবিধার অভাবে, যা জনগণের প্রতি সরকারের অপরাধমূলক উদাসীনতা ও অজ্ঞতা প্রকাশ করে, তখন সরকার করোনা সংকটকে কর্পোরেট ও অতি-ধনীদের ‘সাথ ও বিকাশ’কে শক্তিশালী করার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছিল এবং শ্রমজীবী মানুষকে দুর্দশা ও দাসত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

আবার, ‘প্রতি বছর ২ কোটি কর্মসংস্থান’ প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিপরীতে, নোটবন্দি (বিমুদ্রাকরণ) সহ মোদী সরকারের নীতিগুলি গত কয়েক বছরে কর্মসংস্থান ও জীবিকার ব্যাপক ধ্বংসের দিকে পরিচালিত করেছে, যা গত কয়েক বছরে ২০ কোটিরও বেশি চাকরি হারানোর পরিমাণ, ছাঁটাই এবং বন্ধ হওয়া দিনের নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকারি বিভাগগুলিতে লক্ষ লক্ষ শূন্যপদ পূরণ করা হচ্ছে না। উন্নয়নের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র বহু চর্চিত মন্ত্র সত্ত্বেও, এমএনসি’গুলি ভারতে তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে, যারফলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। কোটি কোটি অসংগঠিত শ্রমিক অনাহারে মজুরি এবং কাজের অনিশ্চয়তায় বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, এবং তাদের ক্ষতগুলিতে লবণ ঘষতে, সরকার কর্পোরেটদের মুনাফা অর্জনের সুবিধার্থে, ইচ্ছাকৃতভাবে জ্বালানীর (ডিজেল, পেট্রোল, গ্যাস, ইত্যাদি) দাম আকাশছোঁয়া করে তুলেছে যারফলে সর্বাঙ্গীণভাবে, দেশবাসীর কোমরভাঙা মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে।

ইতিহাস বলছে বিভিন্ন শিল্পের মালিকপক্ষ ও কর্মী নিয়োগকর্তাদের সর্বদা শ্রম আইনগুলি লঙ্ঘন করার জন্য গোপন ছাড় দেওয়া হয়, তবে এখন মোদী সরকার নিজেরাই সমস্ত শ্রম আইন বাতিল করে দিয়েছে এবং তাদের পরিবর্তে ৪টি শ্রমকোড আইন প্রয়োগ করেছে এবং সেগুলি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত। এই কোডগুলি শ্রমিকদের দাসত্বের কোডগুলি ছাড়া আর কিছুই নয় যা ইউনিয়ন এবং সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকার, আইনী ন্যূনতম মজুরির অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা এবং পেশাগত সুরক্ষার অধিকারের বিপরীতে ‘কাজে নাও এবং ইচ্ছামতো তাড়িয়ে দাও’এর বৈধতা এবং ‘নির্দিষ্ট মেয়াদের কর্মসংস্থান’এর মাধ্যমে চাকরির নিরাপত্তাহীনতা, মহিলা শ্রমিকদের অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক অবস্থাকে আরও ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলবে। সরকার দাবি করে যে তারা ‘একটি নতুন ভারতের জন্য নতুন কোড’ এনেছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা এনেছে ‘কর্পোরেট ইন্ডিয়ার জন্য এক নতুন কোড’।

মোদী সরকারের অধীনে, দেশের সমস্ত পিএসইউ এবং সরকারি বিভাগের বেসরকারিকরণের ব্যাপক অভিযান ‘জাতীয় নগদীকরণ পাইপলাইন’ (এনএমপি) নীতির মাধ্যমে আম্বানি, আদানি এবং টাটাদের মতো বেনিয়া গোষ্ঠীদের কাছে জাতীয় সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ‘বিনামূল্যে বিক্রয়’এর এক বিরাট বাজারে পরিণত হয়েছে এই দেশ। দেশ বেচার এই দুর্বুদ্ধিসম প্যাকেজটি কেবল দেশের জনগণকে কয়েক দশকের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্মিত অবকাঠামোগত সম্পদ ধ্বংসের দিকেই পরিচালিত করবেনা, একই সাথে দলিত, উপজাতি এবং সমাজের অন্যান্য নিপীড়িত অংশের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ সহ তাদের জীবন ও জীবিকাও ধ্বংস হবে। এটি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা থেকে শুরু করে পরিবহন ও বিদ্যুৎ পর্যন্ত সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাগুলিকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল করে তুলবে এবং জনগণের কাছে এগুলিকে এক অলীক পরাবাস্তব হিসাবে প্রতিস্থাপন করবে।

তাই মোদীর ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘নো গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ওনলি কর্পোরেটস’। এই সরকার কর্পোরেট প্রভুদের সেবা করার জন্য দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ চালাচ্ছে।

আগ্রাসীভাবে এই সরকারের তার কর্পোরেট-পন্থী এজেন্ডাকে লাগাতার ধাক্কা দেওয়ার জন্য, মোদী সরকার ‘নিপীড়ন ও দমনমূলক আইনের রাজ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণ এবং প্রতিবাদের অধিকারকেও চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে। মোদীর রাজ অঘোষিত জরুরি অবস্থার যুগে পরিণত হয়েছে। এটি পদ্ধতিগতভাবে এবং আগ্রাসীভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ট্রেড মার্ক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশকে শেষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সর্বশেষ উদাহরণটি হল আরএসএস-বিজেপি তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত ধর্মসংসদের অজুহাতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উস্কে দিচ্ছে এবং উত্তরপ্রদেশে বিজেপি’র চলমান নির্বাচনী প্রচারের সময়ও।

স্ট্রাইককে দুর্দান্ত ভাবে সফল করতে উদ্যোগ নিন

এআইসিসিটিইউ ২০২২ সালের ২৮-২৯ মার্চ দু’দিনের ধর্মঘটকে সফল করার জন্য দেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে বিকশিত শ্রমিক-কৃষক ঐক্যকে সমুন্নত রেখে শ্রমিক শ্রেণীর ধর্মঘটের আহ্বানে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ইতিমধ্যে তার সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এআইসিসিটিইউ সমগ্র মেহনতি জনগণ, কৃষি শ্রমিক ও কৃষক, ছাত্র, যুব ও মহিলা এবং সমস্ত সাধারণ জনগণকে ধর্মঘটের আহ্বানে সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। শুধুমাত্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা ও অধিকারের উপর আঘাত হানা মোদী সরকারকে উৎখাত করা যেতে পারে। আসুন আমরা একজোট হই মোদী-শাহ সরকারের সাম্প্রদায়িক ও বিভেদমূলক পরিকল্পনাকে ধ্বংস করার জন্য, রুটি-রুজি ও কর্মসংস্থান, মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলিকে শক্তিশালীভাবে তুলে ধরার জন্য এবং মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক নীতিগুলিকে উল্টে দেওয়ার জন্য।

ধর্মঘটের দাবী সনদ

ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, এবং ছাঁটাই বন্ধ কর! আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি থামাও!

চারটি শ্রমকোড অবিলম্বে বাতিল কর। কাজের দিন কোনোভাবেই ১২ ঘণ্টা করা যাবেনা। অত্যাবশ্যকীয় প্রতিরক্ষা পরিষেবা আইন প্রত্যাহার কর! শ্রম অধিকার এবং নিয়মিতকরণ এবং সমান কাজের জন্য সমান বেতন নিশ্চিত কর!

চাকরি এবং কর্মসংস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে! রুগ্ন এবং বন্ধ শিল্প পুনরুজ্জীবিত কর এবং পুনরায় শুরু কর! এমএনআরইজিএ শক্তিশালী কর এবং সমস্ত অভাবী মানুষের কাজ ও আয় নিশ্চিত কর! শহরাঞ্চলের দরিদ্রদের জন্যও এই আইনটি প্রসারিত কর।

১০০ শতাংশ এফডিআই এবং কর্পোরেটাইজেশন সহ বেসরকারিকরণ বন্ধ কর! ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন (এনএমপি) প্রত্যাহার কর! বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল প্রত্যাহার কর!

সকল স্কিম/সাম্মানিক কর্মীদের জন্য সংবিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাও! প্রতিটি ফ্রন্টলাইন কর্মীদের জন্য বীমা এবং সুরক্ষা চাই!

বেতন এবং সামাজিক নিরাপত্তা হ্রাস বন্ধ কর! ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২১,০০০ টাকা এবং ১০,০০০ টাকার মাসিক পেনশন বাস্তবায়ন কর! এনপিএস প্রত্যাহার কর এবং ও পিএস পুনরুদ্ধার কর!

কৃষি ও গ্রামীণ শ্রমিক সহ সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য প্রতিমাসে ১০,০০০ টাকা আয় সহায়তা এবং বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে! পিডিএস এবং খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার কর!

কৃষকদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার কর! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্রকে ‘টেনি’ বরখাস্ত কর! এমএসপি’র আইনি গ্যারান্টি নিশ্চিত কর!

রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ইউএপিএ এবং সমস্ত কঠোর আইন বাতিল কর, সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দাও।

লড়াই করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হোন!

Save the country

২৮-২৯ মার্চ গ্রামীণ ভারত বনধ্ সফল করুন

কৃষকদের কর্পোরেটের গোলামে পরিণত করার লক্ষ্যে আনীত তিন কৃষি আইন কৃষক আন্দোলনের চাপে মোদী সরকার প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘ একবছর ধরে চলা সেই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শ্রমিকশ্রেণী ও দেশের সর্বস্তরের মানুষ। গড়ে উঠেছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মেহনতি মানুষের অভূতপূর্ব সংগ্রামী ঐক্য। মোদী সরকারের হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচানোর আন্দোলনে সেই একতা আজ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কৃষক আন্দোলন পথ দেখিয়েছে। ফ্যাসিস্ট ও কর্পোরেটের দালাল মোদী সরকার হঠাও দেশ বাঁচাও আওয়াজ তুলে দেশের মানুষ পথে নেমেছে।

বর্তমানে মোদী সরকার নয়া শ্রমকোড চাপিয়ে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার হরণ করে ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষকে দাস শ্রমিকে পরিণত করতে চাইছে। ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, ট্রেডইউনিয়ন করার অধিকার এসমস্ত কিছুই ওরা তুলে দিতে চাইছে। ব্যংক, বীমা, রেল, প্রতিরক্ষা শিল্প সহ দেশের সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ, ঠিকা-কন্ট্রাক্ট প্রথাকে স্থায়ী রূপ দেওয়া, যখন তখন ছাঁটাই, কর্মসংকোচন, মজুরি কমিয়ে দেওয়া, কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া, যতটুকু সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল সবকিছু বন্ধ করা — এসবের মধ্য দিয়ে মোদী সরকার দেশের মানুষের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আগামী ২৮-২৯ মার্চ সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেডইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলি। দেশের পাঁচ শতাধিক কৃষক সংগঠনগুলির সংগ্রামী মঞ্চ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি এই ধর্মঘটে সামিল হয়ে ঐ দু’দিন গ্রামীণ ভারত বনধের আহ্বান জানিয়েছে।

মোদী সরকার কৃষক আন্দোলন স্থগিত রাখার সময়কালে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করেনি, চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই চলমান কৃষক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, ফসলের ন্যয্য দাম গ্যারান্টি আইন প্রণয়ন, কিষাণ আন্দোলনের কর্মীদের উপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, গাড়ি চাপা দিয়ে কৃষক হত্যাকারী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর শাস্তি প্রভৃতি দাবিগুলির পাশাপাশি ঋণমুক্তি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষকের ফসলের ক্ষতিপূরণ, কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি, ভাগচাষি লিজচাষি সহ কৃষকদের কাছ থেকে সরকারি দরে ফসল কেনা, গ্রাম উন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রভৃতি দাবিতে এই গ্রামীণ ভারত বনধ্ সংগঠিত হবে।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্পোরেটদের মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করে দেওয়া, পেট্রোল ডিজেল সহ সমস্ত নিত্যপণ্যের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব সৃষ্টিকারী নীতির বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই সাধারণ ধর্মঘট ও গ্রামীণ ভারত বনধে সামিল হবে। গ্রামবাংলার কৃষক, গ্রামীণ মজুর সহ সর্বস্তরের জনগণের কাছে আমাদের আহ্বান, দেশ বাঁচাতে দেশবাসী বাঁচাতে সাধারণ ধর্মঘট ও গ্রামীণ ভারত বনধ-কে সফল করে তুলুন।

এরাজ্যের বুকে ফসলের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য আইন প্রণয়ন, দালাল মহাজনদের কাছ থেকে নয় — প্রকৃত চাষি বিশেষত ছোট ভাগচাষি লিজচাষিদের থেকে ধান সহ সমস্ত ফসল কেনা, প্রশাসনের দ্বারা অনথিভূক্ত গরিবদের সরকারি নথিভুক্তি, ফসলের উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম সুনিশ্চিত করা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি দাবিগুলি তুলে ধরে আমরা তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ময়দানে রয়েছি। এরাজ্যে প্রতিবাদী শক্তির উপর তৃণমূল সরকারের স্বৈরাচারী হামলা, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ, দেউচা-পাঁচামীতে আদিবাসী সহ গরিব মানুষদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।

 death in custody in Nadia

মধ্যরাতে পার্টি কর্মীর বাড়িতে পুলিশী হানা!

নদীয়ার নাকাশীপাড়ায় উৎসবের চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে বচসার একটি ঘটনায় বেথুয়াডহরী থানার পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তারপর থানা লকআপে সে নাকি অসুস্থ হয়ে যায়! জেলা সদর কৃষ্ণনগর হাসপাতাল থেকে রেফার করায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতা নীলরতন হাসপাতালে। সেখানেই ঘটে তার দুঃখজনক মৃত্যু৷

“থানা লকআপে পুলিশ ওকে একগ্লাস জল দিতে দেয় নি” স্থানীয় পার্টি ও যুবদের এক তদন্তকারী প্রতিনিধি দল মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গেলে তাদের কাছে এ কথা জানালেন মৃত ব্যক্তির স্ত্রী। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে তাহলে কি পুলিশী অত্যাচারের ফলেই এই মৃত্যু ঘটলো? রাজ্যের অন্যান্য বেশ কয়েকটি থানার মতো এখানেও কি ঘটলো পুলিশের যথেচ্ছাচার? থানায় মৃত ব্যক্তির উপর পুলিশী নিপীড়ন ও চাপসৃষ্টির বিষয়টি আকারে ইঙ্গিতে সন্দেহ আকারে পরিবারটি জানায়। এছাড়া এলাকার মানুষের সূত্রে জানা যায় সেই বাড়িটিতে থানার অফিসারদের যাতায়াত ও তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বভাবতই পরিবারটির পক্ষে মুখ খোলা খুবই দুস্কর হয়ে পড়ে। সামগ্রিক বিষয়টি বিচার বিবেচনা করে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের স্থানীয় শাখা সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশী হেফাজতে এই মৃত্যুর বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি তোলা হবে। সেই রাতেই বেথুয়াডহরী স্টেশনে এই দাবি সম্বলিত বেশ কিছু পোস্টার মারে আরওয়াইএ এবং পার্টিকর্মীরা। কিছুক্ষণ পরে একটু বেশি রাতে পোস্টারগুলি ছিঁড়ে ফেলা হয়। রাত আড়াইটা নাগাদ আরওয়াইএ এবং পার্টিকর্মী বাবাই দত্তর বাড়িতে পুলিশ যায়। ঘটনাচক্রে সে সময় তিনি বাড়ির দরজায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। পায়ে এবং কাঁধে আঘাত লাগায় তার হাড় ভেঙে যায়। বাড়ির গেটে লাথি মেরে পুলিশ ঢোকে। বলে, এদেরকে এভাবেই বলতে হয়! থানায় মৃত্যু নিয়ে পোস্টার মেরেছিস কেন? ওই বাড়ির লোকেরা তোদের কি বলেছে? হার্ট এ্যাটাকেই তো মারা গেছে, তাহলে পুলিশের দোষ বলছিস কেন? বারংবার পুলিশ অফিসার বাবাইকে এই সব প্রশ্ন করতে থাকে। উত্তরে সে জানায় পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তদন্ত এবং পোস্টার মারা হয়েছে। বাবাই ও তাঁর স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করার পর পুলিশ তাকে স্থানীয় বেথুয়াডহরি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার দেখানোর পর বাড়িতে পৌঁছে দেয়। সেই সময়কালে কোনও এক অজ্ঞাত জায়গা থেকে ফোনে নির্দেশ শুনে অফিসার মতো বদল করে তাকে থানায় না নিয়ে বাড়িতে পৌছে দেয় বলে জানা যায়।

গত ৭ মার্চ এই ঘটনার বিরুদ্ধে পার্টি ও যুব কর্মীদের এক দৃপ্ত মিছিল নাকাশীপাড়া থানায় যায়। সেখানে শ্লোগান ওঠে সিপিআই(এমএল) কর্মীকে মধ্য রাতে বিনা ওয়ারেন্টে আটক করা হলো কেন পুলিশ কর্তৃপক্ষ জবাব দাও! লকআপ হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। পুলিশী সন্ত্রাস বন্ধ কর। রাজ্যের বুকে গণতন্ত্র হত্যা করা চলবে না। রাজনৈতিক অধিকারের উপর পুলিশী হস্তক্ষেপ চলবে না। থানার সামনে খালি গলায় বক্তব্য রাখেন নেতৃবৃন্দ। এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পার্টি কর্মী ইয়াদ আলি, আরওয়াইএ-র অমিত দাস, সন্তু ভট্টাচার্য, অমিত মন্ডল প্রমুখ। থানায় ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে ডেপুটেশনে ছিলেন পার্টির লোকাল সম্পাদক শিশির বসাক, নদীয়া জেলা কমিটি সদস্য কৃষ্ণ প্রামানিক, জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ প্রমুখ।

আশ্চর্যের বিষয়, পুলিশ বেগতিক বুঝে গোটা বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। প্রতিনিধি দলের কাছে তারা গল্প শোনালো আদৌ কোনও জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেপ্তার করতে নাকি তারা বাবাইয়ের বাড়িতে যায়নি। রাস্তায় ভ্রাম্যমান অবস্থায় টহলদারীর সময় বাড়ির ভেতর থেকে একটা শব্দ শুনে তারা বাড়িতে ঢোকে। আহত অবস্থায় দেখে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি পৌছে দেয়। এই গল্প আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়, জানিয়ে দিলেন প্রতিনিধিরা। পুলিশী স্বেচ্ছাচার, সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়। নেতৃবৃন্দ জানান লকআপে মৃত্যুর তদন্তের জন্য পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আরও জোরদার আন্দোলন চলবে।

villagers against the coal mine is intensifying

৭ মার্চ সকালে বেশ কয়েক শত গ্রামবাসী মিছিল করে দেওয়ানগঞ্জে বনবিভাগের জমিতে নেমে নিজেদের অধিকার জাহির করেন। সমবেত হয়ে ঘোষণা করে জমিতে খুঁটি পুঁতে চড়কা দেওয়া হয়। আদিবাসী সমাজের সামাজিক-প্রশাসনিক প্রথা অনুসারে কোনও জমিতে চড়কা দিলে সে জমিতে নতুন করে কেউ কোনও কাজ করতে পারবে না। দেওয়ানগঞ্জের সরকারি জমিতে গ্রামবাসীদের চড়কা দেওয়া প্রকৃতপক্ষে গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে এক নতুন ঘোষণা, সরকার যদি ‘সরকারের হাতে থাকা’ জমিতে খনির কাজে নামে তাহলে গ্রামবাসীরাও সমবেতভাবে জমিতে নেমে প্রত্যক্ষভাবে বাধা দেবে। বারোমেসিয়া গ্রামের ধরণাস্থল থেকে মিছিল করে এসে সরকারি জমিতে চড়কা দিয়ে সরকারকে এই বার্তা দিল গ্রামবাসীরা।

২০ ফেব্রুয়ারির মহাসভা সমগ্র এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করায় পরদিন মুখ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে দেউচা প্রকল্প সম্পর্কে কিছু ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমত, পুনর্বাসন প্যাকেজে জমির দাম বা ঘরের সাইজ একটু বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা করেন তিনি। এবং একথা উল্লেখ করেন যে, সরকারের হাতে যে জমি আছে সেখানেই প্রথম খনির কাজ শুরু হবে, সেখানে তো আর কারও সম্মতির প্রয়োজন নেই। মুখ্যমন্ত্রীর এই দুটি ঘোষণাকেই কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে প্রশ্নটা নিছক প্যাকেজের কমবেশির নয়। কোনওরকম প্যাকেজই তাঁদের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না, কোনওরকম প্যাকেজের বিনিময়েই মানুষ নিজেদের জমি জায়গা ছেড়ে, ভিটেমাটি ও সমাজ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে চাইছেন না। তড়িঘড়ি নবান্নে ডেকে দু’চারজনকে চেক দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছুক চাষির কুমির ছানা দেখিয়েছেন মাত্র। ওইদিন জেলা দপ্তরে যারা এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই আসলে খাস জমিতে বসবাসকারি মানুষ যারা জমির পাট্টা নিতে এসেছিলেন। সিঙ্গুরের মতো এখানেও অ্যাবসেন্টি ল্যান্ডলর্ডদের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের জমি দখল করতে চাইছে সরকার। গ্রামবাসীদের সিংহভাগই প্রতিরোধে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি কোনও পরিবারের একজন যদি চাকরির ফর্মে সই করে থাকে তাহলেও পরিবারের বাকি সদস্যরা, বিশেষত মহিলা সদস্যরা, প্রতিরোধে সামিল। দ্বিতীয়ত, নিজেদের জমি দেওয়া তো পরের কথা, সরকারি জমিতেও খনি করার অনুমতি যে তাঁরা দিচ্ছেন না, তা সরকারি জমিতে চড়কা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন গ্রামবাসীরা।

মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সংবাদ সম্মেলনে তৃতীয় একটি কথা বলেছিলেন। তিনি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলেন যে, দেউচা-পাঁচামীর অবৈধ পাথর খাদান মালিকরা মদত যোগাচ্ছে আন্দোলনকারীদের। এভাবে তিনি আন্দোলনকারীদের গায়ে কাদা ছুঁড়তে চেষ্টা করেন। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি যখন মুখ্যমন্ত্রী এই প্রেস কনফারেন্স করছেন তখন গ্রামবাসীদের মিছিল এলাকার খাদান ও ক্রাশারগুলি বন্ধ করতে করতে এগোচ্ছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জ ফুটবল ময়দানে মহাসভা সংগঠিত হওয়ার পর থেকে মিটিং মিছিল সমাবেশ এক দিনও বন্ধ থাকেনি। প্রতিদিন সকালে আরও বেশি বেশি মানুষ ভয় কাটিয়ে প্রতিবাদে সামিল হতে থাকে। ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার ধরণা শুরু হয়, প্রথম দু’দিন হরিণসিঙায় চলার পর ধরণা বারোমেসিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ৭ মার্চ পর্যন্ত এলাকার সমস্ত খাদান ও ক্রাশার বন্ধ ছিল। এক দশক আগে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিকে মান্যতা দেওয়ার দাবিতে খাদান-ক্রাশার মালিকদের বিরুদ্ধে এক লম্বা ‘আইন মানো’ আন্দোলন করেছিলেন এলাকার মানুষ। কিছু কিছু দাবি আদায় হয়েছিল। গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মেনে সরকার বীরভূমের মোট খাদান ও ক্রাশারের ৫% ইউনিটকে বৈধতার সার্টিফিকেট দেয়, যদিও সেই তালিকা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। বর্তমানে এই স্টোন চিপসের কারবারে সুব্যবস্থিত মাফিয়া চক্র গড়ে উঠেছে যার ফুট সোলজার হিসেবে আদিবাসী যুবকদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করত নিজেদের বিকিয়ে দেওয়া কয়েকজন আদিবাসী নেতা। পাথর পরিবহনে নিযুক্ত প্রতিটা ট্রাক দৈনিক ৬ হাজার টাকা তোলা দেয় এই চক্রকে। রীতিমতো রসিদ কেটে এই টাকা তোলা হয়। বীরভূমের সমগ্র পাথর বেল্টে দৈনিক অন্তত ৫ হাজার ট্রাক এরকম পরিবহনে নিযুক্ত। গ্রামবাসীরা খাদান-ক্রাশার বন্ধ রাখার মাধ্যমে নিজেদের এলাকায় এই মাফিয়া চক্রকে ভাঙতে চেয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জে মহাসভার মাধ্যমে গ্রামবাসীদের যে উত্থান ঘটে তা সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।

Convention in Patna

পাটনায় নৃত্যকলা মন্দিরে ৯ মার্চ রোজগার অধিকার মহাসম্মেলন সংগঠিত হল রোজগার সংঘর্ষ সংযুক্ত মোর্চার ব্যবস্থাপনায়। ২৪টির বেশি সংস্থার চাকরিপ্রার্থীরা এতে অংশগ্রহণ করেন।

কনভেনশনের আগে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বিধায়ক মনোজ মঞ্জিল এবং সন্দীপ সৌরভ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, বিএসএসসি ২০১৪’র জন্য সমস্ত কিছু সম্পূর্ণ করেও সফল পরীক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশিত হলো না এবং তাদের নিয়োগপত্রও দেওয়া হলো না। সেনাবাহিনীর উর্ত্তীর্ণযোগ্য প্রার্থীদের অবস্থাও দীর্ঘদিন ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। এসটিইটি ২০১৯’র সফল প্রার্থীদের নিয়োগ আদালতে বিচারাধীন, কারণ শিক্ষা দফতর ও শিক্ষামন্ত্রীর নীতিলঙ্ঘন করা ঘোষণার জন্য। সিটিইটি’তে সফল প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য তারিখের পর তারিখ দেওয়া হচ্ছে। বিহার সরকার ২ লক্ষ ৭৫ হাজারের বেশি খালি শিক্ষক পদের জন্য নিয়োগ করছেন না। একদিকে যুব সম্প্রদায় কর্মসংস্থানের অভাবে হয়রান হচ্ছেন অন্যদিকে ছাত্র সম্প্রদায় শিক্ষকের অভাবে দুর্ভোগে পড়ছেন।

যে বিজেপি-জেডিইউ সরকার ১৯ লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁরা দু’বছর ধরে ‘তথ্য-সংগ্রাহক’ কর্মীদের থেকে কাজ আদায় করে তাদের ফের কর্মহীন করেছেন। দেশে এখন বেকারত্ব শীর্ষে রয়েছে। বিহারে স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি ৫৩.২ শতাংশ। বিহার সরকার এখন পুরোপুরি কর্পোরেট-মুখী কর্মসূচি নিয়ে চলছে। চুক্তিপ্রথায় কর্মী নিয়োগ চলছে ও তাদের শ্রম শোষণ হচ্ছে।

call of Rozgar Sangharsh Morchar

আমাদের দাবি সমস্ত বকেয়া নিয়োগ অবিলম্বে সম্পূর্ণ করতে হবে এবং নিয়োগের তারিখসহ সূচি প্রকাশ করতে হবে। সমস্ত কর্মসংস্থানের বিজ্ঞাপনে জানাতে হবে কোন নির্দ্দিষ্ট তারিখের মধ্যে নিয়োগ সম্পূর্ণ করা হবে এবং এই তারিখ লঙ্ঘিত হলে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সমস্ত প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার ফলাফলে স্বচ্ছতা রাখতে হবে এবং উত্তরপত্র প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিহারের প্রত্যেকটি দফতরের শূন্যপদের তালিকা প্রকাশ ও সেগুলি ভর্তি করার কর্মসূচি জানাতে হবে। কর্মসংস্থান ও নিয়োগ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য বিহার বিধানসভায় একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকতে হবে।

সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এআইএসএ জাতীয় সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভ, আরওয়াইএ জাতীয় সভাপতি মনোজ মঞ্জিল, অনিয়োজিত কার্যপালক সহায়ক সন্তোষ গুপ্তা, আমীন বহালি’র শশী শেখর, সিপাহী বহালি ২০০৯’র রোশন কুমার, সাংখ্যিকি স্বয়ংসেবক’এর অভিষেক, স্পেশাল সার্ভে আমীন বহালি’র অংশু কুমার, এমটিইটি নন মেরিট’এর দীপক কুমার এবং প্যারা-মেডিক্যাল ছাত্র সমিতি’র বিশাল কুমার।

 cancellation of BJP MLA's membership

২৭ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিহার রাজ্য সম্পাদক কুণাল এক বিবৃতিতে বলেন, মধুবনির বিসফি’র বিজেপি বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর জনসমক্ষে অ-সাংবিধানিক এবং মুসলিম বিদ্বেষী বিবৃতিতে বলেছেন মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত। তাই এই বিধায়কের বিধানসভার সদস্যপদ অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। সিপিআই(এমএল) বিধায়করা বিহার বিধানসভায় এই ইস্যুতে প্রতিবাদও করেছেন।

কুণাল বলেছেন, আরএসএস-বিজেপি সারা দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হল সমস্তিপুরে খলিল রিজভি’কে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। হিজাবের অজুহাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুসলিম মহিলাদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে এবং সম্প্রতি বিহারেও হিজাবের জন্য এক মুসলিম মহিলাকে হয়রানি করা হয়েছে।

আরএসএস-বিজেপি’র মনে রাখা উচিত যে স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই সমান অংশীদারিত্ব ছিল। তাই শহীদত্ব বরণে এবং ঐতিহ্যের ওপর কোনও আঘাত আমাদের দেশ কখনও মেনে নেবে না। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যদি কারও কোনও অবদান না থেকে থাকে তবে তারা হলো, আরএসএস — যারা তাদের গঠনের সময় থেকেই হিন্দু এবং মুসলিম এই দুই ভিন্নরাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রচার করে এসেছে।

ভারতীয় সংবিধান দেশের প্রত্যেক নাগরিককে ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গ এবং ভাষা ব্যতিরেকে সমানাধিকার দিয়েছে — তাই মুসলিমদের ভোটাধিকার বাতিল করার অর্থ হল সংবিধানের ওপর আঘাত হানা।

From sidewalks to highways

১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। কনকনে শীত উপেক্ষা করে উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপ নগরে একদল ছাত্র থানায় গিয়েছিল খাবার আর কেরোসিনের দাবি জানাতে। গুলি চালিয়েছিল পুলিশ, লুটিয়ে পড়েছিল নুরুল ইসলামের দেহ।

নিথর হয়ে আনিসের দেহটাও পড়েছিল উঠোনে। পুলিশের পোশাকে চারজন বাড়িতে এসে ছাদ থেকে ফেলে খুন করেছে হাওড়ার আমতার আনিস খানকে। আনিস সমস্ত অন্যায়ের দাবিতে মিছিলে হাঁটতো। এলাকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলতো। কোভিডের সময় এলাকায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি প্রশাসনিক মদতে জমি মাফিয়াদের হাতে চলে যাওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আর শাসক, সে সহ্য করতে পারে না বিরুদ্ধতার তেজকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা তার কাছে গর্হিত অপরাধ। তাই খুন হয়ে যেতে হল আনিসকে। কারা খুন করলো? পুলিশের পোশাকে এসে খুন করে গেল আততায়ীরা। রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠল, রাস্তায় প্রতিদিন যৌবনের স্পর্ধার মিছিল, আবার পুলিশের হামলা, গ্রেপ্তার। গোটা রাজ্যেই যেন প্রিজন ভ্যান গিলতে আসছে। যেন পুলিশ স্টেট হয়ে উঠছে। কামালগাছিতে একটি কর্মসূচি থেকে গ্রেপ্তার করা হলো আইসার ছাত্রছাত্রী ও প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেত্রী-কর্মী ও অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সাথীদের। মিথ্যা মামলায় জেলে ঢোকানো হলো। দেউচা-পাঁচামীতে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হল। একের পর এক নমুনা।

দেশজোড়া বিজেপি’র বিপর্যয়কে রুখতেই এইরাজ্যের মানুষ গণরায় দিয়েছিল ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ক্ষমতায় ফিরে এসে তৃণমূল কংগ্রেস নিজেকে ভাবতে শুরু করেছে একমেবোদ্বিতীয়ম্। তার স্বৈরাচারী দাঁত-নখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গণআন্দোলনের ওপর। তৃণমূল নেত্রী হুঙ্কার ছাড়ছেন, তাকে আন্দোলন শেখানো যাবে না। তিনি আন্দোলন করেই ক্ষমতায় এসেছেন, তাই তিনি নাকি জানেন রাস্তা অবরোধ করাটা ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’! এসব রোষ দেখিয়ে তিনি অস্বীকার করছেন ইতিহাসের দেওয়াল লিখন পড়তে।

আন্দোলনের চাপে রাজ্য সরকার ‘সিট’ গঠন করলেও, তার মাথায় বসানো হয়েছে, রিজওয়ানুর কান্ডে চূড়ান্ত ন্যক্কারজনক ভূমিকা রাখা পুলিশ অফিসারকে। পনেরো দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এখনো কোনো দোষী গ্রেপ্তার হয়নি! সিট ইতিমধ্যে অন্যখাতে তদন্তকে ঘোরাতে বলতে শুরু করেছে, আনিস নাকি ছাদের পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেছে। বস্তুত তাদের বাড়ির গায়ে ওপর থেকে নামানো কোনও পাইপ লাইন নেই। এহেন মিথ্যাচারের মাধ্যমে পুলিশ-প্রশাসনকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।

কিন্তু ছাত্র-যুবদের নাছোড় লড়াই একটা কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে, আনিস আর কেবল ব্যক্তি নয়; আনিস এখন লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে গেছে। তৃণমূল সরকারের গণআন্দোলন ও বিরোধীদের প্রতি দমননীতির সামনে এখন বড়ো প্রতিবন্ধক আনিসের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে লড়াই। বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং সেই তদন্ত প্রক্রিয়াকে সাধারণ্যের গোচরে এনে তবেই নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে। এই দাবি এখন জোরালো হচ্ছে। যদি প্রশাসনের হাত না থাকে, তাহলে পুলিশের পোশাক আততায়ীদের কাছে এলো কীভাবে? পুলিশের বড়ো কর্তারা এবং শাসক দলের নেতৃত্বের যে আঁতাত লাগাতার স্পষ্ট হচ্ছে, তারই পরিণতি আনিসের হত্যা!

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এখন গোটা দেশজুড়ে নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা চালালেও এই রাজ্যে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের স্বরূপটা প্রকট হচ্ছে। আর রাজ্যের গণতন্ত্র রক্ষার সামনের সারির নেতৃত্বে অবশ্যই এখন এই রাজ্যের ছাত্র-যুবরা। আর তাই বারবার ছাত্র-যুবদের ওপরেই নেমে আসছে তৃণমূলের এবং প্রশাসনের যৌথ আক্রমণ। নরেন্দ্রপুরে আইসা কর্মীদের গ্রেপ্তারিই হোক অথবা আনিসের হত্যার বিরোধীতা করতে গিয়ে বাম যুব নেতৃত্বের গ্রেপ্তারি, রাজ্য সরকার প্রমাণ করে দিচ্ছে রাজ্যে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রশ্নে এই বাংলায় বারবার মানুষ শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। একসময় যারা “আমরা ২৩৫, ওরা ৩০” হুঙ্কার দিয়েছে, তাদের পরিণতিটা ভুলে যাচ্ছেন ২১৬’র দর্পে দামামা বাজানো তৃণমূল! এই চরম দমনের মুখেও ছাত্র-যুবরা তাদের ছকভাঙা লড়াই জারি রেখেছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশী দমন নিপীড়ন সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোর কলেজ স্ট্রিটে বিশাল সমাবেশ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে আনিসের হত্যার ইনসাফ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা ছাড়া হবেনা। পুলিশ এখন যে কোনো মিছিল এবং সমাবেশেই জলকামান, টিয়ার গ্যাস শেল সমেত রণসাজে সেজে থাকে। তবুও চোখে চোখে রেখে ব্যারিকেড গড়ার কাজ চলছে, এই রাজ্যের ছাত্র-যুবদের একরোখা লড়াই চলছে।

- নীলাশিস বসু

in the dust for five months

এবছর ৮ মার্চ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ১১৩তম বার্ষিকী। নারীদের জন্য উৎসর্গীকৃত এই দিনটি পালিত হয় নারীদের কর্মকাণ্ড, তার কর্মদক্ষতাকে সম্মান-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য, তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সম্মান জ্ঞাপনের জন্য। কিন্তু একটি বিশেষ দিন নারীদের জন্য উৎসর্গ করে সত্যিই কি নারী জাতির উত্তরণ সম্ভব? সত্যিই নারীকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব? বাকি ৩৬৪ দিনেও কী এই স্বীকৃতি, সম্মান নারীর প্রাপ্য নয় – পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে? নিজেদের কর্মস্থলে? এই প্রশ্নটাই নারীসমাজের কাছে বারবার ফিরে আসে। এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ জন্মলগ্ন থেকেই তাদের পদদলিত করে রাখতে সদাসচেষ্ট। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নারীর মরণপণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মারক এই দিনটিকে নিছক একটি ‘দিবস’ হিসাবে পালন করাটা যথেষ্ট নয়! নারীর জীবন জীবিকা, স্বাধীনতা মর্যাদা সমানাধিকার সুরক্ষিত না হলে, দিনটির প্রকৃত তাৎপর্য হারিয়ে যাবে।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে পৃথিবী যখন নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলেছে তখন সমাজের আনাচে-কানাচে বহু নারী আজও অবহেলিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত। যেখানে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং নারী উন্নয়নের পথের অগ্রদূত, সেখানে তার রাজ্যের নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আজও পথের ধূলায় দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে। ফার্স্ট এসএলএসটি (২০১৬)-র স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম থেকে দ্বাদশ স্তরের শিক্ষক নিয়োগে ঘটে চলা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সমাজ গড়ার প্রথম কারিগর, শিশুর প্রথম শিক্ষক সেই নারীরা এক নির্লজ্জ, বিবেকহীন অন্যায়ের প্রতিবাদে ও ন্যায় পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজপথে (খোলা আকাশের নিচে ফুট পাথে) ২৯ দিনব‍্যাপী রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক অনশন আন্দোলনে পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামিল হয়েছিল। শত সহস্র বছর ব‍্যাপী জীবিত থাকার, কাছের মানুষগুলোকে জীবিত রাখার সেই একরোখা অবিচল জেদ বয়ে নিয়ে চলা আকাঙ্খা নামক সেই অদৃশ‍্য অদ্ভুত বিচিত্র ইচ্ছেডানা তাদের ওপর যেন সেদিন ভর করেছিল। আগামীতে সাদামাটা জীবনকে একটু রঙিন করতে, জীবনের চরম সুখ অনুভব করতে সেইদিন তাদের বিসর্জন দিতে হয়েছিল পরিবারের প্রতি কর্তব‍্যকে, অগ্রাহ্য করতে হয়েছিল দুধের শিশুর হৃদয় বিদারী আর্তনাদকে। শিশুর কান্না যাতে মা’কে দুর্বল করতে না পারে তার জন‍্য ছিন্ন করতে হয়েছিল পরিবারের সাথে সমস্ত যোগাযোগ। বিসর্জন দিতে হয়েছিল নির্মম পুলিশী অত‍্যাচারের ভয়ভীতিকে, লাজলজ্জা, মান সম্মানকে। একদল যোগ্য অথচ বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের সেদিন পথচলতি মানুষের কাছ থেকে নিক্ষিপ্ত তাচ্ছিল্য মাখতে হয়েছিল, ‘উদ্বাস্তু’, ‘ভিখারী’র তকমা মাথা পেতে নিতে হয়েছিল। ২০১৯ সালে অনশন আন্দোলনের ২৯ দিনের মাথায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে অনশন মঞ্চে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনে ওয়ান টাইম রুলস পরিবর্তন করে সমস্ত অনশনকারীর চাকরি নিশ্চিতকরণের যে প্রতিশ্রুতি দেন তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আজও তাই (২০২১ সালে সেন্ট্রাল পার্কে দ্বিতীয় দফায় ১৮৭ দিন) ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর থেকে তৃতীয় দফা (সাড়ে পাঁচ মাস ধরে) শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভের মাধ্যমে সেই প্রতিবাদ অব্যাহত।

১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার নারীরা প্রথম রুটি ও শান্তির দাবিতে প্রতিবাদ জানায়। আজ ১১৩ বছর পরেও বাংলার নারীরা তাদের যোগ্য অধিকারের চাকরি আদায় করতে, নিজের উপার্জনে পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার তাগিদে কলকাতা মহানগরীর বুকে পথের ধারে (গান্ধীমূর্তির পাদদেশে) রোদ-ঝড়-জলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।(১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আমেরিকায় নারী দিবস পালিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চ দিনটিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মর্যাদা প্রদান করে।) সমস্ত আন্দোলনকারীর পক্ষ থেকে আমরা এই বছর নারী দিবসে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করছি, আশা রাখছি মুখ্যমন্ত্রী তার মমতার দৃষ্টি আমাদের উপর বর্ষণ করে এই বেকারত্বের মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলার নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন।

- জয়া খান

corruption in the recruitment of staff

পশ্চিম বাংলার স্কুলগুলোতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগে দুর্নীতি ও নিয়ম না মানা নিয়ে বেশ কিছুকাল ধরে অনেকগুলো মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে। কিন্তু মামলাগুলো নিয়ে বিচারপতিরা যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তাতে মনে হচ্ছে যে, সিঙ্গল বেঞ্চ, অর্থাৎ, এক বিচারপতির বেঞ্চ এবং ডিভিশন বেঞ্চ বুঝিবা পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। মামলাগুলোর শুনানি প্রাথমিকভাবে হয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় স্কুলগুলোতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগের এবং তারপক্ষে জোরালো তথ্যপ্রমাণ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকবারই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পর প্রতিবারই রাজ্য সরকারের তরফে বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তর ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানানো হয় এবং ডিভিশন বেঞ্চ যথারীতি সিবিআই তদন্তের নির্দেশ বাতিল করে তাদের নির্ধারিত কমিটির হাতে তদন্তের ভার দেয়। যে রাজ্য সরকার, স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করছিল, ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে তারা উদ্বেগমুক্ত বোধ করে।

বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর নির্দেশ দেন — চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগে দুর্নীতি ও নিয়ম না মানার অভিযোগের তদন্ত করবে সিবিআই। সেসময় ২৫ জন কর্মীর অসৎ পথে নিয়োগের অভিযোগ সামনে এসেছিল। কিন্তু রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের আবেদনের ভিত্তিতে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ বাতিল করে বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও রবীন্দ্রনাথ সামন্তর ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয় — দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত করবে আদালত গঠিত কমিটি। কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গড়া হয়, কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) সদস্য আশুতোষ ঘোষ, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সহকারী সচিব পারমিতা রায় এবং হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ব্যানার্জী। কমিটিকে দু’মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়।

কিন্তু দু’মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটি তদন্তের রিপোর্ট জমা করতে পারে না এবং কমিটির আবেদনের ভিত্তিতে ডিভিশন বেঞ্চ তদন্ত শেষ করার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারি কমিটিকে আরো চারমাস সময় মঞ্জুর করে। ইতিমধ্যে অন্যায্য পথে চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর আরো বহু সংখ্যক কর্মী নিয়োগের অভিযোগ আসতে থাকে এবং মামলাও দায়ের হয়। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগের সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫৭৩ এবং তৃতীয় শ্রেণীর নিয়োগের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৩৫০ বলে দেখা যায়। মামলাগুলোর শুনানির সময় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এমন একটা সক্রিয়তা দেখান যেটা একেবারেই বিরল নিদর্শন। তিনি ৫৭৩ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী বরখাস্ত বলে ঘোষণা করেন ১০ ফেব্রুয়ারি। এর কয়েকদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৫০ জন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মীর নিয়োগকেও বাতিল বলে ঘোষণা করেন। ডিভিশন বেঞ্চ গঠিত রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়ে বেনিয়মের ভিত্তিতে নিয়োগের অভিযোগের তদন্ত পুনরায় সিবিআই করবে বলে ঘোষণা করেন। নিয়োগ থেকে বাতিল হওয়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের বেতন বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির স্কুল পরিদর্শকদের নির্দেশ দেন — এই কর্মীরা এতদিন যে বেতন পেয়েছে তা তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নিতে হবে। এই নির্দেশের পরই পশ্চিমবঙ্গ সরকার আবার ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায় এবং ডিভিশন বেঞ্চ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়ে তদন্ত শেষ করার জন্য রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে আরো তিনমাস সময় দেয়। এখানে উল্লেখ্য, শুধু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীই নয়, দুর্নীতির ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগকে কেন্দ্র করেও বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ২১ ফেব্রুয়ারি মুর্শিদাবাদ জেলার স্কুলে নিযুক্ত ছ’জন গণিত শিক্ষকের চাকরিও বাতিল করেন। আদালতে আবেদনকারী আব্দুল গণি আনসারি জানায়, নিয়োগের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৮.৬, কিন্তু যে ছ’জনকে নিয়োগ করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই প্রাপ্ত নম্বর তার চেয়ে কম। এই নির্দেশও কার্যকরী হয়না, ডিভিশন বেঞ্চের হস্তক্ষেপে তা স্থগিত হয়ে যায়।

তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পরও সেই প্যানেল থেকে এবং প্যানেলে নাম না থাকাদেরও নিয়োগ। তৃণমূল সরকার ২০১৬ সালে স্কুলগুলোতে ১৩,০০০ কর্মী নিয়োগের কথা ঘোষণা করে। নিয়োগের জন্য যথারীতি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি হয় প্যানেল। সেই প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ২০১৯ সালের ৪ মে। কিন্তু তারপরও ঐ প্যানেল থেকে নিয়োগ হতে থাকে এবং অভিযোগ ওঠে — জেলাস্তরে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিপত্তিশালীরা চাকুরী প্রত্যাশীদের কাছ থেকে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা করে নিয়ে নিয়োগগুলির মূল হোতা হয়ে ওঠেন। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, এই নিয়োগগুলোর পিছনে ‘গোপন হাত’ আছে আর সেই হাতগুলোকেই খুঁজে বার করতে হবে।

স্কুলগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম হল — প্যানেল তৈরির পর স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে, আর মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সেই সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগপত্র দেবে। কিন্তু এসএসসি আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছে — এই নিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে তারা সুপারিশ করেনি। তাহলে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তারথেকে এবং এমনকি প্যানেলে নাম না থাকাদের ক্ষেত্রেও নিয়োগপত্র দেওয়া হল কিসের ভিত্তিতে এবং কারাই বা সেগুলো দিল? সেই ‘গোপন হাতগুলো’ কারা? ডিভিশন বেঞ্চ চাকুরী বাতিলের নির্দেশ খারিজ করলেও নিয়োজিত ৫৭৩ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছে — কাদের কাছ থেকে তাঁরা অনুমতিপত্র ও নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন তা তাঁদের আদালতকে জানাতে হবে। এমনকি মুর্শিদাবাদ জেলায় ছ’জন গণিত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এসএসসি বলেছে, এক্ষেত্রে তাদের ‘ভুল’ হয়েছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়য়ের অভিমত হল এটা ভুল নয়, ব্যাপারটা সজ্ঞানেই করা হয়েছে।

তৃণমূল জমানায় দুর্নীতির অভিযোগ ও উন্মোচন একেবারেই বিরল ব্যাপার নয়। ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগে দেওয়ালগুলো ভরে যেত এই শ্লোগানে, “মমতা ব্যানার্জি সততার প্রতীক”। তাঁরা ক্ষমতায় বসার কিছুদিন পরই সারদা এবং তারসঙ্গে একগুচ্ছ চিটফান্ড দুর্নীতির উন্মোচন ঘটল এবং সেগুলোতে তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগও সামনে এল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন জানাল, সারদা প্রধান সুদীপ্ত সেন দু’কোটি টাকা দিয়ে মমতা ব্যানার্জির আঁকা ছবি কিনেছেন। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে রাজ্য সরকার গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দলের প্রধান পুলিশ কর্তা রাজিব কুমার বাজেয়াপ্ত করা কম্পিউটার থেকে মমতা ব্যানার্জিকে জড়িয়ে থাকা দুর্নীতির কিছু তথ্যপ্রমাণ মুছে দিয়েছেন বলে আওয়াজ উঠল। তারপর থেকে ‘সততার প্রতীক’এর ঐ শ্লোগান আর দেওয়ালে দেখা যায়না। এরপর ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিম বাংলায় অনেকগুলো আসন বিজেপি’র কাছে হারালো। এবং তৃণমূল কংগ্ৰেসকে জনগণের প্রত্যাখ্যানের পিছনে দুর্নীতির, ‘কাট মানি’র দৌরাত্ম্যই মূল কারণ হয়ে থেকেছে বলে তৃণমূল নেতৃত্ব এবং স্বয়ং মমতা ব্যানার্জিও স্বীকার করে নিলেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারির সংবাদ প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটা প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ও রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন — বেআইনি বাড়ি নির্মাণে “পুলিশ ও বিল্ডিং ডিপার্টমেন্ট টাকা খেয়ে ভাঙছেনা, বদনাম হচ্ছে কাউন্সিলরদের”। ফিরহাদ হাকিম দুর্নীতি থেকে কাউন্সিলরদের, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিবিদদের আড়াল করতে চাইলেও পৌরসভার ওয়ার্ড এবং পঞ্চায়েতগুলোর স্থানীয় জনগণ নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, কাউন্সিলরদের এবং পঞ্চায়েত প্রধানদেরও আঙুল ফুলে কেমন মোটা কলাগাছ হয়ে গেছে। তৃণমূল আর দুর্নীতি একাকার হয়ে গেছে এবং ‘জনসেবা’ যে ‘আত্মসেবার’ ধাপ তাকে শাসক দলের রাজনীতিবিদরা হামেশাই প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন।

স্কুলগুলোতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সামনে এসেছে, তাতে যেনতেন প্রকারেণ নিয়োগকে হাসিল করার প্রয়াস এবং দুর্নীতির নিদর্শন জাজ্বল্যমান হয়েই দেখা দিচ্ছে। যে ডিভিশন বেঞ্চ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ খারিজ করায় রাজ্য সরকার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল, সেই ডিভিশন বেঞ্চই নিয়োগ নিয়ে এসএসসি’কে বিদ্ধ করে বলেছে, “আদালত নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারেনা এবং মামলাকারী (এক্ষেত্রে এসএসসি) কোনো সুপারিশ না করার অবস্থান নিলেও তারা ক্লিনচিট পেতে পারে না। ঐ কাজের জন্য কমিশনকে জবাবদিহি করতে হবে এবং কোনো সুপারিশ করা হয়নি বলে অবস্থান নিয়ে তারা দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যেতে পারেনা।” গোটা ঘটনায় এসএসসি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং শাসক দলের প্রভাবশালীরা এক গাঁটছড়ায় আবদ্ধ বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। ভারতের জনগণ নিজেদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, কমিটি গঠন অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে আশু ক্ষোভ প্রশমন ও তদন্তকে দীর্ঘায়িত করারই এক কৌশল। ডিভিশন বেঞ্চের গঠন করা কমিটি স্কুলে কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে কতটা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দেখায়, সেটাই এখন দেখার।

পুনশ্চ: আবারও বেআইনি পথে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে মামলা এবং এবারও ২৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের দুর্নীতির অনুসন্ধানে সিবিআই’কে তদন্তের নির্দেশ। এই লেখা যখন ছাপতে যাচ্ছে রাজ্য সরকার তখনও ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায়নি। তবে, ধারাবাহিকতা বলছে, সম্ভবত ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানানো হবে এবং ডিভিশন বেঞ্চ আরো একবার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ খারিজ করে তদন্তের ভার দেবে ডিভিশন বেঞ্চের গঠন করা কমিটির হাতে।

দুর্নীতির ভিত্তিতে নিয়োগের অভিযোগ অতি সংক্ষেপে এরকম। নবম-দশম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের শিক্ষিকা হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়ে প্যানেলভুক্ত হয়েছিলেন নাসরিন খাতুন। কিন্তু তাঁর চাকরি হয়নি, উল্টে প্যানেলে নাম না থাকা দুজন বাংলা শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ সম্ভব নয়। যাদের নাম প্যানেলেই ছিলনা, এসএসসি তাদের নাম জেনে অনুমোদনপত্র দিল কিভাবে? আবার সেই ‘গোপন হাত’এর খেলা, যে হাত এসএসসি এবং নিয়োজিত প্রার্থীদের মধ্যে সংযোগ মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে। মামলাগুলোর নিষ্পত্তি কবে হবে, এবং অপরাধীরা শাস্তি পাবে কিনা তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে, একটা কথা কিন্তু হলফ করে বলাই যায় — এটাই স্কুলগুলোতে নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির শেষ অভিযোগ নয়; নিয়োগের ক্ষেত্রে বেনিয়মের ব্যাপকতা এতটাই যে, এই ধরনের অভিযোগ আরো সামনে আসবে, এবং মামলাও হাইকোর্টে গড়াবে।

- জয়দীপ মিত্র

Global warming and climate

ভূপৃষ্ঠ লাগোয়া আবহমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিঘটনাকে বিশ্ব উষ্ণায়ন বলে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। তাঁরা বার বার সতর্ক করার পর সংযুক্ত জাতিরাষ্ট্র ১৯৮৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারী প্যানেল (আইপিসিসি) গঠন করে।

২০১৮ সালে আইপিসিসি একটি বিশেষ প্রতিবেদনে জানায় যে শিল্প বিপ্লবের আগের তুলনায় বর্তমানে ভূমণ্ডলের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ ০.৮ থেকে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। এবং এই বৃদ্ধির হার সবচেয়ে তীব্র হয়েছে গত চার-পাঁচ দশকে। বর্তমানে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এই গড় প্রতি মুহূর্তে বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে এবিষয়ে আজ আর কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই যে গত ৫০ বছর ধরে বিশ্ব উষ্ণায়নের মনুষ্যসৃষ্ট মূল দুটি কারণ হল, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অরণ্যের বিনাশ। জীবাশ্ম জ্বালানিগুলির মধ্যে তুলনামূলক বিচারে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয় কয়লা দহনে, আর সবচেয়ে কম প্রাকৃতিক গ্যাস দহনে।

যেসমস্ত গ্যাস সূর্যরশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে দেয় কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপকে মহাশূন্যে বেরিয়ে যেতে দেয় না সেগুলোকে ‘গ্রিন হাউস গ্যাস’ বলে। বায়ুমন্ডলে এই গ্যাসগুলি থাকার কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠে বাসযোগ্য উষ্ণতা আছে। কিন্তু বাতাসে এই গ্যাসগুলির ঘনত্ব বেড়ে গেলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধি যদি খুব দ্রুত হয় তাহলে বাস্তুতন্ত্রের বিদ্যমান ভারসাম্য অস্থির হয়ে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রিন হাউস গ্যাস। বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব অনেকটা বেড়ে গেছে। ফলত তীব্র হারে বিশ্ব উষ্ণায়ন শুরু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে এই উষ্ণায়নের প্রভাব বহুমাত্রিক।

বিগত ২০০ বছরে ২.৩ লক্ষ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঘটেছে, যার অর্ধেকটাই নির্গত হয়েছে গত ৩০-৩৫ বছরের নয়া উদার অর্থনীতির জমানায়। এই ব্যবস্থায় এখন বছরে ৭০০ কোটি টন নিঃসরণ ঘটছে। কিন্তু প্রকৃতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষিত হওয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা বছরে ২০০-৩০০ কোটি টন। আইপিসিসি জানাচ্ছে যে বর্তমানের ক্রবর্ধমান হারে নিঃসরণ হতে থাকলে এই শতাব্দীর শেষে গিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা দাঁড়াবে ৩.৩ থেকে ৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝামাঝি কিছু।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমগ্র ভূমণ্ডল জুড়েই হঠাৎ হঠাৎ অস্বাভাবিক আবহাওয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে, কৃষিকার্যে যার প্রভাব মারাত্মক। ঘূর্ণীঝড়ের তীব্রতা ও প্লাবন বেড়ে গেছে। মেরুদেশের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। সুন্দরবন ব-দ্বীপে বঙ্গোপসাগরের উচ্চতাবৃদ্ধির বাৎসরিক হার ৮ মিলিমিটার যা বৈশ্বিক হারের (৩.৪ মিলিমিটার প্রতিবছর) তুলনায় অনেকটাই বেশি। পৃথিবীর পুরনো নগরগুলির অধিকাংশই সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। বিশ্বে বর্তমানে ২৩ কোটি মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ জোয়ারের তল থেকে ১ মিটার নীচের তলে বসবাস করেন। ১৪০ কোটি ভারতবাসীর মধ্যে ১৭ কোটি মানুষ সমুদ্র উপকূলের গ্রাম বা শহরগুলিতে বসবাস করেন।

Kolkata in climate crisis-news

সংযুক্ত জাতিরাষ্ট্রের রিপোর্ট — “জলবায়ু পরিবর্তন ২০২২: প্রভাব, অভিযোজন ও দুর্বলতা” — বিপদঘন্টি বাজিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন এক বড় বিপদ হয়ে উঠছে। বহু বিপজ্জনক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। উপকূলবর্তী শহরগুলির বিপদ অনেক বেশি। বিপন্ন নগরীর তলিকায় প্রথম দিকেই আছে কলকাতা। জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব সংক্রান্ত সর্বশেষ রিপোর্টে ১১ বার কলকাতার কথা উল্লিখিত হয়েছে সতর্কতা জ্ঞাপন করে। সেগুলোর কয়েকটি হল

• কলকাতার সবুজ গাছপালার বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেল আম্ফানের ঝড়ে। ভারতের সাম্প্রতিক অরণ‍্য সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের প্রধান সাতটি নগরীর মধ‍্যে কলকাতাতেই গাছপালা ঘেরা জায়গা সবচেয়ে কম। এই পরিস্থিতিতে যে পরিকল্পনা নেওয়া দরকার তার কিছুই করা হয়নি বলে জানাচ্ছে ইউনাইটেড নেশনের প্রতিবেদন।

• বিভিন্ন বিপর্যয়কালে মৃত‍্যু ঘটার সম্ভাবনার মাপকাঠিতে বানানো তালিকার প্রথমে থাকা বিশ্বের ৮টি মেগাসিটির মধ‍্যে ৭টি এশিয়া মহাদেশের এবং কলকাতা নগরী তার অন‍্যতম।

• ৩ লক্ষের ওপর মানুষ বসবাস করেন এরকম নগরগুলোর মধ‍্যে ৩৩০টি নগরী খরা কবলিত হয়ে পড়তে পারে। সব মিলিয়ে নগরগুলির মোট ৪১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ এর প্রকোপে পড়বে। এরকম নগরের মধ‍্যে তিনটে হল কলকাতা, দিল্লী ও করাচি।

• ২০৫০ সালের মধ‍্যে সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত বৃহত্তম যে ২০টি নগরী বন‍্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে তার মধ‍্যে ১৩টি এশিয় নগরী এবং এদের মধ‍্যে কলকাতা সহ ৯টি নগর জলমগ্ন হয়ে যেতে পারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও বন‍্যার কারণে। ঝড়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ‍্যা বিপুল পরিমাণে বাড়তে থাকবে যে নগরগুলির তারমধ‍্যেও কলকাতা অন‍্যতম।

বিশ্বের ৯৪৫ জন বিজ্ঞানী সংযুক্ত জাতিরাষ্ট্রের ইন্টার গভর্ণমেন্টাল প‍্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-র পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন যা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে। শহর বসতি ও পরিকাঠামো সংক্রান্ত চ‍্যাপ্টারের রচয়িতা বিজ্ঞানী দলের প্রধান অঞ্জল প্রকাশ বলেছেন, “ভারতে নগরগুলি চরম বিপদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, বিশেষত মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা ও ভুবনেশ্বরের মত উপকূলবর্তী নগরগুলি”। তিনি আরও জানিয়েছেন যে আগামী বছরগুলোতে গরমের জ্বালা ‘লক্ষ‍্যণীয় মাত্রা’ নেবে এবং “ঘুর্ণীঝড় আরও ব‍্যাপক প্রভাব ফেলবে মহানগরগুলিতে, কলকাতার ক্ষেত্রে দুদিক থেকেই বিপদ”।

বঙ্গোপসাগরের জলের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় বঙ্গ উপকূল জুড়ে ঘূর্ণীঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে যা কলকাতাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করবে, জানিয়েছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানী তথা আইপিসিসি রিপোর্টের অন‍্যতম লেখক ম‍্যাথু রক্সি কোল।

বিজ্ঞানীরা অবশ‍্য বলেছেন যে দ্রুত যথোপযুক্ত ব‍্যবস্থা গ্রহণ করলে এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে মোকাবিলা করা সম্ভব। “সবুজ ও নীল পরিকাঠামো সুরক্ষিত রাখা ও শক্তিশালী করাটা জরুরি। জলবায়ু বিকৃতি সহ‍্য করতে শহরে সবুজ পরিকাঠামো আরও সবুজায়ন ও জীববৈচিত্র‍্য রক্ষায় ফোকাস নিশ্চিত করবে এবং নীল পরিকাঠামো, যা জলা ও নদীকে ঘেরা ও সুরক্ষিত করা বোঝায়, জলবায়ু সহনশীলতার জন‍্য গুরুত্বপূর্ণ”, জানিয়েছেন প্রকাশ।

কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, “আমার অগ্রাধিকার হল পরিবেশ, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব”। পরিবেশবিদেরা বলেন ওনার নিজের বলা কথা অনুযায়ী চলা উচিত।

রিপোর্টটির অন‍্যতম লেখক ও জল বিশেষজ্ঞ বলেন, “কলকাতা নগরকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে আমাদের অবশ‍্যই হুগলি নদী ও জলাগুলিকে সুরক্ষিত করতে যা যা করণীয় সবকিছু করা দরকার”।

- (দ‍্য টেলিগ্রাফ, ৫ মার্চ ২০২২ প্রকাশিত জয়ন্ত বসুর প্রতিবেদনের ইষৎ সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর)

‘Panchamrit’ Joomla_1

শিল্প বিপ্লবের আগের বিশ্বের তুলনায় বর্তমান বিশ্বের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি হয়েছে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ইতিমধ্যেই আগের সময়ের তুলনায় অনেক তীব্র ও অনিয়মিত চেহারা নিয়ে বন্যা, ঝড়, খরা, ভূমিধ্বস ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুততর হারে বেড়ে যাওয়ার ঘটনা সামনে এসেছে। সব দেশেই এর প্রকোপ পড়ছে। ভারতের মত বিপুল উপকূল এলাকা সম্পন্ন এবং জনবহুল অথচ দরিদ্র দেশে এর প্রভাব অনেক মারাত্মক চেহারা নেবে, ভারতের চারটি উপকূলবর্তী নগরী — মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা ও ভুবনেশ্বর — জলমগ্ন হয়ে যেতে পারে ২০৫০ সালের মধ্যে।

গ্লাসগো শহরে ২০২১ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে সিওপি ২২ জলবায়ু সম্মেলনে ভারত সরকার জলবায়ু সম্পর্কিত দায়বদ্ধতায় স্বাক্ষর করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পাঁচটি মূল করণীয় ঘোষণা করা হয় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। সেগুলি হল,

• ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্য নামিয়ে আনবে।
• ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে অ-জীবাশ্মজাত শক্তি উৎপাদন ৫০০ গিগাওয়াটে উন্নীত করা হবে।
• ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত তার অর্থনীতির কার্বন-তীব্রতা ৪৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে।
• ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত তার শক্তি চাহিদার ৫০ শতাংশ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি দ্বারা পূরণ করবে।
• বর্তমান হিসেবের প্রজেকশনে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ভারতে মোট সম্ভাব্য কার্বন নিঃসরণ যা হওয়ার কথা তার তুলনায় ১০০ কোটি টন কম নিঃসরণ ভারত করবে ২০৩০ সালের মধ্যে।

প্রধানমন্ত্রী এই পাঁচটি কর্তব্যকে ‘পঞ্চামৃত’ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই পঞ্চামৃত ঘোষণাও কি ‘বছরে দুই কোটি চাকরি’ বা ‘একাউন্টে পনের লাখ টাকা’র মতোই জুমলা মাত্র? নইলে দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা সহ ডজন দুয়েক নতুন কয়লাখনি কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র পায় কী করে? জীবাশ্ম জ্বালানিগুলির মধ্যে পেট্রল, ডিজেল বা গ্যাসের তুলনায় অনেক বেশি কার্বন নিঃসরণ হয় কয়লা পোড়ালে। কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রথম ও প্রধান অপরিহার্য পদক্ষেপ হল বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা নির্ভরতাকে দ্রুত হারে কমিয়ে আনা। আগামি ৫০ বছরে (২০৭০ সালের মধ্যে) নিঃসরণ শূন্য করে ফেলার অমৃতবাণী শোনানো হল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, আর এখানে এসে মানুষকে বলা হচ্ছে আগামী একশ বছর কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মহান কর্তব্যে ২১ হাজার গ্রামবাসীকে ভিটেমাটি ছেড়ে সরে পড়তে হবে! আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলা হচ্ছে, আগামি আট বছরে (২০৩০ সালের মধ্যে) দেশের সমগ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেকটাই হবে পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে, আর এখানে একটি রাজ্য সরকার, যে কিনা ইতিমধ্যেই লক্ষ কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত, তরুণ প্রজন্মের কাজ জোটাতে পারেনা, শিক্ষক সহ সমস্ত সরকারি নিয়োগ বন্ধ, শিক্ষকদের পেনশনও নাকি আর দিতে পারবেনা, সেই সরকার ৩৫ হাজার কোটি টাকা (১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে কেবল তথাকথিত পুনর্বাসনের জন্য) খরচ করবে বলছে, কোনও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎসে নয়, সেই কয়লাতে! গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে ১৩৭টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে নিজ নিজ দেশে অরণ্য সংকোচন সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু সেই রেজোল্যুশনে সই করতেও অস্বীকার করে মোদী সরকার!

Party work in town

বিগতদিনে কামারহাটি পৌরসভা নির্বাচনে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে একাধিক ওয়ার্ডে প্রার্থী দেওয়া হোত। এবার মাত্র একটি ওয়ার্ডে প্রার্থী ছিলেন। পার্টির প্রার্থী মাত্র ৪৬ ভোট পেয়েছেন। পার্টির প্রার্থী দেওয়া প্রায় সব পৌরসভায় ফলাফলে কম-বেশি একই ছবি। পশ্চিমবাংলায় পার্টির এই করুণ অবস্থা কেন? একটু পিছন থেকে শুরু করা যাক, যাতে সমাধানের কোনও রাস্তা বেরোয়।

কামারহাটি পৌরসভায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে ১৯৯০-১৯৯৫-তে প্রাপ্ত গড় ভোট ছিল ১২-১৩ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট ৬০০ ও সর্বনিম্ন ২০০’র আশেপাশে থাকতো। এরপর অল্প অল্প করে ভোট কমতে থাকে। বিধানসভায় বিধায়ক এবং প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যায় বামফ্রন্ট সরকারের প্রধান বিরোধী দল ছিল কংগ্রেস। কিন্তু কংগ্রেসের অতীতের দুষ্কর্মের জন্য মানুষ ওদের বিশ্বাস করতো না। আর রাস্তায় নেমে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোটের কিছুটা অংশ আমাদের পার্টির পক্ষে যেত। যুব-ছাত্ররা এই প্রশ্নে বড় ভূমিকা পালন করতেন। পার্টি নেতৃত্ব এবিএসএ ছাত্র সংগঠনকে কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার জন্যে উৎসাহিত করতেন। সিপিএম’এর হামলা, অত্যাচার, র‍্যাগিং মোকাবিলা করে ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজ, বিকেসি, ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইউনিট গড়ে ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। এরাই আবার এলাকায় ও পাড়ায় ফিরে এসে বুক ফুলিয়ে রাজনীতি ও সংগঠন করতেন। ভ্রাম্যমান রাজনীতির বদলে তারা স্থায়ী রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতেন। আবার পার্টির দেওয়া সামগ্রিক রাজনৈতিক কাজে অংশ নিতেন। এই বুনিয়াদি দিকগুলোর সঙ্গে ছিল অতীত দিনের লড়াইয়ের প্রভাব। যা ভোট পাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যকলাপের হাত ধরেই তখনকার দিনে কামারহাটিতে অনেকগুলো পার্টি কার্যালয় গড়ে উঠেছিল। সেই সময়ও অনেক বিতর্ক হয়েছে ‘বাম ফ্রন্ট মডেলে কতটা বাম অন্তর্বস্তু’ আছে তা নিয়ে।

১৯৯৮-তে তৃণমূল কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ। প্রতিষ্ঠান বিরোধী এবং কংগ্রেস বিরোধী যুব সমাজের ঢেউ মমতা ব্যানার্জিকে কেন্দ্র করে আছড়ে পড়ল। ২০০-র বেশি কিছু ভোট পাওয়া গেল, ২০১০ সালে সব ওয়ার্ডে ভোট ২০০’র নীচে নেমে গেল। এই সময় দুটি ঘটনা লক্ষ্যণীয়। বামফ্রন্ট সরকারের দাপট কমছে। মমতা ব্যানার্জির উত্থান হচ্ছে। রাজ্যে শাসক পরিবর্তনের আবেদনে হাজারে হাজারে যুবকরা টিএমসি’তে সামিল হতে থাকলেন।

এই সময় আমাদের অবস্থা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিকভাবে বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতা করতে হয়েছে, কিন্তু নীতিগত কারণে টিএমসি’র মতো বামফ্রন্ট সরকার উচ্ছেদের ডাক বা ‘বাম হটাও’ শ্লোগান দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় নেতা ও কর্মীদের গড় বয়স বাড়ছে। বয়স বাড়ে সমসাময়িক পাড়ার যুবক ও সমবয়সী বন্ধুদের। কলোনীগুলোর সংস্কার হয়ে কাঁচা বাড়িঘর ক্রমশ বহুতল হয়েছে, পুরনো বাসিন্দারা অনেকেই জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন এবং নতুন নতুন আবাসিকরা এসেছেন। ফলে অতীতের রাজনৈতিক প্রভাব ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। এক কথায় নতুন বাসিন্দা নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের আবেদন কোনও কাজে লাগছে না। প্রজন্মের পার্থক্য ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। এমনকি যে সব কমরেডরা সামাজিক সংগঠন করতেন, সেই সংগঠনে তারা বয়সের কারণে সম্পাদক থেকে সভাপতি/সহ সভাপতি হতে থাকলেন। এই বন্ধ্যাত্ব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আঞ্চলিক কমিটি স্থানীয় স্তরে পৌর সমস্যা সংক্রান্ত দাবি এবং রাজ্য সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে সচেষ্ট হয়। যেমন জলকর ও অতিরিক্ত পৌরকর বিরোধী আন্দোলন, বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি এবং সাগর দত্ত হাসপাতাল বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ইত্যাদি। তবে বিরোধী দল হিসাবে তৃণমূল এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে আমাদের গড়ে ওঠা আন্দোলনের সব ফসল ওদের ঘরে গিয়ে উঠলো। ২০০৫ সালে পৌরসভা নির্বাচনে ২৩ ও ২৭নং ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়েছিল, ভোটের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৬০ এবং ১৮০।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিল। কয়েকজন চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেল বা রাজনীতি তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। বেশিরভাগ সংগঠকদের বয়স বাড়তে থাকলো। নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। দু’একজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যুবক আসছেন। কিন্তু এরা নির্দিষ্ট পাড়া বা ওয়ার্ডের নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা। ব্যতিক্রম ২৭নং ওয়ার্ড কয়েকজন পার্টি কর্মী এই ওয়ার্ডে আছেন, সবাই সমানভাবে সক্রিয় নন। সাধারণ বন্ধু এবং আত্মীয় পরিজনের ভোটেও ভাঁটা শুরু হল। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, নাগরিক সংগঠন ইত্যাদি গড়ে তোলার উদ্যোগ চললো।

টিএমসি ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী পক্ষের আঙিনা আরও ছোট হয়ে গেল। ২০২১ নির্বাচনে ভুল ‘বিজেমূল’ তত্ত্বের জেরে সিপিএম বিধানসভায় শূন্য হয়ে গেল। বিধানসভা নির্বাচনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রচারকে কেন্দ্রীভূত করা হল। এই প্রেক্ষিতে সমাজে উদারনৈতিক একটা ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূল ‘লেফট অফ সেন্টার’ এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে হারের পর তৃণমূল অতীতের ‘ভুল সংশোধন’ করেছে। কিন্তু পুরসভা নির্বাচনে বোঝা গেল কিছু খয়রাতি সংস্কার চালু করলেও তৃণমূল আছে ‘তৃণমূলেই’। অন্যদিকে বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হওয়ার পর সিপিএম ইদানিং রাস্তায় নেমে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াই শুরু করেছে, রাজ্যে ক্রমশ প্রধান বিরোধী পক্ষের দল হিসাবে উঠে আসছে। বিজেপি’র ভোটে ভাঁটার টান। টিএমসি’র চাপ থাকা সত্ত্বেও পুরসভায় সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট অনেকটা বেড়েছে। কামারহাটি পৌরসভায় সিপিএম পেয়েছে ৩৩,৮৭৩ (১,৬৯৮ সিপিআই) ভোট। বিধানসভা থেকে ৫,৫৬৩ ভোট বেশি। বিপরীতে বিজেপি পৌরসভায় ভোট পেয়েছে মাত্র ৮,০৪৪ যা বিধানসভা থেকে ৩০,৩৫৩ ভোট কম। কংগ্রেস (জোট হয়নি) পেয়েছে ১,৫৯৭ মাত্র। আমাদের প্রার্থী সংখ্যা ও ভোট উভয়ই কমেছে।

বাংলায় শহরের রাজনীতিতে পার্টিকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে হবে। অতিমারী, ঝড় ও বন্যায় ত্রাণ দেওয়া বা লাইব্রেরির মতো সংস্কারের কাজ চলবে, কিন্তু এই কাজগুলো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু প্রভাব ফেলতে পারে না, ‘রেড ভলান্টিয়া,’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শহরে পার্টিকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে গেলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসাবে সামনে আসাটাই আশু চ্যালেঞ্জ।

এই প্রশ্নে অতীতের কর্ম পদ্ধতি ও কৌশল কিছু দিক নির্দেশ করতে পারে। যেমন ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্র ও বামফ্রন্ট সরকারের অপশাসন, দমন পীড়ন ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান বিরোধী দল হিসাবে পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। গ্রাম বাংলায় খাসজমি দখল কিংবা বর্গাজমির ইঞ্জাংশন মুক্ত করার বা মজুরি বৃদ্ধির দাবির পাশাপাশি শহরে বর্ধিত বাসভাড়া হোক অথবা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা দরকার। ফ্যাসিবাদী মোদী সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যের অপরাধী রাজনীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে পার্টির সমস্ত ইউনিট ও গণসংগঠন যেভাবে দ্রুততার সাথে রাস্তায় নামে তা প্রশংসনীয়। রাজ্যেও টিএমসি সরকারের তোলাবাজি, দমন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দ্রুততার সাথে রাস্তায় নেমে পার্টির প্রতিষ্ঠান বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের গরিমাকে সামনে আনতে হবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পার্টির শারীরিক ভাষারও পরিবর্তন ঘটবে। ছাত্ররা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি ক্যাম্পাসে যাক, ট্রেড ইউনিয়ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিতরে সক্রিয় হোক, যুব সংগঠন চাকরির দাবিতে রাজপথে ধর্ণায় থাকুক, মহিলা সংগঠন নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় সময়মত হস্তক্ষেপ করুক, কৃষক ও কৃষিমজুর সংগঠন মাঠে নামুক নিজেদের দাবি নিয়ে। বিহার নির্বাচনে ফলাফলের দৌলতে পার্টির প্রোফাইল নিঃসন্দেহে বেড়েছে, কিন্তু তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়া দরকার। দেশ ও বাংলার গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে পার্টি সবার সামনে থাকুক।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত

== সমাপ্ত ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-10