লক্ষাধিক মানুষ সমাবেশিত হয়েছিলেন গান্ধী ময়দানে ‘দেশ বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ শ্লোগানে

chanting-save-country-save-democracy
(পার্টি কংগ্রেসের গণসমাবেশ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা লিখলেন পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য নবেন্দু দাশগুপ্ত)

সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পরলাম গান্ধী ময়দানের উদ্দেশে। পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে পাটনা যাওয়া। খবর আসছিল আগের দিন থেকে লোক আসা শুরু হয়েছে। ময়দানে গিয়ে যখন পৌঁছালাম চারিদিকে মানুষের মেলা বসে গেছে। কেউ কেউ রান্না করে খাচ্ছেন। কেউবা নিজেদের খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। কেউ বা কিনে খাবার খাচ্ছেন। পার্টি থেকে কোনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়নি, জনগণ নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করেছেন।

পার্টি থেকে সমাবেশ স্থলে সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখান থেকে ক্রমাগত প্রচার চলছে। কয়েক হাজার মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজেদের লোকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যেদিকেই তাকাই হাজার হাজার মানুষ লাল ঝান্ডা নিয়ে চলেছেন। মঞ্চ থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঘন ঘন শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে। গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে পাটনা শহরে। মেট্রোরেলের কাজ চলছে, রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, কুছ পরোয়া নেই! মানুষ হেঁটে চলেছেন গান্ধী ময়দানে ‘মালে’-র সমাবেশে। মাঝমাঠে এসে বসলাম, সূর্য তখন মাথার উপরে, এতো লোকের মাঝে সূর্যের তাপও লঘু হয়ে যায়। হঠাৎ নজরে এলো মঞ্চের সামনে বেশ কিছু মহিলা পুরুষ সাদা টুপি পড়ে বসে আছেন। কৌতূহল নিয়ে সামনে গিয়ে দেখলাম ওরা সাদা কাগজে বিভিন্ন দাবি লেখা টুপি পড়ে প্রচার করছেন।

সভা শুরুর আগে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মঞ্চে নিজেদের কার্যক্রম উপস্থাপন করে চলেছে। পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্যরা ও বিহারের বর্ষীয়ান সব নেতারাই মঞ্চে তখন উপস্থিত। কমরেড ধীরেন ঝা সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষ থেকে সভা পরিচালনা করেন। প্রথম বক্তা ছিলেন বিহার রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড কুণাল। কমরেড কুণাল বলেন গান্ধী ময়দানের এই সমাবেশ বিজেপি বিরোধী লড়াইকে আরও শক্তি যোগাবে। তিনি জানান বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য মহাগঠবন্ধন সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত পার্টি নিয়েছিল, এই সিদ্ধান্ত ছিল বাস্তব সম্মত। তা সত্ত্বেও বিহার সরকারের কাছে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলাদের যে দাবিগুলো উঠে আসছে পার্টি সেই সব লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দ্বিতীয় বক্তা কমরেড মঞ্জু প্রকাশ ‘গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ প্রস্তাব সভায় পেশ করেন। এরপর একে একে বক্তারা তাঁদের বক্তব্য রাখেন। আইসা’র সাধারণ সম্পাদক বিধায়ক কমরেড সন্দীপ সৌরভ, আরওয়াইএ সভাপতি বিধায়ক কমরেড মনোজ মঞ্জিল, স্কীম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সমন্বয় কমিটি ও সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির বিহার রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড শশী যাদব, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভার বিধায়ক কমরেড বিনোদ সিং, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বিহার বিধানসভায় পার্টির বিধায়ক দলের নেতা কমরেড মেহবুব আলম, উত্তরাখণ্ড রাজ্য কমিটির সদস্য ও ‘যোশীমঠ বাঁচাও’ আন্দোলনের সংগঠক কমরেড ইন্দ্রেশ মৈখুরি, এআইএআরএলএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি বিধায়ক কমরেড সত্যদেও রাম, সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি সম্পাদিকা কমরেড মীনা তেওয়ারি, এআইএআরএলএ-র বিহার রাজ্য সভাপতি বিধায়ক কমরেড বীরেন্দ্র গুপ্তা এবং এআইকেএম-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজারাম সিং। সর্বশেষ ও মুখ্য বক্তা পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপাঙ্কর ভট্টাচার্য।

dipankar at gandhi maidan patna

তিনি গান্ধী ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি ইঞ্চিতে লড়াইয়ের আহ্বান জানান। পার্টির পতাকাতলে যে গরিব মানুষরা ঐক্যবদ্ধ লাড়াই চালাচ্ছেন তা তুলে ধরেন। তিনি তীব্র ভাষায় বিজেপি সরকারকে অক্রমণ করে বলেন দেশের প্রতিটি মানুষকে সংবিধান, গণতন্ত্র ও দেশ বাঁচানোর সংগ্রামে সামিল হতে হবে। আমাদের উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন প্রতিটি গরীব মানুষকে খাদ্যের সুরক্ষা, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, মনরেগা প্রকল্পে সহায়তা বৃদ্ধি ইত্যাদির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের অধিকারের জন্য, দেশ বিক্রি ও হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্তের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার এবং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে সংকল্প নিতে হবে। সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর সভার পরিচালক কমরেড ধীরেন ঝা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেন।

সমাবেশে অংশ নেওয়া মানুষ কাতারে কাতারে পাটনার রাজপথ ধরে এগিয়ে চলেছেন স্টেশনের দিকে লাল ঝান্ডার লহর তুলে। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। এছাড়াও মানুষ এসেছিলেন সরকারি বেসরকারি পরিবহনে, লড়ি, ম্যাটাডোর, বাস, ট্রাক্টর বিভিন্ন পরিবহন ভাড়া করে। সূর্য ক্রমশ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, মাঠে ধুলো উড়ছে, স্বেচ্ছাসেবকরা মিছিলের জনতাকে নিজেদের জেলা ও গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য সাহায্য করছেন। এক সময় ময়দানে জনতার কলরব শেষ হয়, প্রতিনিধিরা নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসেন। এতো বড় সুশৃঙ্খল জমায়েত ও তার সাথে পার্টি কংগ্রেসের দায়িত্ব বিহারের পার্টি কমরেডরা যে ভাবে সফল করে তুলেছেন তার জন্য তাদের লাল সেলাম অবশ্যই প্রাপ্য। দুদিন বাদে দুঃসংবাদ আসে সমাবেশ থেকে ফেরার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে আরারিয়ার কমরেড রাধাদেবী (৬০) ও টেম্পোর ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে পূর্ণিয়ার রসিদ লাল মুর্মুর (৪৫)। প্রয়াত কমরেডদের লাল সেলাম। এই দুঃখজনক দুর্ঘটনা ছাড়া আর সব কিছুই ছিল পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল।

সিপিআই(এমএল)-এর এতো বিশাল ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমাবেশ পার্টি কংগ্রেসকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম পরবর্তী দুদিনে, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও অবিজেপি বিরোধী দলগুলো এবং বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে। সেখানে বিভিন্ন বক্তারা উল্লেখ করেন হিন্দি বলয়ে ‘মালে’ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমাবেশ শেষ হল এক নতুন আশা ও প্রত্যয় জাগিয়ে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-5