আদানির সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি কি আদানিকে প্রদত্ত উপঢৌকন?

adani powar
নরেন্দ্র মোদীর অতি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানি এখন শুধু ছলচাতুরীর মাধ্যমে নিজেদের সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে তোলা ও ব্যবসার হিসাব-নিকাশে কারচুপির অভিযোগেই অভিযুক্ত নন, দুর্বল ও দরিদ্র প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর অলাভজনক ও অন্যায্য চুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও তাদের তাড়া করছে। সম্প্রতি আদানি গোষ্ঠীর একটা সংস্থা থেকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত একটা চুক্তি চলে এল বিশ্লেষণ ও তীব্র চর্চার কেন্দ্রে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে গৌতম আদানি গোষ্ঠীর সংস্থা আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড)-এর ২০১৭ সালে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় আদানি গোষ্ঠী নির্মিত ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত সমস্ত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনতে বাধ্য থাকবে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ঐ চুক্তির সম্পূর্ণ বয়ানটি প্রকাশ্যে এসেছে এবং চুক্তির শর্তগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একটা অংশের মতে এই চুক্তি শুধু "অত্যধিক ব্যয়বহুল" এবং “অলঙ্ঘনীয়ই” নয়, তা “অপ্রয়োজনীয় এবং অন্যায্যও” বটে। চুক্তি বাতিলের দাবি তাই জোরালোভাবে উঠেছে বাংলাদেশে। প্রসঙ্গত, চুক্তি ২০১৭ সালে সম্পাদিত হলেও এবছরের মার্চ মাস থেকে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ আমদানির কথা।

ঐ চুক্তি অনুযায়ী যে প্রক্রিয়ায় বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হবে, তার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশের প্রভূত ক্ষতির বিনিময়ে আদানির সুবিপুল মুনাফা অর্জনের নিশ্চয়তা। বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের প্রধান মাধ্যম হবে কয়লার দাম। আদানি গোষ্ঠী কয়লার যে দাম দেখাবে, সেটাই হবে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের প্রধান ভিত্তি। ভারতের কয়লা খনিতে উৎপাদিত তুলনামূলক কম দামের কয়লা ঝাড়খন্ডের গোড্ডা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যবহৃত হবে না। ঐ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কয়লা। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতে কয়লা ব্যবসার বৃহত্তম সংস্থা হল আদানিদের সংস্থা আদানি এন্টারপ্রাইজেস আর বিদেশে আদানির কয়লা খনি রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। সেখান থেকে কয়লা এসে ভিড়বে ভারতের সমুদ্র বন্দরে যার পরিচালন ভারও আদানিদের হাতে। তারপর সেখান থেকে ৭০০ কিমি রেলে পরিবাহিত হয়ে কয়লা আসবে ঝাড়খন্ডের গোড্ডায়। সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য তৈরি হবে ট্রান্সমিশন লাইন এবং তার মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত হয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছবে বাংলাদেশ সীমান্তে এবং তারপর সঞ্চারিত হবে বাংলাদেশে। কয়লা আমদানি থেকে ট্রান্সমিশন লাইন তৈরি এবং তার সাথে পরিবহণের সমস্ত খরচ ও মুনাফা যুক্ত করে বিলের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছ থেকে দাম আদায় করবে আদানির সংস্থা। কয়লার সর্বোচ্চ দাম কত হতে পারে তার উল্লেখ অন্যান্য চুক্তিতে থাকে। কিন্তু আদানির সংস্থার সঙ্গে হওয়া চুক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দামের এমন কোনো উল্লেখ চুক্তিতে নেই। কয়লার দাম যত বাড়বে (এবং এখন তা বর্ধমান) সেই অনুযায়ী বাজার দরে নির্ধারিত হয়ে বিদ্যুতের মূল্য বেড়ে চলবে।

এছাড়া, চুক্তির শর্ত অনুসারে ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎ প্রবাহ ধরে রাখার ক্ষমতার জন্য খরচও বিপিডিবি-কে বহন করতে হবে। এর  ব্যয় বছরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার, বিশেষজ্ঞদের ধারণায় যে হার যথেষ্ট বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কত ঘন্টা কাজ হল, কত ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হল বা উৎপাদন আদৌ হল কিনা, ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের ক্ষেত্রে তা বিবেচ্য হবে না। অর্থাৎ, যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কথা চুক্তিতে বলা আছে তা বাংলাদেশকে ২৫ বছর ধরে দিয়ে যেতে হবে, এমনকি কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলেও বিপিডিবি তা দিতে বাধ্য থাকবে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো যন্ত্র খারাপ হলে, রাজনৈতিক কারণে প্ল্যান্টের কোনো ক্ষতি হলে, উৎপাদন ব্যহত হলে তার মেরামতির ব্যয়ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বোর্ডকে বহন করতে হবে। উল্লেখ নিষ্প্রোয়জন যে, মেরামতি ও সংস্কারের এই ব্যয় আদানিদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যয়কে বাড়িয়েই চলবে। প্রাথমিক আনুমানিক হিসাবে আদানিদের সংস্থা থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মূল্য ইউনিট প্রতি ৮.৭১ টাকা হবে বলে ধরা হয়েছিল, কয়লার দাম ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেই দামই এখন ইউনিট প্রতি ১৭ টাকা বা এমনকি ২৪ টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর সম্মিলিত ফল বিপিডিবি-র অর্থ তহবিল এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ।

আদানি এবং বিপিডিবি-র মধ্যে চুক্তি আর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে আসছে – বাংলাদেশ নিজে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং ভারতের অন্যান্য স্থান থেকে যে বিদ্যুৎ আমদানি করে থাকে তার পরও কি আরও বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন বাংলাদেশের রয়েছে? বাংলাদেশ থেকে এ বছরের জানুয়ারি মাসে পাওয়া তথ্য বলছে – বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা হল ২২৭০০ মেগাওয়াট, এবং আরও কিছু কেন্দ্র নির্মীয়মান অবস্থায় রয়েছে এবং সেগুলির নির্মাণ সম্পন্ন হলে আগামী চার বছরে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে আরও ১৩০০০ মেগাওয়াট। এটা অবশ্য ঠিকই যে এই পরিপূর্ণ ক্ষমতার রূপায়ণ বাস্তবে ঘটে না, তবে, সেটাকে হিসেবে নিয়েও শেষমেশ যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় সেটাও কম নয়। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে ২০২২-এর এপ্রিল মাসে, ১৪৭৮২ মেগাওয়াট। প্রয়োজন অনুসারে গরমের সময় বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় ১৩০০০ মেগাওয়াট, এবং শীতের সময় কম প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন নেমে আসে ৯০০০-১০০০০ মেগাওয়াটে। আর বাংলাদেশ ভারত থেকে এখন আমদানি করে ১১৬০ মেগাওয়াট। এর পরও কি আরও বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন বাংলাদেশের রয়েছে? প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আমদানির পরিণামে বাংলাদেশের কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কি অনাবশ্যক হয়ে পড়ে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে না? এই ধরনের প্রশ্ন বাংলাদেশে মাথাচাড়া দেওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধাক্কা খাবে না তা বুক ঠুকে বলা যাবে না। বাংলাদেশের এক বিশেষজ্ঞ এবং উপভোক্তা সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান সামসুল আলম বলেছেন, “দু-দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে বিপর্যয় ঘটানোর সম্ভাবনা এই চুক্তির রয়েছে।… ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে আমাদের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা বৈষম্যপূর্ণ এক চুক্তিতে সায় দিয়েছেন, যার মধ্যে দিয়ে এক বেসরকারি সংস্থাকে তার মুনাফাবাজির অভিপ্রায় পূরণে সহায়তা করা হয়েছে এবং তা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐ স্বত্বাধিকারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য।”

প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে প্রথমবার বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেন যে বাংলাদেশ কতৃপক্ষ যেন “বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিদ্যুৎ পরিবহণ ও বন্টনের ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর প্রবেশের পথ সহজসাধ্য করে।” বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুক্ত ভারতীয় কোম্পানি বলতে আদানির কথা নিশ্চয় তাঁর মাথায় ছিল। গৌতম আদানি অনেক বারই নরেন্দ্র মোদীর বিদেশ সফরের সঙ্গী হয়েছেন এবং গৌতম আদানিকে বিদেশী প্রকল্পের বরাত পাইয়ে দেওয়ার তদবির নরেন্দ্র মোদী করেছেন বলেও শোনা যায়। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাতেও বিদ্যুৎ প্রকল্প আদানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নরেন্দ্র মোদী শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২-এর ১০ জুন শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট কমিটির সামনে তাঁর সাক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা বিদ্যুৎ বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এম সি ফার্দিনানন্দো যা বলেছিলেন তা এইভাবে উল্লিখিত হয়েছিল দ্য মর্নিং পোস্ট পত্রিকার ১২ জুন সংস্করণে – “ফার্দিনানন্দো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সম্পর্কিত পরলামেন্ট কমিটির সামনে শুক্রবার (১০ জুন) বলেন, মান্নারে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাত ভারতের আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছে যার পিছনে ছিল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের উপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চাপ।” এরপর  শ্রীলঙ্কা ও ভারত সরকারের পক্ষে ঐ চাপের কথা অস্বীকার করা এবং ফার্দিনানন্দোর পক্ষেও “আবেগের” বশবর্তী হয়ে "মিথ্যা" বলার কথা উত্থাপন করে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চাপ”-এর কথা কিন্তু শ্রীলঙ্কার জনগণের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আর গৌতম আদানির হাতে ঐ বিদ্যুৎ প্রকল্প তুলে দেওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কা “লক্ষ-লক্ষ ডলার” ক্ষতির মুখে পড়েছে বলেও শ্রীলঙ্কার ভাষ্যকাররা জানিয়ে ছিলেন। গৌতম আদানির প্রতি নরেন্দ্র মোদীর পৃষ্ঠপোষকতা এইভাবে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের  গৌতম আদানি গোষ্ঠীর এক সংস্থার সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিও বাংলাদেশের প্রভূত ক্ষতির বিনিময়ে গৌতম আদানিকে প্রদত্ত এক উপঢৌকন বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। এবং ঐ চুক্তি রূপায়ণের পিছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উমেদারির যে প্রসঙ্গ বাংলাদেশে উঠেছে তা একেবারে ভিত্তিহীন বলে খারিজ করার নয়।

-- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-5