চটকল শ্রমিকরা মজুরির জন্য আদালতের পথে
chat


পশ্চিমবঙ্গে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৭৫-৮০ টি চটকল বর্তমানে আছে। প্রায় ২.৫ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারিরা এই মিলগুলোতে শ্রমশক্তি বিক্রি করে তাঁদের রুটি রুজি চালান। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়াবার পর অন্যান্যদের মতো চটকল শ্রমিকদেরও শ্রমশক্তি বেঁচার বাজার বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ মিল বন্ধ। করোনা ভাইরাস রোধে সরকারী নিদান ২২ মার্চ থেকে ‘লকডাউন’ সবাই গৃহবন্দী থাকুন। আচমকা সরকারী ফরমানে সমস্যায় পড়লেন চটকল শ্রমিকরা। চটকলের সিংহভাগ শ্রমিক রোজগারের জন্য আসেন পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে। কারখানা বন্ধ থাকায় তাদের হাতে অর্থ নেই, কাজ নেই, আবার নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাওয়ারও ব্যবস্থা নেই। এক অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন চটকলের শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। সঙ্কটকালীন অবস্থায় সামান্য একটু আলো দেখলেই মানুষ কিছুটা স্বস্তি পায়, এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ১৩ এপ্রিল জানালেন লকডাউন শিথিল করা হয়েছে ২৫% শ্রমিক নিয়ে ১৮টা চটকলে উৎপাদন চালু হবে। এরপর ১৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন শুধুমাত্র ১৮টা মিল না, সব মিলে খুলবে ১৫% শ্রমিক নিয়ে। শ্রমিকরা আশায় বুক বাধলেন, যাই হোক সঙ্কট কালে ঘুরিয়ে ফিরিয়েও যদি মাসে কয়েকদিন কাজ পাওয়া যায়, আপাতত মন্দের ভালো। দ্বিতীয় দফার লকডাউনের মেয়াদ ছিল ২০ এপ্রিল পর্যন্ত, শ্রমিকদের আশা ছিল মিল খুলবে, না মিল বন্ধই থাকল। উল্টে লকডাউনের মেয়াদ ৩ মে পর্যন্ত বর্দ্ধিত হল।

২১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিনের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা কেন্দ্রের শ্রমমন্ত্রী, বস্ত্রমন্ত্রী, রাজ্যের মুখমন্ত্রী, মুখ্যসচীব, শ্রমমন্ত্রী সহ সব জেলাশাসক, মহকুমাশাসক এবং প্রতিটি মিল কর্তৃপক্ষ এবং মালিকদের প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান জুট মিল অ্যাসোসিয়েশন’ কে জানানো হয়েছে। আবার বিসিএমএফ সহ অন্যান্য ইউনিয়নগুলো সতন্ত্রভাবে প্রশাসনের সবস্তরে শ্রমিকদের দুর্দশা ও লকডাউনের সময়ে পূর্ণ মজুরির জন্যে স্মারক লিপি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সরকারের কাছ থেকে সুরাহার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা মুক ও বধির হয়ে বসে আছেন।

বিসিএমএফ লকডাউনের সময় পূর্ণ মজুরির দাবিতে কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, নৈহাটি, আগরপাড়া, বালি, মহাদেও, বাউরিয়া, নর্থশ্যাম নগর, এঙ্গাস, এবং অন্যান্য মিলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আন্দোলনের চাপে বেশ কিছু মিল শ্রমিকদের ২০০০ – ৪০০০ টাকা অগ্রিম দিয়েছে, মিল খুললে জুন/জুলাই মাস থেকে কয়েক কিস্তিতে শ্রমিকদের এই ধারের টাকা পরিশোধ করতে হবে।

এদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে চলছে। মৃত্যু প্রতিদিন বাড়ছে। সংক্রমণ রোধে সরকার – ‘লকডাউন’ ‘ঘরবন্দি’ ‘দৈহিক দূরত্ব রক্ষা’ ‘মাস্ক ব্যবহার’ সহ ব্যবস্থাদি মেনে চলার নির্দেশ জারি করেছে। ‘লকডাউন’ আপাতত ৩ মে ২০২০ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংগঠিত অসংগঠিত সমস্ত ক্ষেত্রে সকল শ্রমিককে ‘লকডাউন’ সময়ের জন্য পুরো মজুরি/বেতন দেবার নির্দেশ সরকার জারি করেছে যাতে ভুখমারী দেখা না দেয় এবং অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে।

চটশিল্পের মালিকরা সরকারের নির্দেশ পাবার পরেও তাকে কোনোরকম আমলই দিচ্ছে না। মিল কর্তৃপক্ষ ৩১ মার্চ ২০২০ পক্ষকালের মধ্যে শ্রমিকরা যতটুকু কাজ করেছে সেই সময়কার বেতন (earned wages) দিয়েছে, লকডাউনের বাকি সময়ের বেতন দেয়নি। শুধু তাই নয় মালিকরা বেতন না দিয়ে তারা ‘লকডাউন’ ভেঙ্গে কাজ করানো এবং তৈরি পণ্য বের করার জন্য দালাল নিয়োগ করেছে। এই দালালরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ। কয়েকটি কারখানা বেশ কিছুকাল ধরে বন্ধ। তারা দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। শ্রমিকরা বেতন না পেলে ‘ভুখমারী’ দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কা আছে। আবার দালাল লাগিয়ে মাল বের করার চেষ্টা হলে নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা থাকছে। শ্রমিকরা সরকারের সমস্ত বিধি নির্দেশ মেনে চলছে। মেনে চলবে। এর অর্থ এই নয় শ্রমিকরা ‘ঘরবন্দী’ থাকবে আর মালিকরা সেই সুযোগে সরকারের নির্দেশ ভেঙ্গে তাদের জুলুম ও অপকীর্তি চালিয়ে যাবে। এই অবস্থা চললে শ্রমিকরা আইন মেনে আন্দোলনের পথে নামতে বাধ্য হবে। অত্যাবশ্যক পণ্য আইন দেখিয়ে তৈরি মাল বার করার অপচেষ্টায় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদত আছে। মালিকরা যখন বে-আইনিভাবে জুটমিল লক-আউট করে তখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের কথা সরকারের মনে পড়ে না। লকডাউনের সময় সে কথা মনে পড়েছে।

লকডাউনের দিন যত বাড়ছে শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা, ক্রোধ বাড়ছে। হাতের সামনে মিল কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকরা পাচ্ছেন না, অনেক ক্ষেত্রে তাদের রাগের প্রকাশ ঘটে মিলের নেতৃত্বের উপর। এআইসিসিটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চটকল শ্রমিকদের মজুরির জন্য কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। তার প্রস্তুতিতে চটকলের ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ একসাথে ২৭ ও ২৮ এপ্রিল যে যে থানায় জুটমিল আছে সেখানে মিল কর্তৃপক্ষ বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। দায়ের করা প্রথম অভিযোগে আছে সরকারী আদেশ অমান্য করে মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের লকডাউনের সময়ের পূর্ণ মজুরি থেকে বঞ্চিত করেছে। এখন দেখা যাক এতেও মালিকদের চৈতন্যের উদয় হয় কিনা। না হলে? ইউনিয়নকে এক রকম বাধ্য হয়েই আইনের দীর্ঘ পথে ঢুকতে হবে। তাই এই আপৎকালীন অবস্থায় অর্ধাহারে থাকা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকারের হাত বড়িয়ে দিন। ‘বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’ শ্রমিকদের কাছে আপনাদের সহযোগিতার বার্তা পৌঁছে দেবে।

খণ্ড-27