“যারা কেড়ে খায় মুখের গ্রাস!” তাদের বিরুদ্ধে গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ছে রেশন বিদ্রোহ
ration

- জয়তু দেশমুখ।

লকডাউনের একমাস দশ দিন পেরিয়ে গেলো। একটু খোঁজখবর করলেই দেখা যাবে দিন-আনি দিন-খাই অবস্থা যাদের সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে এ অবস্থাটা আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য আজ সবচেয়ে বড় সংকট রূপে তাঁদের কর্মহীন প্রাত্যহিক জীবনে একেবারে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে। ভয়াবহ এই সংকটের সময়কালে রেশনে যতটুকু পাওয়া যায় সেই চাল-গমই তাদের একমাত্র সম্বল! খড়কুটোর মতো সেটুকুই মানুষ আঁকড়ে ধরেছে। লকডাউনে ঘরে থাকার কথাই কেবল আউড়ে গেছে সরকার, গরিব মানুষের রুজি রুটির বিকল্প সংস্থানের জন্য কোনো কিছুই কোনো সরকার করেনি। স্বাভাবিক ভাবেই রেশনের সমগ্র ব্যাবস্থাটার গভীরে যে অপ্রাপ্তি – বঞ্চনা ও দুর্নীতি বাসা বেঁধে রয়েছে, গণবন্টনকে গুটিয়ে ফেলার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে মূলত তার বিরুদ্ধেই দিকে দিকে শুরু হয়েছে প্রবল গণক্ষোভ! জেলায় জেলায় বহু জায়গায় রেশনে বরাদ্দ খাদ্যসামগ্রী পরিমাণে কম দেওয়া হচ্ছে। কোথাও বা নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা, রাইসমিলে বা শাসকদলের গ্রামীণ মাতব্বরদের ঘরে মালপত্র অদলবদল করা ইত্যাদি চলছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে শাসক দলের যে প্রবল আধিপত্য কায়েম রয়েছে তাতে ওদের মদত বা প্রশ্রয় ছাড়া রেশনে এ জাতীয় অনিয়ম-দুর্নীতি বাস্তবে চলতেই পারেনা। সঙ্গতভাবেই উঠে এসেছে ফুড সাপ্লাই তথা শাসক দলের রেশন সিন্ডিকেটের কথা। ওদিকে বহু সংখ্যক মানুষের ডিজিটাল রেশন কার্ড নেই। হাজার হাজার মানুষ নিয়ম বিধি অনুযায়ী ‘টোকেন’ও পায়নি,বহু যায়গায় ‘টোকেন’গুলি পঞ্চায়েতের কর্তারা ঘরে রেখে দিয়ে কারচুপি করে মাল তুলে নিচ্ছে। শাসকদলের নেতারা রেশনের মাল গোপনে তুলে নিয়ে সেটাকেই ‘ত্রাণ’ হিসাবে বিলি করে গরিব মানুষকে তাঁদের অনুগত করে রাখার ঘৃণ্য রাজনীতি করছে। দেখা যাচ্ছে বিডিও অফিসে কার্ড না থাকা মানুষের দীর্ঘ লাইন। সেখানে অনাহার অর্ধাহারে থাকা গ্রামীণ গরিবদের বলা হচ্ছে – পঞ্চায়েতে যাও। পঞ্চায়েত বলছে – বিডিও অফিসে যাও। সব মিলিয়ে চলছে এক চরম বিশৃঙ্খলা। উদাহরণ প্রচুর! বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে বর্ধমানের পূর্বস্থলী, নদীয়ার নাকাশীপাড়া থেকে মুর্শিদাবাদের সালার – বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া খবরে দেখা যাচ্ছে এই সব অনিয়ম বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। বাস্তবে রেশন কার্ড না থাকাটা ব্লক ও জেলার ফুড সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের দীর্ঘসূত্রিতা এবং অতিপরিচিত ঘুষের কারবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত! যেমন একটি পরিবারের মধ্যে অনেকেরই নতুন কার্ডের আবেদনের কাগজপত্র মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ঘুষের বিনিময়ে কার্ড তৈরি করার জন্য সক্রিয় দালাল চক্রর মাধ্যমে কারও কপালে শিকে ছেঁড়ে, অধিকাংশেরই জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যায়। মানুষ মাসের পর মাস বঞ্চিত থেকেই যায়।

এই রেশন দুর্নীতির বিষয়টা নিছক কতিপয় অসাধু ডিলারের রেশন চুরির প্রশ্ন নয়। সমগ্র গণবন্টন ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে দুর্নীতি। স্বভাবতই শাসক দলের গ্রামীণ মাতব্বর, ডিলার, খাদ্য দপ্তরের আমলার যোগসাজসে এই চক্র সক্রিয়। সম্প্রতি যেটা যুক্ত হয়েছে তা হলো বহুসংখ্যক গরীব মানুষকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকার রেশন ব্যাবস্থাকে ধাপে ধাপে তুলে দিতে চাইছে। খাদ্য সুরক্ষার গালভরা কথাটুকু শিকেয় তুলে নগদ ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তুতি জোরকদমে শুরু হয়েছে। রান্নার গ্যাসে যা চালু হয়েই গেছে। রেশনের দোকানে দোকানে চলছে ডিজিটাল কার্ড পাঞ্চ করার পকসো মেশিন চালু করার তোড়জোড়। এ বছর কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্য ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। খাদ্য মজুত ও সরবরাহের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ফুড কর্পোরেশনের অফ ইন্ডিয়া(এফসিআই)-র জন্য বরাদ্দ অর্থও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে খাদ্যদ্রব্যের অবাধ বানিজ্য চালু করার নীতিতে কেন্দ্র এগিয়ে চলেছে। গণবন্টনে কাটছাট করতে করতে যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটাকে তুলে দিলেই বৃহৎ খাদ্য ব্যবসায়ীদের লাভ। সরকার এখন ওদেরই স্বার্থরক্ষা করে চলেছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই এ রাজ্যের ৯ কোটি রেশন কার্ডের ৬ কোটির কিছু বেশি সংখ্যক মানুষকে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় (এনএফএসএ) তিন রকম কার্ডের মাধ্যমে যুক্ত করেছে, বাকি ৩ কোটিকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। আগে বিপিএল-রা ৮ কেজি মাল পেতো। সেটা কমিয়ে করা হয়েছে ৫ কেজি! অন্যদিকে রাজ্য সরকার প্রায় দেড় কোটি গ্রাহককে ২ টাকার খাদ্য প্রকল্পে যুক্ত করলো – বাকি দেড় কোটি হয়ে গেলো বাদ! তারা নাকি রেশন থেকে কিছুটা কমদামে কিনে খাবে! বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই ঐ খাদ্যদ্রব্য তোলে না। ওটা যায় ডিলার ও অসাধু চক্রের পকেটে। তাই দেখা যাচ্ছে গণবন্টন সংকোচন নীতিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একই পথের পথিক। কাগজে কলমে ধান কেনা ও চাল তৈরি করার ক্ষেত্রে এ রাজ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ – রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী এই ফাটা রেকর্ড শুনিয়েই চলেছেন। কিন্তু বাস্তবে রাইস মিলগুলি সরকারের ঘরে চালই পাঠায় না। ওরা ফড়ে দালালের মাধ্যমে চাষিদের থেকে ১০০০-১১০০ টাকায় ধান কিনে ১৮৫০ টাকা সরকারী দর আত্মসাৎ করে। লেভি হিসাবে যতটা চাল সরকারকে দেওয়ার কথা মিলগুলি আদৌ দেয় না। ফলে গণবন্টনের জন্য প্রয়োজনীয় চাল রাজ্য সরকারের কাছেও মজুত নেই। এই বিষয়গুলিই রেশনে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ কম হওয়ার নেপথ্যে বাস্তব কারণ হিসাবে থেকেছে। করোনা লকডাউনের নতুন পরিস্থিতিতে যা প্রকটভাবে একেবারে সামনে উঠে এসেছে।

লকডাউনের পরিস্থিতিতে বিনামূল্যে চাল-গম কারা পাবে, রাজ্যের কাছে প্রয়োজনীয় চাল-গম সরবরাহ হয়েছে কী হয়নি তা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে কেন্দ্র ও রাজ্য চাপান উতোর। রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি চালাচালি। ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ – মাঝখান থেকে বঞ্চিত হলো রাজ্যের ব্যাপক গরিব মানুষ। লকডাউনের ঠিক পরেই কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা ছিলো অতিরিক্ত ৫ কেজি চাল দেওয়া হবে। মার্চ মাসের এক সপ্তাহ এবং এপ্রিল মাসের চার সপ্তাহ মোট পাঁচ সপ্তাহ তরজা করতে করতেই কেটে গেলো। গ্রাহকরা সেই বর্ধিত চাল পেলোই না। সেটা দেওয়া শুরু হলো মে মাসে। তাও রাজ্যের ৩ কোটির কিছু বেশি সংখ্যক গ্রাহকরা সেই বর্ধিত চাল অর্থাৎ মাথা পিছু মাসিক ১০ কেজি পাবে না। আর যারা মে মাসে পেলো কিন্তু তাঁদের প্রাপ্য এপ্রিল মাসের মাথাপিছু ৫ কেজি মাল যে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো, এ দায় কার? কারা কেড়ে খেল মুখের গ্রাস? অবশ্যই কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারই এজন্য সমানভাবে দায়ী। রাজ্য সরকার তার দুই রকম গ্রাহকদের বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার দাবি লাগাতার একগুঁয়ে ভাবে অস্বীকার করে চলেছে। দেখা গেলো এপ্রিল মাসের চার সপ্তাহ আরকেএসওয়াই ২নং গ্রাহকরা ৫ কেজি চাল পায়নি। অসহায় বহু গরিব মানুষ ভুল ভাবে ঐ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছিলো। তাদেরকে লকডাউনের একমাস বঞ্চিত করা হলো। রেশনে পরিবারপিছু মাসিক মাত্র ১ কেজি ডাল কেন্দ্রীয় গ্রাহকদের দেওয়া হবে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য! তাই দাবি উঠছে, মাথা পিছু ১৫ কেজি খাদ্যদ্রব্য আগামী ৬ মাস দিতে হবে। এ দায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে মিলিতভাবে নিতে হবে। স্পেশাল রিলিফের যে খাদ্য দ্রব্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিলি করার কথা - সেটা শাাসকদলের দলীয় কার্যালয় থেকে বিলি করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য এই অবৈধ কাজ করা হচ্ছে স্বজন পোষণ ও দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এটাকে বন্ধ করে রেশনের মাধ্যমে কার্ড না থাকা মানুষদের মধ্যে বিলি করার দাবি সঙ্গত ভাবেই উঠে এসেছে।

রেশন দুর্নীতি বন্ধ করার একমাত্র উপায় গণতদারকি। তাই গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন স্তরের মানুষের ও সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই গণ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই একমাত্র সমাধান! গরিব মেহনতি মানুষের পাল্টা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সাথে এটা সম্পর্কযুক্ত! তাই সার্বজনীন গণবন্টনের অধিকারের দাবীতে, লকডাউনের পরিস্থিতিতে চাল-গম ছাড়াও ডাল, তেল, আলু, মশলা প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের দাবিতে দিকে দিকে গড়ে উঠছে বঞ্চিত ভূখা মানুষের লড়াই।

খণ্ড-27