জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি : অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
asit

৩ জুন ২০২০ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ বেশ নীরবেই চলে গেল। তার একটা কারণ নিশ্চয় এই করোনা আক্রান্ত দিনকাল। তবে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দশ খণ্ডে লেখা সুবিস্তৃত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তর কারণে সাহিত্যের ছাত্র ও গবেষক সহ মননশীল পাঠকদের কাছে যে জায়গায় পৌঁছেছেন, সেই জায়গাটা চিরন্তনই।

অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল হাজার ১৯২০ সালের ৩ জুন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁতে। তাঁর পিতা ছিলেন অক্ষয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা চারুবালা দেবী। ১৯২৫ সাল থেকেই তারা হাওড়ায় বসবাস করতে থাকেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমৃত্যু হাওড়াতেই থেকেছেন। ১৯৩৮ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন। বাংলায় তার তার পাওয়া ৭৭ শতাংশ নম্বর ছিল জেলার মধ্যে এই বিষয়ে সর্বোচ্চ। এরপর তৎকালীন রিপন কলেজ, বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে তিনি আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম-এর পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক স্তরে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনোর সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলেজে পড়ার সময়েই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সায়গন থেকে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলো তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন এবং সেগুলো ফরোয়ার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসন ও যুদ্ধপরিস্থিতির নিরিখে এ ছিল এক দুঃসাহসিক দেশপ্রেমের পরিচয়।

১৯৪৫ সালে নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধ্যাপনা জীবনের শুরু। এরপর তিনি রিপন কলেজে পড়াতে আসেন। ১৯৫৭ সালে যোগদান করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চেয়ার অধ্যাপকের পদে বৃত হন। ১৯৮৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর নেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পরে ২০০২ সালে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই ২০০৩ সালের ২১ মার্চ তিনি প্রয়াত হন।

khand

 

দশ খণ্ডের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’র মতো এই রকম মহা পরিকল্পনা নিয়ে একক প্রয়াসে এত বড় মাপের গবেষণা এর আগে বাংলা সাহিত্যে হয়নি। দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখার কাজটা শুরু করেছিলেন দু-খণ্ডে প্রকাশিত বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বইতে। সুকুমার সেন এর পাঁচ-খণ্ডে লেখা বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস এ আচার্য অনেক বেশি মৌলিক কথা বলেছেন। কিন্তু বিভিন্ন মতের মধ্যেকার বিতর্ক, নানা দৃষ্টিকোণের তুলনামূলক আলোচনা, সাম্প্রতিকতম গবেষণা অবধি সমস্ত তথ্যের সমন্বয় এবং অবশ্যই তার সঙ্গে নিজের গবেষণা, বিশ্লেষণ ও অভিমত যেভাবে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যায়, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায় – এমন কাজ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে এর আগে বা পরে আর হয়নি।

অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসামান্য গবেষণা কর্মের সবচেয়ে মৌলিক অংশটি পাওয়া যাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্ব থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম পর্ব -- ভারতচন্দ্রের পর থেকে মাইকেলের আগে অবধি বাংলা সাহিত্যের তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত পর্বটি নিয়ে। মহা গ্রন্থের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডে প্রায় আড়াই হাজার পাতায় যে তথ্য বিশ্লেষণ ও সাহিত্য বিচারের নিদর্শন তিনি হাজির করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা কমই আছে।

এই মহাগ্রন্থের কোন খণ্ডে কী আছে তার পরিচয় দেওয়া যাক

bang

 

প্রথম খণ্ড - বাংলা ভাষা সাহিত্যের উদ্ভবের পটভূমি, ইতিহাস ও চর্যাপদ, চর্যাপদ এর পর থেকে চৈতন্যদেব-এর আগে অবধি আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। কৃত্তিবাস, মিথিলার বিদ্যাপতি প্রমুখদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এই খণ্ডে।

দ্বিতীয় খণ্ড - ষোড়শ শতাব্দীর চৈতন্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা এখানে আলোচিত। চৈতন্যদেবের জীবন, সাহিত্যে সমাজে তার প্রভাব, চৈতন্য জীবনী সাহিত্য, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের বৈষ্ণবপদাবলী এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচিত। পাশাপাশি রয়েছে মনসামঙ্গলের বিজয়গুপ্ত, নারারণদেব, বিপ্রদাস পিপলাই, চণ্ডীমঙ্গলের দ্বিজ মাধব, মুকুন্দ চক্রবর্তী প্রমুখের আলোচনা।

তৃতীয় খণ্ড - এর প্রথম পর্বে রয়েছে সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের আলোচনা। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল, দৌলত কাজী সৈয়দ আলাওলের মত মুসলিম কবিদের লেখা প্রণয়কাব্য ও অনুবাদ সাহিত্য, কাশীরাম দাসের মহাভারত নিয়ে আলোচনা পাওয়া যাবে এইখানে।

দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম পর্বের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের শাক্ত পদাবলী বা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর নিয়ে আলোচনা এখানে পাওয়া যাবে।

চতুর্থ খণ্ড - এই খণ্ডে আলোচিত বিষয়বস্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্ব থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম পর্ব পর্যন্ত আখড়াই, হাফ আখড়াই, কবিগান ইত্যাদি প্রসঙ্গ।

পঞ্চম খণ্ড - প্রায় হাজার পাতার সুবিশাল এই খণ্ডটি বাংলা গদ্যের আদিপর্বের ইতিহাস সম্পর্কে এখনো অবধি শ্রেষ্ঠ কাজ। বাংলা গদ্যের প্রাক উনিশ শতকীয় বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে আলোচনার পর পর্তুগীজদের লেখা বাংলা গদ্য, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকদের লেখা গদ্য গ্রন্থ নিয়ে অজস্র অজানা অচেনা তথ্যকে তিনি মহাফেজখানা খুঁড়ে বের করে এনেছেন।

ষষ্ঠ খণ্ড - এই খণ্ডে রামমোহন সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাংবাদিকতা ও সাময়িক পত্রের উদ্ভব বিকাশের ইতিহাস পাওয়া যাবে।

bang

 

সপ্তম খণ্ড - এই খণ্ডের কেন্দ্রীয় চরিত্র অবশ্যই মাইকেল মধুসূদন ও বিদ্যাসাগর। ঈশ্বর গুপ্ত এবং মহাকাব্যযুগের রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্রও এখানে আলোচিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর নামে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থও রয়েছে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

অষ্টম খণ্ড - এই খণ্ডের কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্কিমচন্দ্র। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা সাহিত্যের পরিচয় রয়েছে এখানে।

নবম খণ্ড - বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন লেখকেরা এখানে আলোচিত হয়েছেন।

দশম খণ্ড - এই খণ্ডটি লিখতে লিখতে অসিত বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রয়াত হন। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের আলোচনাটুকুই কেবল এখানে পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অন্য গ্রন্থ অবশ্য আগে প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

অলিখিত থেকে গেছে রবীন্দ্র উত্তর সাহিত্য নিয়ে প্রস্তাবিত একাদশ খণ্ডটিও। এই আলোচনা কেমন হতে পারত তার ইঙ্গিৎটুকু কেবল ধরা আছে জনপ্রিয়তায় শীর্ষবিন্দু স্পর্শকারী একখণ্ডে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত বইটিতে।

-- সৌভিক ঘোষাল 

খণ্ড-27