গণবিদ্রোহে জাগরণ বনাম ফ্যাসিস্ট ষড়যন্ত্রের ক্রশরোডে আমেরিকা
usa

গত ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর দশ দিন পেরিয়ে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য ছোট বড় শহরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০টির বেশি শহরে কারফিউ ঘোষণা করেছে শাসকেরা। হোয়াইট হাউসের দিকে এগনো বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হিংস্র কুত্তা লেলিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, কিন্তু তার পরের দিন হোয়াইট হাউস ঘিরে ফেলে বিক্ষোভকারীরা এবং ট্রাম্প পালিয়ে মাটির তলার বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়।

tram

 

এই ঘটনা দুনিয়ার মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে রাইখস্ট্যাগের বাঙ্কারে হিটলারের শেষ পরিণতির কথা। কিন্তু বাস্তবে তুলনাটা বরং উল্টো। ১৯৪৫-এ সোভিয়েত লাল ফৌজের বিজয়ে গর্তে ঢুকে যাওয়া হিটলারের তুলনায় বরং ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার সময়কার হিটলারের সাথেই বর্তমানে ট্রাম্পের অবস্থা বেশি মিল খায়। বাস্তবিকই, হিটলারের কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট ষড়যন্ত্রের কায়দাতে, গত বুধবার ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে একটি ভিডিও কম্পাইলেশন ছড়িয়ে দেয় যেখানে দেখানো হয় যে অ্যান্টি ফ্যাসিস্টরা সাধারণ মানুষ ও সরকারী ভবনগুলিতে হামলা চালানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় ইঁটপাটকেল পাথর ইত্যাদি জমা করছে (দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই কিছু সংবাদমাধ্যম ও প্রতিবাদীরা এই ফেক ভিডিওর মিথ্যা প্রচার উন্মোচিত করে দেয় এবং হোয়াইট হাউস ভিডিওটি ডিলিট করে দিতে বাধ্য হয়। এই ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেলেও কোনরকম ক্ষমা অবশ্য চায়নি ট্রাম্প)। বুর্জোয়া সংবিধানের গণতন্ত্রটুকু নস্যাৎ করে একটি সংকীর্ণ মুমূর্ষু ও মরিয়া পুঁজিগোষ্ঠির ‘ফ্যুয়েরর’ হয়ে ওঠার পথে এখন রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

usa

 

অন্যদিকে আমেরিকার তরুণ শ্রমিকশ্রেণি বলতে শুরু করেছে, “মূল বিষয় হলো এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া যে, আমরাই সিদ্ধান্ত নেব”। বিগত দশ দিনের ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে, মার্কিনী বুর্জোয়া গণতন্ত্র ভেতর থেকে ফুরিয়ে গেছে এবং মার্কিন সমাজ ও রাষ্ট্র এমন এক মোড়ের মাথায় এসে পড়েছে যেখানে হয় শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন অথবা গণতন্ত্রের খোলস ঝেড়ে ফেলে সরাসরি ফ্যাসিস্ট পুনর্গঠন। শ্রেণী সংগ্রামের ময়দানে দুটি পক্ষের এরকম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ার অভিব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট হয়।

force

 

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটগুলির গভর্নররা কেন আরও বেশি সংখ্যায় ‘ন্যাশনাল গার্ড’ নিয়োগ করে বিদ্রোহকে দমন করছে না সে বিষয়ে গভর্নরদের সাথে মিটিঙে ট্রাম্প “প্রতিবাদীদের মুছে ফেলা”-র নির্দেশ দিয়ে বলেন, “এটা একটা আন্দোলন এবং যদি আপনারা একে থামিয়ে না দেন তাহলে পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকবে। আপনাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং যদি এখুনই দমন না করেন তাহলে আসলে আপনারা সময় নষ্ট করছেন। ওরা আপনাদের মাথায় চড়ে বসতে চলেছে এবং আপনারা শেষ পর্যন্ত একগুচ্ছ উদগাণ্ডুতে পরিণত হবেন”। বিচার বিভাগের কাছেও ট্রাম্প আবেদন জানিয়েছে প্রতিবাদীদের অন্ততপক্ষে দশ বছরের জন্য জেলে পুরতে। ট্রাম্পের এক সহযোগী সরাসরি ঘোষণা করেছে, “মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে আমরা টেররিস্টদের শিকার করি সেভাবেই অ্যান্টিফা নিকেশ করতে হবে”। ‘অ্যান্টিফা’ হল অ্যান্টি-ফ্যাসিস্টদের জনপ্রিয় নেটওয়ার্কের নাম। বাস্তবেই ট্রাম্প প্রশাসন বিদ্রোহীদের বিচার ও শাস্তির দায়িত্ব অর্পণ করেছে ‘জয়েন্ট টেররিস্ট টাস্ক ফোর্স’-এর ওপর, যে ফোর্স মধ্যপ্রাচ্য ও সেন্ট্রাল এশিয়ায় গ্রেপ্তার করা টেররিস্টদের বিচার করে শাস্তি দেওয়ার কাজে নিযুক্ত ছিল। তিরিশ হাজারের ওপর ন্যাশনাল গার্ডের সাথে সেনাবাহিনীর পুলিশও নেমে পড়েছে এবং দেশের ভেতরেই সেনা নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি পদক্ষেপের যাবতীয় দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সেনা প্রধানদের সর্বোচ্চ সংস্থা ‘জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ’-এর চেয়ারম্যানের ওপর। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের নেতৃত্বে এক মিলিটারি-পুলিশ-ডিক্টেটরশিপের পথে এগোচ্ছে শাসকেরা।

ame

 

জর্জ ফ্লয়েড বাধা দেননি গ্রেপ্তারির সময়। মাটিতে ফেলে গলায় হাঁটু গাড়া দিয়ে চেপে রাখার সময়ও প্রতিরোধ করতে দেখা যায়নি তাঁকে। ন’মিনিট ধরে কেবল বলার চেষ্টা করেছেন “আমি শ্বাস নিতে পারছি না” এবং ধীরে ধীরে নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু আমেরিকাকে আরেকবার জাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই দৃশ্য মার্কিনী বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নৃশংস বর্ণ-জাতিবাদ দুনিয়ার সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের কাছে এই বাস্তবতা নতুন কিছু নয়। লুট করা জমিতে, লুট করা শ্রমের ওপর, বর্ণবাদের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আদি কাল থেকে এরকম লক্ষকোটি হত্যা সংগঠিত করেছে। বর্তমান বিদ্রোহের নতুনত্ব হল- তরুণ প্রজন্মের শ্রমজীবি জনতা এই ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ সচেতন হয়ে উঠেছে, বর্ণবাদ খতম করে নানা-জাতি-বর্ণের ঐক্য দ্রুত প্রসারিত করছে এবং এই ধ্বংসাত্মক পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির সন্ধানে পথে নেমেছে। কোভিড মহামারীতে লক্ষাধিক মানুষ তো জর্জ ফ্লয়েডের মতোই শ্বাস না নিতে পেরে মারা গেল কেবল নৃশংস মুনাফার স্বার্থে। সরকারি কোষাগার থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বেল-আউট হস্তগত করার ব্যবস্থা পাকা করে এখন খেটে-খাওয়া জনতাকে আবার ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কোভিডের ঝুঁকির ভেতর। নিরস্ত্র নিরিহ ফ্লয়েডকে যারা হত্যা করল সেই পুলিশ বিভাগই নিত্যনতুন মারণাস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম কেনার বাহানায় বাজেটের এক বিপুল অংশ শুষে নেয়। অথচ চার কোটির ওপর তরুণ-তরুণী জীবিকাহীন। এই পুলিশ বাহিনীই আধুনিক মার্কিনী দাসব্যবস্থা -- ‘প্রিজন ইন্ডাস্ট্রি’ -- পরিচালনায় লুটেরা পুঁজিপতিদের শিকারি কুকুরের কাজ করে।

usaa

 

তরুণ প্রজন্ম আওয়াজ তুলেছে, “মৃত্যু ও ধ্বংসের এই পুঁজিবাদী শৃঙ্খলার চেয়ে এখন বিশৃঙ্খলাই ঢের বেশি জরুরি”। এই বিদ্রোহ স্বতস্ফুর্ত প্রাণশক্তিতে যেমন ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে তেমনই সমন্বয় সাধন ও ঐক্যবদ্ধতায় ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। সরকার, গভর্নরগণ এবং কর্পোরেট মিডিয়া প্রতিবাদীদের ইমেজে যতই কালিমা লেপনের চেষ্টা করুক না কেন শান্তিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল গণ বিদ্রোহের বাস্তব ছবিটা সম্পূর্ণ আড়াল করা সম্ভব হয়নি। এই প্রতিস্পর্ধা কতখানি জয়যুক্ত হবে তা বলা না গেলেও পরিবর্তনের দিন যে ঘনিয়ে আসছে তা বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ‘ডেমোক্র্যাট’-রা মুদ্রার অপর পিঠ মাত্র, টুইডিলডি ও টুইডিলডামের চক্কর এই সংকটকালে কার্যকরী থাকবে বলে মনে হয় না। দুনিয়াও আর একই রকম থাকবে না যেরকমটা কয়েক মাস আগেও ছিল। আমাদের দেশেও আপাত শান্ত পরিস্থিতির তলায় খানিকটা একই ধরণের বস্তুগত পরিবর্তন দ্রুত ঘটে চলেছে। মহামারি ও লকডাউন ব্যাপক শ্রমজীবি তরুণ প্রজন্মকে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বহু কিছু শিখিয়েছে। নতুন উপলব্ধি নিয়ে গ্রামে ফিরেছে শহরের শ্রমজীবি তরুণ প্রজন্ম।

খণ্ড-27