করন্দা - শ্রেণী সংগ্রামের আলোকবর্তিকা
katanda

আজ ৩১ মে। আজ থেকে ২৭ বছর আগে বর্ধমানের করন্দা গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে আগুনে পুড়িয়ে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছিলো ৬ জন কৃষিমজুর গরিব কৃষকদের। পরদিন শহীদদের মরদেহগুলি সারিবদ্ধ ভাবে লালপতাকায় ঢেকে রাখা হয়েছিল পাড়ার লাগোয়া উন্মুক্ত মাঠে। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জী সেখানে পৌঁছে গেলে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা শঙ্কর মিত্র, বর্ধমানের কৃষক নেতা বিশ্বনাথ ঘোষ তাঁকে বলেছিলেন, দয়া করে আমাদের শহীদদের নিয়ে রাজনীতি করবেন না। একথা শুনে নেত্রী ফিরে এসেছিলেন। হত্যাকারী সিপিএমের বিরুদ্ধে বর্ধমানের মাটিতে উঠেছিলো নকশালবাড়ির বিপ্লবী সংগ্রামের লালপতাকা। তারপর সেই বধ্যভূমিতে এসে পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিনোদ মিশ্র বলেছিলেন, করন্দা হত্যাকান্ড নিছক কোনো নির্বাচন পরবর্তী হিংসার ঘটনা নয়, এটা পশ্চিম বাংলার গ্রামাঞ্চলে শ্রেণীসংগ্রামের প্রতিফলন। গণহত্যার ঠিক আগের দিনই অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঐ বুথে সিপিএমের পরাজয় হয়েছিলো। জয়ী হয়েছিলো নকশালপন্থীরা। কিন্তু লন্ঠনের আলোয় গননায় ব্যালট বাক্স বদল হয়ে যায় মাঝরাতে। আর পরদিন ভোরে সূর্য ওঠে রক্তস্নাত হয়ে। ঘরপোড়া গ্রাম করন্দা জেগে থাকে শ্রেণীসংগ্রামের আলোকবর্তিকা হয়ে। আজও সেই এলাকার গরিব মানুষেরা শহীদের স্বপ্নকে তাঁদের বুকের গভীরে ধরে রেখেছেন।

নব্বইয়ের দশকের সেই সময়কালে গ্রামাঞ্চলে কায়েমী স্বার্থান্বেষী নব্য ধনী - জোতদারেরা সিপিএম-এর সম্প্রসারিত শ্রেণীভিত্তি হয়ে উঠেছিলো। ওরাই হয়ে উঠেছিলো গ্রামীণ নেতৃত্ব। স্বভাবতই সিপিএমের মধ্যে থাকা কৃষিমজুর ও গরিব কৃষকদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে। দলে দলে শোষিত বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষেরা সংগ্রামী বামপন্থার পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়। জমি ও মজুরির দাবিতে সমবায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে ওঠে। শুরু হয় অধিকার মর্যাদা ও গরিব মানুষের পাল্টা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। এই গতিকে স্তব্ধ করতেই ঘটানো হয় করন্দা গণহত্যা। রচিত হয় সরকারি বামপন্থার কলঙ্কিত ইতিহাস।

nad

 

আজ শাসকের রং বদলে গেছে। কিন্তু বর্ধমান সহ গ্রামবাংলার বুকে আজও এগিয়ে চলেছে কৃষিমজুর, গরিব ভাগচাষি, চুক্তিচাষিদের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই। নকশালবাড়ির পর করন্দা তারপর সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলেছে কৃষকের জীবন-জীবিকা রক্ষা ও বিকাশের লড়াই।

দীর্ঘদিন ধরে সেই হত্যাকান্ডের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে। এতোগুলি বছর ধরে লেগে থেকে হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে আইনি লড়াই সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়িয়েছে। তাদের আদেশে শুরু হয়েছে তথাকথিত “বেকসুর খালাস” খুনীদের পুর্নবিচারের প্রক্রিয়া। মামলা এখন হাইকোর্টে। যদিও জনগণের আদালতে সে বিচার আর বকেয়া নেই। কারা হত্যাকারী সাধারণ মানুষের কাছে দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।

তবু আজও সংগ্রাম ও ঐক্যের দ্বান্দ্বিকতায় ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলন চলছে। দেশব্যাপী কৃষকের লং মার্চ, শ্রমিকের ধর্মঘট, দলিতের জাগরণ, ক্যাম্পাসে আজাদীর লড়াই প্রভৃতি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের সংগ্রামের ময়দানে বাম ঐক্যের পতাকা উড়ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন, কর্পোরেট লুঠ, সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেশকে বিক্রি করে দেওয়ার বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলন। কারন তেভাগা, খাদ্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের বিপ্লবী নেতা কমরেড চারু মজুমদার বলেছিলেন, “জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ”।

করন্দার শহীদের রক্তে রাঙ্গা পতাকা তুলে ধরে বামপন্থার স্বাধীন আত্মঘোষণার সংগ্রাম আজও এগিয়ে চলেছে কঠোর কঠিন পথে। করন্দার শহীদদের জানাই লাল সেলাম।

-- জয়তু দেশমুখ 

খণ্ড-27