ব্লুমসবারির পিছু হটা ও বাকস্বাধীনতা বিতর্ক
cerew

ব্লুমসবারি নামে একটি ইংরেজি বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা ২২ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা Delhi Riots 2020: The Untold Story (বাংলায়, দিল্লী দাঙ্গার অকথিত কাহিনী) নামক বইটি প্রকাশ করবে না। এই বইটির লেখিকা মোনিকা অরোরা, প্রেরনা মালহোত্রা, এবং সোনালি চিতলকার। তারা তিন জনে দিল্লী দাঙ্গার ওপর একটি তথ্য সংগ্রহকারী টিমে ছিলেন। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী “আর্বান নক্সাল” এবং “ইস্লামি জিহাদী” দের দ্বারা এই দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। এই বইটি প্রকাশ করার আগে বইটি নিয়ে একটি আলোচনা সভা ডাকা হয় যেখানে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, ভুপেন্দ্র যাদব, ‘অপ ইন্ডিয়া’ পোর্টালের সম্পাদক নুপুর শর্মা, এবং হিন্দুত্ববাদী চলচ্চিত্র পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল।

এই মানুষগুলি কারা সেটা জেনে নেওয়া যাক। কপিল মিশ্রের উস্কানিমূলক ভাষণের পরেই দিল্লীর দাঙ্গা শুরু হয়। ‘অপ ইন্ডিয়া’ হচ্ছে এমন একটি নিউজ পোর্টাল যাদের একমাত্র কাজ হল বিজেপির পক্ষে বাজারে বিভিন্ন মিথ্যা খবর ছড়ানো। বিবেক অগ্নিহোত্রি এমন একজন লোক যিনি ‘আর্বান নক্সাল’ শব্দবন্ধটির জন্মদাতা। এই ধরণের সভার অয়োজন দেখে লোকের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে আলোচ্য বইটিতে কি আছে। ফলত সাধারণ পাঠকপাঠিকা মহল থেকে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় তা এমন চেহারা নেয় যে চাপে পড়ে প্রকাশক সংস্থা ‘ব্লুমসবারি’ বইটি প্রকাশ করা থেকে পিছিয়ে আসে।

এর ফলে বিজেপি সমর্থক মানুষেরা এবং বেশ কিছু বিশিষ্টজনও বলেন যে প্রকাশকের বইটি প্রকাশ করা উচিত কারণ বাকস্বাধীনতার অধিকার খর্ব হচ্ছে। যারা প্রকাশক সংস্থাকে সমালোচনা করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধেও এই এক অভিযোগ তোলেন তাঁরা। এই অভিযোগ অর্থহীন, কারণ শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বহু মানুষ যে প্রকাশক সংস্থাকে সমালোচনা করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সংস্থাটি যে সেই সমালোচনাকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হল তা সত্যের প্রতি সাধারণ মানুষের দায়বদ্ধতা ও সত্য প্রতিষ্ঠায় ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তাকেই প্রকাশ করে এবং মত প্রকাশ তথা সমালোচনার অধিকারকে তা শক্তিশালী করে। অন্যদিকে, কেবল সত্য কথা বলে ফেলার জন্য বহু মানুষ বহুভাবে যাদের দ্বারা নির্যাতিত, কারারুদ্ধ এমনকি খুন হয়ে যাচ্ছেন তাদেরই মুখে বাকস্বাধীনতার কথা শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু ফ্যাসিবাদীদের সংগঠিত অপপ্রচার ও হুমকির রাজনীতি বিভিন্ন সময়েই এই বাকস্বাধীনতার যুক্তির আশ্রয় নেয়।

ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রধান অস্ত্র হল তার প্রচার যন্ত্র এবং তার দ্বারা তৈরি করা অবাস্তব এক সামাজিক অবস্থা। প্লেটো লিখেছিলেন, বাকস্বাধীনতার অবাধ অধিকার যদি দেওয়া হয় তাহলে মাঝে মাঝেই এমন বক্তৃতাবাজের উদ্ভব হবে যারা মানুষের ভয় এবং ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রই শেষ করে দেবে। ফ্যাসিবাদীরা গণতন্ত্রের এই দুর্বলতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। নাৎসি প্রচার মন্ত্রী গোয়েবেলস বলেছিলেন যে, সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে গণতন্ত্র তার নিজের শত্রুর হাতে গণতন্ত্র নষ্ট করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ারটা তুলে দেয়। আজকে যখন হাজার হাজার ইন্টারনেট ট্রোলরা সরকারের বিপক্ষের লোকেদের চুপ করানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তারা নিজেদের পক্ষে বাকস্বাধীনতার যুক্তি দেয়। গোদি মিডিয়ার টিভি নিউজ এংকররা যখন বিরোধীদের ওপর চেঁচায় তখন তারা একই যুক্তি দেয়। লক্ষ্য করুন যে এসব ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো যুক্তি তর্ক হচ্ছে না তবু আসছে বাকস্বাধীনতার যুক্তি।

এই ব্যাপক প্রচার অভিযান চালানোর লক্ষ্য হল সমাজের জ্ঞান বা সত্য খোঁজার সামর্থ্য নষ্ট করে দেওয়া। তার বদলে প্রধান বক্তৃতাবাজের কথা চুড়ান্ত সত্যের আসনে স্থাপন করা। এর জন্যে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব। এরকম নিশ্চয় শুনেছেন যে “৫০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা সংখ্যা গড়িষ্ঠ হয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যে মুসলমান যুবকেরা হিন্দু মেয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্মান্তরণ করে বিয়ে করছে”। সঙ্ঘীরা এর নাম দিয়েছে “লাভ জিহাদ”। এটি একটি জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। দিল্লীর দাঙ্গার পেছনে যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি কাজ করছিল তা হল “সিএএ-এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন দেশকে ভেঙে ফেলার একটা চেষ্টা। এর পেছনে রয়েছে আর্বান নক্সাল আর ইস্লামিক স্টেট”। একইভাবে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার সময় ছড়িয়ে দেওয়া হল যে মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছে। যার ফলে হুগলিতে মুসলমানদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হল। মাঝে মাঝেই শোনা যায় যে পশ্চিমবাংলায় নাকি “দু কোটি” বাংলাদেশী ঢুকে পড়েছে। নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাটে ভোটে জেতানোর জন্যে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসবাদীরা মোদীকে মারার জন্যে ঢুকে পড়েছে। তারপর তাদেরকে পুলিশ মারলো। পরে জানা গেল সবক’টা ফেক এনকাউন্টার, পুলিশের সাজানো সংঘর্ষ। আজকের ভারতে এরকম আরো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদাহরণ একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবেন।

এই ভুয়ো তত্ত্বগুলো ফেসবুক এবং ওয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বারবার তা মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া হয়। বিজেপির বিরোধীরা এগুলোকে পাত্তা না দিলে বলা হয় যে তারা হিন্দু বিরোধী এবং দেশদ্রোহী। তাদের ওপর ভুয়ো ধর্ম নিরপেক্ষতার অভিযোগ চাপানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সত্যের জন্যে গবেষণা চলে, সেগুলোকে বলা হয় দেশদ্রোহীদের আখড়া। মানুষ সত্য এবং মিথ্যের ফারাক করতে পারেনা। চাটুকার মিডিয়া চ্যানেলগুলো প্রতিনিয়ত সত্যকে ঝাপসা করে তোলে।

সমাজের এই অবাস্তব অসত্যের অবস্থাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। ব্লুমসবারির পশ্চাদপসরণ এই অবাস্তব অসত্যের বেড়াজাল ভেঙ্গে সত্যবদ্ধ সক্রিয়তার বিজয়ের সম্ভাবনার প্রতি মানুষের আস্থাকেই জোরালো করবে।

- প্রত্যুষ নন্দী  

খণ্ড-27
সংখ্যা-30