আয়কর রিটার্ন দাখিল, খুঁটিয়ে দেখা ও আবেদনের নয়া পদ্ধতি-কর্মী সঙ্কোচনের নয়া ফর্মুলা
rae

দেশের ১৩৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৫.৮৭ কোটি মানুষ আয়কর দফতরের কাছে নিজেদের আয় সংক্রান্ত বিবরণ দাখিল করে, যাকে পরিভাষায় রিটার্ন দাখিল করা বলা হয়। আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ এই সময়কালকে রাজকোষ বর্ষ ও বিত্ত বর্ষ হিশেবে ধরা হয়, সাধারণভাবে সেটি অর্থ বর্ষ হিশেবেও পরিগণিত হয়। যদিও ব্যবসায়ীদের অন্যরকম অর্থ বর্ষ বা হিসেব বর্ষ ধরার অধিকার আছে। ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলা সময়ের মধ্যে শেষ হওয়া কোনো অর্থ বর্ষ বা হিশেব বর্ষের জন্য পরবর্তি ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ সময়কালকে আয়কর দফতরের পরিভাষায় এ্যাসেসমেন্ট বর্ষ বলা হয়। অর্থাৎ ১ এপ্রিল ২০১৮ থেকে ৩১ মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে বেতনভোগীরা যে আয় করবেন তার জন্য বা ওই সময়ের মধ্যে শেষ হওয়া (যেমন ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) কোনো ব্যবসায়ীর হিসেব বর্ষের মুনাফার জন্য ১ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ৩১ মার্চ ২০২০-কে এ্যাসেসমেন্ট বর্ষ বলা হবে। বিভিন্ন বিধি নিষেধ সাপেক্ষে ২০১৯-২০ এ্যাসেসমেন্ট বর্ষের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে হয়। বর্তমানে সমস্ত রিটার্নকেই অনলাইনে বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে দাখিল করতে হয়। দাখিলিকৃত রিটার্নগুলির মধ্যে কিছু রিটার্নকে বেছে নিয়ে তাকে খুঁটিয়ে দেখা হয়। যদি সেই খুঁটিয়ে দেখার সময়ে রিটার্নগুলিতে কোনো ত্রুটি দেখা যায় তাহলে সেই রিটার্ন দাখিল করা ব্যক্তির উপরে অর্থদন্ড আরোপ করা হয়। সেই আদেশের বিরুদ্ধে আয়করদাতা আবেদন করতে পারেন। সেই আবেদনকে বিচার করেন আয়কর দফতরের কোনো আধিকারিক, তিনি যে অঞ্চলে আয়করদাতা অবস্থান করেন সেই শহর বা ক্ষেত্রের আধিকারিক হন। বর্তমানে খুঁটিয়ে দেখার জন্য রিটার্ন বাছাই পর্যন্ত আয়করের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে রিটার্নদাতার কোনো মুখোমুখি পরিচয় হওয়ার কথা নয়। ফলে ওই পর্যন্ত মূলত আয়কর রিটার্ন দাতা ফেসলেস বা অবয়বহীন। অতিসম্প্রতি, গত ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পরবর্তি দুটি স্তর, খুঁটিয়ে দেখা ও আবেদনকেও অবয়বহীন অর্থাৎ আয়কর আধিকারিকের সঙ্গে আয়করদাতার কোনো সাক্ষাত ব্যতিরেকেই করার কথা ঘোষণা করেছেন। এছাড়া ‘করদাতার সনদ’ হিশেবে করদাতার দায়িত্ব ও অধিকারও সরকারের তরফে ঘোষিত হয়েছে। এই ধরনের প্রায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঢাক পেটানোর তেমন প্রয়োজন থাকার কথা নয়। যখন প্যান বা বৈদ্যুতিন রিটার্ন দাখিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগত পরিবর্তন প্রবর্তিত হয়েছিল তখন কোনো প্রধানমন্ত্রী তা ঘোষণার নাটক করেননি।  কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশটি এমন এক স্তুতি বন্দনার হীরক-রাজ্যে পরিণত হয়েছে যে সব ঘোষণাই রাজাকে করতে হয়, আর চাটুকার তাঁবেদাররা আহা, বেশ বেশ বলে সমস্বরে গলা মেলায়।

যদিও ৫.৭৮ কোটি রিটার্ন দাখিল করা হয়েছে ২০১৮-১৯ এ্যাসেসমেন্ট বর্ষে, তারা সবাই কিন্তু কর দেননি; দিয়েছেন ১.৪৬ কোটি করদাতা, যা রিটার্ন দাখিলকারীদের ৪ ভাগের ১ ভাগ। করদাতাদের সংখ্যা এত কম কেন তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সাধারণত, বেতনভোগী কর্মচারিদের পক্ষে আয়কর থেকে ছুট পাওয়া দুস্কর। ২০১৮-১৯ এ্যাসেসমেন্ট বছরের আযকর বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে বেতনের থেকে প্রাপ্ত আয় ৫ লক্ষ টাকার বেশি দেখিয়ে রিটার্ন দিয়েছেন এমন করদাতার সংখ্যা ১.৩৩ কোটির মতো। ফলে অনুরূপ সংখ্যক বেতনভোগী আয়করদাতা অবশ্যই কর দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায় থেকে প্রাপ্ত আয়ের ক্ষেত্রে ওই ৫ লক্ষ টাকার সীমা অতিক্রম করেছেন মাত্র ২০ লক্ষের মতো ব্যক্তি যার মধ্যে কোম্পানিগুলিও রয়েছে। ফলে আয় লুকোনো ও কর না দেওয়ার ক্ষেত্রে কারা অগ্রণী তা বোঝাই যাচ্ছে। বেতন থেকে  মোট যে আয়ের পরিমাণ ওই বছরে দেখানো হয়েছে তা হল ২০ লক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশি, অপরদিকে ব্যবসায় থেকে মোট আয়ের পরিমাণ ২২.৫ লক্ষ কোটি টাকার মতো, যার মধ্যে কোম্পানিগুলির আয় ১২ লক্ষ কোটি টাকা, ও ব্যক্তি বা অংশীদারি ব্যবসায় বা পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যবসায় থেকে প্রাপ্ত  মোট ঘোষিত আয় ১০.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই সব তথ্য থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে এত বড় দেশে এত ব্যবসায়ীদের অত্যন্ত কম একটি অংশ আয়কর দিয়ে থাকে। যদিও এই সরকার প্রতিদিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা করে, আর সেই ঘোষণার সব থেকে বড় সমর্থক দেশের বৃ্হৎ ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।

আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় ২.৫ লক্ষ ব্যক্তি ব্যবসায় থেকে আয় আছে বলে জানিয়েছে, কিন্তু মাত্র ২০ লক্ষের বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ টাকার বেশি। সুতরাং আয়কর আধিকারিকদের খুঁটিয়ে দেখার জন্য বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে। ‘ফেসলেস স্বচ্ছ’ বন্দোবস্তের মাধ্যমে সেটা দেখা যাবে এমন ভাবার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। এই ফেসলেস স্বচ্ছ আয়করের মঞ্চ তৈরি ও তা নিয়ে ঢাক পেটানোর অন্য কারণ আছে। এই সরকার আয়কর দফতর, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, সিবিআই, এনআইএ-র মতো এজেন্সিগুলিকে ভয়াবহভাবে ব্যবহার করেছে ও করছে। রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে তা করা যাবে, তা নিয়ে মোদিজির তেমন বলার কিছুই নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অফিসে বা বাড়িতে ছাপা মারার অভিযোগকেতো সামলাতে হবে,  সে দোষ তো আয়কর দফতরের আধিকারিকদের ঘাড়েই দিতে হবে। গত বছরে কাফে কফি ডে-র মালিক সিদ্ধার্থের উপর আয়করের অত্যাচারের ফলেই নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ঘরেও রেইড করা হযেছে। ফলে যে প্রশ্নগুলি মোদিজির ঘরের লোকেদের ভিতর থেকে উঠছে, যারা বিজেপির অর্থ সরবরাহ করে থাকে, তাদের জন্যই এত স্বচ্ছ কর বন্দোবস্তের দরকার। এর আগে আদালতের বাইরে কর সংক্রান্ত বোঝাপড়ার জন্য বিবাদ থেকে বিশ্বাস প্রকল্প, এখন ফেসলেস কর নিস্পত্তি বন্দোবস্ত। তবে এর আগেও করের ক্ষেত্রে নাগরিক সনদ ছিল, তাতে কাজে কাজ কিছু হয়নি। এবার নতুন জামা গায়ে তা করদাতাদের সনদে রূপ বদলাল। কিন্তু সেটিতো আইন নয়, ইচ্ছা, সদিচ্ছা মাত্র। যদি সেই সনদ লঙ্ঘিত হয় তাহলে করদাতা কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে না, কেবল ওই করদাতা সনদের বিভাগে অভিযোগ জানাতে পারবেন। সে বন্দোবস্ত মোটামুটি আগেও ছিল, ওমবুডসম্যানের কাছে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা। তেমন কাজে লেগেছে বলে জানা যায়নি।

একদিকে যখন মোদিজি করের ক্ষেত্রে সব ‘যুগান্তকারী’ ঘোষণা করছেন, অন্যদিকে দেশে কর আদায় তলানিতে ঠেকছে। কর বনাম জিডিপি (মোট অভ্যন্তরিণ উৎপন্ন) অনুপাত ২০১৯-২০ বিত্ত-বর্ষে ১০ বছরের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে, ৯.৮৮%; যা ২০১৮-১৯-এ ১০.৯৭% এ দাঁড়িয়েছিল, ২০১৭-১৮-তে ১১.২২% থেকে কমে। প্রত্যক্ষ কর বনাম জিডিপি অনুপাত ২০১০-১১ সালে ছিল ৫.৮২%, ২০১৫-১৬ সালে কমে হযেছিল ৫.৪৭%; ২০১৯-২০ বিত্ত-বর্ষে তা কমে হয়েছে ৫.১%।  কোম্পানি করের পরিমাণও ১৬% কমেছে। উন্নত দেশগুলির কর-জিডিপি অনুপাত ৩৪% এর তুলনায় ভারতবর্ষ  বহু দূর পিছিয়ে রয়েছে। এর একাধিক কারণ রয়েছে। ধনীদের উপর কর না বসিয়ে তাদের উদ্যম বাড়িয়ে আয়ের বৃদ্ধি ঘটিয়ে কম হারে কর বসানো সত্বেও মোট কর রাজস্বকে বাড়ানোর তথাকথিত ল্যাফারের সূত্র প্রয়োগের ভাবনা বিজেপি শাসকদের পছন্দের দর্শন। তাই গত ১০ বছরে প্রত্যক্ষ করের মধ্যে কোম্পানি করের অংশ কমেছে। ২০১০-১১ সালে মোট প্রত্যক্ষ করের মধ্যে কোম্পানি করের পরিমাণ ছিল ৬৭%, ২০১৮-১৯ সালে সেই অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮%; ২০১৩-১৪ সালে, ইউপিএ সরকারের আমলের শেষ বর্ষে তা ছিল ৬২%। ভারতের সর্বোচ্চ ধনী কোম্পানি, সকল সরকারের নেক নজরে থাকা রিলাযেন্সের দিকে তাকানো যাক। ২০১৬-১৭ সালের পর থেকে রিলায়েন্স প্রদত্ত আয়করের সঙ্গে কোম্পানির নগদ মুনাফার অনুপাত কমেছে। ২০১৬-১৭ সালে তা ছিল ১৯.৭৪%, ২০১৯-২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.৫৬%। অন্যান্য তাবেদার কোম্পানিগুলির হিসেবে চোখ রাখলে হয়তো এমনটাই পাওয়া যাবে।

মোদিজির সাম্প্রতিক ঘোষনায় তাই যতটা নাটক আছে ততটা অন্তর্বস্তু নেই। তবে অন্য শঙ্কার দিক রয়েছে। আয়কর দফতরের আধিকারিক ও কর্মীদের যত্রতত্র বদলি ও শেষ পর্যন্ত কর্মী-সঙ্কোচনের ষড়যন্ত্র থাকতেই পারে। এক অঞ্চলের আধিকারিক অন্য অঞ্চলের করদাতার রিটার্ন খুঁটিয়ে দেখবে, আবার অন্য কোনো অঞ্চলের কেউ আবেদনের নিস্পত্তি করবে, তাতে কর্মচারিদের বদলি হোয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে যেহেতু পুরো খুঁটিয়ে দেখার জন্য রিটার্ন বাছা থেকে শুরু করে আবেদনের নিস্পত্তি পর্যন্ত সব কাজটাই কম্পুটারে হবে, ফলে কর্মচারিদের প্রয়োজন কমবে। ফলে কর্মী-সঙ্কোচনের জোরালো আশঙ্কা আছে।

-- অমিত দাশগুপ্ত  

খণ্ড-27
সংখ্যা-29