সম্পাদকীয়
কুর্নিশ এই কিষাণ জোয়ারকে
dder

সরকারকে “তিন নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার করতেই হবে”! এর অন্যথা কিছুতেই মানা হবে না। কৃষক আন্দোলন জারী থাকবে। প্রতিরোধে পণ করা কৃষক জনতা প্রতিদিন প্রমাণ করছেন দাবির প্রশ্নে কত সাচ্চা, আন্দোলনের প্রশ্নে কত দৃঢ়চেতা, রণকৌশলে কত কুশলী, আর যে কোনও কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারে — এমনকি আত্মত্যাগে আজ তাঁরা এক কদম পিছু হটার নন। পাঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে কৃষক জনারণ্যে আওয়াজ উঠেছে “দিল্লী চলো”! সবচেয়ে কাতারে কাতারে ঢল নেমেছে শহীদ-ঈ-আজম ভগৎ সিং ও অসংখ্য শহীদের রক্তেভেজা আর বহতা পাঁচ নদীর প্রদেশ পাঞ্জাব থেকে। আন্দোলন জোর সমর্থন কুড়োচ্ছে দেশের পাঁচ শতাধিক কৃষক সংগঠনের সংঘর্ষ সমন্বয় মঞ্চের পক্ষ থেকে। সংহতি অর্জন করছে দেশের নানা মতের রাজনৈতিক দলগুলোর। নৈতিক সহমত পেয়ে চলেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, সমাজের সমস্ত বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-শোষিত-পীড়িত অংশ ও সম্প্রদায়গুলো থেকে। সমর্থন সংহতি মিলছে বিশ্বের দেশে দেশে। সবদিক থেকেই ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে এক বিরাট সংগ্রামী কৃষক শক্তি হয়ে ওঠার।

বিপরীতে, মোদী সরকার আর বিজেপি একঘরে। এনডিএ-তেও ঘটেছে ভাঙন।

কৃষকের এই আন্দোলনকে ক্ষমতার অতি দম্ভে মোদী সরকার তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল। যখন ধাক্কা খেলো তখন নামালো নির্মম প্রতিআক্রমণ। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, শারীরিক, মানসিক সবদিক থেকে চালালো হামলা। কুৎসা ছড়ানো হল, এর পিছনে কাজ করছে ‘খালিস্তানী সন্ত্রাসবাদ”-এর চক্রান্ত ষড়যন্ত্র, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর হাত, আর বিরোধী দলগুলোর তরফে উস্কে দেওয়া। আরও কি ক্ষমাহীন ধূর্তামি আর ন্যক্কারজনক উপেক্ষা দেখিয়েছে! সংগ্রামরত কৃষকদের প্রতি সংহতিতে সারা ভারত সর্বাত্মক ধর্মঘটের দিন মোদী ভার্চুয়াল লেকচার দিলেন মোবাইল পরিষেবা প্রদানে সরকার কত নিবেদিত! পাশাপাশি পাতাজোড়া রঙীন বিজ্ঞাপনের বাহার প্রদর্শিত হল, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার কৃষক স্বার্থে কতই না কি সব করেছে! কৃষক আন্দোলনের প্রশ্নে ‘নমনীয়তা প্রদর্শন’ বা ঝক্কি ‘আপসে মিটিয়ে নেওয়া’র নামে সরকারপক্ষ বস্তুত তথাকথিত সংশোধনীর টোপ দিয়েছে। তা আসলে নয়া আইনফলিত নাভিশ্বাস ওঠা থেকে বেঁচেবর্তে যাওয়ার নতুন ফন্দি আঁটা প্রতিশ্রুতি মাত্র। এপর্যন্ত তিন মন্ত্রীমশাই — কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরপর পাঁচটি বৈঠক করেছেন। অমিত শাহ আলোচনায় বসার পূর্বশর্ত দিয়েছিলেন আগে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে। ব্যর্থ হয় সেই হম্বিতম্বি। তারপরে শর্তদেন আলোচনায় বসবেন নিজের পছন্দের নেতাদের সাথে। উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের যৌথ নেতৃত্বের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ভাঙন ধরানো। তাতেও ব্যর্থ হয়েছে। কৃষক নেতারা দ্ব্যর্থহীনভাবে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারের ওসব ‘সংশোধনী’ প্রস্তাব জারিজুরি মাত্র, নয়া তিন আইন কৃষি ও কৃষককে কর্পোরেট পুঁজির খাসতালুক ও দাসে পরিণত করার দলিল, সরকারের সংশোধনী সংযোজন ঐ সর্বনাশা আইনগুচ্ছকে আড়াল দেওয়ার আবরণ, তাই তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বিরোধী দলগুলোর এক প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির কাছে কৃষকদের দাবির প্রতি উপর্যুপরি ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছে। প্রতিবাদী কৃষকরা আগেই আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপতির কাছে, তাদের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে, সংসদের ভিতরে ও বাইরে থাকা সমস্ত বিরোধী পক্ষকে, দেশের ও সমাজের বৃহত্তম অংশের কথা না শুনে যে নয়া আইনে শীলমোহর দিতে বলে মোদী মন্ত্রীসভা, যাতে এমনকি এনডিএ সরকারের কোন এক শরিকদলেরও সায় নেই, তাতে যেন রাষ্ট্রপতি সম্মতি না দেন। কিন্তু শোচনীয় পক্ষপাতিত্ব করেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর কাছে কৃষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবির পরিবর্তে সরকারের তৈরী অন্যায় আইন গ্রাহ্য হয়ে যায়। তিনি ও তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট সরকার দিবাস্বপ্ন দেখেছিলেন এভাবেই হয়ত ইতি টানা গেল। কিন্তু না, পাল্টা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মারে বল আবার বারেবারে সরকার আর রাষ্ট্রপতির ডাবল কোর্টেফেরত যাচ্ছে।

কুর্ণিশ এই কিষাণ জোয়ারকে। এ এক নয়া দৌড়। এ লড়াইয়ের সাথে থাকতে হবে দেশজুড়ে কৃষক জনতাকে, পাশে থাকতে হবে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে। হিম্মৎ রাখতে হবে। এ লড়াই লড়তে হবে, এ লড়াইয়ে জিততে হবে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-44