সম্পাদকীয়
কোপের পর কোপ!
st

তেল সংস্থাগুলো আবার গ্যাসের দাম চড়ালো। একবার নয়, এক সপ্তাহে পরপর দুবার! পঞ্চাশ-পঞ্চাশ করে একশ টাকা! মোদী সরকার গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতা থেকে ইতিমধ্যেই তুলে দিয়েছে। মাত্র এক স্বল্পাংশের জন্য ভর্তুকিযুক্ত গ্যাসের এখনাবধি সংস্থান রাখা আছে। সেক্ষেত্রেও অভিযোগের পাহার জমার অন্ত নেই। ভর্তুকির টাকা ব্যাঙ্কের পাশ বইয়ে ঠিকমতো না আসার নানা গাঁট গেরোর দূর্ভোগ পোহাতে হয়। আর ভর্তুকিহীন গ্যাসের দাম চড়চড়িয়ে বাড়ালেও ভর্তুকির পরিমাণ কিন্তু বাড়ানোর নাম নেই। এবারের নমুনাটাই দাঁড়াচ্ছে কি? মূল্য বাড়লো মোট একশ টাকা। আর ভর্তুকির অঙ্ক পড়ে রইল সাড়ে ঊনিশ টাকায়। বস্তুত ভর্তুকির প্রশ্নটিকে পরিত্যক্ত করে রাখা হচ্ছে, বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে উত্তরোত্তর মূল্যবৃদ্ধির বোঝা।

পশ্চিমবঙ্গে গ্যাসের গ্রাহক সংখ্যা দু’কোটি নব্বই লাখের মতো। এর ব্যাপক অংশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এর মধ্যে উচ্চবিত্ত নেই, উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীও প্রায় নেই বললে চলে। এই বিত্তশালী শ্রেণীগুলো রান্নার উপায় হিসাবে বহুমূল্যের বিদ্যুৎচালিত উপকরণগুলি ব্যবহার করে থাকে। অন্যদিকে কেরোসিনের সরকারী বণ্টন ব্যবস্থায় ক্রমাগত পরিমাণ হ্রাস আর মূল্যবৃদ্ধির সাঁড়াশি চাপ সহ খোলাবাজারে দেদার চড়া দামের কারণে নিম্নবিত্তের এক উল্লেখযোগ্য অংশ গ্যাসের ব্যবহারকারী। আর, ব্যাঙ্কের বই খুললেই যে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা বহনের ক্ষমতা রাখে এমন যুক্তিজাল ধোপে টেঁকে না। কারণ, এখন পেনশন, বেতন, তথাকথিত ‘সাম্মানিক’ মাসোহারা, সরকারী বিভিন্ন অনুদান, বরাদ্দ যেটুকু মেলার, বলাবাহুল্য সবই পেতে গেলে ব্যাঙ্কের পাশবই দরকার। সুতরাং ওটা দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সাফাই গাওয়ার উপায় নেই, ওই চালাকি খাটে না। তেল সংস্থাগুলোর চাপানো মূল্যবৃদ্ধির বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো চাপানো রয়েছে জিএসটি। ২০১৭-র জুলাই থেকে জারি রয়েছে পাঁচ শতাংশ জিএসটি। রাজ্যকে জিএসটির টাকার ন্যায্য ভাগ দেওয়া হচ্ছে না, মোদীর কেন্দ্র দেয় না। না দেওয়ার ক্ষেত্রে ছুতো দেখায় অতিমারী জনিত কেন্দ্রের রাজকোষের টানাটানি অবস্থার। কিন্তু অতিমারীতে বে-রোজগারী হয়ে যাওয়া, আর্থিক দূর্গতিতে অতিষ্ট হওয়া জনতার কাঁধে উপর্যুপরি চড়া মূল্যের সিলিন্ডার চাপিয়ে দেওয়া হল।

মোদী সরকার পেট্রোপণ্যের মূল্যমান নির্ধারণকে বহু আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম-ওঠা নামার সাথে যুক্ত করে দিয়েছে। আমজনতার বহু সংগ্রামের মূল্যে অর্জিত একদা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোকে কার্যত কর্পোরেটরাজ-কোম্পানিরাজের স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। এ হল নয়া উদারবাদী অর্থনীতির খাঁড়ায় মারা কোপের পর কোপ। তারপর থেকে যখনই মূল্যবৃদ্ধির পন্থা নিয়েছে শোনায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম চড়া হওয়ার ‘গল্প’। তা ধরে ফেললেই শুরু করে দেয় গলাবাজি। মিথ্যাচার ধাপ্পাবাজিকে ‘সত্যি’ আর হিসেব কষে হাতেনাতে ধরে ফেলে স্বরূপ উন্মোচন ও পাল্টা আঙুল তুললে দাগিয়ে দেওয়া হয় ‘উন্নয়ন বিরোধী’! তাছাড়াও প্রশ্ন হল, আন্তর্জাতিক বাজারে আগুন লাগলে কি দেশের বাজারেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে? অতিমারী পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ যখন আর্থিকভাবে নাজেহাল হচ্ছে, জীবনীশক্তি পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে সহায়-সম্বল পেতে দিশেহারা, যখন গ্যাসের ভর্তুকি আরও বাড়ানো, ভর্তুকির আওতায় আসতে চেয়ে আবেদন করলেই মঞ্জুর করার পলিসি ও পদক্ষেপের জরুরি পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, তখন সেসব না করে আবারও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হল। এ এক তীব্র ও ব্যাপক জনবিরোধী ক্ষমাহীন আচরণ।

এই কারণে আজ প্রত্যেক সাধারণ রাজ্যবাসী ও দেশবাসীকে মোদী জমানার বিরুদ্ধে সরব হওয়া দরকার। পশ্চিমবাংলায় আসছে বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচনকে চাঁদমারী করে বিজেপি প্রচারের ঢাক পেটাচ্ছে, ক্ষমতায় এলে কেন্দ্র-রাজ্যের অভিন্ন যুগল সরকারের জোরে ‘উন্নয়নের বান’ ছোটাবে! এর জবাবে আজ জেরবার করা মূল্যবৃদ্ধির জবাব দেওয়া দরকার, বিজেপিকে বাংলা ছাড়া করার পণ করা প্রয়োজন।

খণ্ড-27
সংখ্যা-45