এই অগ্নিমৃত্যু কি অনিবার্য ছিল?
The death of this fire

অর্ধশতক পার করা নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিং-পূর্ব রেলের সদর দপ্তর। প্রায় দু’হাজার মানুষের কর্মস্থল। সেখানেই ঘটে গেল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। চলে গেল ন’টি প্রাণ।

দুটি লিফ্ট – যেন দুটি মৃত্যুযান। একটিতে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গেলেন রেলের ডেপুটি চিফ কমার্সিয়াল ম্যানেজার পার্থসারথি মণ্ডল এবং শিয়ালদহ’র সিনিয়র কমার্সিয়াল ক্লার্ক শ্রবণ পাণ্ডে।

অন্যটিতে আগুনে ঝলসে জীবন্ত দগ্ধ হলেন উদ্ধার করতে যাওয়া চার দমকলকর্মী – অনিরুদ্ধ জানা, গৌরব বেজ, বিমান পুরকায়েত এবং গিরিশ দে। হেয়ার স্ট্রিট  থানার এএসআই অমিত কুমার ভাওয়াল। আরও দু’জন।

আমরা শোকাহত, স্তব্ধ-বিপন্নকে উদ্ধার করতে গিয়েই তারা প্রাণ দিলেন! সরকারী কর্মচারিদের বাপান্ত না করে যারা জলগ্রহণ করেন না এবং বেসরকারীকরণের ওকালতি করেন – তাদের একটু ভাবতে অনুরোধ করছি!

কিন্তু এই মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল?

লিফ্ট – অভিশপ্ত লিফ্ট! কিন্তু কেন অগ্নিকাণ্ডের পর লিফ্ট চলল? কেন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়নি? কেন উদ্ধার কাজে গিয়ে দমকলকর্মীরা রেল ভবনের ম্যাপ চেয়ে পাননি? রেল আধিকারিকরা কেন উপস্থিত থেকে দমকল ও প্রশাসনকে সাহায্য করেননি? কেন উদ্ধার কাজে সমন্বয়ের অভাব ছিল? যে লিফ্টে দমকলকর্মীরা উঠেছিলেন সেটি কি আদৌ ‘ফায়ারম্যানস লিফ্ট’ ছিল? তবে ‘স্লাইডিং ডোর’ কেন? কেন কোলাপসিবল গেট নয়? আপৎকালীন ব্যবহারের জন্য তো সেটাই থাকার কথা! যদি আদৌ ফায়ারম্যানস লিফ্ট না থেকে থাকে – তবে কেন নেই? যে বাড়িতে দৈনিক দু’হাজার কর্মী আসা যাওয়া করেন? বিল্ডিং-টিতে গত তিরিশ বছর কেন আপৎকালীন মহড়া হয়নি? নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ঠিকমত কাজ করেনি – ঐ ভবনের কিছু কর্মী জানিয়েছেন। কেন? ফায়ার অ্যালার্ম আদৌ বেজেছিল কি? বিল্ডিং এর হাইড্র্যান্টে জল ছিল না কেন?

আগুনের উৎস সম্পর্কে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত – বাড়ির পুরোনো ওয়্যারিং ও ওভারলোড থেকেই অগ্নিকাণ্ড। সম্ভবত সার্ভার রুম থেকে। পুরোনো বহুতল। বিভিন্ন তলে বিভিন্ন অফিস। রয়েছে সার্ফেস ওয়্যারিং। বছরের পর বছর জমেছে ফাইলের পাহাড়। সেগুলোকে সরানোর জন্যে তৈরি হয়েছে ফলস সিলিং। আর যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে অস্থায়ী স্টোর রুম। হতে পারে সেটা সিঁড়ির পাশেও। মানে চলাচলের পথটুকুও সংকীর্ণ! জতুগৃহ থেকে পালাবার পথও নেই! ভবনের সংরক্ষণের, আপৎকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার এই হাল! অথচ সেটা দেখার জন্যে তো অনেক বড় বড় পদে রয়েছেন বড় বড় আধিকারিক! তারা শুধু দুর্ঘটনা ঘটার পর নীচুতলার কর্মীদের ওপর দায় চাপাবেন – তারা কেন নির্বোধের মতো মৃত্যুকে বরণ করে নিল! চার সদস্যের তদন্ত কমিটি তৈরি করেছে রেল। তাতে আছেন অনেক পায়াভারি লোক। তারা রিপোর্ট দেবেন। অনেক সুপারিশ করবেন। কিন্তু সাধারণ কর্মীদের নিরাপত্তা যে আঁধারে সেই আঁধারেই থাকবে! কারণ রেলটাই তো বিক্রি হয়ে যাবে কিছু দিন পর! তাই অবসরের পর নতুন নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ। উপযুক্ত দক্ষ কর্মীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। নিরাপত্তার বিষয়টা দেখার লোক কোথায়?

আমাদের অতি-সক্রিয় রাজ্যপাল যাকে কেউ কেউ বিজেপি’র রাজ্য মুখপাত্র বলে থাকেন তিনি তার প্রগলভতার নয়া নজির রাখলেন। দমকলের ওপর যাবতীয় দোষ চাপিয়ে সপাটে বলে দিলেন ‘রেলের কোনো গাফিলতি নেই’! হায় রে! যিনি কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের পাওনা কানাকড়িটুকু উদ্ধারে আজ অবধি কোনো ভূমিকা নেননি, তার বিলাসী জীবন যাপনের জন্য রাজ্যকে কত গুণগার দিতে হয়? যাক সে কথা। তবে রাজ্যপাল মশাই, ঠিক ঠাক তদন্ত হলে, রেলের গাফিলতি কিন্তু ধরা পড়বেই!

দমকলকর্মীরা লিফ্টে উঠেছিলেন কেন? এই সব ক্ষেত্রে তো লিফ্ট ব্যবহারের কথাই নয়! তারা কি তা জানতেন না? এর উত্তর দেওয়ার জন্য আজ আর কেউ বেঁচে নেই!

তবে কি তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, যথেষ্ট দক্ষ অগ্নিযোদ্ধা ছিলেন না? তাদের কি অগ্নিপ্রতিরোধী পোশাক, উপযুক্ত জুতো-এসব ছিল না? এর উত্তর অবশ্য দিয়েছেন তাদের সহযোদ্ধারা – কান্না গিলে, বুকভাঙা আফশোসে!

চার জনের মধ্যে তিনজনই ছিলেন অস্থায়ী কর্মী। হ্যাঁ, প্রশিক্ষণ তাদের ছিল – সম্ভবত ২২ দিনের – ৩ মাসের নয়। যেটা স্থায়ী কর্মীরা পেয়ে থাকেন। স্থায়ী কর্মীদের বেতন কাঠামো ভালো, তারা দুর্ঘটনায় আহত হলে বিনামূল্যে চিকিৎসা পান। কিন্তু অস্থায়ীদের মাসিক ভাতা সাড়ে সতেরো হাজার টাকা। বিনামূল্যের চিকিৎসাও তাদের প্রাপ্য নয়। এসব ক্ষোভ তারা উগড়ে দিয়েছেন দমকলমন্ত্রীর সামনেই।

তাহলে তাদের পাঠানো হল কেন ঐ বিপর্যয়ের মধ্যে? আসলে এখানেও সেই একই ছবি। বেশ কয়েক বছর ধরে ‘ফায়ার অপারেটর’ পদে নিয়োগ বন্ধ। ‘অক্সিলিয়ারি ফায়ারম্যান’ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। দক্ষতা? সেটা তো অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ। কাজটা ভালোবেসে মনপ্রাণ দিয়ে করবেন বলেই তো ইংরিজিতে স্নাতকোত্তর হয়ে সাংবাদিকতার ডিগ্রি নিয়ে এই অস্থায়ী কাজে ঢুকেছিলেন এদের একজন! (উপযুক্ত অন্য কাজ না পেয়েই হয়তো ঢুকতে বাধ্য হয়েছিলেন।) উপযুক্ত পোশাক, জুতো, ওয়াকিটকি ও অনান্য সরঞ্জাম প্রতিবছর কেনা হয়, ফায়ার স্টেশনে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে পাওয়া যায় না। কর্মীরাই জানিয়েছেন। কেন? মন্ত্রী দাবি করেছেন, দপ্তরটিকে আধুনিক করে তোলার জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। হয়েছে হয়তো। কিন্তু কর্মীদের যদি এমন অসুরক্ষিত অবস্থায় যুদ্ধে যেতে হয়, তাহলে তো এমন মর্মান্তিক পরিণতিই ঘটতে থাকবে। কর্মী সুরক্ষা, উন্নত পরিকাঠামো, প্রশিক্ষণ – এসব দেখার জন্যে নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল আধিকারিকরা আছেন। তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করলে তো এই বেহাল অবস্থার করুণ চিত্র উঠে আসতো না! ২৫টা ইঞ্জিন নিয়ে সহযোদ্ধাদের হারানোর মর্মান্তিক কষ্ট বুকে চেপে রেখে, বাঘের মতো প্রায় দশ ঘন্টা  লড়ে দমকলকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছেন, তাই-ই তারা করে থাকেন সব সময়ে, নিজেদের জীবন বাজি রেখে। যদিও এই আগুন স্টিফেন কোর্ট বা আমরির মত অত তীব্র, অত ভয়ঙ্কর ছিল না।

তাই এই ন’টি মৃত্যু একেবারেই অনিবার্য ছিল না! সংশ্লিষ্ট কর্তারা, কর্তৃপক্ষ বুকে হাত রেখে নিজেদের বিবেককে একটু প্রশ্ন করবেন! বারবার কিন্তু ছাড় পাবেন না জবাবদিহি থেকে! আর ক্ষমতাসীন-ক্ষমতালিপ্সু সব দলের কাছে আবেদন – নত মস্তকে নীরব থেকে এই মৃত্যুকে সম্মান জানাতে শিখুন, এবার থেকে অন্তত! ওঁরা মানুষের জন্য, মানবতার জন্য জীবন দিয়ে গেলেন, আপনাদের সংকীর্ণ স্বার্থে নয়!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-9