কমরেড হিমাংশু বিশ্বাস স্মরণে
Comrade Himanshu Biswas

কমরেড হিমাংশু বিশ্বাস (৭১), পার্টিতে ‘রামু’ বলে পরিচিত ছিলেন। বাবা ছিলেন মোহিনী মিলের সূতাকল শ্রমিক, মা অনেক পরিশ্রম করে সংসার টেনে নিয়ে চলতেন। তিন ভাই ও তিন বোন, হিমাংশু ছিল সবার বড়। কৈশোরেই জীবিকার জন্য বেরিয়ে পড়তে হয়। এই অঞ্চলে তখন বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সহযোগী ছোট ছোট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ছিল। সেখানেই রামুর কাজ শেখা ও দক্ষ শ্রমিক হয়ে ওঠা। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও মাইক্রোমিটার, ভার্নিয়ার স্কেলের মাপ বুঝতেন এবং যে কোনো ড্রইং দেখে বস্তুটির আকৃতি লেদ মেশিনে অপারেট করে স্যাম্পল বানিয়ে দিতে পারতেন। এই শিল্পীয় দক্ষতার জন্যে ২০ বছর বাদে যখন আবার কর্মক্ষেত্রে ঢুকছেন, তখন কাজের নিরীখে সহজেই সেই প্রতিষ্ঠানের নির্ভরযোগ্য দক্ষ শ্রমিকের মর্যাদা পেয়েছেন। এরপর শিল্প পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে, কারখানার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকল এবং নিজের শরীরও আর টেনে নিয়ে চলতে পারছিলেন না। মজুরি অনিয়মিত হয়ে গেল, ধীরে ধীরে কাজে যাওয়া বন্ধ হল। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়েছে। যা এখনো চলছে। শ্রমিকদের সমস্যাগুলো নিয়ে শোনা ও বিচার করার মতো অবস্থা রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তরের ছিল না, এখনো নেই।

রামু ৭০ দশকে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিল। কিছুদিন জেল জীবন এবং পরে মুক্তি। আবার ৭৭ সালে পার্টির সাথে যোগাযোগ। এই সময় সিপিআই(এমএল) বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গেছে, নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নির্বাচন করা কমরেডদের কাছে কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল। নিজের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী পছন্দের গোষ্ঠীতে কমরেডরা শামিল হয়েছেন। বহু কাছের কমরেডের সাথে দূরত্বও তৈরি হয়েছে। এই সন্ধিক্ষণে হিমাংশু বিশ্বাস সিপিআই(এমএল) ‘২৮শে জুলাই কমিটি’র সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। বর্তমানে যা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নামে খ্যাত।

রামু তখন কারখানায় কাজ ও রাজনীতি করছে এবং তাদের বাড়ি পার্টির আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে। অনেক অভাব অনটন থাকা সত্বেও ওদের পরিবারের সবাই পার্টি কমরেডদের পছন্দ করতেন।

পার্টির ভিতর শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু হয়েছে, রামু প্রতিটি দস্তাবেজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন, মিটিংগুলোতে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ঠিক সময় উপস্থিত হতেন। ১৯৭৮ সালে পার্টি শ্রমিকদের গ্রামে যাওয়ার জন্যে আহ্বান রাখে। পার্টির ডাকে সারা দিয়ে রামু কাজ, বাড়ি ঘর ছেড়ে গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে চলে গেলেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, নদীয়ায় সহ বিভিন্ন জেলায় পার্টি সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। এই পর্যায় স্থানীয় পার্টি কর্মী মায়া বিশ্বাসের সাথে প্রেম ও বিবাহ হয়। তারপর তাদের দু’টি কন্যা সন্তান জন্মায়। এই মেয়েরা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৯২ সালে পার্টির প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়। এই পর্যায়ে পার্টিতে বেশ কিছু সাংগঠনিক রদবদল হয়। হিমাংশু এবার উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সদস্য হয়ে বেলঘরিয়া পার্টি কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব সামলান। এই সময় তিনি পার্টি গঠন ও কামারহাটিতে ট্রেড ইউনিয়নের কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি সব সময় আন্দোলন, লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকতেন। রামু বরাবর’ই সাহসী ও একরোখা ছিলেন। পার্টির রাজনৈতিক লাইন তখন কতগুলো বাঁক অতিক্রম করছিল। সেই সময় সমগ্র পার্টি খোলস ছেড়ে গণআন্দোলনের নতুন রাস্তা ধরছে, এই সময় রামু নতুন চিন্তা এবং প্রয়োগে পিছিয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু পার্টির দেওয়া কাজ আন্তরিকতার সাথে করতেন। একটা সময় রাজ্য কমিটি রামুকে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ায় পরামর্শ দিল। অনেক বিতর্ক, দুঃখ ও অভিমানে পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নেন রামু। কঠোর উৎপাদন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুনরায় নিজে দক্ষ শ্রমিক হয়ে উঠলেন। এতোসবের পরেও কোনদিন পার্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। এটাই বোধহয় একজন শ্রমিকের পার্টি বোধ।

কমরেড হিমাংশু ১ এপ্রিল ২০২১ সাগর দত্ত হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রামুকে অন্তিম বিদায় জানাতে জেলা কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল সহ জেলা ও আঞ্চলিক কমিটির সদস্য এবং স্থানীয় পার্টি সদস্যবৃন্দ। কমরেড রামুকে আর মিছিল মিটিংয়ে দেখা যাবে না। কমরেড হিমাংশু বিশ্বাস (রামু) লাল সেলাম।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত  

খণ্ড-28
সংখ্যা-13