তামিলনাড়ুতে হিন্দুত্ব শক্তিগুলোর উদ্বেগজনক বৃদ্ধি
Hindutva forces in Tamil Nadu

ওপর-ওপর দেখলে তামিলনাড়ু হল বিজেপির সবথেকে দুর্বল রাজ্যগুলোর অন্যতম যে রাজ্য থেকে লোকসভায় তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই আর রাজ্যে রয়েছে মাত্র চারজন বিধায়ক। এখানে দ্রাবিড় আন্দোলনের গভীর শিকড় ওপ্রগতিশীল সামাজিক মূল্যবোধ থাকার জন্য মনে করা হয়ে থাকে যে এই রাজ্য বিজেপি ও তার পশ্চাদমুখী হিন্দু আধিপত্যের মতাদর্শের কাছে দুর্ভেদ্য। তবে তামিলনাড়ুতে বিজেপির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উপস্থিতি ও মতাদর্শগত প্রভাবকে উপেক্ষা করলে সেটা এক বড় ভুল হবে। উপদলীয়তায় জর্জরিত এআইএডিএমকে ও তামিলনাড়ুর অন্যান্য ডিএমকে-বিরোধী দলগুলোর ওপর ভর করে গেরুয়া শিবির বেশি আলোড়ন সৃষ্টি না করে কিন্তু দৃঢ়ভাবে এই রাজ্যে জায়গা করে নিচ্ছে।

রাজনৈতিক জোটের স্তরে নানান রকমফের প্রচেষ্টা ছাড়াও সংঘ বর্তমানে জোর দিচ্ছে বৈধতা অর্জন এবং তামিল সমাজের মতাদর্শগত পরিমণ্ডলকে পাল্টানোর ওপর। এই লক্ষ্যে তারা ভিওসি (ভি এম চিদাম্বরনার, যিনি ছিলেন কংগ্ৰেসের দৃঢ়চিত্ত নেতা যাঁর সঙ্গে গান্ধির মতপার্থক্য ছিল) এবং মহান লেখক ও স্বাধীনতা সংগ্ৰামী সুব্রমানিয়া ভারথিয়ারের মতো তামিল আইকনদের আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। সংঘের অবশ্য সমস্যা রয়েছে পেরিয়ার ও তাঁর প্রগতিশীল ঐতিহ্যকে নিয়ে যা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদকে জনপ্রিয় করেছিল, এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ ও পিতৃতান্ত্রিক বিধানের বিরুদ্ধে নারীর অধিকারের জন্য এবং মনুস্মৃতির নাগপাশের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। যখন সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ যথেষ্ট শক্তিশালী ও নাছোড় প্রকৃতির ছিল সেই সময় তামিলনাড়ুই ছিল প্রথম রাজ্য যা এক বৃহৎ গণআন্দোলনের অংশ হিসাবে জাতের উপাধিকে বর্জন করেছিল।

বেশ কিছু বছর ধরে সামাজিক ন্যায় ও যুক্তিবাদ আন্দোলনের প্রখরতা হ্রাস পেতে থেকেছে এবং আরএসএস এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে তার পাল্টা বক্তব্যকে এনে পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করছে। তারা গণেশ পূজো ও ঐ ধরনের অন্যান্য উৎসব বাড়িয়ে চলেছে, তাদের এজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মন্দির কমিটিগুলোকে দখল ও ব্যবহার করছে, এবং উত্তর ভারতে রাম যেমন ঠিক তেমনি সমাবেশ ঘটানোর আবেগসঞ্চারী আইকন হিসাবে প্রাচীন তামিল দেবতা মুরুগানকে তুলে ধরছে। এই পাল্টা আখ্যান এবং তার সাথে আগ্ৰাসি সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে যুক্ত করা ও রাজনৈতিক জোট গড়াটা তামিলনাড়ুতে হিন্দুত্ব রাজনীতির বিকাশে আরএসএস’এর সূত্র বলে ধরে নেওয়া যায়। আরএসএস গান্ধী জয়ন্তিতে সারা তামিলনাড়ুতে মিছিল সংগঠিত করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাজ্য সরকার আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনার গোয়েন্দা রিপোর্টের যুক্তিতে মিছিলের অনুমতি দিতে অস্বীকার করলে হাইকোর্ট ৬ নভেম্বর মিছিলের অনুমতি দিতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। প্রশাসন এমন তিনটে জেলার তিনটে স্থানে মিছিলের অনুমতি দেয় যেখানে আরএসএস’এর উপস্থিতি তেমন শক্তিশালী নয়, ২৪টা স্থানে মিছিলের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে এবং ২৩টা স্থানে ঘেরা জায়গায় মিছিলের অনুমতি দেয়। আদালতও লাঠি নিয়ে যাওয়া, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হলে তার দায় নিতে হওয়া, ইত্যাদির মতো কঠোর শর্ত নির্দিষ্ট করে। এই সমস্ত শর্তে হতাশ হয়ে আরএসএস এখন সুরাহার জন্য সুপ্রিম কোর্টে গেছে, আর ৬ নভেম্বর যে তিনটে স্থানে মিছিল বের করে সেগুলো আরএসএস’এর মানদণ্ডে তেমন উল্লেখযোগ্য হয়নি।

বিরোধী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলও এখন কিছুটা বিজেপির অনুকূলে। দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এড্ডাপাডি পালানিস্বামী এবং ও পনিরসিলভমের মধ্যে কাজিয়ায় এআইএডিএমকে অভ্যন্তরীন বিবাদে জর্জরিত। এর পরিণামে এআইডিএমকে নেতৃবৃন্দ যথাযত স্থান লাভের প্রত্যাশায় বিজেপির কাছে ভিড়ছে। মিডিয়ার একটা অংশের সমর্থনে বিজেপি এখন তামিলনাড়ুতে চোখে পড়ার মতো বিরোধী পক্ষের ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছে। পিএমকে আবার উৎকৃষ্টতর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় বিজেপি-এআইএডিএমকে শিবিরের সঙ্গে লেগে থাকছে। ডিএমকে’র সঙ্গে জোট বেঁধে কয়েকটা বিধায়ক পাওয়া সত্ত্বেও শক্তিশালী রাজ্য নেতৃত্বের অভাবে কংগ্ৰেস শিবির এখন বিভাজিত। এই প্রেক্ষাপটে আরএসএস-বিজেপি তামিলনাড়ুতে কংগ্রেসের সামাজিক ভিত্তিকে নিজেদের পক্ষে আনার লক্ষ্যে চেষ্টা চালাচ্ছে। গান্ধিকে শ্রদ্ধা জানানোর নামে গান্ধী জয়ন্তিতে গোটা রাজ্যে ৫২টা স্থানে মিছিল সংগঠনের প্রয়াসও ছিল কংগ্ৰেসের উচ্চবর্ণ, ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ ভিত্তিতে হানা দেওয়ার একটা কৌশল। কয়েক দশকের তাদের প্রচেষ্টায় সংঘ-বিজেপি তামিলনাড়ুর দক্ষিণে সংখ্যায় ভারী ‘মাল্লার’ (আগে ছিল পাল্লার) নামে দলিতদের একটা ধনী অংশের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। বস্তুত, ঐ জাতের তথাকথিত রাজকীয় অতীতের কথা বলে কিছু দলিত সংগঠনকে তাদের জন্য সংরক্ষণ প্রত্যাখান করাতেও তারা সফল হয়েছিল। এটাও ঠিক যে মোদী সরকার এবং আগে এআইএডিএমকের রাজ্য সরকারও চতুর কৌশলে তফশিলি জাতের তালিকা থেকে সাতটা দলিত জাতকে বাদ না দিয়ে ঐ প্রক্রিয়াকে সহজসাধ্য করেছিল এবং তাদের ‘দেবেন্দ্রকুলা ভেলালার’ বর্গে একত্রিত করেছিল, যা ক্ষত্রিয় জাত থেকে উদ্ভবের দাবি করে দেবতা ইন্দ্রর সঙ্গে একাত্মতাকে বোঝায়। কন্যাকুমারি জেলায় ‘নাদারা’ নামক তামিল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যেও সংঘের তাৎপর্যপূর্ণ ভিত্তি রয়েছে। এআইএডিএমকে’র সহায়তায় সংঘ-বিজেপি শিবির প্রভাবশালী ওবিসি জাত ‘গৌন্ডার’দের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করছে, যে জাতটা হলো পূর্বতন এআইএডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী এড্ডপাডি পালানিস্বামীর জাত। বিজেপি এমএসএমই লোনের হাতিয়ারকে বেছেবেছে ব্যবহার করে গ্ৰামীণ এবং পশ্চিম তামিলনাড়ুর শহরাঞ্চলের উঠতি উদ্যোগপতিদের মধ্যে তাদের প্রভাবকে আঁটোসাটো করছে। এই অঞ্চলের সাফাই কর্মীদের জাত অরুণাদাথিয়ারসদের মধ্যে প্রভাব অর্জনের প্রণালীবদ্ধ প্রচেষ্টাও কিছু সুফল এনে দিয়েছে, তবে পশ্চিম তামিলনাড়ুতে ঐ দলকে এখনও অনেক উদ্যোগ নিতে হবে। মোদী মন্ত্রিসভায় বিজেপির পূর্বতন সভাপতি এল মুরুগানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ঐ জাতকে পক্ষে আনার লক্ষ্যে।

মোদী ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণকে এমনভাবে কাজে লাগাচ্ছেন যাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে তামিলনাড়ুতে বিজেপির হস্তক্ষেপ ও প্রভাবের বৃদ্ধি ঘটানো যায়। জিএসটি’র মাধ্যমে আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর আক্রমণ থেকে নিট এবং ২০২০’র জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলা পর্যন্ত বিস্তৃত উদ্যোগ নিয়ে বিজেপি এই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছে। নিয়োগ করা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তাব্যক্তিদের প্রবল রাজনীতিকরণ ঘটানো হচ্ছে যাতে আরএসএস অনুগত অফিসারদের রাজ্যে বসানো যায়, এবং ন্যায়পরায়ণ অফিসারদের ফিরিয়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় কাজে রাজ্যের বাইরে নিয়োগ করা হচ্ছে। রাজ্যপালও সাংবিধানিক অনুমোদনকে আটকে দিয়ে এবং সংস্কৃত আর নানান পশ্চাদমুখী হিন্দুত্ববাদী ধারণাগুলোতে মদত দিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এজেন্ট হিসাবেই কাজ করছেন।

ডিএমকে সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয়তার রক্ষায় যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে, তবে কর্পোরেটদের তুষ্ট করার ব্যাপারে তারা বিজেপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রত হচ্ছে। হিন্দু পরিতুষ্টির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, যেমনটা দেখা যাচ্ছে অনেক বিরোধী দলের ক্ষেত্রেই। উদাহরণস্বরূপ, মন্দিরের জমি দখলমুক্ত করার নামে ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। দখলমুক্তির এই উদ্যোগ দরিদ্র এবং ক্ষমতাহীনদের বিরুদ্ধেও চালিত হচ্ছে আর ধনী এবং ক্ষমতাবানদের নানা উপায়ে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। কোয়েম্বাটুর এবং নাগেরকয়েল জেলাতেও আমরা গেরুয়া অনুগত পুলিশ প্রশাসনকে দেখতে পাচ্ছি যেখানে গান্ধী স্মরণ দিবসে গডসের সমালোচনা করার জন্য প্রগতিবাদী ব্যক্তিদের আটক করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দলিতদের ওপর আক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কথাও সুবিদিত। যে ডিএমকে সরকার তিন কৃষি আইনের বিরদ্ধে প্রস্তাব পাশ করেছিল তারা বিধানসভায় শ্রম বিধির বিরুদ্ধে একই ধরনের প্রস্তাব গ্ৰহণে অনিচ্ছুক।

ডিএমকে অবশ্য কিছু মাত্রায় কল্যানবাদকে যুক্ত করে তার কর্পোরেটপন্থী মডেলে ভারসাম্য আনতে চাইছে। তারা কিন্তু কল্যাণবাদকে কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারিকরণ এবং নানা কর্পোরেটপন্থী পদক্ষেপের পক্ষে এক বীমা হিসাবে। ডিএমকে তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার করছে নয়া-উদারবাদের সঙ্গে কল্যাণবাদকে যুক্ত করে তাকে অর্থনীতির দ্রাবিড়িও মডেল বলে চালিয়ে, এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত করছে তার রাজনৈতিক আখ্যান যা আত্মমর্যাদা, সামাজিক ন্যায়, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা এবং রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতার কথা তুলে ধরে। তারা ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকছে এবং জাতীয় শিক্ষানীতির মোকাবিলা করছে তাদের নিজস্ব শিক্ষা নীতি দিয়ে এবং সংস্কৃত ও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিজেপির প্রচেষ্টার বিপরীতে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে। সামগ্ৰিক দৃষ্টিতে, ডিএমকে মোদী সরকার এবং তার ফ্যাসিবাদী আগ্ৰাসন ও আক্রমণাত্মক হিন্দু এজেন্ডার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অধিকাংশ আঞ্চলিক ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে আছে।

থোলাপ্পিয়ানের নেতৃত্বাধীন ভিদুথালাই চিরুথাইকাল কাচি দল (লিবারেশন প্যান্থার পার্টি, ভিসিকে), সিপিআই ও সিপিআই(এম) যারা ডিএমকে নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসাবে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তারা রাজ্য সরকারে নেই। বিজেপির ফ্যাসিস্ট এজেন্ডার বিরুদ্ধে এখন প্রয়োজন বাম ও প্রগতিবাদী শিবিরের স্বাধীন ভূমিকাকে বাড়িয়ে তোলা এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং শ্রমজীবী জনগণের প্রয়োজন ও আকাঙ্খা পূরণে সক্রিয় হওয়ার জন্য ডিএমকে সরকারকে দায়বদ্ধ করা। সিপিআই(এমএল) এই লক্ষ্যে তার সংগঠনের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে ও বিভিন্ন ফ্রন্টে উদ্যোগকে বাড়িয়ে চলেছে এবং ভিসিকে, সিপিআই ও সিপিআই(এম) এবং তার সাথে নানান আম্বেদকরপন্থী ও পেরিয়ার অনুগামী ধারা, গণতান্ত্রিক শক্তি ও সংগ্ৰামের সহযোগিতা ও সমর্থন লাভে উদ্যোগী হচ্ছে।

– ভি শঙ্কর
(লিবারেশন ডিসেম্বর)

খণ্ড-29
সংখ্যা-49