প্রতিবেদন
ভারত এবার জগত সভায় নিকৃষ্ট আসন লভে
India got the worst seat

বিশ্বের দরবারে এবার ভারত দখল করে নিল একনম্বর স্থান। শ্রেষ্ঠত্বের নয়। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা ছড়ানো ক্রমাঙ্কনের ভিত্তিতে যে তালিকাটি তৈরি হয়েছে সেই সূচকে ভারত রয়েছে সবার উপরে।

কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন’স্থিত ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টার’ এক প্রতিবেদন সামনে আনল। এই সংস্থাটি ১৯৮টি দেশের উপর সমীক্ষা চালিয়ে জানাচ্ছে যে সামাজিক বিদ্বেষ সূচক বা সোশ্যাল হস্টিলিটি ইন্ডেক্সে (এসএইচআই) ভারত রয়েছে এক নম্বরে! ১৯৮টি দেশের মধ্যে ১১টি দেশে ওই সূচক ‘অত্যন্ত বেশি’ বলে একই বন্ধনীভুক্ত করা হয়েছে, আর, ভাবা যায়, আফগানিস্থান, সোমালিয়া, পাকিস্থান, সিরিয়া ইরাকের মতো দেশগুলোকে টপকে ভারত চলে এসেছে এক নম্বরে! উল্লেখিত দেশগুলোর স্থান ওই ১১’র মধ্যে যথাক্রমে ৩-৬-৭-১০-১১। কোভিডের সময়ে অতিমারীর নানান বিধি নিষেধের পর্যায়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা বিরাট মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও, করোনা জিহাদ হ্যান্ডেলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়।

“২০২২ সালে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিবেশটা মোটেই ভালো নেই। এই বছরে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, বেশ কিছু রাজ্য ও স্থানীয় স্তরে এমন সমস্ত আইন-রাজনীতি-ধর্মান্তরকরণ-গো হত্যা-ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য বিবাহ সংক্রান্ত প্রশ্নে মুসলিম, শিখ, ক্রিশ্চান, দলিত, আদিবাসীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে যা ওই সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাটভাবেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারটি সমালোচনামূলক স্বরকে লাগাতারভাবে কন্ঠরুদ্ধ করছে, বিশেষ করে তা যদি কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। আর, যারা সেই সমস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হয়ে কথা বলছেন তাঁদের উপর চলছে নজরদারি, নানাভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে, ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরদোর ও সম্পত্তি, অবাধ যাতায়াতে দেয়াল তোলা হচ্ছে, আটক করা হচ্ছে ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইনে। অসমে এনআরসি রূপায়ণ করার যে প্রক্রিয়া জারি আছে, তাতে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন কারণ ২০১৯’র নাগরিকত্ব আইন তাঁদের সমস্ত সুরক্ষাই কেড়ে নিয়েছে। সব মিলিয়ে, সরকারের এই সমস্ত পলিসি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়িয়েছে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরো অনেক চওড়া করে দিয়েছে। হিংসা-মৃত্যু-যৌন নির্যাতন, সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া, ধর্মস্থান ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া, যথেচ্ছ গ্রেপ্তার হয়রানি, অনলাইনের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তপশীলি জাতি ও আদিবাসীদের সামাজিক বয়কট যেন একটা দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

এই কথাগুলো দেশের বিরোধী দলের নয়। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে এক সমীক্ষা ‘রিলিজিয়াস ফ্রিডম ইন ইন্ডিয়া’ (ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা)। প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) — ভারত নিয়ে কান্ট্রি আপডেট। ২০২১-২২ সালে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেমন ছিল, ভারত সরকার যে সমস্ত নীতি অনুসরণ করে চলেছে তার একটা মূল্যায়ন করেছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে উদঘাটিত করা হয়েছে ভারতের মতো বহুমাত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান যখন ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার করেছে, তখন তাকে রীতিমতো লঙ্ঘন করে ভারত সরকার কিভাবে চরম বিভেদমূলক দমননীতিকেই তার শাসনতন্ত্রের অঙ্গ করে ফেলেছে। নাগরিক সমাজ, প্রতিবাদী স্বরকে কণ্ঠরুদ্ধ করতে কিভাবে দমনের রাস্তা বেছে নিয়েছে।

সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছে উল্লিখিত রিপোর্ট। বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার দল বিজেপি’র সাথে গলায় গলায় জড়িয়ে থাকা আরএসএস সংগঠন হল এক আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, যারা খোলাখুলিভাবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বুনিয়াদকে ভেঙ্গে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তুলতে উদ্যত, আর সেই লক্ষ্যেই সমস্ত রাজনৈতিক নীতিমালাকে পরিচালিত করা হচ্ছে।” উক্ত ফোরাম ২০২১ সালেই তার আরেকটা রিপোর্টে আরএসএস’কে এক আধা-সামরিক বাহিনী হিসাবে চিহ্নিত করে, যারা কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আদর্শকে উদ্বাহু সমর্থন করে আসছে। এবছরের ১৯ অক্টোবর, ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্র সংঘের মহাসচিব গুটেরাস ভারত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তাও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসাবে ভারতের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্বের মানবাধিকারকে সংহত করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহ প্রতিটি ব্যক্তি নাগরিকের অধিকারকে সুরক্ষিত ও বিকশিত করা। মূল ধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণের পাশাপাশি সমাজে বিবিধ সাংস্কৃতিক-বহুধর্ম-বহুবর্ণের যে অপরিসীম অবদান রয়েছে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘৃণা ভাষণকে নির্দ্বিধায় নিন্দা করতে হবে। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র ও শিক্ষাব্রতীদের অধিকার ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে।”

সুশীল সমাজ, বিরোধী কন্ঠস্বর, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা যারাই এই সরকারের নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন তাদের উপরই নেমে এসেছে দমন পীড়নের খাঁড়া। ইউএপিএ সহ নানা দানবীয় আইনের বিভিন্ন ধারায় আটক করা, নজরদারি চালানো, প্রভৃতি কাজগুলো ২০২২ থেকেই এই সরকার লাগাতার ভাবে চালিয়ে এসেছে বলে উক্ত রিপোর্ট উল্লেখ করেছে। ২০১৮ সালে অল্ট নিউজের জুবেইরকে ছোট্ট একটা টুইটের জন্য গ্রেপ্তার করা হল এই অজুহাতে যে তা নাকি হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত দিয়েছে। অথচ, বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা মুসলিমদের ধর্মীয় গুরু মহম্মদ সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিজনক ও কুরুচিকর মন্তব্য করার পর দেশজুড়ে তীব্র অশান্তি সৃষ্টি হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিদ্দিক কাপ্পান, তিস্তা শেতলবাদ, ফাদার স্ট্যানস্বামী, উমর খালিদ থেকে শুরু করে নানা অছিলায় মোদী সরকার যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তার উল্লেখ রয়েছে এই রিপোর্টে। আর জেলের ভেতরেও বন্দিদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করার জন্য ফাদার স্ট্যানস্বামীর মৃত্যুর জন্যও ভারত সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রান্তে বুলডোজার চালিয়ে সংখ্যালঘু মানুষদের বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতি সাপেক্ষে বিলকিস বানোর গণধর্ষক খুনে ও দাগি আসামীদের ১৫ আগস্ট ২০২২ জেল থেকে মুক্তি দেওয়া, সিএএ ও এনআরসি’র মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণের নাগরিকত্ব বাতিলের চক্রান্ত শুরু করা, সংগঠিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনলাইন প্রচারের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়ানো, এমনকি এই ঘৃণ্য কাজে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ মদতের উল্লেখও রয়েছে। উক্ত ফোরাম জানিয়েছে যে মুসলিম, ক্রিশ্চান, দলিতদের উপর হিংসা ও ভয়ভীতি ছড়ানোর হাতিয়ার হিসাবে হিন্দুত্ববাদীরা ওই সমস্ত সম্প্রদায়ের উপর যৌন অত্যাচার, এমনকি ধর্ষণকেও যে হাতিয়ার বানিয়েছে, তার অনেক রিপোর্ট তাদের কাছে এসেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তারা জানিয়েছে, ‘ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট ডেসিগনেট’ ভারতকে ‘কান্ট্রি অফ পার্টিকুলার কন্সার্ন’ (বিশেষ উদ্বেগজনক দেশ) হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ হিংসা ছড়ানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যেভাবে পক্ষ অবলম্বন করছে, তার বিরুদ্ধে গোটা রিপোর্ট তীব্র সমালোচনা করেছে।

সমস্ত ধরনের নেতিবাচক, পশ্চাদমুখী অনুন্নয়ন ও গণতন্ত্রহীনতার ক্ষেত্রে জগতসভায় ভারত নিকৃষ্টতম আসন দখল করে নিয়েছে। এ আমাদের লজ্জা। গোটা দেশ ও জাতির লজ্জা।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-47