শ্রদ্ধার্ঘ্য : “যব দিল হি টুট গয়া - হাম জিকে কেয়া করে”
hum jike kya kare

গত ২ ডিসেম্বর ২০২২ রতন (অশোক) বিশ্বাস (৬৮) আগাম কোনো খবর না দিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন। গতকাল সন্ধ্যায় রোজকার মতো কামারহাটির শ্রমিক মহল্লায় গিয়েছিলেন। শ্রমিকদের এবং তাদের পরিজনদের সাথে দেখা করে জেলা অফিসে আসেন। সাগর দত্ত হাসপাতালে তৃণমূলী লুম্পেনদের দাদাগিরি, বিশ্বকাপ ফুটবল, গুজরাট নির্বাচন — এসব নিয়ে চর্চায় স্বাভাবিক ছন্দেই অংশ নিয়ে রাত সাড়ে ন’টায় বাড়ির দিকে হাঁটা দেন। শারীরিক কোনো অসুবিধার কথাও বলেননি, আমাদের নজরেও পড়েনি। পরের দিন সকাল ৮টা নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়।

দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে অনেকের মতো রতন বিশ্বাসের বাবা তেজেন্দ্র লাল বিশ্বাস (প্রয়াত) বেলঘরিয়া, আনন্দগড়, দেশপ্রিয় নগর উদ্বাস্তু পল্লীতে আশ্রয় নেন। জীবিকার তাগিদে ইণ্ডিয়া পটারিতে শ্রমিকের কাজে যুক্ত হন। মা লীলাবতী বিশ্বাস (প্রয়াতা) গৃহবধূ ছিলেন। রতন অকৃতদার। বর্তমানে আছেন অকাল বিধবা এক বোন। আর আছে পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু ও পার্টি কমরেডরা। রতন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বাংলার বাইরে ও বাংলায় বেশ কিছু কারখানায় ফাউন্ড্রিতে চাকুরি করেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়, কোথাও বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। ব্যতিক্রম এইচডিসি, ডানকুনি। সেখানে বহু বছর কাজ করেছেন। শ্রমিকদের কাছের মানুষ ছিলেন, সেক্ষেত্রে পদাধিকার কখনও বড় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না, একসময় কাজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। এমনকি ফ্যাক্টরি থেকে নিজের পাওনাগুলির জন্যেও আর কারখানা মুখো হননি। অন্যায়ের প্রতিবাদ তার স্বভাবেই ছিল, স্থান-কাল-পাত্র মাথায় থাকতো না। চাকরি ছাড়ার পর রাজনীতি ও সংগঠনের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেললেন। সাগরদত্ত হাসপাতাল বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ও বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৫ সালে পার্টির পূর্ণ সদস্য হন। পার্টির ছোট বড় যেকোনো কর্মসূচিতে রতন থাকতেন। ঝাণ্ডা, ব্যানার লাগানো, খোলা, বয়ে নিয়ে আসা রতনের স্বাভাবিক কাজ ছিল। নিজেই করতেন, কারও নির্দেশ বা অনুরোধে নয়। চাকরি ছাড়ার পর তীব্র অভাব অনুচর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্ত তা সত্ত্বেও পার্টি সদস্য হিসেবে আর্থিক দায় বহনে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। আগামী পার্টি কংগ্রেসের ন্যূনতম দেয় ২০ টাকাও তিনি দিয়ে গেছেন।

১৯৭০ সাল থেকেই নকশালবাড়ি রাজনীতির সমর্থক হিসাবে কিছু সক্রিয়তা ছিল। ফলে কংগ্রেসীরা ও পুলিশ বিভিন্ন সময় তাকে হয়রানি করেছে। রতন সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন, নাটক, গান, নতুন নতুন বই নিয়ে চর্চা তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল (পরের দিকে অর্থ ও সময়ের অভাবে যা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল)। বহু গানের লিরিক ছিল মুখস্থ। বই কিংবা খবরের কাগজ মন দিয়ে পড়তেন। দেশব্রতীও খুব খুঁটিয়ে পড়তেন। সব সময় চেষ্টা করতেন মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে।

মনুবাদের কট্টর বিরোধী রতনের তৃণমূল সরকারের কার্যকলাপ নিয়ে ছিল উষ্মা। ওদের কাজ ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে জমি করে দিচ্ছে বলে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন। বামপন্থীদের ঐক্য চাইতেন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা হতাশ ছিলেন।

ছিন্নমূল হয়ে এই দেশে আসার যন্ত্রণা ওঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। পার্টিতে আর্থিকভাবে বা অন্যভাবে পিছিয়ে থাকা কমরেডদের সাহায্যের জন্যে সব সময় চেষ্টা করতেন। দেশে মুসলমান সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে যেভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে তা সহ্য করতে পারতেন না। বিশ্বাস করতেন, সংখ্যাগুরুদের কাজ সংখ্যালঘুকে আশ্বস্ত করা। সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে বছরের পর বছর বিনা ছেদে কামারহাটি সংখ্যালঘু শ্রমিক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। এমনকি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মহিলাদের কাছেও পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। বোরখা পরিহিতা ঐ মহিলারা শিশু কোলে পার্টি অফিসে এসে চোখের জলে তাঁকে শেষ বিদায় জানিয়ে গেছেন। একজন জানালেন, “অনেকেই আমাদের ওখানে যান, কিন্তু রতনদা আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গেছিল”। কামারহাটি ও বেলঘরিয়ার মধ্যে সেতু ছিলেন কমরেড রতন। শেষ দিন কামারহাটি বিসিএমএফ ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সবাইকে চা, লেট্টি খাওয়ান। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে গেয়ে ওঠেন “যব দিল হি টুট গয়া/ হাম জিকে কেয়া করে” শ্রমিক কমরেডরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এই গান কেন গাইছেন?” রতন স্বভাবসিদ্ধ হাসিটি হেসেছিলেন। কিন্তু এই গান যে মনের অতল গভীর থেকে উঠে এসেছিল সেটা কাউকে বুঝতে দেননি।

রতনের সদা হাস্যময় মুখ, প্রাণখোলা হাসি হারিয়ে গেল চিরতরে। কমরেড রতনের মতো একজন কমিউনিস্ট গুণাবলী সম্পন্ন অ্যাক্টিভিস্ট বেলঘরিয়া পার্টি কমিটিকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেলেন। জেলা পার্টি কার্যালয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলার দুই প্রবীণ সদস্য নারায়ণ দে ও সুজিত ঘোষ। আর ছিলেন স্থানীয় পার্টির সদস্য, সমর্থক ও প্রতিবেশীরা। অন্তিম যাত্রা শেষে সগর দত্ত হাসপাতালে কমরেড রতনের ইচ্ছানুযায়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে তাঁর দেহ চিকিৎসকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কমরেড রতন বিশ্বাস লাল সেলাম।

খণ্ড-29
সংখ্যা-47