‘মানসাই’, হেরেও জিতে যাওয়ার গল্প

উত্তরবঙ্গের জলঢাকা নদীতে এসে মিলেছে মুজনাই নদী। যার ফেলে আসা নাম মানসাই। তবে সময়ের জাঁতাকলে পড়েও মুজনাই কিন্ত মানসাই হয়েই থেকে গেছে সেখানকার মানুষদের কাছে, বলা ভালো উত্তরবঙ্গের মানুষদের কাছে। মানসাইয়ের পাড় ঘেঁষে তৈরি হয়েছে জনপদ। মানসাইয়ের সাথে সখ্য তৈরি করেও তাকে ছেড়ে সেই জনপদের বাইরের পৃথিবীর উদ্দেশে পা বাড়িয়েছে অনেকেই। সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের স্মৃতি আগলে মানসাই আপন গতিতে বয়ে চলছে। আবহমান কালের হিসেব দেওয়ার দায় কী তার আছে! সমস্ত নদীর আত্মকথাই তো তাই! কিন্তু সদ্য যৌবনের ডাকে সাড়া দেওয়া মানোর তো এতকিছু জানার কথাই না! নদীর মতোই উচ্ছল বহমানতা নিয়ে সেতো দিব্য ছিল। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মানোর দেখার আকাশটা তখন শরতের মতোই মেঘহীন। মানো স্বপ্ন দেখতো নিজের মতো করে বাঁচার। তির-তির করে বয়ে চলা মানসাইয়ের জলে পা ডুবিয়ে সে যখন বন্ধুদের সঙ্গে খুশিতে মেতে উঠতো, মাতিয়ে রাখতো সকলকে, তার সেই উচ্ছ্বাসের অনুরণনকে বুক দিয়ে আগলে রাখতো মানসাই। মানোর স্বপ্ন, ভালোলাগা, খারাপ লাগা, নীরব অভিমানের অন্যতম সাক্ষী মানোর আদরের মানসাই। আসলে আজকের সমাজেও কত মেয়েই তো স্বপ্ন দেখে। অন্যরকমভাবে গোছাতে চায় নিজেকে। কিন্তু স্বপ্ন দেখা আর তাকে টিঁকিয়ে রাখার মধ্যে যে হাজার যোজন দূরত্ব! সেই দূরত্ব অতিক্রম করার আগেই, দিন প্রতিদিন পলি জমতে জমতে স্বপ্নের মৃত্যু বা অপমৃত্যু ঘটে। সময়ের আগেই চলার গতি শ্লথ হয়ে আসে কত, কত মেয়ের। তাদের খবর কে রাখে। মানোর সাথেও তাই হল। বিয়ে ঠিক করেছিল পরিবার। কিন্তু মানোর দিকে বরাবরই নজর সমাজের নিকৃষ্ট মানুষের। তারা তুলে নিয়ে যায় মানোকে। তাদের হিংস্রতার শিকার হয় মানো। মানো মন থেকে মেনে না নিলেও পারিবারিক চাপ, সমাজের চাপের কাছে আপাত দৃষ্টিতে হেরে যায়। গ্রামের এক প্রভাবশালীকে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু মানোরা তো হেরে গিয়েও জিতে যাওয়ার দলে। তাই বিয়ের পর নৌকা করে যাওয়ার সময় সে নৌকা থেকে মানসাইয়ের জলে ঝাঁপ দেয়। আপাতদৃষ্টিতে গল্পের ট্রাজিক শেষটা এখানে হলেও মানসাই যেভাবে মানোর শরীরের সাথে সাথে তার মানসিক ক্ষতের জায়গাটিতেও কোমল পরশ বুলিয়ে দিয়ে, তাকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চেয়েছে — তীব্র জলরাশির ঝাপটায় ধুয়ে দিতে চেয়েছে জীবনক্ষত, গল্প বোধহয় সেখান থেকেই বাঁক নেয় নতুন দিকে।

কিছু অবধারিত জিজ্ঞাসা নিয়ে দর্শকরা হল ছাড়েন। মনে থেকে যায় মানসাইকে ঘিরে তৈরি হওয়া প্রশ্ন — এত জানে তবু নদী কথা বলে না... কেন বলে না...

এই জিজ্ঞাসা হয়তো জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন গল্পকার অতনু দাস। যিনি এই মানসাইয়ের পাড়েরই ছেলে। তার জীবনের অনেকটা সময় আবর্তিত হয়েছে মানসাইয়ের তীর ধরে গড়ে ওঠা বিরামহীন জনপদের সঙ্গে। তাই তার এই গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে মানসাই। কিন্তু বাস্তব তো কাউকে রেয়াত করে না। তাই লকডাউনের কদর্যতায় অতনু দাস যখন হতোদ্যম তখন শিলিগুড়ির মানুষ, অভিজিৎ দাস, সুরকার রজত বিশ্বাসরা দায়িত্ব তুলে নেন নিজেদের কাঁধে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণতা পেতে শুরু করে যৌথ স্বপ্ন। তিস্তা বুড়ির গান, ভাওয়াইয়ার সুরে রাজবংশী সমাজের একটুকরো চালচিত্রের ছবি দিন রাত এক করে এঁকে ফেলেন অভিজিৎ দাস, রজত বিশ্বাসরা। ছোট্ট, ছোট্ট মিউজিক স্কোরে আনন্দ, বিষাদ চিহ্ন নিপুণ হাতে এঁকে দেন। কখনও তাতে বাঁশি হাতে যোগ্য সঙ্গত করেন পরেশ রায়। কখনও অন্য কেউ। পায়েল মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ে মানোকে নিশ্চিত মনে থেকে যাবে অনেক, অনেকদিন। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী কৃষ্টি, সংস্কৃতির কথক চুরানব্বই মিনিটের এই সিনেমাটি ইতিমধ্যেই দেখানো হয়েছে ২৮তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে। এছাড়াও কেরল ও বাংলাদেশের দু’টি চলচ্চিত্র উৎসবেও জায়গা করে নিয়েছে ‘মানসাই’। এখন শুধু একটাই চাওয়া — মানসাই ফিরে পাক নতুন গতিপথ — তার আলোতে উদ্ভাসিত হোক উত্তরের জনপদ। জন ডেনভারের গানে, গানে মানসাই ছেড়ে আসা সকলে যেন অন্তত একবার গেয়ে ওঠে, “সেখানেই আমাকে নিয়ে যাও, একবার যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। মানসাই!”
- শাশ্বতী

খণ্ড-29
সংখ্যা-50