খবরা-খবর
বর্গা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন : মিছিলে, বিক্ষোভে উত্তাল ধনেখালি
Dhanekhali riots in marches

আদিবাসী বর্গাদারদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা চলবে না। প্রোমোটার-প্রশাসনের অশুভ আঁতাত ধ্বংস হোক। গণআন্দোলনের নেতাদের ওপর মিথ্যা মামলা চাপিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা যায় না, যাবে না — শত কণ্ঠের এমনতর বলিষ্ঠ আওয়াজ, প্রতিবাদী জনতার রণধ্বনিতে যেন ফিরে আসছে সংগ্রামী বাংলার সেই চিরচেনা ছবি। স্থান- হুগলী জেলার ধনেখালি কলেজ মোড়। ১৪ ডিসেম্বর বিকেল ৩টে। তাঁতশিল্পের নাম জড়ানো ছোট্ট শহরের রাজপথ শত শত লাল পতাকার ঢেউয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে। দৃপ্ত এ মিছিলে অংশ নিয়েছেন খেতমজুর, গরিবচাষি, গ্রামীণ মেহনতিদের সাথে সাথে শহরের শ্রমিক, ছাত্র-যুব — এক কথায় সর্বস্তরের প্রতিবাদী মানুষ। মিছিলে সামিল দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসা মানুষদের এক বড় অংশই ছিলেন মহিলা। পার্টির হুগলী জেলা কমিটির পরিচালনায় এই মিছিল রাজ্যের দুর্নীতিবাজ শাসকদের অন্যতম ঘাঁটি বলে পরিচিত ধনেখালির মাটিতে নিশ্চিতভাবেই নতুন সমীকরণের সূচনা ঘটালো।

বৃহৎ পুঁজি বা মালিক শ্রেণীর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য মমতা ব্যানার্জী যেদিন রাজ্যে ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ তৈরির ঘোষণা করেন সেদিন থেকেই সরকারি বীজ খামার থেকে শুরু করে অবণ্টিত খাস জমি, বনাঞ্চলের সরকারী জমি — সবই বিভিন্ন ফাটকাবাজরা হাতিয়ে নিতে শুরু করে। গ্রাম বাংলার বহু জায়গায় খাস ও বর্গা জমি থেকে গরিবদের উচ্ছেদযজ্ঞ শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে ছোট ছোট প্রতিবাদও জায়গায় জায়গায় সংগঠিত হতে দেখা যায়। আর এই প্রতিবাদ অবশেষে প্রতিরোধের রূপ নেয় ধনেখালির মাটিতে। প্রায় বছর খানেক আগে ধনেখালির যদুপুর গ্রামে প্রোমোটারচক্র টাকার লোভ দেখিয়ে আদিবাসী বর্গাদারদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য আসরে নামে। গরিব বর্গাদারদের কয়েকজন জমির দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও রাসমণি মুর্মু, সিদ্ধেশ্বর মুর্মুদের মতো কয়েকজন বর্গা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। পার্টির ধনেখালি লোকাল কমিটি কৃষিমজুর সমিতি এবং আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চকে সামিল করে বর্গা জমি রক্ষার আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায়।

গত মরশুমে আমন ধান রোয়ার সময় রাসমণি মুর্মুর ওপর প্রোমোটার চক্র প্রাণঘাতী হামলা চালায়। স্থানীয় পুলিশ রাসমণিদের সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে প্রোমোটারদেরই মদত দেয়। পার্টির প্রচেষ্টায় আদালতে আদিবাসী নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়। কিন্তু অনমনীয় প্রোমোটাররা স্থানীয় পুলিশ ও ভূমি দপ্তরকে প্রভাবিত করতে থাকে। ‘ওয়ারিশন বর্গার’ কিছু ফাঁক ফোকরকে কাজে লাগানোর বিস্তর অপচেষ্টা চলতে থাকে। পার্টির পক্ষ থেকেও জেলা ভূমি সংস্কার আধিকারিক, পুলিশ সুপার (গ্রামীণ)-এর দপ্তরে বার বার ডেপুটেশন দেওয়া হয়। উজ্জীবিত বর্গাদারদের অন্যতম রাসমণি মুর্মু গত ১৪ নভেম্বর বর্গা জমির ধান কেটে তাঁর খামারে নিয়ে যান। ক্ষিপ্ত প্রোমোটাররা রাসমণি সহ কয়েকজনের নামে চুরি, অস্ত্র নিয়ে হামলা ইত্যাদি অভিযোগ এনে এফআইআর করে। এই মিথ্যা মামলায় পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য তথা সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির (আয়ারলা) রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারীকেও জড়িয়ে দেওয়া হয়। পার্টির হুগলী জেলা কমিটির উদ্যোগে দ্রুততার সঙ্গে ধনেখালি থানা, এসপি (গ্রামীণ), জেলা ভূমি সংস্কার দপ্তর, আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর ও মহকুমা শাসকের (সদর) নিকট জোরদার ডেপুটেশন দেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতির দাবি ছিল আরও বেশি কর্ম উদ্যোগের। যে মাটিতে জমিচোর লুটেরাদের তান্ডব চলছে সেই ধনেখালির মাটিতেই জমির আন্দোলনকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভব ছিল না। যেভাবে জেলা জুড়ে খাস ও বর্গা জমি থেকে গরিব মানুষ উচ্ছেদ হচ্ছেন তাকে অন্তত একটা জায়গায় রুখে দেওয়া প্রয়োজন।

Dhanekhali riots in marches, protests

এই লক্ষ্যে জেলা জুড়ে সমগ্র পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে ধনেখালি অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। কোনও সন্দেহ নেই, কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে শয়ে শয়ে গ্রামীণ গরিবদের পাশাপাশি শহরাঞ্চলের শ্রমিক ও নওজোয়ানরাও মিছিলে সামিল হয়ে ধনেখালির মাটিতে সঞ্চার করলেন গণআন্দোলনের এক নতুন উত্তাপ। যে কারণে কলেজমোড় থেকে শুরু হওয়া মিছিল বিএল এন্ড এলআরও দপ্তরের সামনে এসে এক জনবিষ্ফোরণে ফেটে পড়ে। সমাবেশের জঙ্গী মেজাজ দেখে ধনেখালির ভূমি দপ্তরের আধিকারিকরা এবার আর কোনও ভুল করেন না। সজল অধিকারীর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ভূমি দপ্তরে প্রবেশ করলে বিএলএলআরও তাঁদের স্বাগত জানান। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, মৃত বর্গাদারের বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে রাসমণি মুর্মু, সিদ্ধেশ্বর মুর্মুদের নাম অবিলম্বে নথিভুক্ত করা হবে। তিনি অন্যান্য বর্গাদার ও খাস জমি বিষয়ক আরো কিছু সমস্যারও দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন। সমাবেশ থেকে তপন বটব্যালের নেতৃত্বে আর এক প্রতিনিধিদল ধনেখালি বিডিওর সাথে সাক্ষাৎ করে। সেখানে প্রোমোটার-পুলিশ আঁতাতের বিরুদ্ধে এবং গরিব আদিবাসীদের সুরক্ষার প্রশ্নকে জোরের সাথে তুলে ধরা হয়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সমাবেশ এবং এই গণডেপুটেশনের সফলতার বার্তা ধনেখালি ছাড়িয়ে জেলার এক বৃহত্তর অংশে নিশ্চিতভাবেই ছড়িয়ে পড়বে। বয়ে আনবে সাফল্যের আরো আরো নতুন সংবাদ।

খণ্ড-29
সংখ্যা-49