চাষির আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি এক মরীচিকা মাত্র
farmer's-income-is-just-a-mirage

২০২২’র মধ্যে চাষির আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বিরাট ঢাক ঢোল পিটিয়ে সেই ঘোষিত কাজের লক্ষ্যকে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল সরকারের উচ্চাসন থেকে। ২০২৩ সাল এলো। এ’বছরের বাজেট বক্তৃতায় তার কোন প্রতিধ্বনি শোনা গেল না। ভারতীয় অর্থনীতিতে বেকারত্ব যখন এক নির্মম বাস্তব, অর্থমন্ত্রীর গোটা বাজেট ভাষণে ‘বেকারত্ব’ শব্দটি একবারের জন্যও শোনা গেল না। বরং বাজেটে দেখা গেল, চাষির ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করার যে উদ্যোগগুলি আগে ঘোষিত হয়েছিল, এবার কার্যত তা বাতিল করা হয়েছে। যেমন, প্রধানমন্ত্রী অন্নদাতা আয় সংরক্ষণ যোজনা অভিযান (পিএম আশা)। প্রধানত তৈলবীজ ও ডাল চাষিদের জন্য ২০১৮ সালে এই প্রকল্প শুরু হয়, যাতে ফসলের দাম পড়ে গেলে সরকার সরাসরি ফসল কিনে নানা উপায়ে চাষিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। ২০২২-২৩ এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল এক কোটি টাকা, ২০২৩-২৪’র জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাত্র এক লক্ষ টাকা। আনাজ ও ফল চাষিদের ক্ষতি সামাল দিতে ঘোষিত মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম অ্যান্ড প্রাইস সাপোর্ট স্কিমে বরাদ্দ দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ টাকা। কী করে তৈলবীজ বা আনাজ চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন, তার কোনো দিশাও নেই এবারের বাজেটে। ফসল বিমা থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা তাঁদের। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে বিমাই ভরসা তা স্বীকার করেছে এবারের আর্থিক সমীক্ষাও। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনায় বরাদ্দ কমেছে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা। পিএম কিষাণে বরাদ্দ কমেছে আট হাজার কোটি টাকা! সারে ভর্তুকির অঙ্কেও বড় কাটছাঁট হয়েছে।

যে তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গোটা ভারতবর্ষ দেখল ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন, যে সুসংগঠিত প্রতিবাদ প্রতিরোধের চাপে মোদী সরকার কার্যত রাজনৈতিক পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়, সেই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা এবং সরকারি ক্রয় আরো বাড়ানোর দাবি। খুব সম্প্রতি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পেঁয়াজ, টমেটো চাষিরা উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে আবার উৎপাদিত ফসল নষ্ট করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছেন। পরিহাস এটাই, এবারের বাজেট বক্তৃতায় একবারের জন্যও উচ্চারিত হল না এমএসপি শব্দটি — খাদ্যে ভর্তুকির বরাদ্দ ছাঁটা হল প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। স্বাভাবিক ভাবেই, এরফলে সরকারি ক্রয় সংকুচিত হবে।

দেশের অর্থনীতি এখনও তার বিরাট ঝিমুনিকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ২০২১-২২এ প্রকৃত মাথাপিছু আয় এখনও ২০১৮-১৯’র স্তর থেকে নীচে ঘোরাফেরা করছে। ২০১৬-১৭ এবং ২০২১-২২এ সামগ্রিক বৃদ্ধির হার ৩.৭ শতাংশ রয়েছে — গত চার দশকে পাঁচ বছরের পর্যায়ে যা সর্বনিম্ন!

একথা আজ সকলেই স্বীকার করেন যে, অতিমারির প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ে, আর কোভিড অতিমারি সেই মরার উপর খাঁড়ার আঘাত নামিয়ে আনে। অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ার যে সমস্ত কাঠামোগত কারণগুলো নিহিত ছিল, তা কখনই সমাধান করা হয়নি, আর গত তিন বছর ধরে সরকার কোনোক্রমে সংকট সামাল দিয়ে চলার চেষ্টা করেছে মাত্র। এর মধ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল চাহিদার ক্ষয় — ভোগব্যয় (কনজাম্পশন) ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যা প্রতিফলিত। ব্যক্তিগত ভোগব্যয় অর্থনীতির প্রায় ৬০ শতাংশ দখল করে রাখে, কিন্তু অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিন সচল হল না। চাহিদার অভাবে শিল্প মহল নতুন বিনিয়োগেও আগ্রহী নয়। আর গ্রামাঞ্চলে এই আর্থিক সংকট অনেক বেশি তীব্রতা নিয়ে হাজির। বিগত এক দশক ধরে গ্রামীণ মজুরি থমকে রয়েছে। চাষিদের আয় হ্রাস প্রাপ্ত হয়েছে, অথবা গত পাঁচ বছরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একই জায়গায়। সর্বশেষ সিএমআইই তথ্য দেখাল, গ্রামীণ বেকারত্ব এক লাফে বৃদ্ধি পেয়েছে – জানুয়ারি ২০২৩-এ ৬.৪৮ শতাংশ থেকে ফেব্রুয়ারিতে তা হয়েছে ৭.২৩ শতাংশ! উচিত ছিল, ২০২৩’র বাজেটে গ্রামীণ আয় বাড়ানোর জন্য একপ্রস্থ পদক্ষেপ ঘোষণা। যা এবারও দেখা গেল না।

গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার ছিল, দেখা যাচ্ছে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই তার উপর কোপ মারা হয়েছে। গতবছর কৃষিক্ষেত্রের জন্য যা বরাদ্দ ছিল, এবার তা কমানো হয়েছে। বাস্তব এটাই, কৃষিক্ষেত্র যখন সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে, তখনই এই ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে দশ শতাংশ কাটছাঁট করা হল বাজেটে। সারের উপর ভর্তুকি তুলে দেওয়ার ফলে চাষের ইনপুট খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এমনকি নাম কা ওয়াস্তে পিএম কিষাণ প্রকল্পে যে নগদ হস্তান্তর করা হতো, সেই বরাদ্দও এবার ছেঁটে ফেলা হয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে বাজেটে কৃষিক্ষেত্রের প্রতি যে মনোভাব দেখানো হয়েছিল, এবারও সেই ধারা বজায় রয়েছে। ঠিক যে পর্যায়ে ভারতীয় কৃষি অর্থনীতি লাভজনক হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় ধরনের সংকটে ভুগছে, সেই ২০১৬-১৭ ও ২০২০-২১-এ কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ প্রতিবছর কমেছে ০.৬ শতাংশ হারে!

গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখন অ-কৃষি ক্ষেত্র অনেক বেশি অবদান রাখছে। কিন্তু, এবারের বাজেটে বরাদ্দ এই ক্ষেত্রেও সংকুচিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রামীণ বিকাশের ১.৫৭ লক্ষ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ গতবছরের সংশোধিত বরাদ্দের থেকে ১৩ শতাংশ কম! দেখা যাচ্ছে, নরেগা প্রকল্পে কমানো হয়েছে ৬০,০০০ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রকল্প খাতে প্রকৃত বরাদ্দের সাপেক্ষে এবারের বরাদ্দ সর্বনিম্ন! একমাত্র যে প্রকল্পে আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, তা হল গ্রামীণ আবাস যোজনা — ৪৮,৪২২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪,৪৮৭ কোটি টাকায়। এদিকে, লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিনামূল্যে খাদ্য শস্য বন্টনের প্রকল্পটি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সামনের দিনগুলোতে গ্রামীণ ভারতে ঘোর দুর্দিন নেমে আসবে। ২০২৩-২৪’র জন্য পোষণ ‘মিড-ডে-মিল’এর জন্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১,২০০ কোটি টাকা। আর, ২০২৩-২৪’র জন্য খাদ্যে ভর্তুকি হ্রাস করা হয়েছে ৮০,০০০ কোটি টাকা! গভীরতর সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত ভারতের অর্থনীতি।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-6