প্রতিবেদন
ইতিহাস গণহত্যার কারবারিদের কোনও দিনই ক্ষমা করবে না
History will never forgive

এবারের গুজরাট নির্বাচন কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ নরেন্দ্র মোদীর কাছে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরো কুড়ি বছর। ২০০১ সালে ভূজে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে গুজরাট যখন ত্রাণ এবং পুণর্গঠন নিয়ে নাজেহাল, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেল অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময়ে, লালকৃষ্ণ আদবানি, তাঁর সুযোগ্য শিষ্য, সংঘ পরিবারের বিশ্বস্ত নরেন্দ্র মোদীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসান। যদিও তখন, নরেন্দ্র মোদীকে দেখে বোঝা যায়নি, এই মানুষটিই আগামী দিনে তিনবার মুখমন্ত্রী হয়ে, তারপরে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন। তাহলে, কী এমন জাদুবলে এই কাজটি করলেন নরেন্দ্র মোদী, যার ফলে তাঁর প্রভাব এই পরিমাণে বৃদ্ধি পেল? আজকে যখন নির্বাচনী প্রচারে দাঁড়িয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এই গুজরাট বানিয়েছেন, তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে কি কোনও সারবত্তা আছে? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। যে গুজরাট, মহাত্মা গান্ধীর রাজ্য, সেই রাজ্যের মানুষের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের বিভাজন, তিনিই করিয়েছেন। গুজরাট বলতে অনেকেই হয়তো গুজরাট মডেল, উন্নত রাস্তাঘাট, বড় বড় শিল্প বোঝেন, কিন্তু গুজরাট মানে যে দাঙ্গা, তা কি আমাদের মাথায় থাকে? কীভাবে গুজরাট হয়ে উঠলো হিন্দুত্ববাদের পরীক্ষাগার, তা নিয়ে বহু কথা হয়তো হয়েছে, বহু লেখাও হয়েছে, কিন্তু এই বিভাজনের রাজনীতিই যে আসল গুজরাট মডেল, তা ভুলে যদি শুধুমাত্র উন্নয়নের কথা বলা হয়, তাহলে কিন্তু ভুল হবে। পুরনো ইতিহাস হয়তো আজকের প্রজন্মের মনে নেই, কিন্তু তা মনে করে আগামীর পথ দেখাটাই বর্তমান সময়ের কাজ।

২০০১ সালে গুজরাটে তখন কংগ্রেস যথেষ্ট শক্তিশালী। সদ্য সদ্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। হঠাৎ, সমস্ত সমীকরণ বদলে গেল ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে। গোধরায়, সবরমতী এক্সপ্রেসে করসেবকেরা ফিরছিলেন। কে বা কারা, ওই ট্রেনের চারটে কামরায় আগুন লাগিয়ে দেয়, তা আজ অবধি জানা যায়নি, কিন্তু প্রায় ৬০ জন করসেবক সেদিন মারা গিয়েছিলেন ওই ঘটনায়। তারপর সারা গুজরাট জুড়ে শুরু হয় তান্ডব। বেছে বেছে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে শুরু হয় হত্যালীলা। খুন করা হয় অসংখ্য মানুষকে, যাঁদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই সংগঠিত হত্যালীলায় সরকারী হিসেব অনুযায়ী মারা গিয়েছিলেন ১০৪৪ জন মানুষ, যার মধ্যে ৭৯০ জন মুসলমান এবং ২৫৪ জন হিন্দু। বেসরকারী হিসেব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা দু’হাজারের ওপরে। ধর্ষিতা হন অসংখ্য সংখ্যালঘু মানুষজন। নারকীয় এই ঘটনার বিবরণ, তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রায় রোজই এসেছে। অনেকে এই ঘটনাকে দাঙ্গা বললেও, সারা বিশ্বের বেশীরভাগ মানুষ আজও এই ঘটনাকে ‘সংগঠিত হত্যালীলা’ বলে থাকেন। অনেকেই বলে থাকেন, নরেন্দ্র মোদী সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাঁর প্রশাসনিক পদের অপব্যবহার করে ওই হত্যালীলা সংগঠিত হতে দিয়েছেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী অবধি নরেন্দ্র মোদীকে এই বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, তাঁর আচরণে ‘রাজধর্ম’ পালিত হচ্ছে না। সংসদে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বরখাস্তের দাবিতে আওয়াজ ওঠে, এমনকি এনডিএ সরকারের শরিকেরাও এই দাবিতে গুজরাট সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। চাপে পড়ে, নরেন্দ্র মোদী সহ সমস্ত মন্ত্রীসভা পদত্যাগপত্র দিয়ে দেন রাজ্যপালের কাছে। নির্বাচনও বেশি দূরে না থাকার কারণে, রাজ্যপাল সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। সেই সময়, কুড়ি বছর আগে এমনই এক নভেম্বরে নির্বাচন কমিশন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা করে দেন। অনেকে ভেবেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আস্থা হারানো আদবানী-বাজপেয়ী এবং সংঘ পরিবার হয়তো আর মোদীকে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে তুলে ধরতে চাইবেন না, কিন্তু কার্যত দেখা যায়, মোদীকে সামনে রেখেই বিজেপি এই নির্বাচনী লড়াইতে নামতে আগ্রহী এবং তার ফলও মেলে হাতেনাতে। যে বিভাজনের রাজনীতি নরেন্দ্র মোদী গুজরাটে ওই ২০০২ সালে করেছেন তার ফলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। ১৮২ আসনের মধ্যে ১২৭টি আসনে জয়লাভ করে বিজেপি।

আজকে ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, যিনি সেই সময়ে সেই গুজরাট গণহত্যার অন্যতম মূল একজন কারবারি ছিলেন, গুজরাট নির্বাচনে প্রচার করতে গিয়ে বলেছেন, যে তাঁরা ২০০২ সাল থেকে গুজরাটে স্থায়ী শান্তি এনে দিয়েছেন। যাঁরা দাঙ্গাকারী, তাঁদের শায়েস্তা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? গুজরাটে ঐ সংগঠিত গণহত্যার সময়ে যেভাবে হাজার হাজার সংখ্যালঘু মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, যেভাবে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, যেভাবে তাঁদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছিল, তা কি আমরা ভুলে গেছি? বিখ্যাত সাংবাদিক, রানা আয়ুবের ‘গুজরাট ফাইলস’ এই সমস্ত ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করেছিল সেই গণহত্যার পরে, যা পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। আজকে তাহলে কেন আবার সেই ঘটনাকে মানুষের স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনা হল? আসলে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ, অনেক আগে থেকেই এই বার্তা দিতে চেয়েছেন, যে ঐসব ভাইব্রান্ট গুজরাট বা গুজরাট মডেল দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে বোকা বানানো হবে, যাতে সারা দেশের মানুষ তাতে মজে থাকেন, কিন্তু গুজরাটের নির্বাচকদের বারেবারেই হিন্দু অস্মিতা জাগ্রত করেই তাঁদের জিততে হবে। গুজরাট গণহত্যা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বললেই যে নামটি আমাদের প্রথম মনে পড়ে, তা হল, বিলকিস বানো, যিনি আজও জীবিত আছেন। যখন স্বাধীনতা দিবসের দিনে, তাঁর ধর্ষণকারীদের সাজা শেষ হওয়ার আগেই ‘ভাল ব্যবহারের’ কারণে মুক্তি দেওয়া হলো, সেদিনই বোঝা গিয়েছিল, বিজেপি এবারেও হিন্দু-মুসলমান তাস খেলতে চলেছে। গুজরাটের গোধরা বিধানসভার বর্তমান বিধায়ক, যিনি এই ধর্ষণকারীদের আগাম মুক্তির বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং তাঁরা মুক্তি পাওয়ার পরে বলেছিলেন, যে ওই অপরাধীরা আসলে ‘সংস্কারী ব্রাহ্মণ’, সেই চন্দ্র সিং রাউলজীকেই আবার বিজেপির প্রার্থী করা হবে কেন এবারের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে? আসলে বিজেপি জানে, এই গুজরাটে তাঁদের যে বিভাজনের রাজনীতির শিকড় আছে, তা আজকে নয়, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে প্রোথিত হয়েছিল, তাই এবারও যদি তাঁদের জিততে হয়, যাঁর হাত ধরে তাঁদের জিততে হবে, তা নরেন্দ্র মোদীর হাত। যে হাত, যত ওপরে তুলে বিকাশের কথা বলুক না কেন, যে হাত বিভাজনের রাজনীতি করতে বিখ্যাত, যে কণ্ঠ থেকে যতই বলা হোক ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’, সেই হাতকেই আজ আবার বিজেপির প্রয়োজন।

যেদিন বিজেপি তাঁদের প্রার্থী ঘোষণা করেছিল এবং সেই তালিকাতে নারোদা পাটোয়ার মতো গণহত্যা, যাতে ৯৭ জন সংখ্যালঘু মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার অন্যতম কারবারি মনোজ কুকরানির কন্যা পায়েল কুকরানিকে প্রার্থী করা হয়েছিল, সেদিনই বোঝা গিয়েছিল, বিজেপি তাঁদের বিভাজনের রাজনীতি করেই এবারও জিততে চায় গুজরাটে। শুধু তাই নয়, প্যারোলে মুক্ত হয়ে মনোজ কুকরানি, তাঁর কন্যার হয়ে প্রচারও করছেন, যা সামাজিক মাধ্যম সহ নানান গণমাধ্যমে প্রচারিতও হয়েছে। এই বিধানসভায় কি মনোজ কুকরানি, মোদীর উন্নয়নের প্রচার করছেন, না যে বিভাজনের রাজনীতির শিক্ষা ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদী দিয়েছিলেন, তার প্রচারই করছেন? নারোদা পাটায়া থেকে পায়েল কুকরানিকে বা গোধরা থেকে চন্দ্র সিং রাউলজীকে প্রার্থী করার মধ্যে দিয়ে বিজেপি এই বার্তাই দিতে চেয়েছে, তাঁরা সংখ্যাগুরুর পক্ষেই আছে, তাঁদের কাছে সংখ্যালঘু মানে আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও ছিল, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, আজও তাই আছে। সুতরাং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, যে ২০০২ সালে তাঁরা সেখানে শান্তি এনে দিয়েছেন, স্থায়ী শান্তি, তখন কি একবারও তাঁকে প্রশ্ন করা উচিৎ নয়, যে এই শান্তির মানে কী শ্মশানের শান্তি, যে শান্তির বাণীতে মিশে থাকে সংখ্যালঘু মানুষের চোখের জল, না ভূমিষ্ঠ হওয়া ভ্রূণের রক্ত? তবে শেষ করা যাক, সেই অশোক পারমারের কথা বলে, যাঁর মুখটা সেই গুজরাট গণহত্যার সময়ে আমরা চিনেছিলাম, হিংস্র, হিন্দুত্ববাদের মুখ হিসেবে, সেই অশোক পারমার এখন একটি জুতো সেলাইয়ের দোকান চালান। তিনি সারসত্যটি বলে দিয়েছেন, যে মোদী এবং অমিত শাহ তাঁদের ব্যবহার করে নিয়েছেন এবং সেই রাজ্যে সাধারণ মানুষের কোনও উন্নয়নই হয়নি। তাঁদের ব্যবহার করে হিন্দুত্ব রাজনীতির হয়তো জয় হয়েছে, কিন্তু তাঁরা যে তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই আছেন। এবারের গুজরাটের নির্বাচনে কি সাধারণ মানুষ মোদী এবং অমিত শাহের এই ধাপ্পাবাজি ধরতে পেরে, গণতন্ত্রের পক্ষে তাঁদের ভোট দেবেন? তার উত্তর পেতে গেলে, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৮ ডিসেম্বর ২০২২ অবধি। বিজেপি জিতেও যদি যায়, যদি তাঁদের বিভাজনের রাজনীতি আবারও জয়ী হয়, তাও ইতিহাস সেই গণহত্যার কারবারিদের কোনোদিনই ক্ষমা করবে না।

- সুমন সেনগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-46