আজকের দেশব্রতী : ১৮ এপ্রিল ২০২৪ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-18-04-2024commitment-of-22-april-2024_222-april-2024

আমরা ২০২৪’র ২২ এপ্রিল, সিপিআই(এমএল)-এর ৫৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নির্ণায়ক একটি লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে। এই উপলক্ষ্যে আমরা উষ্ণ অভিনন্দন জানাই আমাদের সমস্ত সদস্য, শুভার্থী এবং ভারতের সংগ্রামী জনতাকে। এই বিশেষ মুহূর্তে আমরা সকল প্রাপ্ত বয়স্ক ভারতীয়ের কাছে একটি আবেদন রাখছি, তাঁরা যেন নিজেদের ভোটদানের মৌলিক অধিকারটি প্রয়োগ করেন ফ্যাসিবাদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তি এবং সংসদীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রক্ষা করার লক্ষ্যে।

২২ এপ্রিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মহোত্তম রূপকার কমরেড লেনিনের জন্মদিবস। আমরা কমরেড লেনিনের প্রতি আমাদের বিপ্লবী শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছি এবং এক শোষণ ও যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ার কমিউনিস্ট ব্রতে নতুন উদ্যমে ব্রতী হচ্ছি, যে পৃথিবীতে মানবতা হবে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন।

জন্মলগ্ন থেকেই সিপিআই(এমএল) ভারতকে একটি যথার্থ জনগণের গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করা এবং একটি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছে। মোদী সরকার তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরলে, সেই অভীষ্ট বিপ্লবী লক্ষ্য এক বিরাট বাধার সম্মুখীন হবে, আম্বেদকরের কথায়, এটা হবে এক, ‘চরম বিপর্যয়’। ২০২৪’র নির্বাচনকে তাই আমাদের, ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে চূড়ান্ত আঘাত হানার এবং স্বৈরতান্ত্রিক মোদী রাজত্বের উৎখাতের জন্য জনতার এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম হিসাবে দেখতে হবে।

ইন্ডিয়া জোটের অংশ হিসাবে আমরা বিহার ও ঝাড়খণ্ডে চারটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। এই দুটি রাজ্য ছাড়াও আমরা পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে একটি করে আসনে স্বাধীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। আমরা অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশায় কয়েকটি বিধানসভা আসনে লড়ছি। বিহারে কমরেড মনোজ মঞ্জিলের অন্যায় দণ্ডাদেশের জন্য বিধায়ক পদ খারিজ হওয়ায়, সেখানে ঐ আসনটির উপনির্বাচনে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের নির্বাচনী প্রচার চালানোর পাশাপাশি আমরা বিজেপি/এনডিএ’র পরাজয় এবং ‘ইন্ডিয়া’র জয়ের জন্য দেশজুড়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছি।

পার্টি প্রতিষ্ঠার এই দিনে আমরা সশ্রদ্ধ বিপ্লবী অভিবাদন জানাই আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড চারু মজুমদারকে, তাঁর উত্তরসূরী যাঁরা সত্তর দশকের গোড়ায় ধাক্কার পর পার্টির পুনর্গঠন করেছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই কমরেড জহর ও কমরেড বিনোদ মিশ্রকে। এই বিশেষ ক্ষণে আমরা সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই কমরেড নাগভূষণ পট্টনায়ক, কমরেড রামনরেশ রাম, কমরেড অনিল বড়ুয়া, কমরেড মহেন্দ্র সিং এবং আমাদের প্রিয় শহীদ ও নেতাদের স্মৃতির উদ্দেশে — যাঁরা তাঁদের সর্বস্ব বলি দিয়েছিলেন পার্টি, জনগণ ও বিপ্লবের স্বার্থে। আমরা সালাম জানাই আমাদের সেইসব কমরেডদের যাঁরা এই মুহূর্তে কারাযন্ত্রণা ভোগ করছেন। আমরা অবিলম্বে তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি চাই। আমরা নিঃশর্ত মুক্তি চাই সেইসব ‘বিবেকের বন্দি’ মানুষের জন্য যাঁরা ন্যায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে আজ কারাবন্দি এবং জেলবন্দি সমস্ত বিরোধী দলের নেতাদের।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
সিপিআই(এমএল) দীর্ঘজীবী হোক!
আমরা লড়ব, আমরা জিতব!

কেন্দ্রীয় কমিটি,
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন

modi-manifesto-deception-and-reality_2deception-and-reality

ভারতবাসী লোকসভা নির্বাচনের সাত দফা দীর্ঘ ভোটের প্রথম দফার ভোট দিতে যাওয়ার ঠিক পাঁচ দিন আগে শাসন ক্ষমতায় থাকা দল বিজেপি তাদের ৭৬ পৃষ্ঠার ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। ২০১৪ সাল থেকে মোদী সরকারের নিজেদের দেওয়া প্রতিটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব‍্যর্থতা ও প্রতারণা বিষয়ে ইস্তাহারে কিছুই বলা হয়নি, জনসাধারণের এজেন্ডায় মূল মূল যে বিষয়গুলি সবার ওপরে রয়েছে সেগুলো সম্পর্কেও ইস্তাহার কিছু বলেনি, ভারতের জন্য কেবল ২০৪৭ সালের এক গুলাবী স্বপ্নজাল বোনা হয়েছে! ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি দলটিই ‘জুমলা’ শব্দটি চালু করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে প্রত্যেকের একাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ঢোকার প্রতিশ্রুতিকে অমিত শাহ ভোটের পর জুমলা বলে অভিহিত করেছিলেন। জুমলা শব্দটি এখন যখন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির সমার্থক শব্দ হিসেবে সর্বত্র চালু হয়েছে, বিজেপি তখন নতুন শব্দবন্ধ আবিষ্কার করেছে, ‘মোদীর গ্যারান্টি’। কিন্তু নাম যাই দেওয়া হোক জুমলা তো জুমলাই!

২০১৪’র নির্বাচনে বছরে দু’কোটি চাকরি দেওয়ার ও কালাধন ফেরত আনার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা অস্বীকার করার পর মোদী সরকার ২০২২ সালের ভারতের জন্য এক নতুন প্রতিশ্রুতির তালিকা বানাতে ব্যস্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীকে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল অনেকগুলি বিষয় অর্জন করার সময়সীমা হিসেবে : শৌচালয় ও প্রবাহী জল সহ সর্বজনীন আবাস, কৃষি উপার্জন দ্বিগুণ হওয়া, এক শত স্মার্ট সিটি, দশটি নতুন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২২’র পর আরো দু’বছর পেরিয়ে গেছে। দেশকে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে না দিয়ে সরকার তো ২০২২’র প্রতিশ্রুতিগুলির কী হল না হল সেই হালখাতা প্রকাশ করতে পারত! কিন্তু আরো একবার গোলপোস্ট সরিয়ে দেওয়া হল — এবারে ২০৩৬-এ অলিম্পিক আয়োজন আর ২০৪৭-এ বিকশিত দেশ!

মার্চের শেষ ও এপ্রিলের শুরুর দিনগুলিতে ১৯টি রাজ্যের ১০,০১৯ জনের মধ্যে চালানো সিএসডিএস লোকনীতি প্রাকনির্বাচনী সমীক্ষা সাধারণ মানুষকে যে ইস্যুগুলি ভাবাচ্ছে সে বিষয়ে একটি স্পষ্ট ছবি আমাদের সামনে হাজির করেছে। যে দুটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ব‍্যক্ত হয়েছে তা হল বেকারত্ব (২৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন) ও মূল্যবৃদ্ধি (২৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন)। এই চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতে, মোদী সরকার তার অর্জন হিসেবে যে দুটি বিষয় তুলে ধরেছে — অযোধ্যায় রামমন্দির বানানো আর মোদী জমানায় আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তি ভালো হওয়া —এই দুটির গ্রহণ যোগ্যতা খুবই কম, যথাক্রমে ৮ শতাংশ ও ২ শতাংশ। বিজেপি তার অর্জন হিসেবে যে আইন-পরিবর্তনগুলিকে বা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকে তুলে ধরেছে সেই সিএএ, ইউসিসি, নতুন ফৌজদারি আইন অথবা শ্রমকোড — এগুলো সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। বস্তুত উত্তরাখণ্ডে ইউসিসি’র যে নমুনা প্রণীত হয়েছে তা মানুষের মাঝে যথেষ্ট সমালোচিত হয় তার ‘আনসিভিল’ চরিত্রের কারণে, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নাগরিকের পছন্দ অপছন্দকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণশীল সামাজিক হস্তক্ষেপের অধীনস্ত করা হয়েছে।

modi-manifesto-deception

বহু সংখ্যক সমীক্ষা ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যেগুলি আজকের ভারতে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের নিদারুণ অবস্থা আমাদের সামনে হাজির করেছে। সম্প্রতি আইএলও এবং ইন্সটিটিউট অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রকাশিত ২০২৪’র ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট দেখিয়েছে ভারতের বেকারদের অধিকাংশই যুব। ৮০ শতাংশের বেশি সংখ্যক কর্মহীনেরা যুব। তাদের মধ্যে ৬ শতাংশের বেশির মাধ‍্যমিক বা তার বেশি ডিগ্রি আছে। তরুণ শিক্ষিত মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার আরো বেশি। মোদীর বিলিয়নেয়ার রাজত্বে অসাম্য এমনকি ঔপনিবেশিক যুগের থেকেও গভীর, মাত্র ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তির হাতে দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশেরও বেশি জমা হয়েছে এবং তাঁরা মোট জাতীয় বার্ষিক উপার্জনের ২২ শতাংশ পকেটস্থ করেন। গরিব ও মধ্যবিত্তদের উপার্জন এক জায়গায় আটকে আছে আর ঋণগ্রস্ততা বিপজ্জনক মাত্রা নিয়েছে। এই চরম আশঙ্কাজনক অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রসঙ্গে বিজেপির ইস্তাহার চোখ বন্ধ করে আছে।

নরেন্দ্র মোদী সবসময় আমাদের বলেই চলেছেন যে ১৪০ কোটি ভারতীয়র আশা আকাঙ্খা পূরণ করাই তাঁর মিশন। একদিকে মোদী সরকার কোটি কোটি ভারতীয়কে দারিদ্র্য থেকে টেনে তুলেছে বলে দাবি করছে, অন্যদিকে আবার তাঁর সরকার ৮০ কোটি মানুষকে বিনা পয়সায় ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য সরবরাহ করছে বলে কৃতিত্ব নিচ্ছে। এর থেকে সহজেই প্রমাণ হয়ে যায় যে দারিদ্র দূরীকরণ বা ১৪০ কোটি ভারতীয়ের আকাঙ্খা পূরণের দাবি সর্বৈব মিথ্যা। আসলে দেশে দ্রুত বর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্য মোদী সরকার ও তার নীতিনির্ধারক ও প্রচারকদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সোৎসাহ উদযাপনের মধ্যে দিয়েই ঘটছে। সরকার ‘সম্পদ সৃষ্টিকারী’ শব্দবন্ধটি সংরক্ষিত রেখেছে সম্পদ আহরণকারী বিলিয়নেয়ার শ্রেণীর জন্য, আর ৮০ কোটি মানুষকে কেবল প্রতি মাসে বিনামূল্যে ৫ কেজি খাদ্যশস্য পাওয়ার যোগ্য বানিয়ে রেখেছে।

এই সরকারের চাপিয়ে দেওয়া অঘোষিত জরুরি অবস্থার মতোই বিজেপির ইস্তাহারের প্রকৃত লক্ষ্য অফিসিয়ালি অঘোষিত। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব এবং অনন্ত হেগড়ে, জ্যোতি মির্ধা, লালু সিং ও অরুণ গোভিলদের মতো প্রার্থিরা প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান মাত্রায় সমস্বরে সংবিধান বদলে দেওয়ার কথা বলে আসল লক্ষ্য প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন যে এই কারণেই মোদী ৪০০ আসনসীমা অতিক্রম করার লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছেন। বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত সংবিধানকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক ভারতের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনায় ভীত হয়ে মোদী এখন ‘গ্যারান্টি’ দিচ্ছেন যে এমনকি আম্বেদকরের পক্ষেও সংবিধান ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব নয়। যদি তিনি সত্যিই ভারতকে সংবিধান সম্পর্কে আশ্বস্ত করতে চাইতেন তাহলে তো তাঁর উচিৎ ছিল গোলওয়ালকরের নাম উল্লেখ করা কারণ আরএসএস কোনোদিনই সংবিধানকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং তার জায়গায় মনুস্মৃতি প্রণয়ন করতে চেয়েছে।

বাবাসাহেব বস্তুত জনসাধারণকে সতর্ক করেছিলেন সংবিধান সম্পর্কে আত্মতুষ্ট না থাকতে এবং তার বদলে বরং যারা সংবিধান কার্যকর করছে সেইসব ব্যক্তিবর্গের গুণমান ও উদ্দেশ্যের দিকে ধ্যান দিতে। খারাপ হাতে পড়ে একটা ভালো সংবিধানও বিপর্যয়কর ফলাফল দিতে পারে। এ’কথাটি স্বাধীন ভারতে ‘বাদামি ইংরেজ’এর ক্ষমতা দখল করে নেওয়া সম্পর্কে ভগৎ সিংহের সতর্কবাণীর সাথে মিলে যায়। বাবাসাহেবই দেখিয়ে গিয়েছেন যে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’এর সমতা অর্থহীন হয়ে যাবে অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক ও সামাজিক অসাম্যের ফলে। আজ ভারতকে আম্বেদকরের সতর্কবাণী স্মরণে রেখে গণতন্ত্র ও তার সাংবিধানিক ভিত্তিকে বাঁচাতে সংবিধান-বিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ভোটে পরাস্ত করতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

biggest-financial-crime_2biggest-financial-crime

সংবাদে প্রকাশ, ভোট মিটলেই টেলিকম মাশুল লাফ দিয়ে বাড়বে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ হারে! ইতিমধ্যেই বহুগুণ বাড়ল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওষুধপত্রের দাম। রহস্যাবৃত নির্বাচনী বন্ডের আল্ফানিউমেরিক সংখ্যার প্রহেলিকা আব্রুবিহীন হওয়ার পর নিত্যনতুন তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে, হরেক সংস্থা — টেলিকম, নির্মাণ কর্পোরেট ওষুধ সংস্থাগুলি বিপুল অর্থের বিনিময়ে যে সমস্ত নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল, এবার তারাও মওকা দেখে নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছে — মাশুল বাড়িয়ে পকেট কাটতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের।

দেখা যাচ্ছে, ৩৩টি কর্পোরেট সংস্থা, যাদের ২০১৬-১৭ থেকে ২০২২-২৩ পর্বে সামগ্রিক লোকসান (এগ্রিগেট লস) এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি, তারা নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার আর যার ৭৫ শতাংশই গেছে বিজেপির কোষাগারে! রহস্যের অবগুণ্ঠন অপসৃত হওয়ার পর দেখা গেল — লোকসানে চলা সংস্থাগুলো মোটা টাকার বিনিময়ে বন্ড কিনেছে, মুনাফা কামানো সংস্থাগুলো তাদের মোট লাভের থেকে অনেক বেশি টাকা দিয়েছে। কিছু কিছু সংস্থা তাদের নিট মুনাফার কোনো রিপোর্ট জমা করেনি, বা সমস্ত কর দেওয়ার পর কত মুনাফা থাকল, তাও প্রকাশ করেনি। আরো কৌতুকের ব্যাপার হল, বেশ কিছু সদ্য নথিভুক্ত সংস্থা আবির্ভূত হওয়ার তিন বছর আগেই নিয়ম বহির্ভূতভাবেই মোটা অঙ্কের নির্বাচনী বন্ড কিনেছে — বেনিয়মে সন্দেহজনক সংস্থার মাধ্যমে নির্বাচনী বন্ড কেনার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

মুনাফা না হওয়া সত্ত্বেও ভারতী গ্রুপ তার দুটি সংস্থা — ভারতী এয়ারটেল ও ভারতী টেলিমিডিয়া নির্বাচনী বন্ড মারফত শুধু বিজেপি’কেই দিয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা। আর, বিরাট লোকসানে চলা আদিত্য বিড়লা গ্রুপের ভোদাফোন-আইডিয়া, বা সংক্ষেপে ভিআই’র ডুবন্ত সংস্থাকে বাঁচাতে মোদী সরকার এক ‘বেলআউট’ প্যাকেজ নিয়ে আসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্বাচনী বন্ড মারফত বিজেপিকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার দু’মাসের মধ্যেই বিড়লা গ্রুপ বেলআউটের নামে সেই উপঢৌকন পেয়ে যায়। আর, এখন সেইসব অনুদান কড়ায় গন্ডায় উশুল করতে মাশুল বৃদ্ধির পথ ধরেছে টেলিকম সংস্থাগুলি।

যে চারটি আইনকে সংশোধন করে মোদী সরকার নির্বাচনী বন্ড নিয়ে এল, শীর্ষ আদালত তার তিনটিকেই অসাংবিধানিক বলে চিহ্নিত করেছে। মোদীর আমল এমনকি লোকসানে চলা সংস্থাগুলোর জন্যও দরজা খুলে দেয়, যা আগের স্কিমে ছিল না। বারংবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশন সেই সময়ে এই আশঙ্কা প্রকাশ করে যে নির্বাচনী বন্ডকে ব্যবহার করা হবে কর ফাঁকি, অসদুপায়ে বা বেআইনি পথে সংগৃহীত মুলধনকে আইনি প্রসাধনে সাজানোর উপায় হিসাবে। নানা শেল কোম্পানি মারফত, লোকসানে চলা বা সদ্য গজিয়ে ওঠা সংস্থাগুলোর নির্বাচনী বন্ড কেনার এই হিড়িক অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, যার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি জানায়।

নিজেদের আর্থিক অপরাধ থেকে পার পেতে, শাঁসালো সরকারি বরাত কব্জা করতে, বিপুল কর ফাঁকিকে আইনি করতে, বেআইনি পথে অর্জিত টাকা ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে সাদা করতে নির্বাচনী বন্ড ছিল কর্পোরেটদের কাছে মোদীর সবচেয়ে বড় উপহার। এই রহস্যাবৃত অস্বচ্ছ অন্ধকারে ঢাকা বন্ড আজ দিনের আলো পেতেই উন্মুক্ত হল বিরাট অপরাধের ইতিবৃত্ত — মোদী সরকার যার সৃষ্টিকর্তা।

ভারতের শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ যে নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে বাতিল করে, সেই পদক্ষেপকেই চ্যালেঞ্জ করে মোদী বললেন তা নাকি দেশকে কালো টাকার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আচমকা নোট বাতিলের বিপর্যয়কারী সিদ্ধান্তকে সেই সময় মোদী কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। দেখা গেল, কালো টাকা বাজেয়াপ্ত হল না, উল্টে তা সাদা হয়ে আবার ব্যাঙ্কেই ফিরে এলো। এবারেও দেখা গেল, নির্বাচনী বন্ড চালুই করা হয়েছিল অনৈতিক অন্যায় অসাংবিধানিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতে।

স্বাধীনতা উত্তর বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির খলনায়ক এই মোদী সরকারকে তাই আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোই ভারতবাসীর পবিত্র কর্তব্য।

phule-and-ambedkar-on-birth-anniversaryambedkar-on-birth-anniversary

১১ এপ্রিল ও ১৪ এপ্রিল যথাক্রমে ফুলে ও আম্বেদকর জন্ম জয়ন্তী। ভারতে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জ্যোতিরাও ফুলে ও বাবাসাহেব আম্বেদকর সর্বাগ্রগণ্য দু’টি নাম। এ’বছর আমরা ফুলের (১১ এপ্রিল ১৮২৭ - ২৮ নভেম্বর ১৮৯০) ১৯৭তম ও ডক্টর আম্বেদকরের (১৪ এপ্রিল ১৮৯১ - ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬) ১৩৩তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপন করছি। বর্তমান সময়ে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তির ওপর যে ধরনের আক্রমণ ও সামন্তী পিতৃতান্ত্রিক পশ্চাদপদতার নাগপাশ যেভাবে নতুন করে গ্রাস করছে আধুনিক ভারতকে সেখানে দাঁড়িয়ে ফুলে ও আম্বেদকরের বার্তা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণাদায়ী হয়ে উঠেছে।

দুনিয়া জুড়ে প্রগতিশীল মানুষ ১৯৪৮ সালকে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের বছর হিসেবে জানে। ঐ একই বছরে তরুণ জ্যোতিরাওও (জনপ্রিয় পরিসরে জ্যোতিবা নামে পরিচিত) ফুলে মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর ১৭ বছর বয়স্কা স্ত্রী সাবিত্রী ফুলের সাথে মিলে ভারতে মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন পুণে শহরের ভিদেওয়াড়াতে। সেই বছরই ফুলেরা আমেরিকান দার্শনিক টমাস পাইনের ‘রাইটস অব ম্যান’ বইটি পড়েন। এই বইটি ফরাসি বিপ্লবের সমর্থনে লেখা। নিপীড়িত জাত ও নারীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে ফুলেদের উদ্যোগ মনুস্মৃতি অনুসরণকারী সংরক্ষণশীল উচ্চবর্ণ অভিজাতদের হিংসার উদ্রেক করে এবং ফুলেরা এমনকি তাঁদের নিকটজনদের দ্বারাও একঘরে হয়ে যান। ফুলেরা তাঁদের নারীশিক্ষা অভিযান চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন তাঁদের দুই মুসলমান বন্ধু ফাতিমা শেখ ও আঁর দাদা উসমান শেখের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পৃষ্ঠপোষকতায়।

এখান থেকেই শুরু হয় বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত এবং আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সামাজিক ন্যায় ও নারীশিক্ষার এক মহতী অধ্যায়। নারীশিক্ষা হয়ে ওঠে নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার, বিধবা বিবাহের পক্ষে ও নবজাতক হত্যার বিরুদ্ধে ওঠে জোরালো আওয়াজ। আজকের দিনের নারীবিদ্বেষী শক্তিদের দ্বারা ভণ্ড ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ জুমলার তীব্র বৈপরিত্বে ফুলেদের উদ্যোগ ছিল নারীশিক্ষা ও সমতার লক্ষ্যে এক আদি ও অকৃত্রিম অভিযান যা প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তী ব্যবস্থাপনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৮৭৩ সালে জ্যোতিরাও ফুলে তাঁর প্রজনক গ্রন্থ ‘গুলামগিরি’ রচনা করেন ভারতের নিজস্ব সামাজিক দাসত্ব ব্যবস্থা জাত প্রথার বিরুদ্ধে এবং গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন আমেরিকার সেইসব মানুষদের প্রতি যারা সেখানকার বর্ণবাদী দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়ছেন।

জ্যোতিরাও ফুলে ১৮৯০ সালে প্রয়াত হন। ওই সময়েই আম্বেদকরের জন্ম। ১৯২০’র দশকে এসে সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের মহান প্রবক্তা তথা নতুন নেতৃত্ব হয়ে ওঠেন আম্বেদকর। তিনি তখন ইংল্যাণ্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতি ও আইনের ডিগ্রি নিয়ে ভারতে ফিরেছেন। আম্বেদকর ফুলেকে তাঁর তিনজন মহান শিক্ষকদের একজন হিসেবে গণ্য করেন, অন্য দু’জন হলেন বুদ্ধ ও কবীর। ১৯২৭ সাল ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ বছর। আম্বেদকর সে বছর মার্চ মাসে মাহাড় সত্যাগ্রহ সংগঠিত করেন সবরকম বৈষম্য ভেঙ্গে পানীয় জলকে সর্বসাধারণের অধিকার হিসেবে তুলে ধরতে, এবং ডিসেম্বর ১৯২৭-এ মনুস্মৃতিকে দাসত্বের সংহিতা বলে অভিহিত করে তা পোড়ানোর কর্মসূচি সংগঠিত করেন। ১৯৩৬-এ আম্বেদকর তাঁর রণধ্বনি ‘জাতের বিনাশ’ ঘোষণা করেন। সেই বছরই তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন জাতব্যবস্থা ও পুঁজিবাদ — এই জমজ শত্রুকে নিশানায় রেখে।

পরবর্তী দুটি দশকে, ঔপনিবেশিক ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জনের দিকে এগোচ্ছিল, আম্বেদকর বৃহত্তর ভূমিকা নেন একসারি বৈপ্লবিক চিন্তা ও উদ্যোগকে রূপ দিয়ে এবং আম্বেদকরের সভাপতিত্বে সংবিধানসভা স্বাধীন ভারতের সংবিধান গ্রহণ করে যে সংবিধানের খসড়া লিখেছিলেন আম্বেদকর। সংবিধান গ্রহণেই আম্বেদকরের পথচলা শেষ হয়ে যায়নি। নবলব্ধ সংবিধানের ভিত্তিতে সুবিচার ও সামাজিক সমতার লড়াই চলতে থাকে। হিন্দু ব্যক্তিগত আইনের আধুনিকীকরণের মাধম্যে হিন্দু মহিলাদের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘হিন্দু কোড বিল’ আনা ছিল তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের আগের শেষ বড় লড়াই। সংবিধানে নিজের ধর্ম নিজে বেছে নেওয়ার যে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে তা প্রয়োগ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।

আজ ভারত তার ইতিহাসের সর্বাধিক নির্ধারক নির্বাচনী সংগ্রামের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র বিপন্ন। এখন আমাদের ফুলে ও আম্বেদকরের অনুপ্রেরণা ও বৈপ্লবিক ধারার প্রতিটি শক্তিবিন্দুকে একত্রিত করতে হবে। আমাদের অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে বাবাসাহেব আম্বেদকর আমাদের সংবিধান ও সংরক্ষণ দিয়েছেন এমনটাই শুধু নয়, তিনি আমাদের সতর্ক করে গেছেন রাজনীতিতে ভক্তি প্রয়োগের মারাত্মক ফলাফল সম্পর্কে, যাকে তিনি বর্ণনা করেছেন স্বৈরতন্ত্রের নিশ্চিত রাস্তা হিসেবে। এবং তিনি বিশেষভাবে সতর্ক করে গেছেন সেই চরম বিপর্যয় সম্পর্কে যা আমাদের গ্রাস করবে যদি হিন্দুরাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয়। ফুলে ও আম্বেদকরের জন্মবার্ষিকী পালনের সাথে সাথে আসুন আমরা আম্বেদকরের এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাণীগুলিও স্মরণ করি এবং আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে ভারতের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষা করি।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৯ এপ্রিল ২০২৪

call-of-aipwaprogressive-womens-association

কি ভাবছেন?

বিজেপি নারীদের পক্ষে আছে?

আমরা তাহলে কেন বিজেপিকে ভোটে হারাতে বলছি?

আপনার ভোট পাঁচ বছরের জন্য কেন্দ্রে একটা সরকার নির্বাচিত করবে, যে সরকার কেন্দ্রে গিয়ে আমাদের ভালো থাকা অর্থাৎ আপনার আমার জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চাকরি, ন্যায্য মজুরি, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি সুনিশ্চিত করবে।

গত ১০ বছর শাসন করল বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার।

মহিলারা কী পেল এই দশ বছরে? আসুন দেখি,

বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও

এই প্রকল্পে কেবল প্রচারেই ব্যবহার হয়েছে ৮০ শতাংশ টাকা। বাস্তবে বেটিদের নয় ধর্ষকদের পাশেই থেকেছে বিজেপি। বিজেপি একমাত্র দল যারা ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করে। কাঠুয়ায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যার পরে ধর্ষকের সমর্থনে জাতীয় পতাকা হাতে মিছিল করেছে বিজেপির বিধায়ক। হাথরসে দলিত মেয়ে ধর্ষণ হওয়ার পর প্রমাণ লোপাটের জন্য রাতের অন্ধকারে ধর্ষিতার দেহ পুড়িয়ে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।

বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ শেঙ্গার উন্নাওতে এক তরুণীকে ধর্ষণ করার পর, তরুণী ও তাঁর পরিবার বিচার চাইতে গেলে, মেয়ের বাবাকে গ্রেফতার করে জেলের মধ্যে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তরুণীকেও লরির তলায় পিষে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। বিজেপি শাসিত মণিপুরে তিন আদিবাসী মহিলা’কে নগ্ন প্যারেড করানো হয়েছে।

অলিম্পিক জয়ী মহিলা কুস্তিগিররা বিজেপির সাংসদ ব্রিজভূষণ সিং এর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলে, সেই ব্রিজভূষণকেই পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছে সরকার। নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু’কে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন ব্রিজভূষণ।

বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সাজা ফুরানোর আগেই মুক্ত করে দিয়েছিল গুজরাট সরকার।

প্যারোলে মুক্ত রাম রহিম সহ অনেক ধর্ষক।

ঊজ্বলা যোজনা

প্রাথমিকভাবে কিছু মহিলারা উনুন, গ্যাস পেলেন বটে, ভর্তুকিও এল। তারপর গ্যাসের দাম হু-হু করে বাড়লো আর ভর্তুকি কমতেই থাকল। তাই গরিব পরিবারের গ্যাস সিলিন্ডারে নয়, ভরসা হল সেই কাঠ কুটো।

সংবিধান নয়, দেশ চলবে ধর্মীয় অনুশাসনে

ক্ষমতায় আসার পর থেকে মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবন, অধিকার ও স্বাধীনতার উপর হামলা নামিয়ে আনা হচ্ছে।

কর্ণাটকে শুধুমাত্র হিজাব পরে স্কুলে যাবার জন্য মুসলিম ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা হয়েছে। অথচ শিক্ষা সমস্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

হিন্দু মেয়ে মুসলমান ছেলের স্বাভাবিক প্রেম বিবাহকে মুসলমান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করার ষড়যন্ত্র বলে তাকে ‘লাভ জিহাদ’ হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করে চলেছে বিজেপি-আরএসএস। বর্তমানে এই বিয়ে আটকাতে আইনও পাশ হয়েছে বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে। এইভাবেই তারা নারীর শরীর, নারীর ইচ্ছার উপর দখলদারি চালাতে চায়।

নারীদের ক্ষমতায়ন, নারী সশক্তিকরণ মোদীর নারীদের সশক্তিকরণের লম্বা চওড়া ভাষণের সাথে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের বাস্তবের আকাশ পাতাল পার্থক্য।

ভোটের আগে সংসদে নারীদের ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ আইন পাশ করে মোদী নাকি নারীর ক্ষমতায়ন করলেন বলে চমক দিলেন, কিন্তু ২০২৪ নির্বাচনে সেটি লাগু করলেন না কেন?

আমাদের দেশে ৭৩.২ শতাংশ গ্রামীণ মহিলা কৃষি কাজের সাথে যুক্ত, কিন্তু ভারতে কৃষিজমির ১৩ শতাংশেরও কম মহিলাদের মালিকানাধীন। কৃষি মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে (২০২০-২১) ভারতে মহিলা ক্ষেতমজুর গড়ে দৈনিক ৮৮ টাকা কম পান পুরুষদের দৈনিক মজুরির (৩৮৩ টাকা) থেকে।

ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৩-এ মহিলাদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুযোগের ক্ষেত্রে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪২তম।

১০০ দিনের কাজে গ্রামীণ মহিলারাই বেশি যুক্ত, কিন্তু ১০০ দিনের প্রকল্পকেও মোদী সরকার ক্রমেই গুটিয়ে নিয়ে আসছে। ফলত কাজের অভাবে মহিলারা কম মজুরিতে বহু পেশার সাথে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন।

এমএসপি গ্যারান্টি আইন, ঋণমুক্তি, শস্যবীমা, ফসলের ক্ষতিপূরণ সহ কৃষক আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলিকে কোনো মান্যতাই দেওয়া হচ্ছে না। উল্টে কৃষিতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে কর্পোরেটদের বিপুল পরিমানে কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

বিজেপি’র ক্ষমতায় আসার ১০ বছর পরে আজ দেশের বেকারত্বের হার বিগত চার দশকে সবচেয়ে বেশি। জানেন নিশ্চয়ই মেয়েরা বেশি পরিমাণে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ না পেলে দেশের অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে না।

বিজেপি কি হিন্দু নারীদের পক্ষে?

তাহলে অসমে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ যাওয়া বেশিরভাগ নাম হিন্দু নারীদের কেন?

সম্প্রতি সারা দেশে সিএএ আইন পাশ হয়েছে। আচ্ছা বলুন তো মতুয়ারা তো এই দেশের নাগরিকই। তারা ভোটে দাঁড়ায়, ভোট দেয়। মতুয়া সম্প্রদায় থেকে আসা শান্তনু ঠাকুর নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ। তাহলে মতুয়াদের সরকার নাকি নাগরিকত্ব দেবে এই ভাওঁতা দেওয়া হচ্ছে কেন? আর এইটা জানেন নিশ্চয়ই, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কাগজ দেখাতে হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মেয়েরাই। কারণ বেশিরভাগ মেয়েদের না আছে স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট, না আছে বাবার সম্পত্তিতে নাম, না আছে নিজস্ব জমি।

সব সরকারই নারীদের অধিকারের ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখায়। কিন্তু বিজেপির মতো ফ্যাসিবাদী শক্তি মতাদর্শগতভাবে নারী অধিকারের বিরোধী। এদের আদর্শ হলো মনুসংহিতা মেনে মেয়েদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা। কিন্তু মেয়েদের স্বাধীনতা কদাপি নয়।

তাই মেয়েরা এক হোন।

এইবারের নির্বাচনে পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপি সরকারকে পরাস্ত করুন।

জুমলা নয় জবাব চাই,

১০ বছরের হিসাব চাই।

বিজেপিকে একটি ভোটও নয়।

ambedkas-birth-anniversarycelebrated-in-jadavpur

১৪ এপ্রিল ডাঃ বি আর আম্বেদকরের জন্মদিবস উপলক্ষে যাদবপুর ১০৯ নম্বর ব্রাঞ্চ এবং এলাকার সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে একটি কর্মসূচি পালিত হয়। ভারতের সংবিধান রচয়িতা ডাঃ বি আর আম্বেদকরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শুরুতে ভারতের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তাঁর অবদান এবং গণতন্ত্রকে বাঁচাতে বক্তব্য রাখেন ব্রাঞ্চের সম্পাদিকা স্বপ্না, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির কলকাতা জেলা সম্পাদিকা চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, ঢাকুরিয়া-যাদবপুর লোকাল কমিটি সম্পাদক বাবুন চ্যাটার্জি এবং কলকাতা জেলা পার্টি সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী। সমগ্র কর্মসূচিটি পরিচালনা করেন ১০৯ নম্বর ব্রাঞ্চের সম্পাদিকা স্বপ্না চক্রবর্তী।

corruption-in-the-state-centers-propaganda-exposedcenters-propaganda-exposed

একশ দিনের কাজ নিয়ে রাজ্য সরকারের দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে বিগত দিনগুলোতে বিস্তর চাপান উতর চলেছে। ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০২১’র ডিসেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে বকেয়া মজুরি প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নরেগা আইনের ২৭নং ধারা প্রয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপর, রাজ্যে পাঠানো হয় ১৬টি কেন্দ্রীয় টিম। তারা নাকি অনুসন্ধান, খোঁজ খবর নিয়ে বিস্তর অনিয়ম, টাকা নয়ছয়, ভুয়ো জবকার্ডের অস্তিত্ব খুঁজে পান। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই সমস্ত অভিযোগকে অস্বীকার করে গোটা ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির পাল্টা অভিযোগ করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান রাজ্য সরকারের বক্তব্যকেই জোরালো করল।

কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত পরিসংখ্যান জানিয়েছে, পশ্চিমবাংলায় সমস্ত জবকার্ডকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর দেখা যাচ্ছে রাজ্যের ৯৯.৯৮ শতাংশ জবকার্ডই আসল আর তাতে কোনো গরমিল ধরা পড়েনি। 

২০২৩-২৪’র অর্থবর্ষে ১৩,৬৬২,৬০১ কার্ড যাচাই করা হয়। দেখা গেছে, তার মধ্যে ১৩,৬৫৮,৫৪২ কার্ডের কোনো গন্ডগোল নেই। এটাও কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বিলি করা ৯,২৫৮,৩২৮ কার্ডই সক্রিয় বা অ্যাক্টিভ আর তার মধ্যে ৯,২৫৬,৪৫৭ কার্ডকেই যাচাই করা হয়। অর্থাৎ, ১.৩৬ কোটি কার্ডের মধ্যে মাত্র ৪,০৫৯টি কার্ড এখনও যাচাই করা হয়নি, যা সমগ্রের মাত্র ০.০২ শতাংশ! আর, এনিয়েই কেন্দ্রীয় সরকার, সমস্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিরাট হৈচৈ তুলে গরিব গ্রামীণ মজুরদের ন্যায্য প্রাপ্য মজুরি আটকে রেখে দিয়েছে।

ইন্ডিয়া টুডের পক্ষ থেকে স্বাধীন এক অনুসন্ধান রিপোর্ট একই তথ্য প্রকাশ করেছে।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এ’বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ২৫ লক্ষ ভুয়া জবকার্ড তৈরি করেছে। এর জবাবে রাজ্য সরকারের এক আধিকারিক জানান, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ পর্যন্ত যে ২৫ লক্ষ জবকার্ড বাতিল করা হয়, তার সবটাই ভুয়ো ছিল না। জবকার্ড বাতিল হয় প্রচলিত নিয়মানুসারে। কোনো ব্যক্তি কাজ না করলে, বা অন্য রাজ্যে রুটি রুজির সন্ধানে পাড়ি দিলে তা বাতিল হয়। তিনি আরও জানান, ৫,৯৫৬ কার্ড ভুয়া ছিল, যা বাতিল করা হয়।

এদিকে, একশ দিনের কাজে এ’রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা বকেয়া রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

আসন্ন নির্বাচনে গ্রাম বাংলায় এটা এক বড় ইস্যু হয়ে সামনে আসবে।

- ইন্ডিয়া টুডে, ৫ এপ্রিল ২০২৪

workers-are-not-getting-the-minimum-wagethe-minimum-wage

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কৃষিকাজে যুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ছিল ৩০০ টাকা, আর নির্মাণ শিল্পে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য (সি টাইপ) তা ছিল ৩৫০ টাকা।

সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে, কৃষিকাজে যুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল, তার মধ্যে ৪০.৮ শতাংশ নিয়মিত শ্রমিক ও ৫১.৯ শতাংশ ক্যাজুয়াল শ্রমিক সেই নির্ধারিত মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়।

নির্মাণ শিল্পে নিযুক্ত ৩৯.৩ শতাংশ নিয়মিত শ্রমিক এবং ৬৯.৫ শতাংশ ক্যাজুয়াল শ্রমিক এই শিল্পে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত মজুরি পাননি।

- ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪

crore-rupees-recovered-from-bjp-candidaterecovered-from-bjp-candidate

তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলি লোকসভা আসনে বিজেপির প্রার্থী নৈনার নাগেরত্থানের নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করার জন্য অবৈধ ৩.৯৮ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করল কেন্দ্রীয় নির্বাচনী আধিকারিক। আদর্শ আচরণ বিধি চালু হওয়ার পর এটাই ছিল তামিলনাড়ুতে সবচেয়ে বড় পরিমাণে টাকা বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা।

বিজেপি প্রার্থীর হয়ে যারা সেই টাকা ট্রেনে গোপনে নিয়ে যাচ্ছিল, গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশকে জানায় ভোটারদের মধ্যে সেই টাকা বিলি করার জন্য এই বিপুল পরিমাণে টাকা বিজেপি প্রার্থীর দু’জন অনুগামী চেন্নাই-এগমোর নেল্লাই সুপারফাস্ট ট্রেনে যাচ্ছিল। পুলিশের কাছে গোপন খবরের ভিত্তিতেই এক বিশেষ দল তাম্বারাম রেল স্টেশনে শনিবার আকস্মিক হানা দিয়ে তা নিজেদের হেফাজতে নেয়। তাড়া তাড়া ৫০০ টাকার নোট পুলিশ উদ্ধার করে তাদের কাছ থেকে।

চরম অস্বস্থিতে পড়ে বিজেপি এখন কিভাবে নিজের ভাবমূর্তি উদ্ধার করবে, তার রাস্তা খুঁজছে।

- দ্য হিন্দু, ৭ এপ্রিল ২০২৪

voted-for-a-dignified-financial-lifea-dignified-financial-life

আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়দের সামনে প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। সিএসডিএস-লোকনীতি’র প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষা থেকে এই তথ্যই উঠে এল।

প্রায় সকলেই বলেছেন, গত পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক কমে গেছে। আবার, তার হাত ধরে মাথা তুলেছে মূল্যবৃদ্ধি। এই যুগ্ম সমস্যা অধিকাংশ পরিবারের আর্থিক জীবনের মানকে নিচের দিকে নামিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে এই দুটি বিষয় প্রভাব ফেলবে।

সমীক্ষায় ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মনে করেন, এখন কাজ পাওয়াটা রীতিমতো কঠিন হয়ে গেছে। কর্মহীনতা এতটাই প্রকট যে তা আর গ্রাম-শহরের বিভাজন রেখা মানছে না।

সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মানুষই জানিয়েছেন, বড় বড় শহরে, ছোট শহরতলীতে, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও শোভন কাজ জোগাড় করাটা বেশ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, কর্মসংস্থানের বিষয়টিতে লিঙ্গ অসাম্যও বেশ প্রকট। নারীদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমেই কমে আসছে।

সমীক্ষায় ৭১ শতাংশ মানুষ মনে করে, গত পাঁচ বছরে মূল্যবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধি সমস্ত স্তরের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন গরিব, নিম্ন আয় সম্পন্ন পরিবার এবং প্রান্তিক গ্রামীণ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা। ব্যাপক সংখ্যক ভারতবাসীর অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্তসীমায় চলে যাওয়াটা দেশের আর্থিক অসাম্যকে অনেক চওড়া করে দিয়েছে।

চলমান আর্থিক সংকট নতুন এক মাত্রা পেয়েছে। সমস্ত সামাজিক স্তর মনে করে, বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের আর্থিক জীবনে বড় ধরনের সংকট নিয়ে এসেছে। দলিত, আদিবাসী এবং মুসলিমরা এ’প্রশ্নে অনেক সোচ্চার। ৬৭ শতাংশ মুসলিম জানিয়েছেন, তাঁদের কাজ পাওয়াটা ক্রমেই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ৭৬ শতাংশ মুসলিম ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে খুব চিন্তিত। সমীক্ষা দেখিয়েছে, তৃণমূলস্তরে আর্থিক প্রশ্নগুলো সামাজিক অবস্থানের আয়নায় বিবেচিত হচ্ছে।

সমীক্ষায় অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। ২১ শতাংশ মানুষ মনে করেন বেকারত্বের জন্য কেন্দ্র এবং ১৭ শতাংশ মনে করেন রাজ্য সরকার এরজন্য দায়ী। আর, ৫৭ শতাংশ উভয় সরকারকেই দায়ী করেছেন।

favored-religious-pluralismfavored-religious-pluralism

সিএসডিএস-লোকনীতি প্রাক নির্বাচনী পর্বে যে সমীক্ষা করে, তাতে উঠে এল চমৎকার এক তথ্য। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় (৭৯ শতাংশ) ধর্মীয় বহুত্বের পক্ষেই নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন।

সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের দেশ ভারতবর্ষ — এই বক্তব্যের পক্ষে সহমত পোষণ করেন ৭৯ শতাংশ ভারতীয়। আর, মাত্র ১১ শতাংশ মনে করেন ভারত হল হিন্দুদেরই দেশ। ১০ শতাংশ কোনো মতামত দেননি।

সবচেয়ে আশার ব্যাপার, ৭৩ শতাংশ বয়স্ক ভারতীয় অপেক্ষা ৮১ শতাংশ তরুণ ধর্মীয় বহুত্ববাদের পক্ষেই জোরালো মত ব্যক্ত করেন।

সমীক্ষা থেকে উঠে আসা মতামত যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, নীচুতলায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মিলে মিশে ধর্মীয় সৌহার্দ বজায় রেখে চলাটাই এখনও দস্তুর হয়ে রয়েছে, রাজনৈতিক জগতে যতই অপর ধর্ম সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানো হোক না কেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে ভারতকে ধর্মীয় বহুত্ববাদী দেশ হিসাবে গণ্য করাটা স্বাভাবিক, কিন্তু সংখ্যাগুরু ধর্মীয় মতাবলম্বীদের তরফ থেকে মনে করা যে ভারতে সমস্ত ধর্মের সমান মর্যাদা ও বিশ্বাস নিয়ে বসবাস করাটাই হচ্ছে ভারত অর্থের বৈশিষ্ট্য, এই সমীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি।

our-countrys-economy-nowcountrys-economy-now

আমাদের দেশের অর্থনীতির হাল কেমন এখন তা একটু বোঝার জন্য এই লেখাটা বানানো। আমরা মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে পড়ি ভারত অর্থনীতির মাপে একদিন ৩ নম্বর দেশ হয়ে যাবে।

এই দাবিটার মাঝে কয়েকটা ফাঁক ফোকর আছে, সেটা বোঝা দরকার।

এর একটা মানে হতে পারে অর্থনীতিতে সামনের সারির দেশগুলো এগোচ্ছে বা একজায়গায় রয়ে গেছে, আর আমরা তাদের থেকে বেশি এগিয়ে যাচ্ছি।

আসলে তা নয়।

আমরা এগোচ্ছি না।

আমাদের আগে থাকা দেশগুলোয় সংকট চলছে, তারা মাপে পিছিয়ে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে। আমরা যেখানে থাকার সেখানেই আছি, ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আমাদের আগের মাপের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছি না।

এ হল অঙ্কের মারপ্যাঁচ।

অন্যরা পিছিয়ে যাচ্ছে, আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, আর তাই বলা হচ্ছে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আমি আমারটা বাড়িয়ে বলছি।

আর একটা মাপের কথা বলা হচ্ছে।

আমাদের দেশে গরিবের সংখ্যা কমছে, কমবে। বেশ তাই যদি হবে তাহলে দেশের একটা বড়ো মাপের মানুষজনকে বিনা দামে খাবার, চাল, ডাল এমন সব দিতে হচ্ছে কেন? তারা নিজেদের আয়ে খাবার কিনতে পারছে না বলেই তো সরকারকে দিতে হচ্ছে। এই ধাঁচের অর্থনীতিকে বলে ‘ডোল অর্থনীতি’ বা ‘ভিক্ষে অর্থনীতি’।

কেন বিনা দামে দিতে হচ্ছে?

কারণ তারা কিনতে পারছে না বলে।

কেন তারা কিনতে পারছে না?

তারা কেনার মতো আয় করতে পারছে না বলে।

কেন তারা আয় করতে পারছে না?

আয় করার মতন অর্থনীতির অবস্থা নেই, অবস্থা বানানো যায়নি বলে। আয় করার মতন অবস্থা বানানো দরকার।

শুরু করা দরকার কৃষি থেকে।

কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয় কৃষি থেকে। সে গ্রামে চাষেই থাকুক, কী চাষের সাথে জড়িয়ে থাকা কাজেই থাকুক। সরকার চাষিদের জন্য কোনো নীতি বানায়নি। আমাদের দেশে কোনো ‘কৃষিনীতি’ নেই। এখানেই বেশিরভাগ মানুষের থাকা, কাজ করা, আর এখানকার জন্য কোনো সরকারি নীতি নেই।

এর ফলে আর একটা কাণ্ড হয়ে চলেছে। কৃষি ছেড়ে, চাষ ছেড়ে লোকজন চলে যাচ্ছে। যাদের এখন দেওয়া নাম ‘পরিযায়ী শ্রমিক’। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’রা যে কাজ করে, তা আজ আছে, কাল নেই, আজ এতোটা আছে, কাল অতোটা নেই, এ মাসে এবারে এতোটা টাকা রোজগার হলো, ও বারে/ও মাসে অতোটা টাকা হবে, তার কোনো ঠিক নেই। আজ এখানে আছো, কাল বাড়ি ফিরে যাও।

গ্রামকে, গ্রামের চাষবাসকে অবহেলা করার আর একটা উদাহরণ গ্রামের ভিতর দিয়ে, গ্রামকে ভেঙ্গে, গ্রামকে নষ্ট করে ‘হাইওয়ে’ বানানো। হাইওয়ে থেকে গ্রামে নামা যায় না, গ্রাম থেকে হাইওয়েতে ওঠা যায় না। গ্রামের একটা জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় যাওয়া যায় না। গ্রাম টুকরো হয়ে যাচ্ছে। তুলনায় গ্রামে রাস্তা তেমনটি বানানো হচ্ছে না। গ্রামের রাস্তা বানানো না হলে চাষবাসের ক্ষতি, গ্রামের অর্থনীতির ক্ষতি, গ্রামের মানুষজনের ক্ষতি।

উল্টোদিকে হাইওয়েতেই সরকারের বিরাট টাকা খরচ করা। তা বড়োলোকেদের জন্যই আর সাধারণ মানুষকে আটকানোর জন্য। আর একভাবে দেখা দরকার বিষয়টাকে। স্বাধীনতা পাবার পর থেকে কৃষিতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ, লগ্নী কমেই চলেছে।

কারণ ধরে নেওয়া হচ্ছে, আমাদের মনে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রাম, কৃষি এসব মানেই অউন্নয়ন, না-উন্নয়ন।

আর এই ‘না-উন্নয়ন’এর ভাবনাতেই আমরা ফেঁসে গেছি।

গ্রাম, চাষবাস মানে অ-উন্নয়ন, ফলে এখানে বিনিয়োগ কমিয়ে দাও।

বিনিয়োগ কমালে আয় কমবে, আয় কমলে চাহিদা কমবে। ব্যস্‌ এই ফাঁদে গ্রামকে, গ্রামের মানুষজনকে ফেলে দেওয়া। অবশ্যই গ্রামে বড়োলোকেরা, বড়ো চাষি, বড়ো ব্যবসাদার আছে। তাদের টাকা গ্রামে খরচ হয় না। হয় শহরে।

ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষজনের দু’বেলা ঠিকঠাক খাবার জোটে না। খাবার জোটে না বলে শরীরের দরকারি পুষ্টি নেই, পুষ্টি নেই বলে অসুখ বিসুখ, অসুখ বিসুখ হলে ওষুধ কেনার, ওষুধ পাবার উপায় নেই। যতটুকু কাজ করা তাও কমে যাওয়া, আরও গরীব হয়ে যাওয়া।

এখানেই সরকারি জোড়াতালি।

গ্রামবাসীরা নিজেরা খাবার যোগাড় করতে পারছে না, ঠিক আছে, বিনা পয়সায় খাবার দাও। ভিখারি বানিয়ে দাও।

গ্রামে স্বাভাবিক ভাবে কাজ বানানো যাচ্ছে না, ঠিক আছে, ১০০ দিনের কাজের ভিক্ষে দাও। খাবার-ভিখারি, কাজ-ভিখারি বানাও।

কাজ নিয়ে আর একটা দিক আছে। জরুরি দিক।

ভারতে ‘কাজ না-পাওয়ার’ পাশে রয়েছে দরকারের তুলনায় ‘কম কাজ পাওয়া’, কম মজুরিতে কাজ পাওয়া, আজ কাজ আছে, কাল কাজ নেই।

গ্রামের মানুষ গ্রামে ‘তেমন আয়ের কাজ’ না পেয়ে শহরে আসছে। শহরে আবার ঠিক তেমনি, শহরে ‘তেমন আয়ের কাজ’ না পেয়ে গ্রামে ফিরে আসছে। সব মিলিয়ে ‘ঠিকঠাক খেয়ে পরে থাকার কাজ’ না-থাকা।

আর একটা খারাপ দিক রয়েছে। গ্রামের লোকেরা কাজ পেতে পারতো ঠিকঠাক পড়াশোনা করতে পারলে। গ্রামে শিক্ষার দায় অবশ্যই সরকারের। আর শিক্ষাখাতে সরকারের খরচ সবসময় কম হয়েছে। এর সাথে মিলিয়ে দেখা দরকার গ্রামে সরকারের স্বাস্থ্য খাতে খরচ। এই খাতে খরচের পরিমাণ সব সময় দরকারের তুলনায় কম।

এবার, দুটো যোগ করে কি দাঁড়াচ্ছে?

খারাপ স্বাস্থ্য থাকলে খারাপ শিক্ষা পাওয়া, ঠিকঠাক লেখাপড়া করতে না পারা। খারাপ শিক্ষার জন্য যে কাজ পাওয়া তাতে রোজগার কম। রোজগার কম বলে শরীর খারাপ। শরীর খারাপ হলে কাজ না পাওয়া। একটার সাথে অন্যটা জড়িয়ে।

অন্য একটা দিক দিয়েও দেখা যায়।

মা বাবা অসুস্থ হলে সন্তান অসুস্থ হয়। সন্তান অসুস্থ হলে তার লেখাপড়া ঠিকঠাক হয় না। লেখাপড়া ঠিকঠাক হয় না বলে ঠিকঠাক কাজ পায় না। এইভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা চাকরি এক চলমান সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। দারিদ্রের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে।

ফলে ‘দারিদ্রের মাপ’ শুধুই ‘আয়’ নয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজ, খাবার, আয় সব মিলিয়েই দারিদ্রের মাপ।

আর দারিদ্রের একটা মাপ হয় না। নানা মাপ হয়। ‘হত দরিদ্র মানুষ’, ‘সরকারের কষে দেওয়া দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষজন’, ‘যে কোনো সময় দরিদ্র হয়ে যেতে পারে এমন লোকজন’।

অন্য আর একভাবেও দেখা যায়।

‘উপরে থাকা’দের সাথে ‘নিচে রেখে দেওয়া’দের তুলনার মাপে।

উপরে থাকা দেশের ১০ শতাংশ লোকের অবস্থা প্রতিদিন ভালো, আরও ভালো হয়ে চলেছে। আর নিচে রেখে দেওয়া ৫০ শতাংশ দেশবাসীর অবস্থা খারাপ, আরও খারাপ হয়ে চলেছে। এখানেও ‘একটা’ হচ্ছে বলেই ‘আর একটা’ হচ্ছে। একটার সাথে অন্যটা জড়িয়ে আছে।

ধরা যাক দেশের মোট আয় ১০০ টাকা। তলার দিকে থাকা লোকেরা যত কম আয় করবে, সেই টাকাটা উপরের দিকে থাকা লোকেদের হাতে চলে যাবে। এদের কমলে ওদের বাড়বে। আর তলার দিকে থাকা লোকেদের তো কোন অধিকার নেই। ফলে যে কোনো বিষয়ে তাদের ওপর আঘাত নামিয়ে আনা যায়। কয়েকটা উদাহরণ, নোটবন্দি, জিএসটি বসানো, কোভিডে অনেক দিন সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া। এসব তলার দিকে থাকা লোকজনকে আঘাত করেছে। আর এই তলার দিকেই রয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের লোকজন। এদের কোনো অধিকার নেই, এদের জন্য কোনো আইন নেই, সরকারি মদত নেই। আর এটা বুঝতে পেরেই আস্তে আস্তে অর্থনীতির একটা বড় অংশকে ‘অসংগঠিত’ করে তোলা হচ্ছে, ‘অ-আইনি’ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, না-অধিকারে নিয়ে ফেলা হচ্ছে। কৃষি ‘অসংগঠিত’ বিষয়, কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ‘অসংগঠিত’ বিষয়, পরে কারখানা খোলা সে’ও ‘অসংগঠিত’ বিষয়, শিক্ষা ‘অসংগঠিত’ বিষয়।

সবচেয়ে বেশি ‘অসংগঠিত’ করে তোলা হচ্ছে সরকারি কাজের জায়গাকে। ফলে সেখানে যারা কাজ পাচ্ছে তাদের সংখ্যাটা কাজ-না-পাওয়াদের তালিকায় নেই, কাজ পাওয়াদের তালিকায় আছে। আর সেই তালিকার সংখ্যাটা দেখিয়ে আমাদেরকে কাজ পাওয়ার ভুল অঙ্কটা দেখানো হচ্ছে। বেকারের সংখ্যা কম দেখানো হচ্ছে। ভিতরের গল্পটা আড়াল করা হচ্ছে, আমরাও ভুল বুঝছি। যারা কাজ পেয়েছে বলা হচ্ছে, তাদের বেলায় বলা হচ্ছে না তাদের কোনো সামাজিক সুরক্ষার অধিকার নেই। আমাদের কাছে যা দেখানো হচ্ছে, আমরা তার বাইরেটা দেখে মেনে নিচ্ছি, ভেতরটা দেখছি না, ভেতরটা চেপে রাখা হচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারের দাবি, তথ্য, অঙ্ক, হিসেব, কথা মেনে নিচ্ছি।

যা নয়, তাই মেনে নিচ্ছি।

এবার যাচাই করে নেওয়া শুরু করা যাক।

সবাই মিলে। যে যার জায়গার হাল নিজেদেরই বুঝে নেওয়া দরকার।

অন্যদেরকে জানানো দরকার।

- বিশ্বজিৎ ধর এবং শুভেন্দু দাশগুপ্ত

drug-companies-to-the-ruling-partycompanies-to-the-ruling-party

ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে ওষুধ কোম্পানিগুলির মোটা টাকা ঘুষ শাসকদলগুলোকে বিনিময়ে লাগামহীন ওষুধের দাম বৃদ্ধি সহ নিম্নমানের ওষুধের অবাধ ছাড়পত্র প্রতিবাদে সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের প্রেস কনফারেন্স

সম্প্রতি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ওষুধ কোম্পানিগুলো কে কত টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে তার একটি আংশিক তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে আজ হয়তো মানুষের মনে সন্দেহ জাগছে ওষুধের বাজারমূল্য কেন এত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ ওষুধের গুণমান নিয়ে হয়তো অতটা চিন্তিত নন। যতটা চিন্তা করেন ওষুধের দাম নিয়ে। কোন কোম্পানির কী ওষুধ, কী কাজ করে তা নিয়েও মানুষ হয়তো ততোটা ভাবিত নয়। তারা রোগভোগে একটু ওষুধ পেলেই খুশি থাকে। তা সে হাসপাতালের বিনা পয়সার ওষুধই হোক, কিংবা ডাক্তার না দেখিয়েই পাশের ওষুধের দোকানের ছেলেটির কাছ থেকে পয়সা দিয়ে দুটো ওষুধ পেলেই হল। কিন্তু অনেক ওষুধ খেয়েও রোগ না সারলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কেন জানিনা মানুষের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে কোনো না কোনো ডাক্তারের উপর। সচেতন কিছু মানুষ অবশ্যই ওষুধের গুণমান নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু তাদের অনেকেরই গাটের কড়ি খরচ করে দামি কোম্পানির ওষুধ কেনার ক্ষমতা থাকে না। ফলে তারা সরকারের জনমোহিনী বিভিন্ন জনঔষধি প্রকল্প কিংবা পিপিপি মোডের ন্যায্যমূল্যের দোকানের খপ্পরে গিয়ে পড়েন। কমদামে অনেক ওষুধ! কিন্তু তার মান কে যাচাই করছে।

ইলেক্টোরাল বন্ডের বিষয়টি সামনে আসতে আজ সমাজের যে অংশের মানুষ কিছুটা হলেও সচেতন এবং যাদের অর্থবল রয়েছে তারাও কি ওষুধের গুণমান সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারছেন? তথ্য কী বলছে?

গত ১৪ মার্চ ২০২৪ নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে ইলেক্টোরাল বন্ডের মারফত ৩৫টি ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থা ভোট সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট তহবিলে অনুদান হিসেবে দিয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭টি বৃহৎ কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধের গুণমান পরীক্ষায় ফেল করার পরে ঐসব বন্ড কিনেছে এবং যথারীতি ফেল করা ঐসব ওষুধগুলোও বাজারে রমরমিয়ে চলছে!

এদের মধ্যে কয়েকটির উদাহরণ দেখা যাক।

ক) কোম্পানির নাম গ্লেনমার্ক : ২০২২’র নভেম্বরে এই ওষুধ কোম্পানিটি ৯.৭৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। পেছনের ইতিহাসটা কী? তাদের উৎপাদিত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ‘টেলমা’ বারংবার ল্যাবরেটোরিতে গুণমান পরীক্ষায় ডাহা ফেল। এরজন্য ২০২২-২৩ সালে কমপক্ষে পাঁচ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফল কী হল? ঐ ইলেক্টোরাল বন্ডের নীচে চাপা পড়ে গেল গুণমান পরীক্ষার রিপোর্ট।

খ) ঠিক একই রকম ভাবে ‘সিপলা’ কোম্পানি তার উৎপাদিত ওষুধ ‘Ramdicivi’র, যা এক সময়ে করোনার আতঙ্ক থেকে বাচতে মানুষ চড়া দামে কিনতে বাধ্য হয়েছিল। গুণমান পরীক্ষায় ফেল করা সত্ত্বেও মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেদিন চড়া দামে মানুষকে কিনতে বাধ্য করা হয়েছিল। আজ প্রকাশ্যে আসছে কোম্পানিটি ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ২৫.২ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে তার কথা।

এর আগেও ঐ কোম্পানির উৎপাদিত কফ সিরাপ ‘আরসি কফ’ ল্যাবোরেটরি টেষ্টে ফেল করেছিল। এবং পরের বছর কোম্পানিটি ১৪ কোটি টাকার বন্ড কেনে।

গ) এরপরে আরেকটি অত্যন্ত নামীদামি কোম্পানির কথায় আসা যাক। কোম্পানিটির নাম ‘টোরেন্ট ফার্মা’। যে কোম্পানি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাটেই প্রধাণত উৎপাদন করে। এর ইতিহাস কী? এই কোম্পানিটির উৎপাদিত ওষুধ স্যালিসাইলিক অ্যাসিড গুণমান পরীক্ষায় ফেল করে ২০১৮ সালে। ঐ বছরই এই কোম্পানির উৎপাদিত আরেকটি ওষুধ ‘ডেপল্যাট ১৫০’কেও নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে মহারাষ্ট্রের ফুড অ্যাণ্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। আবার ২০১৯-তে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ‘লোসার এইচ’কে নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে গুজরাটেরই ফুড অ্যাণ্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্টেশন। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে হার্টের ওষুধ ‘নিকোরান এলডি’ মহারাষ্ট্রের ফুড অ্যাণ্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গুণমান পরীক্ষায় অনুতীর্ণ হয়। ২০২৩’র ফেব্রুয়ারিতে ঐ কোম্পানির ডায়েরিয়ার ওষুধ ‘লোপামাইড’ও গুণমান পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে। এতগুলো জীবনদায়ী ওষুধ গুণমান পরীক্ষায় ফেল করার পরেও ওষুধগুলো বাজারে রমরমিয়ে চলছে! এর পেছনে রসায়নটা কী? ২০১৯ থেকে ২০২৪’র জানুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটি ৭৭.৫ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে। হায়রে মোদীর মনকে বাত!

ঘ) এরপরে আসা যাক, আইপিসিএ ল্যাবোরেটরিজ লিমিটেডের কথায় : ২০১৮’র অক্টোবর মাসে তাদের তৈরি অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধ ‘ল্যারিয়াগো’র কথায়। যে ওষুধে কম মাত্রায় ক্লোরোকুইন আছে বলে পরীক্ষায় ধরা পড়েছে — মুম্বাই ড্রাগ রেগুলেটরের দ্বারা। অথচ এই রিপোর্ট পরে পাল্টে যায় উত্তরাখন্ডের ড্রাগ রেগুলেটরের দ্বারা। খোজ নিয়ে দেখা গেল ঐ কোম্পানি ২০২২ থেকে ২০২৩’র অক্টোবরের মধ্যে ১৩.৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে।

ঙ) ‘জাইডাস হেলথকেয়ার’ মূলত গুজরাটে অবস্থিত এই ওষুধ কোম্পানির তৈরি ‘রেমডিসিভিরের’ একটা ব্যাচের ওষুধের মধ্যে ব্যাক্টোরিয়া জাত এন্ডোটক্সিন পায় বিহার ফুড অ্যাণ্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং একে নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে। পরে এই ওষুধ ব্যবহারের ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও ঘটে। অথচ গুজরাটের ড্রাগ রেগুলেটরি অথরিটি এই ওষুধের নমুনা পর্যন্ত সংগ্রহ করলো না। ফলে কোভিডের আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটি নিম্নমানের ও ক্ষতিকারী এই ওষুধটি চড়া দামে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করলো। আর আজ প্রকাশিত হচ্ছে — কোম্পানিটি ২০২২ এবং ২০২৩ সালের মধ্যে ২৯ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে।

এছাড়াও বড় বড় কোম্পানিগুলির মধ্যে ডক্টর রেড্ডিজ ল্যাবোরেটরি ৮৪ কোটি টাকা, সিরাম ইনস্টিটিউট ৫২ কোটি টাকা, সান ফার্মা ৩১.৫ কোটি টাকা সহ দেশের মোট ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি ১ হাজার কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। বলাই বাহুল্য যেখানে দেশে ওষুধ পরীক্ষার ল্যাবরেটরির বিপুল ঘাটতি থাকায় বেশিরভাগ ওষুধ টেস্ট করাই হয় না। অথবা টেস্টে পাঠানোর পরে রিপোর্ট আসতে এতটাই দেরি হয়, যখন গুণমান পরীক্ষায় ফেল করা ওষুধও ঐ সময়ের মধ্যে ব্যবহার করা হয়ে যায়। যতটুকু পরীক্ষায় ধরা পড়ে, যা কার্যত হিমশৈলের চূড়া মাত্র; তা শাসক দলের নির্বাচনী তহবিলে কয়েক কোটি ঢেলে দিলেই কালা রিপোর্ট সাদা হয়ে যায়। শাসকদল এবং সরকারের বদান্যতার সুযোগ নিয়ে ঐ কোম্পানিগুলি জনগণের পকেট কেটে আরো বহুগুণে মুনাফা অর্জন করতে থাকে।

চ) এরপর আসা যাক, কোভিড ভ্যাক্সিন কেলেঙ্কারির কথায়। সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিপুল ঘাটতি এবং সরকারি উদাসীনতা ও ভ্রান্ত স্বাস্থ্য পরিকল্পনার ফলে কোভিডে আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ যখন কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মুখে ঢলে পড়ছে। রাজ্যে রাজ্যে গণচিতা জ্বলছে। লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ পরিত্রানের পথ খুজছেন। তখন মোদীজী মানুষকে থালা বাজাও, তালি বাজাওয়ের নিদান দিচ্ছেন। তারই অনুগামীরা মানুষকে গোমূত্র ও গোমোই সেবনের নিদান দিচ্ছেন। অন্ধ ভক্তগণ অনেকেই তা সেবন করে চলেছেন। তখন মোদীজী শুধু এর মধ্যেই থেমে থাকেননি। তিনি ভারতবাসীর প্রাণ বাঁচানোর দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিলেন এবং ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের পূর্বেই কবে থেকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হবে তার দিনক্ষন ঘোষণা করে বসলেন। অথচ বিজ্ঞান বলছে জরুরি ভিত্তিতেও ফাস্ট ট্রাক ট্রায়ালের মাধ্যমেও ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল শেষ করতে গেলে ন‍্যূনতম যে সময় লাগে তার অর্ধেক সময়ও তিনি দিলেন না। ফলে ট্রায়াল শেষের আগেই মোদীজীর আশির্বাদে সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ভ্যাক্সিন ‘কোভিশিল্ড’ ছাড়পত্র পেয়ে গেল! মানুষও সাতপাচ অত না ভেবে গদোগদো চিত্তে মোদী সরকারকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করতে লাগলো।

আজ প্রকাশ্যে আসছে ২০২২ সালের ১ আগস্ট, ২ আগস্ট ও ১৭ আগস্ট সিরাম ইনস্টিটিউটের মালিক কিভাবে ৫০ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে। তারপর ঐ কোম্পানির CEO আদার পুনাওয়ালা ২৩ আগস্ট ২০২২ সাক্ষাৎ করছেন মোদীজীর সাথে আর সাথে সাথেই ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই কিভাবে ছাড়পত্র পেয়ে গেল ‘কোভিশিল্ড’। অতীতের সমস্ত নজির ছাড়িয়ে এর দাম ধার্য করা হলো ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে। অতীতে ভ্যাক্সিন যেখানে সারা বিশ্বজুড়েই বিনামুল্যেই দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সেখানে এই রকম একটা চড়া দাম ধার্য করা হল। এবং মানুষকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এই দামে নিতে বাধ্যও করা হলো। পরে দেশজুড়ে আন্দোলনের চাপে সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করে চড়া দামে সিরাম ইনস্টিটিউটের থেকে কিনে নিয়ে বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতাল থেকে কিছু মানুষকে ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা করলো। পাশাপাশি ঐ কোম্পানি বাজারে চড়াদামে কোভিশিল্ড বিক্রি করতে থাকলো। মানুষের মধ্যে ভয়ে আতঙ্কে ভ্যাক্সিন নেওয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। বছর শেষে দেখা গেল ঐ কোম্পানির মালিক সাইরাস এস পুনাওয়ালার ঘরে মুনাফা জমলো ১ হাজার কোটি টাকা। আর ঘুর পথে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির ঘরে গেল ৫০০ কোটি। সবটাইতো জনগণেরই টাকা। অথচ মানুষ এখনো জানতেই পারলো না কোভিশিল্ডের ক্রিয়া এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া কী কী হয়েছে!

ছ) ইতিমধ্যে খবরে প্রকাশ হয়েছে — দক্ষিণ ভারতের অরবিন্দ ফার্মা কোম্পানির (২০২২-২৩-এ যার নিট মুনাফা ছিল প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা) ডিরেক্টর পি শরৎচন্দ্র রেড্ডির বয়ানের ভিত্তিতে ইডি দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করেছে। এই ভদ্রলোক ১০ নভেম্বর ২০২২ ইডির হাতে গ্রেফতার হন ও ১ জুন ২০২৩ রাজসাক্ষী হয়ে যান। এর আগে এপ্রিল ২১ থেকে অক্টোবর ২২ পর্যন্ত এই কোম্পানি ২২ কোটি টাকার বণ্ড কেনে যার মধ্যে বিআরএস ১৫ কোটি, বিজেপি ৪.৫ কোটি ও টিডিপি (তেলেগু দেশম পার্টি) ২.৫ কোটি টাকা পেয়েছিল।

ঘটনাক্রম লক্ষ্য করুন, গ্রেফতারি, বয়ান দেওয়া ও রাজসাক্ষী হওয়ার পর ৮ নভেম্বর ২০২৩-এ এই কোম্পানি ২৫ কোটি টাকার বণ্ড কেনে যার সবটাই যায় বিজেপির ঘরে! ইলেক্টোরাল বণ্ডের কি মহিমা!

ইতিপূর্বে সরকার বহুবার জাতীয় ওষুধ নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে ভেষজ নীতিকে আজ চূড়ান্ত জনবিরোধী করে তুলেছে। ড্রাগ প্রাইসিং অথরিটিকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগিয়ে সরকার দফায় দফায় অত্যাবশ্যকীয় এবং জীবনদায়ী ওষুধের দাম বিনিয়ন্ত্রিত করে চলেছে। এমনিতেই ওষুধ কোম্পানিগুলো তার উৎপাদন খরচের উপর মোটামুটি ১ হাজার থেকে ৩ হাজার শতাংশ পযর্ন্ত লাভ করে থাকে। তার উপরে ওষুধের বাজার দর বিনিয়ন্ত্রণের ফলে এবং ওষুধের গুণমান পরীক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো দেশে না থাকার ফলে ইতিমধ্যেই ওষুধ কোম্পানিগুলো চড়া দামে অত্যন্ত নিম্নমানের ওষুধ দিয়ে বাজার ছেয়ে ফেলেছে। ফলে মানুষ এমনিতেই চড়া দামে অত্যন্ত নিম্নমানের ওষুধ বাজার থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তার উপরে যতটুকু গুণমান পরীক্ষা হচ্ছে, তার ফলটাও ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে ইলেক্টোরাল বন্ডের তলায়। নির্বাচনের আগে কোম্পানিগুলো মোটা টাকা শাসক দলের নির্বাচনী তহবিলে ঢেলে দিচ্ছে আর সাত খুন মাফ হয়ে যাচ্ছে। এই সব বন্ডের টাকা বতর্মান শাসক দল বিজেপি এবং স্বাধীনতার পর থেকে সব থেকে বেশি সময় শাসন ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস সহ বিভিন্ন রাজ্যের শাসক আঞ্চলিক দলগুলোও পাচ্ছে। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো পরীক্ষায় ফেল করা নিম্নমানের ওষুধ চড়া দামে বিক্রি করার অঘোষিত লাইসেন্স পেয়ে জনগণের পকেট কেটে তার মুনাফা সুদে আসলে উসুল করে নিচ্ছে।

যেখানে মানুষের চিকিৎসা খরচের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ খরচই হয়ে থাকে ওষুধ বাবদ। এবং যে দেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ২৫ শতাংশের উপরে মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। যে দেশের বাজার ইতিপূর্বেই নিম্নমানের এবং ক্ষতিকর ওষুধে ভর্তি হয়ে রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে এইসব ক্ষতিকর ওষুধের বৃহত্তম বাজার হিসেবে ভারতবর্ষ চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সেখানে নির্বাচনী তহবিলে ঘুরপথে ভোট সর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ দেওয়ার মধ্য দিয়ে — দেশের কমপক্ষে ৩৫টি বৃহত ওষুধ কোম্পানির অসাধু ব্যবসায়ের লাইসেন্স আজ আরো পাকাপোক্ত হল। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সরকারি ওষুধ সরবরাহ বিপুল ভাবে কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে আরো বাধ্য করা হচ্ছে চড়া দামে বাজার থেকে নিম্নমানের ওষুধ কিনতে। এর সুযোগ নিয়ে মানুষের পকেট কেটে ঐ কোম্পানিগুলো ইলেক্টোরাল বন্ডে দেওয়া অর্থের হজারো গুণে টাকা অচিরেই তুলে নেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আর রাজনৈতিক দলগুলো ঐ টাকা দিয়ে নির্বাচনে যথেচ্ছ রিগিং করবে, জঘন্যতম গুন্ডামীর পেছনে ঐ টাকা উড়াবে। ঐ মাসেলম্যানদের দাপটে মরবে সাধারণ মানুষ এবং ভোটে হারবে সাধারণ মানুষের স্বার্থ। মৃত্যু ঘটবে গণতন্ত্রের। জিতবে ঐ সব ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো। ভোটে জিতে ঐসব দলগুলো আবারও জনবিরোধী ভেষজ নীতি প্রয়োগ করে ওষুধের দাম আরো বাড়াবে। যাতে ঘুষ দেওয়া ঐসব কোম্পানিগুলো আরো বেশি মুনাফা করার সুযোগ পায়। মানুষ মরবে বিনা ওষুধে বা ক্ষতিকর ওষুধে। ভোটের মাধ্যমে চক্রাকারে কি এই জিনিসই চলতে থাকবে!

- ডাঃ দুর্গাপ্রসাদ চক্রবর্তী এবং

ডাঃ সজল বিশ্বাস

employment-situation-in-indiaemployment-situation-in-india

কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার আগে নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তাঁর শাসনে বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি জনগণের, বিশেষভাবে যুব সম্প্রদায়ের কাজ পাওয়ার প্রত্যাশাকে উসকিয়ে তুলেছিল এবং লোকসভায় বিজেপির আসন সংখ্যাও উপচিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মোদীর দু’দশকের শাসনে কাজের পরিস্থিতি ঠিক কী রকম? প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে কি তিনি পেরেছেন? পরিসংখ্যানের প্রতি নিষ্ঠ হওয়াটা মোদী সরকারের ধাতে নেই এবং ভারত সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা শুধু ভারতেই নয়, বিদেশের গবেষক ও বিশ্লেষকদের কাছেও তেমন ভরসাযোগ্য হয় না। মোদী সরকার ২০১৭ সালে কর্মে নিযুক্ত বেকারি সমীক্ষা তুলে দেয় এবং ২০১৮’র মার্চেও লেবার ব্যুরোর ত্রৈমাসিক কর্মোদ্যোগ সমীক্ষাকে পরিত্যাগ করে। অতএব, কর্মসংস্থান সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের লভ্যতা তেমন সহজ নয়। যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তার ওপর নির্ভর করেই বিষয়ের বিশ্লেষণে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

মোদী জমানায় বেকারির হার ২০১৭-১৮ বর্ষে পৌঁছায় ৬.১ শতাংশে যা ছিল ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর কোভিড১৯ অতিমারীর সময় ঐ হার গিয়ে দাঁড়ায় ২০.৮ শতাংশে। আর সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-২৩ বর্ষে বেকারির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩.২ শতাংশে। কোন ক্ষেত্রে কীভাবে এত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হল যে ২০১৭-১৮’র অনুপাতে বেকারি অর্ধেক হয়ে গেল? আর কাজে যোগদানের হার যদি বেড়েই থাকে সেই কাজের গুণমান কী রকম? এ সম্পর্কে বিশ্লেষণে আমরা পরে আসব। তবে একটা কথা এখানে উল্লেখ্য যে, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির চালানো সমীক্ষা ও পরিসংখ্যানের ওপরই বেশি নির্ভর করেন।

মোদী সরকার ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ২০১৪ সালে নামায় ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও ২০২০ সালে শুরু করে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্প। কিন্তু উৎপাদকরা এই প্রকল্পগুলোয় তেমন সাড়া দেয়নি, ফলে প্রকল্পগুলো তেমন সচলও হয়নি। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৬ থেকে ২০২১’র মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান অর্ধেক হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান থেকে এটাও প্রকাশ পেয়েছে যে কোভিড অতিমারী শুরু হওয়ার আগে থেকেই ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পেতে শুরু করে।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অফিস প্রদত্ত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, পরিকাঠামো ও বাড়ি-ঘর নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার ২০১১-১২ বর্ষে ছিল সমগ্রের ১০.৬ শতাংশ। সেই হারই ২০২২-২৩ বর্ষে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। এই ক্ষেত্রে কাজে যুক্ত আছেন ৭ কোটিরও বেশি মানুষ, এবং ২০৩০ সাল নাগাদ সেই সংখ্যাটাই বেড়ে ১০ কোটি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে, নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মীর সংখ্যা বেড়ে চললেও এখানে কাজের গুণগত মান উৎকৃষ্ট নয়, অর্থাৎ, কাজ থেকে আয় তেমন সম্মানজনক নয়। এই ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে চালানো সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, মোট শ্রমিকদের ৮৩ শতাংশই ঠিকা কাজ করেন, আর ১১ শতাংশ রয়েছেন স্বনিযুক্ত রূপে।

কৃষিক্ষেত্র থেকে কর্মরতদের একটা অংশের শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গমনই অর্থনীতির বিকাশের সাধারণ নিয়ম। ভারতে সেই ধারাকেই প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমশক্তির হার ২০০৪-০৫ বর্ষে যেখানে ছিল ৫৮.৫ শতাংশ, সেটাই কমে ২০১১-১২ বর্ষে আসে ৪৮.৯ শতাংশে। মোদী জমানায় সেটা আরও কমে ২০১৮-১৯ বর্ষে দাঁড়ায় ৪২.৫ শতাংশে। কিন্তু কোভিড অতিমারির সময়কালে এক বিপরীত ধারার পরিযান ঘটতে থাকে। ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণক্ষেত্রে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঐ সমস্ত ক্ষেত্রে কর্মরতরা গ্রামে ফিরে কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত হন। কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিতদের হার আবার বেড়ে ২০২১-২২ বর্ষে দাঁড়ায় ৪৫.৫ শতাংশে। আর কৃষিক্ষেত্র এমনিতেই সংকটজনক অবস্থায় এবং সেখানে নিযুক্তি থেকে আয় যে একেবারেই সন্তোষজনক নয় তা বলাই বাহুল্য।

মোদী জমানায় শ্রমজীবীদের আয় বৃদ্ধি একেবারেই নগন্য। মূল্যস্ফীতিকে হিসাবে নিলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ বর্ষে মজুরি বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম। বিজেপি যে দুটো ক্ষেত্রের ওপর জোর দিয়েছিল, সেই কৃষি ও নির্মাণক্ষেত্রে মজুরি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ০.৯ ও ০.২ শতাংশ। কিছু ক্ষেত্রে বৃদ্ধি একেবারেই হয়নি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বৃদ্ধি নেতিবাচকও হয়েছে। ২০২২-২৩’র অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সরকারও স্বীকার করেছে যে, ঐ বছরে গ্রামাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধির হার নেতিবাচকই ছিল।

সবশেষে আসা যাক বেকারির হার কমা নিয়ে সরকারের দাবি প্রসঙ্গে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি আক্ষরিক অর্থেই অস্তিত্বহীন। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি দূরে থাক, লক্ষ লক্ষ যে সমস্ত পদ শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে সেগুলোও পূরণ হয় না। কোভিড অতিমারী ছাড়াও নোটবন্দি এবং তেমন বিবেচনা ছাড়াই অপ্রত্যক্ষ কর জিএসটি’র সূচনা অর্থনীতিতে প্রবল ধাক্কা দেয় যে ধাক্কা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাহলে কি বেসরকারি ক্ষেত্রের বিপুল বাড়বাড়ন্ত ঘটে সেখানে প্রচুর নিযুক্তির মধ্যে দিয়েই বেকারির হ্রাস হয়েছে? কিন্তু ওপরে আমরা দেখেছি, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে বৃদ্ধি তেমন ঘটেনি, আর নির্মাণ ক্ষেত্রে কিছু বৃদ্ধি হলেও তার সম্ভাবনা তেমন জোরালো নয়। সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অতএব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। তবুও বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রমের বাজারে যোগদানের হার যদি কিছু বেড়ে থাকে তবে তার মূলে রয়েছে স্বনিযুক্তিতে যথেষ্ট বৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞরা কর্মসংস্থানের তিনটে শ্রেণীকে নির্দিষ্ট করে থাকেন — নিয়মিত মজুরি বা বেতনের কাজ, ঠিকা কাজ এবং স্বনিযুক্তি। নিয়মিত বেতনের কাজ ও ঠিকা কাজ কমেছে, বা বাড়লেও তার হার সামান্য। স্বনিযুক্তিকে ভাগ করা যায় তিনটে ধারায় — যাঁরা নিজেদের চালানো ব্যবসায় শ্রমিক নিয়োগ করেন; যাঁরা নিজেদের ব্যবসা নিজেরাই চালান; আর যাঁরা অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে নিযুক্ত হন। এরমধ্যে শ্রমিক নিয়োগকারী ব্যবসার বৃদ্ধি ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২’র মধ্যে ১ শতাংশেরও কম, ৩.৭৮ শতাংশ থেকে ৪.৫৭ শতাংশ। আর বিনা বেতনে পারিবারিক শ্রমে নিযুক্তির হার এই সময়কালে বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ — ২৬ শতাংশ থেকে ৩১.৪ শতাংশ। বেকারির হার যদি কম দেখায় তবে তা এই ধারাটির বৃদ্ধির জন্যই। আনন্দবাজার পত্রিকায় এ’বছরের ১ মার্চ অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক তাঁর ‘কাজের বাজারে অন্ধকার’ শিরোনামের উত্তরসম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছেন, “যার জোরে... বেকারত্বের হার কমেছে, তা হল মূলত অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে যোগদানের প্রবণতা বৃদ্ধি; ...যদিও কর্মসংস্থানের সার্বিক হার বেড়েছে, সেই কাজ তৈরি হয়েছে পারিবারিক অবৈতনিক শ্রমিক হিসাবে — যেমন, পরিবারের মালিকানাধীন মুদিখানায় কর্মী হিসাবে। যাঁরা স্বনিযুক্ত হিসাবে নিজেই কাজ করেন, পারিবারিক সদস্য ছাড়া অন্য কোনও শ্রমিক নিয়োগ করেন না — 

যেমন চা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি — দেশের কর্মরত জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাতই সর্বাধিক, প্রায় ৩৫ শতাংশ।”

মোদী ভারতের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’, অর্থাৎ, জনসংখ্যায় তরুণদের প্রাধান্য জনিত সুবিধা লাভের কথা বলে থাকেন। কিন্তু ভারতের যত বেকার তার ৮৩ শতাংশই যুবক। অতএব, যুবকরা যেমন কর্মসংস্থান ও আয় থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকছে, সেরকমই ভারতীয় অর্থনীতির তারুণ্যের সুবিধা লাভও কল্পকথা বলেই পরিগণিত হচ্ছে। ভারতে মোট কর্মসংস্থানের ৮২ শতাংশই হল অসংগঠিত ক্ষেত্রে, আর ঠিকা ক্ষেত্রে কাজ করা ৬০ শতাংশ শ্রমিকই ন্যূনতম মজুরি পান না। মোদী সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরণ গত ২৭ মার্চ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ও মানব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা ‘ভারতের কর্মসংস্থান রিপোর্ট ২০২৪: যুব কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও কর্মদক্ষতা’ বিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, সরকার বেকারি সমস্যার সমাধান করবে তা প্রত্যাশা করা উচিত নয়। সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, জনগণের এই প্রত্যাশা তবে কি অমূলক? বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মোদীর প্রতিশ্রুতি তবে কি ‘জুমলাই’ ছিল? সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যানও সেই গোত্রেরই বলে ধরে নিলে তাকে কি মনগড়া বলা সঙ্গত হবে? দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার এ বছরের ৩০ মার্চ সংখ্যায় ‘বেকারি ব্যুরো’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে, “জয়োল্লাসময় বুকনি, বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের অলভ্যতা এবং অ-নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান ভারতে কর্মসংস্থানের ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আড়াল করতে পারবে না।”

- জয়দীপ মিত্র

stop-exporting-labor-to-israelstop-exporting-labor

ইজরায়েলি ও ভারত সরকারের বোঝাপড়ায় ইজরায়েলের নির্মাণ ক্ষেত্রে বেশ কয়েক হাজার ভারতীয় শ্রমিকের কাজ করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার ৬৪ জনের প্রথম ব্যাচটি ইজরায়েলে পৌঁছেছে এপ্রিলের গোড়ায়। এপ্রিল মাসের মধ্যেই ১,৫০০ ভারতীয় শ্রমিক ইজরায়েলে নির্মাণ কাজে যোগ দেবে বলে খবর। এই শ্রমিকদের এমন সময় ইজরায়েলে পাঠানো হলো যখন ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজার ওপর নিরন্তর আক্রমণে ইজরায়েল গাজাকে আক্ষরিক অর্থেই পরিণত করেছে ধ্বংসস্তূপে; হাজার হাজার নারী ও শিশু সহ ৩৩,০০০’রও বেশি প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করেছে; গাজাকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যাওয়া ট্রাককে ঢুকতে না দিয়ে ২০ লক্ষ গাজাবাসীকে ফেলা হয়েছে অনাহারের মুখে এবং সেখানে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আর অবাস্তব নয়; ত্রাণ সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের ওপর অন্তত তিনবার হামলা চালিয়ে তাদের দশ ত্রাণকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং ঐ সংস্থা তাদের ত্রাণকাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে; আর ইজরায়েলে যে ৯০,০০০ প্যালেস্তিনীয় শ্রমিক নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করত তাদের কাজ থেকে উচ্ছেদ করে হামাসের ইজরায়েল বিরোধী সামরিক আক্রমণের বদলা নিয়েছে ইজরায়েল। অতএব, ইজরায়েলের নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য ভারতীয় শ্রমিকরা এমন পরিস্থিতির মধ্যে ইজরায়েল পৌঁছলেন যখন ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের ওপর মানবতা বিরোধী নির্মমতাকে উজাড় করে দিচ্ছে এবং প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের রুটি-রুজির সংস্থানও হরণ করছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ইজরায়েল গিয়ে ভারতীয় শ্রমিকদের কাজ করার উদ্যোগটির বিরোধিতা করে বলেছিল, এখন ইজরায়েলে ভারতীয় শ্রমিক পাঠালে তা হবে অনৈতিক, শ্রমিক সংহতির প্রতি প্রতারণা এবং ইজরায়েলি নির্মমতায় মদত দান। কিন্তু সেই অভিমতে কোনো গুরুত্ব মোদী সরকার দেয়নি। উল্টে এখন বলা হচ্ছে যে, ২০২৩’র মে মাসে ইজরায়েলি বিদেশমন্ত্রী এলি কোহেনের ভারত সফরের সময় সে বছরের ৯ মে ৪২,০০০ শ্রমিক পাঠানোর যে চুক্তি হয়েছিল (৩৪,০০০ নির্মাণ ক্ষেত্রে এবং ৮,০০০ রোগী পরিচর্যা বা নার্সিং ক্ষেত্রে) তারই অনুসরণে এই শ্রমিকদের ইজরায়েলে পাঠানো হয়েছে। এরসঙ্গে হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এগুলোও তো বাস্তব ঘটনা যে, ২০২৩’র অক্টোবরে ইজরায়েলের ওপর হামাসের সামরিক হানাদারির পরিপ্রেক্ষিতেই শুরু হয়েছিল ইজরায়েলি নির্মাণ ক্ষেত্রে কর্মরত ৯০,০০০ প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের কর্মচ্যুত করার প্রক্রিয়া, কেননা, তখনই ইজরায়েলের নির্মাণ সংস্থাগুলো নেতানিয়াহু সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল যে নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য ভারত থেকে এক লক্ষ শ্রমিক আনা হোক। ভারতের অর্থমন্ত্রক স্থাপিত পিপিপি মডেলের সংস্থা ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএসডিসি) ২০২৩’র ১৫ নভেম্বর ইজরায়েলি সংস্থা পপুলেশন এন্ড ইমিগ্রেশন অথোরিটির কাছ থেকে সত্বর ১০,০০০ শ্রমিক পাঠাবার অনুরোধ পেয়েছিল। ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুও ঐ বছরের ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে শ্রমিকদের ‘আগমনকে এগিয়ে আনার’ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এর পরই ইজরায়েলে পাঠাবার জন্য শ্রমিক বাছার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এ’বছরের ১৬ জানুয়ারি ইজরায়েলে পাঠাবার জন্য হরিয়ানায় ৯,৭২৭ জন শ্রমিককে বাছাই করে এনএসডিসি। অতএব, হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধ, প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের কাজের লাইসেন্স বাতিল করা, ভারতীয় শ্রমিক পাঠানোর জন্য ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের আর্জি, শ্রমিক প্রেরণ ত্বরান্বিত করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর ফোন — এসবের সঙ্গে শ্রমিক পাঠানোর কোনো যোগ নেই বললে তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?

তবে, শুধুমাত্র ইজরায়েলের নির্মাণ শিল্পের পরিত্রাতা হওয়াই নয়, প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলি হামলার অবসানে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাবেও সমর্থন জানাতে ভারত কুণ্ঠিত হয়েছে। গত ৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদ তাদের পেশ করা প্রস্তাবে বলে, ইজরায়েলকে অবিলম্বে গাজা বিরোধী হানাদারি বন্ধ করতে হবে; খাদ্যদ্রব্য প্রবেশের জন্য ইজরায়েলকে অবরোধ তুলে নিতে হবে; ইজরায়েলকে সর্বপ্রকারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি ও সরবরাহ সমস্ত রাষ্ট্রকে স্থগিত করতে হবে; পূর্ব জেরুজালেম সহ সমগ্ৰ প্যালেস্তাইনে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দায় নির্ধারণ করতে হবে। এই প্রস্তাবেও ভারত সমর্থন প্রদান করতে পারেনি। চিন, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ ২৮টা দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় ৬টা দেশ — আমেরিকা, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, বুলগেরিয়া, মালাওই ও প্যারাগুয়ে। আর ভারত, জাপান, ফ্রান্স, রোমানিয়া সহ ১৩টা দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ইজরায়েল গাজার ওপর শুধু বর্তমানের ধ্বংসলীলাতেই মেতে উঠেছে এমন নয়, ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর থেকেই প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ডের ওপর দখলদারি ও তাদের ওপর জুলুমবাজি চালিয়ে আসছে। প্যালেস্তিনীয়দের ধারাবাহিক উৎপীড়ন, তাদের ওপর হুমকিবাজি, তাদের দমিয়ে ও কোণঠাসা করে রাখার অবসান চাইলে, তাদের অবমাননা, অমর্যাদা, সম্ভ্রমহানির ন্যায়বিচার চাইলে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার পরিষদের এই প্রস্তাবে অনুমোদন প্রদানে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীরা তাদের মতাদর্শগত মিত্রর দানবীয় প্রতাপের কোনো ধরনের লাঘবকেই মেনে নিতে রাজি নয় এবং তারা যে ইজরায়েলি নৃশংসতার দোসর তা প্রকাশেও দ্বিধান্বিত নয়।

প্যালেস্তাইনের জনগণ, সেখানকার শ্রমিকদের প্রতি ভারতীয় জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? নরেন্দ্র মোদী সরকার যেমন দেশের পরিস্থিতি থেকে, এখানকার কর্মসংস্থানের অভাবের চরম সংকটজনক অবস্থা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে ইজরায়েলে ভালো বেতনের কাজের দিকে শ্রমিকদের প্রলোভিত করতে চাইছেন, ভারতীয় শ্রমিকরাও কি তাঁদের বোধকে তার মধ্যেই আচ্ছন্ন করতে চাইবেন? অথবা, মোদী সরকার যেমন ইজরায়েলের ওপর হামাসের সামরিক হামলাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বলে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবে সেই কাজের সমালোচনা না থাকাকে অছিলা করে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় বা ভোটদানে বিরত থাকে, ভারতীয় জনগণও কি সেই ধারাতেই ভারতীয় বিদেশ নীতিকে দেখতে চাইবেন? দেশে কাজের সুযোগ না থাকায় বেকারির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ কিছু শ্রমিক ইজরায়েলে ছুটে যেতে চাইছেন ঠিকই, তবে সেটাই কিন্তু ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। একইভাবে ভারতীয় জনগণও কি ঔপনিবেশিক অতীত থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য একটা ধারাকে বিস্মৃত হয়ে প্যালেস্তিনীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে? ইজরায়েল যদি প্যালেস্তাইনের জমি নিজেদের দখলে রাখে, যদি তাদের ওপর লাগাতার দমন চালিয়ে যায় তবে প্রতিরোধের অধিকার, এমনকি সশস্ত্র ধারাতেও প্যালেস্তিনীয়দের থাকবে এবং সে কথা রাষ্ট্রপুঞ্জও স্বীকার করে। ইজরায়েলে কাজে যোগ দিতে চাওয়া শ্রমিকদের ২ এপ্রিলের বিদায় সম্বর্ধনায় ইজরায়েলের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন বলেন, “আমি নিশ্চিত, এই শ্রমিকরা ভারত ও ইজরায়েলের জনগণের মধ্যে মহান সম্পর্কের ‘রাষ্ট্রদূত’ হয়ে উঠবেন।” এই প্রসঙ্গে আমরা কুণ্ঠাহীনভাবে বলতে চাই, পেটের দায়ে কিছু শ্রমিক ইজরায়েল রওনা দিলেও সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েল এবং ফ্যাসিবাদী ভারত সরকারের এই যৌথ প্রযোজনার অংশীদার ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণী কখনই হবেন না। স্বাধীনতার পর থেকে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্যালেস্তাইনের মুক্তির সহচর থাকলেও ১৯৯২ সাল থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরিণামে ভারত তাদের এবং তার সাথে মার্কিন রণনীতির সহযোগী হয়ে উঠেছে। ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণী কিন্তু প্যালেস্তিনীয় জনগণের মর্মযন্ত্রণার সমব্যথী, তাদের মুক্তি সংগ্রামের সহযাত্রী। ভারত সরকারের কাছে ভারতীয় জনগণের তাই দাবি,

ইজরায়েলে শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ কর!

ইজরায়েলি রাষ্ট্রের সামরিক হামলাকে ধিক্কার জানিয়ে প্যালেস্তাইনের মুক্তি সংগ্রামের পাশে দাঁড়াও!

memories-in-the-air-of-day-and-nightday-and-night

ডি এল রায় সরণী (তখন রাস্তার এই নামকরণ হয়েছিল কিনা জানা নেই)। কিন্তু বাবার হাত ধরে যতবার মহানন্দা পাড়ার ঐ নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছি, বাবা অদ্ভুতভাবে গলা নামিয়ে সরু গলায় বলতেন, ঐ যে, ঐ দেখ চারু মজুমদারের বাড়ি। তখন ক্লাস টু থ্রি হবে। কি বুঝতাম কে জানে, কিন্তু চুপ করে থাকতাম। পরের দিকে দেখতাম, ২৮ জুলাই দার্জিলিং জেলায় হরতাল হয়। ফলে স্কুল বন্ধ থাকত। আর আমার স্কুল কালেচক্রে জলপাইগুড়ি জেলাতে, ফলে ছুটি নাই। মনে মনে খুব রাগ হতো চারু মজুমদারের ওপর। তখন বার কয়েক ‘নকশাল’ শব্দটি কান অব্দি এসেছে, কিন্তু মাথাতে তখন মার্ক্স, লেনিনের পরেই জ্যোতি বসুর নিত্য যাতায়াত! কিন্তু ছুটি পাইনি বলে যার ওপর একসময় ভীষণ রাগ হতো! বাবার সরু গলার উৎস সন্ধানে গিয়ে কখন যে নিষিদ্ধ ইস্তাহারের মতো কমরেড চারু মজুমদার আমার টিনএজের অনেকটাই দখল করে নিয়েছিলেন, না, তখনও বুঝতে পারিনি!

কেমন ছিল সত্তরের সেই স্বপ্নদর্শীরা — কেমন ছিলেন আমার বেড়ে ওঠার শহরের আরেক প্রান্তের মানুষটি, আটটি দলিল আর একটি ছোট্ট অচেনা জোত, জনপদ নকশাল বাড়ির নাম পৃথিবীর বুকে খোদাই করার কারিগর চারু মজুমদার! ‘কালবেলা’ থেকে ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ থেকে ‘ইন দ্যা ওয়েক আপ অফ নকশালবাড়ি’ হাতড়ে খুঁজে ফিরেছি আন্দোলনের পরতে পরতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চারু মজুমদারকে — কিন্তু সাফল্য, ব্যর্থতার অন্ত্যমিলে ‘পারিবারিক’, ‘ব্যক্তি মানুষ’ চারু মজুমদার? ওনার মতো মানুষদের নিয়ে কিছু ‘মিথ’ তো তৈরি হয়েই যায় — তবুও তার পরে — কলেজ শেষ হতে হতেই স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের সাদা পতাকাটি নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম! ততদিনে নকশালবাড়ি সম্পর্কে খানিক জানা বোঝার চেষ্টা করে চলছি। স্যারের (অভিজিৎ মজুমদার) কাছে শোনা টুকরো টুকরো আলাপচারিতা ক্রমেই জানার খিদেকে আরও আরও উস্কে দিচ্ছে।

ততদিনে আমার চলার পথে সিপিআই(এম)-এর সাথে ‘এল’ জুড়ে গেছে অনায়াসে। স্যারের ফ্ল্যাটে পড়া বোঝার অজুহাতে বার কয়েক গেলেও ছোটবেলায় দূর থেকে দেখা কাঠের বাড়িটি তখনও অধরা — সুযোগ হল ২০১৬’র সেপ্টেম্বরে এক বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায়! ঘরে ঢুকে আবেগ, আবেশ, অনুভূতি সবটা মিলিয়ে — বেশ মনে আছে, অনেকক্ষণ কিছু বলতেই পারিনি। তারপর কখন আর কবে যেন দিদিরা সবটাই নিজের মতো করে নিলেন — ততদিনে পড়েছি মিতুদির (মধুমিতা মজুমদারের) ছোট গল্পের সংকলন থেকে ছড়ার বই। যখন ভেবেছি আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ছোটদের কথা সহজভাবে আর কজন এরকম করে ভাবেন? মিতুদি মাথার দরজাতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বলেছেন, আছি তো আমি! আবার পরক্ষণেই কিডনি, বিয়েবাড়ি, ফিনিক্স পাখিরা, ছাঁট, অতসী, সোনালীর স্বপ্ন’র মতো অণুগল্প, ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে ওনার সামাজিক বীক্ষণের প্রসারতাকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

তবে ওনার কাছে সব থেকে সহজ ছিল তো একজন ‘বাবা’ হিসেবে চারু মজুমদারকে উপস্থাপন করা। পাশাপাশি অবশ্যই একজন মা, একজন সবসময়ের সহযোদ্ধা হিসেবে লীলা মজুমদারকে তুলে আনা। যার যথার্থ সূত্রায়ণ ‘লীলা মজুমদার : এক অন্য রাজনৈতিক যাপন’এ ওনারা করেছেন। কিন্তু যে চারু মজুমদার শুধু লোক দেখবেন বলে উৎসবের রাতে সেদিনের ছোট্ট শহর শিলিগুড়িতে পরিবারের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়তেন রিকশা করে, আপন মনেই ‘যেতে যেতে একলা পথে’ গাইতে গাইতে পাড়ি জমাতেন রাহুল দেব বর্মনের ‘ফিরে এসো অনুরাধা’তে! যার রান্নার হাত রীতিমতো প্রশংসার দাবি রাখতো! পাজামা’র ওপর শার্ট চাপিয়ে যিনি হাসিমুখে জেল যাত্রার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যেতেন। সময় পেলেই পরিবারের সকলের সাথে আনন্দে রসিকতায় মেতে উঠতেন। আমৃত্যু স্বপ্ন দেখতেন চলমান ব্যবস্থার খোল নলচে বদলে দিয়ে এক নতুন ‘আগামী’র! সন্তানদের উৎসাহিত করতেন একজন ‘বাবা’ হিসেবে! আবার কমরেড বাবুলাল বিশ্বকর্মকারের শহীদ হওয়ার খবরে শীর্ণকায় দৃঢ়চেতা মানুষটির চোখের জল বাঁধ মানেনি।

‘বেলা-অবেলার স্মৃতিলেখা’তে মিতুদি সহজাতভাবে কলস্বনার মতো বলে গেছেন সেই মানুষটির যাপনের কথা, সেই মানুষটিকে নিয়ে যাপনের কথা। মিতুদির শারীরিক অসুস্থতা তার লেখাতে কোনও বিষাদ চিহ্ন এঁকে দিতে পারেনি। বরং নকশালবাড়ির পথ নিয়ে নিশ্চিতভাবেই আছে আশাবাদের প্রতিস্পর্ধী উচ্চারণ। যা চারু মজুমদার ও লীলা মজুমদারের সেদিনের দৃপ্ত পদচারণা ও পাড়া প্রতিবেশীদের সদর্থক সমর্থনের মধ্য দিয়েই আজও ছড়িয়ে আছে দেশ থেকে দেশান্তরে। মিতুদির অভিযাত্রা এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিতে — আমরা সকল প্রকার ঔদাসীন্য কাটিয়ে সাড়া দেবো পূব আকাশ লাল হয়ে ওঠার চির আঙ্খাকাকে সঙ্গী করেই।

- শাশ্বতী সেনগুপ্ত

in-memory-of-dilip-banerjeein-memory-of-dilip-banerjee

নিপীড়িতের থিয়েটার বলে কিছু হয় না, বরং বলা যায় থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্ট। এভাবেই বিপ্লাণু মৈত্র শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য। ১৩ এপ্রিল ২০২৪, ক্রিক লেনের জর্জ ভবনে তিনি বক্তব্য রাখছিলেন দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসে দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক কমিটি আয়োজিত স্মারক বক্তৃতায়। বিষয় ছিল নিপীড়িতের থিয়েটার। দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের দেড় দশক পড়েও তিনি যে কত প্রাসঙ্গিক তা বোঝা যায় দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতায় বিপ্লাণু মৈত্রের নিপীড়িতের থিয়েটার বিষয়ক আলোচনা থেকে। রসায়নে পিএইচডি এবং বেসরকারি সংস্থা আইপিএ-এর কর্মী ছিলেন দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সকলের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে মিশতেন এবং বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। চলচ্চিত্র বিষয়ক বহু লেখা তিনি লিখেছেন। বাংলা ভাষায় লিখিত প্রবন্ধগুলির একটি নির্বাচিত সংকলন গ্রন্থ এদিন প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির সম্পাদনা করেন নিত্যানন্দ ঘোষ।

এবার আসি বিপ্লাণু মৈত্রের থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের জন্য থিয়েটারের বিষয়ে। রবীন্দ্র ভারতীর কৃতী ছাত্র এই মানুষটি একসময় নিশ্চিত পেশা ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রান্তিক মানুষের মাঝে গিয়ে তাঁদের সচেতন করে তুলেছেন এবং বাংলা নাটক ডট কমের মাধ্যমে প্রত্যন্ত জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর চিন্তাভাবনা। তাঁর কথায় অত্যাচারীর স্বরূপ যখন আমাদের কাছে পরিষ্কার নয় তখনই মানুষ নিয়তি নির্ভর হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা। অনেক সময়ই এই প্রান্তিক মানুষদের জন্য করা সরকারি প্রকল্পগুলি প্রত্যাশিত সাফল্য পায় না। যেমন পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেওয়া হয় একটি শূকরছানা ও একটি মুরগি। কিন্তু প্রত্যাশিত ফললাভ না হওয়ায় কারণ অনুসন্ধান করা হয় এবং দেখা যায় প্রকল্প সম্পর্কে তাঁরা অবগত নয়। এরপর নাটকের মাধ্যমে তাঁদের সেই সচেতনতা জাগ্রত হয় এবং প্রত্যাশিত ফললাভ হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি অন্তরায় ছিল তাঁদের পড়তে না পারা বা পড়ার প্রতি চরম অনাগ্রহ। এখানেই সাফল্য বলা যায় উন্নয়নের জন্য থিয়েটারের।

পশ্চিম ভারতের একটি বিলুপ্তপ্রায় উপজাতি বেগার উপজাতি। সরকার তাঁদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক টাকা খরচ করে। একবার এই উপজাতির আটশো জন ম্যালেরিয়ায় মারা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় মশারি দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা সেটা না খাটিয়ে সেটা দিয়ে মাছ ধরে। ম্যালেরিয়া সম্পর্কে তাঁদের ভুল ধারণা ছিল। পরে অবশ্য সেই সব ভুল ধারণা দূর হয়। ফলে নাটক অনেক সহজে মানুষের কাছাকাছি যেতে পারে।

পরবর্তী পর্যায়ে ছিল অমিত রায়ের গান। সেই গানগুলি এই পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দর্শকদের মনকে আপ্লুত করে দিয়েছে। বিপ্লাণু মৈত্র ছাড়াও কিন্নর রায় এবং আরও অনেকে সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা ও পরিচালনা করেন নিত্যানন্দ ঘোষ।

- দীপা জোয়ারদার

xxx===xxx

খণ্ড-31
সংখ্যা-14