খবরা-খবর
ধর্মঘট : নদীয়া

নদীয়ায় লাল পতাকা ছিঁড়ে ফেলে তৃণমূলীদের হামলা - পাল্টা রুখে দাঁড়ালো লালঝান্ডার মিছিল।

ধর্মঘটে নদীয়ার জেলা সদর কৃষ্ণনগরের জনজীবন একেবারেই স্তব্ধ ছিলো। ভোর থেকেই বাসস্ট্যান্ডে সারিবদ্ধ বেসরকারি বাসগুলি দাঁড়িয়ে থেকে জানান দিচ্ছিলো সমস্ত পরিবহন শ্রমিকরাই ধর্মঘটে সামিল। সকাল সাড়ে ৬ টায় লাল ঝান্ডা নিয়ে যৌথভাবে বামকর্মী ও নেতৃবৃন্দের পথ অবরোধে যোগ দিলেন কয়েকজন পরিবহন কর্মীরাও। আটক হয়ে পড়লো স্টেট বাস। প্রায় আধঘন্টা অবরোধ চললো, পুলিশের সাথে তর্কবিতর্ক-চাপ সৃস্টি করার পরবর্তীতে শুরু হলো মিছিল। এর পর দুপা বন্ধ থাকা দোকান-বাজারের মধ্য দিয়ে, যানবাহনহীন রাস্তাজুড়ে মিছিল যত এগিয়েছে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও তত বেড়েছে। গুটিকয়েক খোলা দোকানে ধর্মঘটের দাবিগুলি তুলে ধরে আবেদন করা মাত্র সেগুলির দরজা-সাটার বন্ধ হয়ে গেছে। মিছিলে দুই শতাধিক অংশগ্রহণকারীদের মুখে শ্রমজীবী মানুষের দাবিসম্বলিত স্লোগান শুনে পার্শ্ববর্তী মানুষেরা সহমর্মীতা জানিয়েছেন, কিছু যানবাহন রাস্তার পা যাত্রা স্থগিত করে দিয়েছে। কয়েকটি সরকারি বাসে উঠে যাত্রীদের অনুরোধ করাতে অনেকেই বাস থেকে নেমে গেছে। এ ভাবেই জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়ে মিছিল উদ্দীপনাময় হয়ে ওঠে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বড় এলাকাজুড়ে বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে চলমান মিছিল ধর্মঘট সফল করার কাজে সক্রিয় থাকে। সামনের সারিতে ছিলেন সিটুর এসএম সাদি, এআইসিসিটিইউ’র অমল তরফদার, বর্ষীয়ান নিহার ব্যানার্জী, কিষাণ মহাসভার জয়তু দেশমুখ প্রমূখ নেতৃবৃন্দ। সামনে পেছনে ছিলো বিশাল পুলিশবাহিনী। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ একটি প্রাথমিক স্কুলের সামনে অভিভাবকদের সাথে কথা বলাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃস্টি হয়, স্কুলের কতিপয় শিক্ষক তথা তৃণমূলী নেতা বামকর্মীদের গালিগালাজ করে। তার কিছুক্ষণ পরেই তৃণমূলীরা জড়ো হয়,বাইক বাহিনী পার্শ্ববর্তী পোঃঅফিস মোড়ে লাগানো লাল পতাকা ফ্লেক্স ব্যানার ছিঁড়ে দেয়। ধর্মঘটে জনগণের সাড়া দেখে মরিয়া হয়ে ওরা এভাবে তান্ডব চালায়,কয়েকজন বামকর্মীকে মারধোর করে। এ খবর পৌছালে দ্রুতই মিছিল ঘটনাস্থলে এসে তৃণমূলীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। লাল পতাকা পুনরায় লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ কাজে মহিলাকর্মীরা অগ্রণী ভূমিকা নেয়। এর পরে বেগতিক বুঝে তৃণমূলীরা সরে যায়। ঐ দিনই বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত শতাধিক কর্মীর এক দৃপ্ত মিছিল পুনরায় শহরের মূল এলাকা পরিক্রমা করে। ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন সকাল ১০টা নাগাদ যৌথ মিছিল কিছুদূর চলার পরেই বিশাল পুলিশ বাহিনী গতিরোধ করে,থানায় নিয়ে যায় এবং সকলকেই গ্রেপ্তার করে। এভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে নেতৃবৃন্দ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ধর্মঘট ঠেকাতে পুলিশ ও তৃণমূলের এই নক্কারজনক ভূমিকার বিরুদ্ধে, বিজেপির পাহারাদার তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়।

গ্রামাঞ্চলের পার্টি কাজের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ধুবুলিয়াতেও ধর্মঘটে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ভোর থেকেই শতাধিক বাম কর্মীরা যৌথভাবে পথে নামে। ৩৪ নং জাতীয় সড়কে যানবাহন এমনিতেই ছিল খুবই কম, সেখানে শুরু হয় অবরোধ। পুলিশী বাধা মোকাবিলা করে সকাল ৮টা থেকে ১০টা দুই দফায় দীর্ঘসময় সড়ক অবরোধে যানচলাচল স্তব্ধ হয়ে পড়ে। তারপর পার্শ্ববর্তী বাজারে মিছিল পরিক্রমা করলে সেটিও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বিডিও-বিএলআরও দপ্তরে পিকেটিং করা হয়। এই কর্মসূচির সামনের সারিতে ছিলেন কিষাণ মহাসভার রাজ্য ও জেলা নেতা সুবিমল সেনগুপ্ত সহ অন্যান্য বাম নেতৃবৃন্দ। দ্বিতীয় দিন সকাল ১০টায় বিডিও- বিএলআরও দপ্তরে পিকেটিং করলে সেখানকার কর্মচারীরা বাইরে চলে আসেন, ফলে নামমাত্র কর্মী থাকায় সরকারি কাজ কার্যতঃ বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ৪টায় ধর্মঘটকে সফল করার জন্য জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে ধুবুলিয়া নেতাজী পার্কে এক যৌথ জনসভা সংগঠিত হয়। রাজ্যের দিকে দিকে তৃণমূল সরকারের হামলাবাজীর বিরুদ্ধে সভা সোচ্চার হয়ে ওঠে। “দিদি আর মোদী”র অশুভ আতাঁতের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে বাম নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।

নদীয়া জেলায় বিজেপির শক্তিশালী জায়গা বলে কথিত নাকাশীপাড়াতেও ধর্মঘটে ব্যাপক গণ সমর্থন দেখা যায়। এখানে ধর্মঘটের আগের দিন আমাদের ট্রেড ইউনিয়নে সম্প্রতি যোগ দেওয়া মিড ডে মিল ইউনিয়নের চার শতাধিক রন্ধনকর্মীরা ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল করে, যা এলাকায় ভালো প্রভাব ফেলে। ধর্মঘটের দিন বেথুয়াডহরীতে যৌথভাবে কিছু সময়ের ব্যবধানে চার পাঁচ বার জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়, সড়ক জুড়ে মিছিল যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। সামনে ছিলেন আয়ারলার রাজ্য নেতা কাজল দত্তগুপ্ত সহ বামপন্থী নেতৃবৃন্দ। ঐ স্থানে দ্বিতীয় দিনও অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়।

ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন শিমুরালী স্টেশনে যৌথ রেল অবরোধ বেশ কিছু সময় চলার পর পুলিশের উপস্থিতিতেই তৃণমূল আশ্রিত সমাজবিরোধীরা অবরোধকারীদের উপর হামলা করে। প্ল্যাটফর্মে ওঠার পরেও বামপন্থী কর্মীদের মারধোর করতে থাকে। ছয় জন কর্মী আহত হন।এক মহিলাকর্মীকে নিগ্রহ করা হয়, প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ালে একজন পার্টিকর্মীকে জোর করে আটক রেখে মারধোর করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে বিকাল ৫ টায় দুই শতাধিক কর্মীর দৃপ্ত মিছিল চাকদা শহর পরিক্রমা করে। সামনের সারিতে ছিলেন পার্টি নেতা মল্লার মৈত্র, বিজয় সাহা, জয়তু দেশমুখ, সিপিএম জেলা সম্পাদক সুমিত দে প্রমূখ। ধর্মঘটের প্রথম দিন চাকদায় যৌথ মিছিল হয়, মৈত্রী এক্সপ্রেসকে কিছুসময় রেল অবরোধে আটক রাখা হয়। তাহেরপুরে যৌথ মিছিল, পথ অবরোধ হয়। স্থানীয় এক বন্ধ থাকা ব্যাংকে পতাকা লাগানোর সময় পুলিশ ও তৃণমূলীরা হামলা চালাতে এলে পার্টিনেতা জীবন কবিরাজ সহ বাম কর্মীরা রুখে দাঁড়ান।

ধর্মঘট সফল করতে ২৮ ডিসেম্বর ধুবুলিয়ায় শতাধিক মানুষের এক দৃপ্ত মিছিল গোটা এলাকা পরিক্রমা করে সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার চালায়। এরপর নেতাজী পার্কে সংগঠিত হয় জনসভা। সিপিএম ও আরএসপি দলের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীরাও এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহন করেন। পরবর্তীকালে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ স্থানীয় হাটে ব্যাবসায়ীদের কাছে ধর্মঘটে সামিল হওয়ার আহ্বান জানায়, এতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। গত ২ জানুয়ারী নপাড়া ২ নং অঞ্চলের সোনাতলায় এবং ৩ জানুয়ারী ধুবুলিয়ার বটতলা মোড়ে বামপন্থী দলসমূহের যৌথসভা সংগঠিত হয়। ৪ জানুয়ারী নাকাশীপাড়ার গাছা হাটতলা ও যুগপুরে অনুরূপ সভা অনুষ্ঠিত হয়। গত ৩০ ডিসেম্বর নাকাশীপাড়ায় এক যৌথ কনভেনশন এবং পরবর্তীতে বেথুয়াডহরী মোড়ে প্রচার সভা সংগঠিত হয়। ২৮ ডিসেম্বর নবদ্বীপের রাধাবাজার মোড়ে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। রেল স্টেশন থেকে হকার ইউনিয়ন ও এ আই সি সি টি ইউ-র ব্যানারে এক মিছিল শহরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে সমাবেশস্থলে আসে। ৩০ ডিসেম্বর রেলগেটে যৌথ প্রচারসভা সংগঠিত হয়। ২১ ডিসেম্বর জেলা সদর কৃষ্ণনগরের শক্তিনগরে যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ ডিসেম্বর শহরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে এক দৃপ্ত মশালমিছিল বামপন্থী দলগুলির যৌথ উদ্যোগে সংগঠিত হয়। এর আগে শহরের ব্যাস্ততম বাসস্ট্যান্ডে এ আই সি সি টি ইউ-র নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে “পরিবহন বার্তা” বুলেটিন বিক্রী করে। দুই শতাধিক বুলেটিন বিলিবন্টন হয়। ১৬ ডিসেম্বর চাকদা শহরের বাসস্ট্যান্ডে যৌথ কনভেনশন, ২০ তারিখ নেতাজী পার্কমোড়ে প্রচারসভা, ২৮ তারিখ শরডাঙ্গা দুর্গাপুরে, ৩০তারিখ শিমুরালী চৌমাথায় যৌথ জনসভা সংগঠিত হয়। ৫ জানুয়ারী তাহেরপুর বাজারে এক যৌথ প্রচার সভা অনুষ্ঠিত হয়। ট্রেড ইউনিয়ন, কিষাণসভা, আয়ারলা এবং পার্টির জেলা ও রাজ্য নেতৃবৃন্দ সভাগুলিতে বক্তব্য রাখেন।

খণ্ড-26
সংখ্যা-2