ধান কেনা নিয়ে তৃণমূলের প্রতারণা ও মিথ্যাচার প্রতিবাদে রাস্তায় ফসল ফেলে অবরোধ—ব্লকে ব্লকে বিক্ষোভ

ধান কেনা নিয়ে চরম প্রতারণা ও মিথ্যাচার করছে শাসক তৃণমূল। গত এক সপ্তাহ ধরে জেলায় জেলায় ৩৪২টি কিষাণ মান্ডিতে ধান কেনা শুরু হয়েছে। অথচ ঐ ধানক্রয় কেন্দ্রগুলির দখল নিয়েছে ফড়ের দল। শাসক দল আশ্রিত দালাল- মাতব্বররা গ্রামে গ্রামে চাষীদের থেকে ব্যাংকের পাশবই-ভোটার আইকার্ড নিয়ে এসেছে। ব্যস কেল্লা ফতে, সরকারী ধান কেনার পদ্ধতি অত্যন্ত সরল। ঐ দুটি থাকলেই ৪৫ কুইন্টাল ধানের দাম ঢুকে যাবে এ্যাকাউন্টে। যেভাবে ১০০ দিনের কাজ না করিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা এ্যাকাউন্টে ঢুকে যায়, পার্টির "দাদাদের" সাথে সেই টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়—সেই একই কায়দায় চাষীর থেকে ১০০০/১২০০ টাকায় কেনা অভাবী বিক্রীর ধান সরকারী দর ১৭৫০ টাকায় সরকারের ঘরে ঢুকিয়ে মধ্যসত্বভোগীরা কুইন্টাল পিছু ৫০০-৭০০ টাকা মুনাফা করে নিচ্ছে! পঞ্চায়েতে "বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়ী" শাসকের দাপটের সামনে মুখ খোলার অনেক খেসারত দিতে হতে পারে! তাই নিঃশব্দে চলছে কৃষকের রক্ত ঘামে তৈরী ফসলের ন্যায্য দামের টাকা লুঠ। ওদিকে ধানের সহায়ক মূল্য নির্ধারণে কেন্দ্রের মোদী সরকার চরম প্রতারণা করেছে। খরচের দেড় গুন দামের হিসাবে কারচুপি করে ২৩০০ টাকার ধানকে করে দিয়েছে ১৭৫০ টাকা কুইন্টাল। ফলে চাষীর ৫৫০ টাকা চুরি গেলো, এ রাজ্যের সর্বক্ষেত্রে "অনুপ্রেরণাদাত্রী" দিদির' ভাই'রাও ঠকিয়ে নিলো প্রায় সমপরিমাণ টাকা! হুগলীর পান্ডুয়া থেকে বাঁকুড়ার ওন্দা, নদীয়ার চাপড়া থেকে বর্ধমানের কালনা কিংবা জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি! সর্বত্রই একই চিত্র। এখনও পর্যন্ত এই সিজনে ১৮০০ কোটি টাকার ধান কেনা হয়েছে বলে রাজ্য সরকার জানিয়েছে। এর মধ্যে তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ অর্থাৎ কৃষকের প্রাপ্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঢুকেছে ফড়ে দালাল মহাজনদের পকেটে। রাজ্য সরকার এই পর্যায়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ধান কিনবে বলে জানিয়েছে, অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা যা চাষীদের পাওনা—সেটা চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে, সম্পূর্ণ অবৈধ পথে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা মোটেই কম নয়! যদিও এখানে কোন "কেগ" কিংবা "সিএজি" নেই, ফলে এসব ধান কেলেঙ্কারীকে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়।আর তৃণমূল মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে চলেছে, সরাসরি চাষীর থেকে নাকি ধান কেনা হচ্ছে, ফড়েদের বিরুদ্ধে পুলিশী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কৃষকদের "আয় তিন গুণ বৃদ্ধি" সহ এই ধরনের অনেক নাটকীয় কথাই শোনা গেলো। কিন্তু গ্রামে গ্রামে কেম্প করে ধান কেনার ন্যায়সঙ্গত দাবীকে গ্রাহ্যই করা হলো না। গ্রামে সর্বসাধারণের চোখের সামনে 'নয়-ছয়' করা তুলনায় একটু কঠিন। এছাড়া চাষীরা নিজের এলাকাতেই ধান বিক্রী করতে বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করে থাকে, তাই জনগণের কিছুটা নজরদারীর মাধ্যমে ধান কেনার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হলো না। দূরবর্তী স্থানে থাকা অকার্য্যকর "কিষাণ মান্ডি"গুলিকেই সচেতন ভাবে ধান কেনার স্থান হিসাবে নির্দিষ্ট করা হলো। আর সেখানে অবাধে চালানো হচ্ছে দুর্নীতির অবৈধ কারবার। সরকারী বিধি অনুযায়ী ধান কেনায় পঞ্চায়েতের কোন ভূমিকা থাকার কথাই নয়। চাষীরাই সরাসরি ক্রয় কেন্দ্রে নাম-পরিমাণ নথীভূক্ত করতে পারবে। কিন্তু শাসকদলের আধিপত্য বজায় রাখতে পঞ্চায়েত থেকে "টোকেন" দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হলো। দুর্নীতির সাথে যোগ হলো দলবাজী-দাদাগিরি। এ সবের ফলে সবচেয়ে বেশী বঞ্চিত হয়েছে গরীব ভাগচাষী-চুক্তিচাষীরা, যাদের কাছে জমির কাগজপত্র নেই, অথচ গ্রামের মোট জমির প্রায় অর্ধেক এই "সিজন লিজ" পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে থাকে। ঋণ ফাঁদে জর্জরিত হয়ে এই গরীবরাই হয়ে চলেছে অভাবী বিক্রির নির্মম শিকার।

বিগত দিনে ধান কেনায় সরকারের ইচ্ছাকৃত গাফিলতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই ধান দিতে এক ধরনের অনীহার মনোভাব ব্যপক মানুষের মধ্যে রয়েছে। অতীতের বঞ্চনা-প্রতারণার নানাবিধ উদাহরণ আছে। যথা সরকারকে ধান বিক্রী করে বহু বিলম্বে দাম পাওয়া, নানা অজুহাতে পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া, পরিবহনের খরচবৃদ্ধি, জমির কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতা প্রভৃতি। এটাকেই প্রচার করে শাসকদলের মাতব্বররা পরোক্ষে ফড়েদের স্বার্থেই কাজ করেছে। বহুল প্রচারিত স্বনির্ভর গোষ্ঠির মাধ্যমে ধান কেনা গল্পই রয়ে গেছে, সমবায়গুলিকে নামানোই হয় নি।

ধানের পাশাপাশি অর্থকরী সব্জীচাষ এ রাজ্যের কৃষির এক বিকাশমান প্রবণতা। পারিবারিক শ্রমের বিপুল ব্যবহারে ছোট-মাঝারী চাষীরাও এক্ষেত্রে নিয়োজিত।অথচ আলু সহ সব্জীর ন্যায্য দাম নিয়ে সরকারের কোন পরিকল্পনাই নেই। প্রায়শঃই দেখা যায় প্রকৃত উৎপাদকেরা ২-৩ টাকায় যে ফসল বিক্রী করতে বাধ্য হয়, ৩০/৪০ কিলোমিটার দুরের বাজারে সেটা বিক্রী হয় চারগুণ দামে। এক্ষেত্রে অতি উৎপাদনের কথা তুলে ধরা হয়। অথচ সরকারের কৃষি বিপন দপ্তর আছে, তারা দেড় গুণ দামে ফসল কিনে হিমঘরে সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করবে না কেন? কিষাণমান্ডিতে হিমঘর নেই কেন? সেই সুযোগ চাষীরা পাবে না কেন? তাহলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার "কিষাণ দরদী" বলে নিজেদের জাহির করে কোন মুখে? এই প্রতারণা-বঞ্চনা-মিথ্যাচারের বিরুদ্ধেই আজ সারা দেশের মতো এ রাজ্যের কৃষকরাও পথে নেমেছে। নৈশব্দ ভাঙছে। এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠছে কৃষক জাগরণ।

খণ্ড-25
সংখ্যা-39