প্রতিবেদন
সাবিত্রী ফুলে ও ফতিমা সেখ

ভারতে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রথম স্থাপিত হয়েছিল ১৮৪৮ সালে, পুণের ভিদেওয়াড়াতে। সাবিত্রী ফুলে ও তাঁর সাথী ফতিমা সেখ এই বৈপ্লবিক পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করেছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক দাসত্ব ও অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মেয়েদের মুক্ত করা। চরম প্রতিকুলতা, অবমাননা এমনকি শারিরীক নিগ্রহের শিকার হয়েও শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন।

সাবিত্রী ছিলেন নিরক্ষর। বিবাহের পর জ্যোতিবা ফুলে তাঁকে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করেন। ভারতীয় ঐতিহ্যের ব্রাহ্মণ্যবাদী নাগপাশ থেকে দলিত ও মহিলাদের মুক্ত করা সাবিত্রীর জীবনের ব্রত হয়ে ওঠে। শিক্ষা অর্জনকে মুক্তিপথের প্রথম পদক্ষেপ বলে চিহ্নিত করেন তিনি। ফুলে দম্পতির কাজকর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজকর্তারা প্রবল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ওদের চাপে অচিরেই তাঁরা বাড়ি থেকে বহিস্কৃত হন। এই সময় তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান দুই ভাইবোন—উসমান সেখ ও ফতিমা সেখ। তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় পায় ফুলে দম্পতি। দাদা উসমানের অনুপ্রেরণায় ফতিমাও ঝাঁপিয়ে পড়েন ফুলে দম্পতির মিশনে। সাবিত্রী ও ফতিমা জোট বেঁধে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। ফতিমার বাড়িতেই তাঁরা মেয়েদের শিক্ষার জন্য চালু করেন “ইণ্ডিজেনাস লাইব্রেরি”। ক্রমে ক্রমে পাঁচটি স্কুল স্থাপিত হয় যার প্রতিটিতেই সাবিত্রী ও ফতিমা পড়াতেন। পেশাগত শিক্ষক হওয়ার জন্য দুজনেই আমেদাবাদ শহরে গিয়ে ইংরেজি স্কুলে প্রশিক্ষণও নিয়ে আসেন।

ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যে নারীকে চরম নীচু চোখে দেখা হয়। নারী ও শুদ্রের জন্য জ্ঞান অর্জনকে গর্হিত অপরাধ হিসেবে ফতোয়া দেওয়া আছে মনুবাদী বিধানে। স্কুলে যাওয়ার পথে গালিগালাজ তো বটেই এমনকি পাথর ও গোবর ছুঁড়ে দেওয়া হত সাবিত্রী ও ফতিমার দিকে। স্কুলে পড়ানোর কাজ ছাড়াও ফতিমা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী জোগাড় করতেন। নিপীড়িত সম্প্রদায়ের মানুষদের বোঝাতেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব। ইসলামে নারীর শিক্ষার ওপর কোনও বিধিনিষেধ নাই, বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষা অর্জনে গুরুত্ব দেওয়া আছে, কিন্তু তবু নিজ সম্প্রদায়ের সংরক্ষণশীল অংশের দ্বারা প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকেও। উচ্চবর্ণের লোকেরা এমনকি জ্যোতিরাও ফুলেকে হত্যার চেষ্টাও করেছিল। তবু থেমে যাননি তাঁরা।

সাবিত্রী ফুলে অনেক প্রবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন। তাঁকে মারাঠি আধুনিক কবিতার জননী বলেও অভিহিত করা হয়। কিন্তু ফতিমা সেখ সম্পর্কে বেশি জানা যায়নি, যদিও মহারাষ্ট্রের স্কুলপাঠ্যে তাঁর নাম সম্প্রতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘দলিত হিস্টরি’ ওয়েব সাইটে ২০১৭ সালে লিখেছে,

“ফতিমা ও সাবিত্রীর বন্ধুত্ব ছিল শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। সেই পুরো পর্ব জুড়ে জ্যোতিরাও-কে লেখা চিঠিগুলিতে সাবিত্রী ফতিমার কথা সাদরে ও আগ্রহভরে বারংবার উল্লেখ করেছেন। প্রান্তিক মানুষের উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছার ভিত ও তা অর্জনের বাস্তব কাঠামো রূপেই বর্তমান সময়ে তাঁদের বন্ধুত্ব জীবন্ত হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ্যবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুসলমান, দলিত, আদিবাসী ও বহুজনদের সংগ্রামী ঐক্যের দীর্ঘ ইতিহাস আছে যা বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রায়শই ভুলিয়ে দেওয়া হয় বা অপব্যাখ্যা করা হয়।”

বর্তমান সময়ে যখন ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশক্তি নতুন করে মেয়েদের গৃহাভ্যন্তরের দাসত্বের অন্ধকারে আবদ্ধ থাকার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তখন সাবিত্রী ফুলে ও ফতিমা সেখের জীবন কাজ ও বন্ধুত্ব আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

খণ্ড-27
সংখ্যা-5