বিবৃতি
বাংলায় বামপন্থী আন্দোলনের মূল নিশানা হবে বিজেপি
press

প্রেস ক্লাবে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, বাঙালির প্রিয় দুই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক তাঁর সাংবাদিক সম্মেলন শুরু করেন। কলকাতা প্রেস ক্লাব তখন কাণায় কাণায় ভর্তি। বিহার ভোটে সিপিআই(এমএল) সহ বামেদের চমকপ্রদ সাফল্য এবং বাংলার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের ভূমিকা নিয়ে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য শোনার জন্য রাজ্যের সমস্ত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিয়ার মিডিয়ার প্রতিনিধিরাই সেখানে উপস্থিত। লিবারেশনের পলিটব্যুরো বৈঠকের অব্যবহিত পরে আয়োজিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে দীপঙ্কর মূলত তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। বিহার নির্বাচন ও তার বার্তা, ২৬ নভেম্বর দেশজোড়া ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান এবং আগামীদিনে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজ্য রাজনীতি ও বিশেষ করে সেখানে বামপন্থীদের ভূমিকা বিষয়ে সিপিআই(এমএল)-এর ভাবনাচিন্তা।

বিহার নির্বাচন প্রসঙ্গে দীপঙ্কর বলেন -- বিহারের নিরবাচনে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সরকার বদলে যাক, সেটা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। তবে মানুষের সরকার বিরোধী ক্ষোভের তীব্রতাটা বোঝা গেছে।

পোস্টাল ব্যালটের গণনার হিসেবে দেখা গেছে বিজেপি বিরাট মাত্রায় সেখানে পিছিয়ে থেকেছে। যা দেশের অন্যান্য নির্বাচনে সাধারণভাবে দেখা যায় না। এই হিসাব থেকে থেকে বোঝা গেছে শিক্ষক ও সরকারী কর্মচারিদের ক্ষোভ বিহার নির্বাচনে কী মাত্রায় ছিল। সরকারি কর্মচারীদের চাকুরির ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এই ফলাফলে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।

বিহার নির্বাচনে যে ২৫ দফার দাবিসনদ প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেখানে ছিল সমান কাজের জন্য সমান বেতন, ঠিকা প্রথা বাতিল, মর্যাদাপূর্ণ নিরাপদ কর্মসংস্থান এর ওপর বিশেষ জোর ছিল। আশা অঙ্গনওয়ারি সহ বিভিন্ন স্কিম ওয়ার্কারদের দাবি সেখানে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে হাজির হয়েছিল। সাধারণ সময়ের রাজনীতিতে চর্চিত হলেও নির্বাচনের সময়ে এই অর্থনৈতিক দাবিগুলো অনেক সময় পেছনের দিকে চলে যায়। ভালো ব্যাপার বিহার নির্বাচনে এবার এটা হয়নি। বিহার নির্বাচন বস্তুত এবার জনগণের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। সিপিআই(এমএল) সহ বামেদের ভালো ফলের চাবিকাঠিটি এখানেই নিহিত আছে।

করোনা আবহে এই নির্বাচন হয়েছে। মানুষ কিন্তু তা সত্ত্বেও বিপুল মাত্রায় ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনে সরকারটাকে বদলে দেবার আকাঙ্ক্ষা যে তাদের ছিল, এটা থেকে তা বোঝা যায়।

বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য এই প্রথম একটা বড় জোটে আমরা সামিল হই। জোট জনগণের মধ্যে তীব্র আশা তৈরি করতে সক্ষম হয়।

বামেরা এই নির্বাচনে খুব ভালো ফল করেছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর স্ট্রাইক রেট নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। জোটের দলগুলির মধ্যে সিপিআই(এমএল)-এর স্ট্রাইক রেটই সবচেয়ে ভালো। সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন মেহবুব আলম। তাঁকে সিপিআই(এমএল) বিধায়ক দলের নেতা নির্বাচন করা হয়েছে।

সিপিআই(এমএল) তিনজন ছাত্র-যুবকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছিল, যারা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন। সন্দীপ সৌরভ, জেএনইউ-এর প্রাক্তন সভাপতি জিতেছেন পালিগঞ্জ থেকে। মনোজ মঞ্জিল, সড়ক পর স্কুল আন্দোলনের নেতাও বড় জয় পেয়েছেন।

বিজেপি চেয়েছিল ভোটে হেরে গেলে দোষ হবে নীতীশের, জিতলে তা বিজেপির পক্ষে আসবে। ফলাফল বেরনোর পর বিজেপি বলার চেষ্টা করছে যে ক্ষোভ ছিল কেবল নীতীশের বিরুদ্ধে এবং সরকারটা নাকি নরেন্দ্র মোদির জন্য বেঁচে গেল। ২০১০-এর ভোটে এনডিএ ২০০-র বেশি আসন পেয়েছিল। বিজেপি তখন ৯০-এর বেশি আসন পেয়েছিল। সেটা কিন্তু প্রাক মোদি জমানা ছিল। এই নির্বাচন অবশ্যই নীতীশ বিরোধী এবং বিজেপি বিরোধীও।

বিজেপির কিছু নির্বাচনী কৌশলের কথাও দীপঙ্কর তুলে ধরেন। এই নির্বাচনে ভিআইপি পার্টি ছিল এনডিএ-র সহযোগী। তারা এক্সট্রিম ব্যাকওয়ার্ডক্লাসের প্রতিনিধি হিসেবে লড়েছিল বলা হচ্ছে। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে ১৩টা আসনের মধ্যে দুটো আসনে তারা পাঁচশোরও কম ভোট পায়। আসলে ১১টা আসনে তারা লড়ে বিজেপির ছায়া হিসেবে। তাদের চারজন জয়ীই আসলে বিজেপি নেতা। যেমন মেহবুব যাকে হারিয়ে এবার জিতলেন তিনি আগের বার প্রত্যক্ষভাবেই বিজেপিরই প্রার্থী ছিলেন। এভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের নামটুকু ব্যবহার করে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিজেপি আসলে এই অংশের মানুষকে অসম্মানই করল।

প্রশ্নোত্তর পর্বে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ও মিমের নির্বাচনে লড়ার প্রশ্নটি ওঠে। এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জানান যে অ-বাম অ-বিজেপি দলগুলো মুসলিম ভোট পেতে আগ্রহী। কিন্তু মুসলিমদের ওপর যখন আক্রমণ নামে তখন এরা চুপ থাকে বা কোনওরকমে এই ইস্যুগুলোকে পাশ কাটিয়ে যায়। এইখান থেকে অনেক মুসলিমের ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মিম-এর মতো দলের সমর্থনের ভিত্তি এখান থেকেই তৈরি হয়।

এই নির্বাচনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল কোথাও শক্তিশালী কোনও বিরোধী থাকবে না, বিজেপির এই ‘মন কি বাত’কে এই নির্বাচন আঘাত করেছে। নির্বাচন একটা আন্দোলন এর চেহারা নিয়ে শক্তিশালী বিরোধীপক্ষকে সামনে এনেছে।

নতুন সরকার সদ্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই বেশ কিছু দিক সামনে এসেছে যা অচিরেই বেশ কিছু ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

নতুন সরকার যাকে বিহারের শিক্ষামন্ত্রী বানাল তিনি আর্থিক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আগে দল থেকেই সাসপেন্ড হয়েছিলেন।

বিহারের নির্বাচন দেখিয়ে দিল আন্দোলন যথার্থ হলে মানুষের দাবি সামনে আসতে পারে ও বিজেপিকে বেগ দিতে পারে।

বাংলার আসন্ন নির্বাচন ও বামেদের অবস্থান প্রসঙ্গে দীপঙ্কর বলেন -- বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃঢ়তা দেখানোটাই এই সময়ের বাম আন্দোলনের লিটমাস টেস্ট। সেটা বিহার, বাংলা সহ গোটা ভারতের জন্যই সত্যি। বিজেপির কুৎসা ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। প্রথম পর্যায়ে আমাদের যে ৮ জন লড়েছিলেন ৭ জন তার মধ্যে জিতেছেন নড্ডা ইত্যাদিদের জোরালো আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে।

বোঝা যাচ্ছে বিজেপির সঙ্গে বামেদের মতাদর্শগত লড়াই ই সবচেয়ে তীব্র হবে আগামীদিনে।

আমার একটা কথা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আমি বলেছিলাম বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলাটা এখন সবচেয়ে জরুরি।

বিমানবাবু সবচেয়ে প্রবীণ বাম নেতা। তাঁকে পরামর্শদেওয়ার চেষ্টা আমি করছি না। আমার মূল বলার বিষয় বামেদের পুনর্জাগরণের প্রয়োজনিয়তা ও রাস্তা। সিঙ্গুর পর্বথেকে এখানে বামেদের ভোট ক্রমশ কমছে। বামেদের উঠে দাঁড়াতে হবে নতুন করে।

অন্যদিকে বিজেপির শাসন মানেই বিপর্যয়। নোটবন্দী, জিএসটি, লক ডাউন হয়ে ক্রমশ তলার দিকে চলেছে অর্থনীতি। হিন্দু-মুসলিমের ভালোবাসাকে লাভ জেহাদ নামে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলেছে। স্বাধীন দেশে খাদ্যাভ্যাস, প্রেম ভালোবাসা, মত প্রকাশের অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতার নানা দিকের ওপর হামলা চালিয়ে তারা দুঃস্বপ্ন নামিয়ে আনছে। আমরা চাই না রবীন্দ্রনাথ, চৈতন্য, লালন, সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণের বাংলায় এই দুঃস্বপ্ন নেমে আসুক।

বিজেপি গণতন্ত্রর কথা বলে যে এই রাজ্যে শক্তিশালী হবার চেষ্টা করতে পারছে, তার মূল দায় তৃণমূলের। আমরা কখনো বলিনি তৃণমূল সম্পর্কে নরম থাকুন। আমরা বলেছি তৃণমূলের অগণতন্ত্রের কথা প্রচার করে বিজেপি যেন আড়ালে থাকার সুযোগ না পায়। ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ, আসাম সহ বাংলার আশেপাশের যে সব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আছে, সে সব জায়গায় গণতন্ত্রের স্বরূপ মানুষ দেখছেন। গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিজেপির ভূমিকাকে প্রচারে সামনে আনা জরুরি। যেহেতু এটা রাজ্য নির্বাচন, তাই রাজ্যের শাসক দল নিয়েই শুধু কথা হোক, আর কেন্দ্রের শাসক দল সেই সুযোগে খানিকটা আড়ালে চলে যাক – এটা যেন না হয়।

(২৬ নভেম্বরের দেশজোড়া ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য রয়েছে প্রথম পাতায়)।

পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর আগামীদিনের আন্দোলন ও নির্বাচনী লড়াই প্রসঙ্গে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন -- লকডাউনের সময় হুগলিতে মাইক্রো ফিনান্স-এর চড়া সুদের জাঁতাকলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আদিবাসীদের বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। হাজারে হাজারে মহিলা সামিল হয়েছেন মাইক্রো ফিনান্সের সংকটের বিরুদ্ধে।

আমাদের পক্ষ থেকে এইসব আন্দোলনের বাছাই করা কয়েকজন নেতা নির্বাচনে লড়বেন। আগামী দিনের রাজ্য কমিটির বৈঠকে সেগুলো ঠিক হবে। অন্যান্য বাম দলগুলির সঙ্গেও কথা হবে।

বিহারের নির্বাচন ও বাংলার রাজ্য নির্বাচন ঠিক একইরকম নয়। বিহারে রাজ্যে কেন্দ্রে দু জায়গাতেই এনডিএ ছিল। ফলে একটা ব্যাপক এনডিএ বিরোধী জোট বিহারে তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই সরলরেখা নেই। এখানে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায়। ফলে এখানে বিজেপির বিরুদ্ধে বাম কংগ্রেস তৃণমূল সবাই মিলে জোটের অবস্থা এখন নেই। তবে মহারাষ্ট্রে বিজেপি আর শিবসেনাকে আলাদা করে দেখা হচ্ছে। আগামীদিনে এখানে কী হবে সেটা দেখা যাবে। এখন এখানে বামেদের শক্তিশালী হওয়াটা বিশেষ দরকার।

বাংলায় গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের বর্শামুখ থাক বিজেপির বিরুদ্ধে থাকুক এটা আমরা চাই। একটা গোটা রচনা তৃণমূলের বিরুদ্ধে লিখে ফুটনোটে কিছুটা বিজেপি বিরোধিতা – এইভাবে চলতে পারে না, সেটা আমরা স্পষ্ট বলতে চাই। নতুন করে বামপন্থাকে পশ্চিমবঙ্গে সামনে আনতে হবে। ২০১১-র আগের কথা বলে নয়, নতুন সময়ের নতুন ইস্যুগুলির মোকাবিলা করেই এটা করতে হবে বামপন্থীদের।

খণ্ড-27
সংখ্যা-41