কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে?
How active is the ear

কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছিল, বিশ্বে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬৯ লক্ষ মানুষের, যে সংখ্যাটা সরকারী পরিসংখ্যানের দ্বিগুণেরও বেশি। ইন্সটিটিউট অব হেল্থ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ভ্যালুয়েশন এমনটাই জানিয়েছিল। ভারতবর্ষেও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাটা যে অনেক বেশি সেই অনুমানকেই সত্যতা দিল যোগীরাজ্যের পরশ হাসপাতালের গত ২৬ এপ্রিলের ভয়ঙ্কর ঘটনা। মক ড্রিলের নাম করে অক্সিজেন বন্ধ করে অন্তত ২২ জন রোগীকে কার্যত হত্যা করার ঘটনাকেও প্রশাসন প্রথমে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পরে চাপের মুখে তদন্ত শুরু হয়েছে। এমন বহু মৃত্যুর কোনো হিসেবই নেই।

শিশু অধিকার রক্ষা বিষয়ক জাতীয় কমিশনের রিপোর্ট বলছে-গত বছর এপ্রিল থেকে এ বছর ৫ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৩৬২১টি শিশু কোভিড-অনাথ হয়েছে। বাবা-মায়ের কোন একজনকে হারিয়েছে এমন শিশুর সংখ্যা ২৬০০০-এরও বেশি। এটা সরকারী পরিসংখ্যান। কার্যত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হতে পারে। এই অনাথ শিশুদের দায়িত্ব হয়তো সরকার বা বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নেবে। কিন্তু বাবা-মায়ের আদর থেকে ওরা চিরবঞ্চিত থেকে যাবে।

লকডাউনে পেটের তাগিদে মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারে কাজে গিয়েছিল একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ইকবাল হোসেন। ঠিকাদারের দালাল বলেছিল, পাইপ বসানোর কাজ। কিন্তু নামানো হল নর্দমা পরিষ্কারের কাজে। অনভিজ্ঞ কিশোর বিষাক্ত গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে আর উঠতে পারেনি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। একই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে তার সঙ্গী আরেক তরুণের। অসুস্থ আরও অনেকে । মাত্র কিছু দিন আগে একই ভাবে মারা গেছেন আরও চারজন কলকাতায় নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে। এইসব মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল?

মধ্য ত্রিশের শিক্ষক, সুস্থ দেহে ইলেকশন ডিউটি করতে গিয়েছিলেন। ফিরলেন সংক্রমণ নিয়ে। স্ত্রীও সংক্রমিত হলেন। দু-বছরের ছোট্ট সন্তানটিকে রেখে দুজনেই চলে গেলেন অক্সিজেনের অভাবে। এই শিশুর বাবা মায়ের স্নেহ-আদর থেকে চিরবঞ্চিত হয়ে হতভাগ্য জীবন কাটানোটা তো অনিবার্য ছিল না! রাস্তার ধারে রুটি সব্জির দোকান চালিয়ে মেয়েকে মনের মতো গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল অনূর্ধ্ব চল্লিশের এক মা। সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে একটি বেডের অভাবে স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে চলে যেতে হল তাকে। তার কবন্ধ সংসারটার কী হবে!

দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই অক্সিজেনের, ওষুধের, বেডের অভাবে গণচিতা জ্বলেছে। নদীর চরে গণকবর দিতে হয়েছে। গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে সংক্রমণে। কারণ গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অত্যন্ত করুণ অবস্থায় এই সংক্রমণ রোখা তথা মানুষকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয়। মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিটি মানুষের একটা নাম ছিল, ঘর ছিল, সংসার ছিল। পরিবারে পাড়ায় সমাজে কর্মস্থলে নানা সম্পর্কের বাঁধনে ছিলেন তারা। আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক। কিন্তু সরকার নিজের অপদার্থতা ঢাকতে সংখ্যা গোপন করতে গিয়ে, শুধু যে তাদের মৃত্যুকে অস্বীকার করছে তই-ই নয়, অসম্মানও করেছে। তারা সকলেই ভারতবর্ষের মানুষ। এমন ভয়ঙ্কর কষ্টের অকালমৃত্যু, মৃতদেহের এমন নিষ্ঠুর পরিণতি তো প্রাপ্য ছিল না কারও! কেন হল? তাদের অপরাধ একটাই। এমন একটা সরকারের তদারকিতে থাকা যার হৈমালিক ঔদাসীন্যের কাছে, তীব্র অহমিকার কাছে, মূঢ় আত্মম্ভরিতা আর আত্মসন্তুষ্টির কাছে সাধারণ নাগরিকের ধন, প্রাণ, মর্যাদা-সব তুচ্ছ! অমর্ত্য সেন একেই ‘স্কিৎজোফ্রেনিয়া’ বলেছেন।

পঞ্চাশের (১৯৪৩-৪৪ সাল) মন্বন্তরে এই বাংলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩০ লক্ষ মানুষ স্রেফ না খেতে পেয়ে। তার কারণ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, ব্রিটিশ শাসকের নিষ্ঠুর বর্ণবিদ্বেষী ঔপনিবেশিক নীতি। সম্প্রতি এক ভারতীয় তথা বাঙালি গবেষক সরাসরি এই গণসংহারের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দায়ী করেছেন।

Dead by corona virous

 

আজকের ভারতের এই অতিমারীজনিত গণসংহারের জন্য দায়ী অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের একটি নির্বাচিত সরকারের চরম ঔদাসীন্য, ভ্রান্ত স্বাস্থ্য নীতি এবং অতিমারী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমাহীন অপদার্থতা। গোটা বিশ্বেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

অতিমারী পরিস্থিতিতে কোভিড ছাড়াও অন্যান্য রোগে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল অবস্থাটা সম্পূর্ণ বেআব্রু হয়ে পড়েছে।

লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকরা কতজন পথেই ক্ষুধা ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছে অসুস্থ হয়ে বা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সরকারের নির্মমতায়। কাজ হারিয়ে কঠোর দারিদ্র্যের নির্মম পেষণে অনাহারে মারা গেছেন অনেক মানুষ। নিরুপায় হয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন কতজন। সে সব হিসেব কি সরকারের ঘরে আছে! তিনটি জনবিরোধী কৃষি আইনের বিরোধিতায় দীর্ঘদিন ধরে চলা কৃষক আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছেন সে খবর রাখেন দাম্ভিক মোদী!

কেন্দ্রীয় সরকারের সাত বছরের অপশাসন সমাজ পরিসরেও এক অমানবিক বিদ্বেষপূর্ণ হিংস্র আবহ তৈরি করেছে যার বলি হয়েছে বহু প্রাণ-ভীড় হিংসায়, পিতৃতান্ত্রিক বর্বরতায়, জাতি ও বর্ণ বিদ্বেষে। সমাজ যেন ক্রমশ গরিব শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যুতে নিস্পৃহ উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। তাই পরের পর দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চলে গেল কত প্রাণ। বজ্রাঘাতে দু'দিনে তেত্রিশটি প্রাণ বলি হল।

এইসব মৃত্যুকে অসম্মান ও অস্বীকৃতি জানানোর ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রতিটি মৃত্যুকে স্মরণে রাখা, শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে সমাজে বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা এক গণস্বাক্ষরিত আবেদনে জানিয়েছেন, মানবতা যখন সরকারের কাছে সংখ্যাগত পরিসংখ্যান মাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমাদের নিজেদের মধ্যেকার মনুষ্যত্বকে জ্বালিয়ে তুলতে হবে। সরকার আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের অস্তিত্ব ভুলিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু আমরা তাদের ভুলবো না! আমরা তাদের প্রত্যেককে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করব। প্রতিটি অঞ্চলে পাড়ায় মহল্লায় প্রতিটি মৃত্যুর হিসেব রাখতে, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গে তাদের ব্যথা, কষ্ট ভাগ করে নিতে প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় দীপ জ্বালিয়ে সমবেত বা ব্যক্তিগতভাবে স্মরণ অনুষ্ঠানের আহ্বান রেখেছেন।

প্রতিটি মোমবাতির আলোয় উৎসারিত হোক প্রয়াত প্রিয়জনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আর দাম্ভিক সরকারের অমানবিক তার বিরুদ্ধে শাণিত প্রতিবাদ!

-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-21