ভারতে কোভিড সৃষ্ট গণহত্যা: মোদীকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে
Modi Must Go

কোভিড-১৯ সংক্রমণ যাদের প্রাণ কেড়ে নিল তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশে প্রধানমন্ত্রী মোদী টিভি ক্যামেরার সামনে যে অশ্রু ঝরালেন, তাতে দেরি হয়ে গেল অনেক; দেরি হয়ে গেল তাঁর সরকারের ঔদাসীন্যের জন্য দুঃখপ্রকাশে, যে ঔদাসীন্যই ঐ মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের বা আমাদের হারানো স্বজনদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে তিনি চোখের জল ফেলছেন না, ঐ মৃত্যুগুলোতে নিজের ভূমিকায় অনুতপ্ত হয়েও তিনি অশ্রুপাত করছেন না – তাঁর অশ্রুমোচন এই জন্য যে, আমরা যেন তাঁর প্রতি সমব্যথী হই এবং যে সমালোচনা তাঁর প্রতি বর্ষিত হচ্ছে তার থেকে তাঁকে রেহাই দিই। তবে, যে বিপর্যয়ের মধ্যে তিনি নিজেই দেশকে এনে ফেলেছেন, তারই এক বলি হিসাবে তিনি নিজেকে তুলে ধরতে পারেন না।

যে মোদী বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমার জন্য কৃতিত্বের ভাগীদার করেছিলেন তাঁর ‘সৌভাগ্য’কে, আজ তিনি কিন্তু কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের নির্মমতা থেকে নিজের দায়কে ঝেড়ে ফেলতে পারেন না। প্রথম ঢেউ চলার সময় তথাকথিত “করোনার উপর বিজয় অর্জনের” জন্য নিজের নেতৃত্বকেই বারবার কৃতিত্ব দিয়েছিলেন –  এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিপর্যয়ের দায় তিনি বিরোধী পক্ষের ওপর, “কংগ্ৰেসের সত্তর বছরের শাসনের ওপর” বা অন্য কোনো নন্দ ঘোষের ওপর চাপাতে পারেন না। এই যে মৃত্যুগুলোকে এড়ানো যেত, সে মৃত্যুগুলোর দায় সম্পূর্ণতই প্রধানমন্ত্রী মোদীর।

আরএসএস প্রধান এবং কয়েকজন হাতুড়ে ধর্মগুরু “নেতিবাচকতা”কে সরিয়ে তার স্থানে “ইতিবাচকতার” মনোভাব দেখানোর প্রয়োজনিয়তার উপদেশ ভারতবাসীদের দিচ্ছেন (নেতিবাচকতা বলতে সরকারের সমালোচনা এবং অতিমারীর দৈনন্দিন বিভীষিকার উল্লেখকে বোঝানো হয়েছে)। আরোপিত এই “ইতিবাচকতা” ভারতবাসীর কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হয়েই দেখা দিচ্ছে, যে ভারতবাসীদের সরকার অতিমারীর পরিস্থিতিতে পরিত্যাগ করে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যে ভারতবাসীদের প্রতিদিনই লড়াই চালাতে হচ্ছে – যে লড়াইটা প্রায়শই ব্যর্থ হচ্ছে – অক্সিজেন, ওষুধ, হাসপাতালের শয্যা, টিকা এবং এমনকি মর্যাদা সহকারে নিকটজনদের দাহ করা বা সমাধিস্থ করার জন্যে।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে “ইতিবাচক” হওয়ার যে দাবি ভারতবাসীদের কাছে করা হচ্ছে সেটাই চূড়ান্ত অমানবিক। ভারতে অতিমারী সৃষ্ট নির্মমতম বিভীষিকার ওপর “ইতিবাচক” আবরণ চাপাতে আর এস এস ও বিজেপির ব্যবহার করা নির্দয় ও নির্লজ্জ ভাষা বিষয়টাকে আরও কদর্য করে তুলছে। আরএসএস প্রধান ঘোষণা করলেন – কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে যাঁরা মারা গেলেন তাঁদের “মুক্তি ঘটেছে” এবং মৃত্যু নিয়ে ভারতবাসীর বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, কেননা, গোটা ব্যাপারটাই “জীবন ও মৃত্যুর চক্র”। গঙ্গায় ভেসে যাওয়া এবং গঙ্গার তীরে গণ কবর দেওয়া হাজার-হাজার মৃতদেহ সম্পর্কে বিজেপির এক নেতাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এগুলো পবিত্র হিন্দু ঐতিহ্য “জল সমাধির” সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ! উত্তরপ্রদেশের প্রত্যেকটা গ্ৰামেই এখন মৃত্যু হানা দিচ্ছে, এবং তা দ্রুতই উত্তর ভারতের সমস্ত গ্ৰামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। মর্যাদার সঙ্গে স্বজনদের দাহ করার উপায় না থাকায় বা স্থান না মেলায় দরিদ্ররা মৃত স্বজনদের হয় নদী তীরে সমাধিস্থ করতে বাধ্য হচ্ছেন, আর না হয় সেগুলোকে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন নদীর জলে যেখান থেকে স্রোত বেয়ে সেগুলো চলে যাচ্ছে বিহারে। কিন্তু কেন্দ্রে এবং উত্তরপ্রদেশেও শাসন ক্ষমতায় থাকা বেহায়া বিজেপি আমাদের বলছে যে, আমাদের নাকে যা ঢুকছে তা লাশের পচা দুর্গন্ধ নয়, বরং তা ফুলের সুবাস।

ইতিমধ্যে টিকার অনটন দেখা দিয়েছে, এবং তার সাথেই হ্রাস পেয়েছে টিকার জন্য নাগরিকদের কাছে আসা সরকারী বার্তা। এছাড়া, ফাঙ্গাস রোধী ওষুধ অ্যামফোটেরাইসিন-বি-এর আকালও প্রবল আকারে দেখা দিয়েছে, যার ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থতির জন্য ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়া যে সমস্ত কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুকে এড়ানো যেত, তা আর সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণের জন্য নির্ভরযোগ্য এবং সস্তায় স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভের ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতিতে অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত হচ্ছে হাতুড়েদের, যারা কোভিড-১৯-এর আরোগ্য হিসাবে ফেরি করছে কুসংস্কার এবং “অলৌকিক নিরাময়”।

মোদী সরকার সংক্রমিতদের এবং মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাকে চেপে দিচ্ছে: কোভিড মোকাবিলার যথাযথ উপায় বার করতে এবং জীবন বাঁচাতে যে তথ্য একান্তই জরুরি। গুজরাটের যে  কবি “শববাহী গঙ্গা” নামক তাঁর  কবিতায় বলেছেন “আমাদের রাজা নগ্ন”, সেই কবির ওপর তীব্র আক্রমণ হানছে বিজেপির ট্রোল বাহিনী। যে সমস্ত মানুষ এবং এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অক্সিজেন অমিল হওয়া নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন, “জাতীয় নিরাপত্তার” প্রতি বিপদ ছাপ দিয়ে তাদের গ্ৰেপ্তার করা হচ্ছে। বিরমবিহীন এই সমস্ত আক্রমণ সত্ত্বেও প্রশ্ন ওঠানোকে কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। মোদী সরকার শাসন ক্ষমতায় বসে থাকলে কোভিড-১৯ সৃষ্ট গণহত্যার পথই প্রশস্ত হবে। ভারতকে যদি বাঁচতে হয়, অন্তত এখনকার মতো গ্ৰামের পর গ্ৰাম উজাড় হওয়াকে যদি আটকাতে হয় – তবে মোদীকে অবশ্যই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে।
– (লিবারেশন সম্পাদকীয়, জুন ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-20