“বিকল্প’ বামের বেহাল দশা” লেখাটি প্রসঙ্গে কিছু কথা
Some words in the context of the article

(‘বিকল্প’ বামের বেহাল দশা কেন, সে প্রশ্নও উঠুক একটি লেখা এই সময় কাগজে লিখেছিলেন সৌমিত্র দস্তিদার। সেই লেখাটির পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাটি লিখেছেন নবেন্দু দাশগুপ্ত)

সৌমিত্রবাবু পাঠকদের বোঝাতে চেয়েছেন নকশালপন্থা হল কয়েকটি গোষ্ঠীর সমাহার। নির্দিষ্ট কোনও দল নয়। এই চালাকির মাধ্যমে তৃতীয় ধারাকে অপ্রাসঙ্গিক করার কসরৎ তিনি করেছেন। ‘সংযুক্ত মোর্চা’র ভরাডুবির জন্য নকশালপন্থীদের দায়ী করেছেন। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘কলঘরের বিশ্রী ঝগড়া’য় ওনার নজরে পড়েনি ‘চটি চাটা’ ‘ডেপোঙ্কর’ ইত্যাদি টুম্পা মার্কা সংস্কৃতির বুলিগুলি। তথ্যচিত্র নির্মাতা হয়ে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলুন! লিখেছেন ‘নকশাল আন্দোলনের বয়স এখন চুয়ান্ন’। ‘যে রাজ্যে নকশালবাড়ি, সেখানেই কেন তার এই বেহাল দশা’। এরপরের প্রশ্ন হবে তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ কেন বেহাল? শেষে করবেন মার্কসের জার্মানি, লেনিনের রাশিয়ার কেন এই হাল? গুড বাই। আমরা কিন্তু প্রশ্ন করবো না আইএসএফ হুগলির জাঙ্গিপাড়া বিধানসভায় বেহাল এবং ভাঙড়ে কেন বাজিমাত করল।

আপনার কল্পকথা – “আধা বা পুরো সামন্তবাদ কিংবা লগ্নি না মুৎসুদ্দি পুঁজি, নয়া না জনগণতন্ত্র, এসব তাত্ত্বিক কচকচানি তো অনেক হল। গ্রামের বা শহরের গরীব দুটো ভাত চায়। পরনের কাপড় চায়, ছেলেমেয়ে যেন লেখাপড়া শিখে বড় হতে পারে, তার স্বপ্ন দেখে”। দায়িত্ব নিয়ে বলছি এই বিতর্ক এম-এল ঘরানায় নেই। মধ্যবিত্ত চালাকি দিয়ে নিজের অজ্ঞানতাকে খামোখা কেন জাহির করছেন!

আপনি সনাতনপন্থী বা প্রাচীনপন্থী চশমা চোখে দিয়ে সেকালের নকশালবাড়িতে আছেন, একালের নকশালপন্থায় আসুন। দেখবেন পরিবর্তন হয়ে চলেছে, আর আত্মসমালোচনা তার ভিতরেই আছে। আনুষ্ঠানিক আত্মসমালোচনা করার তাত্ত্বিক কাঠামো ৮০ দশকেই লিবারেশন ভেঙে দিয়েছে। আপনি লিখেছেন পার্টি কর্মসূচি, রাষ্ট্রের চরিত্র বা কৃষি অর্থনীতি মোটামুটি ষাটের দশকে আটকে আছে। কোনো কিছু না পড়ে না জেনে খবরের কাগজে লিখে দিলেন! লিবারেশন ইতিমধ্যেই দশম কংগ্রেস সম্পন্ন করেছে। লিবারেশনের আরকাইভে সব দলিল পেয়ে যাবেন। পড়ে তারপর মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখুন, সমালোচনা করুন। তা না হলে ২০০৭ সালের বাংলার শিল্প ও বিরোধীদের ভূমিকা নিয়ে তৈরি করা ফরমায়েশি তথ্যচিত্রের মতো হয়ে যাবে।

তথ্যচিত্র নির্মাতা লিখছেন ‘মিডিয়ার একটা অংশও লিবারেশন, কিংবা বলা ভালো তাদের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে আগামীর বাম আইকন হিসেবে যে সামনে আনছেন, সেটা বোঝা যায়’। ইনি বলতে চান নকশালপন্থীরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে কেন সামনের সারিতে থাকবেন বা প্রচার পাবেন! তারজন্য তো ওনার সংযুক্ত মোর্চার জোটই যথেষ্ট। লিবারেশনকে নিশানা বানিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি শিবের গীত গেয়েছেন। শ্রেণি ভিত্তি মধ্যমবর্গ ইত্যাদি নিয়ে কাচের ঘরে বসে গবেষণা করে চলেছেন। উনি জানেন না বিহার বিধানসভা নির্বাচনে যে ১৯ জন লিবারেশন প্রার্থী ছিলেন তাঁরা সবাই দলিত, ওবিসি এবং মুসলমান। উনি খবর রাখেন না লিবারেশনের সাংগঠনিক কাঠামোগুলোর। একদম ফিল্মি ডায়লগ দিয়েছেন ‘ফের গ্রামমুখী হতেই হবে’। আর উনি শহর সামলাবেন। আপনার কথা ‘দুর্বল’ নকশালপন্থা। সেই নকশালপন্থাকে শেষ করতে মুলুক, করন্দা, কৃষ্ণনগরের গোপালপুর কত গণহত্যা হয়ে গেল, কিন্তু তারা শেষ হয় না! আপনার পছন্দের বামদল আবার তাদের নিয়েই কর্পোরেট হামলার বিরুদ্ধে, শ্রমকোডের বিরুদ্ধে, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে, নতুন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে, নারীর অধিকারের দাবিতে একসাথে মিছিলে হাঁটে। এটাই একালের নকশালপন্থা। নকশালপন্থীরা কয়েকটি পকেটে আছে ঠিকই লিখেছেন, মূল্যায়ন তো করতেই হবে কেন লাফিয়ে লাফিয়ে সংগঠন বাড়ছে না। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়, যাদের অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখাই যায় না, তাদের ‘বিজেপি কে ভোট নয়’ প্রচারে সংযুক্ত মোর্চার ৩০ শতাংশ ভোট অন্যের বাক্সে জমা হল কিভাবে, এই অনুসন্ধানটা করুন। আর মোদীজীর মতো ‘আরবান নকশাল ভূত’ যদি মাথায় ঢুকে যায়, তা হলে রাতের ঘুম গেল। বাম বিকল্প সব বামেদের নিয়েই হবে, তবে এই বামফ্রন্টের কাঠমোতে নয়। নতুন আঙ্গিকে, নতুন দিশায়। নকশালপন্থীদের জন্যে অন্য কিছু হবে না।

খণ্ড-28
সংখ্যা-23