শতাব্দীর সন্ধিলগ্নে রাষ্ট্রবিপ্লবের মহড়া অথবা কাঙালদের মালসাট বা আস্ফালন বৃত্তান্ত
The rehearsal of the Revolution


(২৩ জুন নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্মদিন ছিল। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রইলো এই লেখাটি)

“ঘাটের দু ধারে বসার রোয়াক। বাঁ দিকটাতে তিনজন বসেছিল। একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে মোটা আর তিননম্বরকে দেখলেই বোঝা যায় পাগলাখ্যাঁচা। ... এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক যে, বাঁ দিকের তিনজন হল ফ্যাতাড়ু যারা গোপন একটি মন্ত্রের বলে উড়তে পারে এবং নানা ধরনের অনুষ্ঠান বা সুখের সংসারে ব্যাগড়া দিয়ে থাকে। ফ্যাতাড়ু আরও অনেক আছে। কিন্তু আপাতত এই তিনজনকে চিনলেই কাফি। ঢ্যাঙা মালটা হল মদন। ওর ফলস দাঁত পকেটে থাকে। বেঁটে কালো মোতাটা হল ডি এস। ওই নামে একটি হুইস্কি আছে – ডিরেক্টরস স্পেশাল। ওর তোবড়ানো – মচকানো ব্রিফকেসের দু পাশে নাম ও পদবির আদ্যক্ষর সাঁটা আছে যদিও পড়া কঠিন। তিন নম্বর স্যাম্পেলটা হল কবি পুরন্দর ভাট।”

পাঠকের সাথে ফ্যাতাড়ুদের নবারুণ প্রথম পরিচয় করালেন খানিকটা অনাড়ম্বর ভাবেই। কিন্তু ফ্যাতাড়ুরা ও তাদের চমকপ্রদ কার্যকলাপ (মালসাট কথাটির অর্থ মল্ল আস্ফোট বা বানরদের হাতের আস্ফালন। দ্রষ্টব্য – বাঙ্গালা ভাষার অভিধান – জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস – দ্বিতীয় খন্ড – পৃ-১৭৬২, সাহিত্য সংসদ প্রকাশনা)  সমকালীন বাংলা আখ্যান সাহিত্য ও সেই পরিধি পেরিয়ে সার্বিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এমনকী সমাজতত্ত্ব রাজনীতি জগতেও সাড়ম্বর চর্চার বিষয় হয়ে উঠল অনতি বিলম্বেই। ১৯৯৯ এর শেষ মাসটিতে প্রমা পত্রিকায় প্রথমবারের জন্য ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেন নবারুণ, ‘’কাঙাল মালসাট’ এর দ্বিতীয় কিস্তি নতুন শতাব্দীর প্রথম মাসে ফ্যাতাড়ুদের পরিচয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কাঙাল মালসাট ছাড়াও বিভিন্ন ছোটগল্প সংকলনে ফ্যাতাড়ুরা এসেছে, যেমন ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক’ এ বা ‘ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক’ এ। ফ্যাতাড়ুদের বিচিত্র কার্যকলাপ এর এপিসোডিক বিবরণ সেখানে পাওয়া যাবে। আপাতত আমাদের আলোচনা ‘কাঙাল মালসাট’কে নিয়েই।

কাঙাল মালসাটে ফ্যাতাড়ুদের প্রথম উন্মোচন, যেখানে ফ্যাতাড়ু আর চাকতিদের যৌথ ফ্রন্ট ওয়ার ঘোষণা করে লালবাজার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। এর আগে নকশালবাড়ি ও সেইসূত্রে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ এর ধারণাকে নবারুণ নানাভাবে নিয়ে এসেছেন ‘হারবার্ট’ ও ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’তে। নকশালবাড়ির কিছু উল্লেখ ‘কাঙাল মালসাট’ এও আছে, কিন্তু তার খানিক অপরিকল্পিত প্রস্তুতির কথাই এখানে ইঙ্গিত করেন নবারুণ। তবে নয়া রাষ্ট্রবিপ্লবে সেখান থেকে প্রেরণা নেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্যই আছে। “নকশালদের কোনও পরিকল্পনা ছিল কি? থাকলেও আগেভাগেই তো তারা মরে গেলো”। অথবা “প্রথমে আরসিপিআই, পরে নকশাল – সবই আনপ্রিপেয়ার্ড স্ট্রাগল। অথচ স্বপ্ন দেখা তো থামেনি। সেই বন্দুক আজ আমরা হাতে হাতে, ঘরে ঘরে ...”

রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পুরোদস্তুর এক মিলিটারি স্ট্রাটেজির কথা ভাবে ফ্যাতাড়ু-চাকতি যৌথ ফ্রন্টের কমাণ্ডার মার্শাল ভদি এবং উপন্যাসের অগ্রসরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রমশ সেই পরিকল্পনার সাথে পরিচিত হই। অবশ্যই ‘কাঙাল মালসাট’ একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক উপন্যাস কিন্তু ফ্যাতাড়ু-চাকতিদের রাজনীতিটা টানা কোনও ন্যারেটিভ বা বর্ণনার মধ্য দিয়ে এখানে আভাসিত নয়। বরং চলতি রাষ্ট্র ও রাজনীতি কাঠামোর একটি পুরোদস্তুর ক্রিটিক হিসেবেই তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ। সেই রাষ্ট্র ও রাজনীতি কাঠামোর বিভিন্ন দিকগুলিকে নবারুণ উপন্যাসের বিভিন্ন পরিসরে ছড়িয়ে রাখেন। ফ্যাতাড়ুদের ডিসরাপশান অভিমুখী কার্যকলাপের সঙ্গে আখ্যানের এই প্যাটার্নটা বিশেষ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এই উপন্যাস যখন লিখছেন নবারুণ তখন ভারতে নব্য উদার অর্থনীতির জমানা এক দশকের বেশি সময় অতিক্রম করে ফেলেছে। সমস্ত কিছু সহ ছোটদের খেলাধূলাকেও পণ্য বানাবার কারবার সাফল্য পেয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় রমরমিয়ে চলছে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প। “আজ বাঙালি অন্য নানা খেলার মতো ফুটবলেও কেলিয়ে পড়েছে এবং ক্রিকেট বা টেনিসে গুচ্ছের টাকা বলে বাঙালি বাপ মায়েরা বাচ্চাগুলোকে হ্যাঁচকা টানে ঘুম থেকে তুলে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নাকি হুদো হুদো কোচ, যারা বরং কোচোয়ান হলে আরও ভালো হত।”

ফ্রেডরিক জেমসন যাকে ‘কালচারাল লজিক অব লেট ক্যাপিটালিজম’ বলেছিলেন ‘পোস্টমর্ডানিজম’ নামাঙ্কিত তাঁর বিখ্যাত বইতে, তা তখন ভালোরকম ফ্যাশানেবল। দেরিদা ফুকো লাঁকা বাখতিন আদি ব্যক্তিবর্গ উচ্চারিত হন কিন্তু তাদের চিন্তার ছকভাঙা প্যাটার্নের বাইরে থাকতেই পছন্দ করে এসব আউড়ানো বুদ্ধিজীবী আজ্ঞাবহ দাসকুল। বস্তুতপক্ষে কাক কাকের মাংস খায় না এই প্রবাদকে এড়িয়ে গিয়েই সমকালীন বুদ্ধিজীবী মহল/লেখক সমাজকে নিয়ে নবারুণ ভালোরকম তামাশা করেছেন এখানে। “আজ বাঙালি কথায় কথায় সেমিনারে বাখতিন ফুকো ঝাড়ে, ভবানীপুর এলাকায় পাঞ্জাবি ও গুজরাটিদের দাপট ও রোয়াব সম্বন্ধে গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্ব আওড়ায়, বিগ ব্যাং হইতে স্মল ব্যাঙাচি সকলই তার নখের ডগায় ডগোমগো হইয়া রহিয়াছে ...” কিন্তু আসলে বুলি সর্বস্ব এরা আজ্ঞাবহ দাস বৈ অন্য কিছু নয়। পুরন্দর ভাটের কয়েকটি ‘অমোঘ লাইন’ এর মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ক্রিটিকটাকে স্যাটায়ারের বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নবারুণ

“আজ্ঞাবহ দাস, ওরে আজ্ঞাবহ দাস
সারা জীবন বাঁধলি আঁটি,
ছিঁড়লি বালের ঘাস,
আজ্ঞাবহ দাসমহাশয়, আজ্ঞাবহ দাস!
যতই তাকাস আড়ে আড়ে,
হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে,
বাম্বু ভিলার রেকটো – কিলার,
গাঁট – পাকানো বাঁশ,
আজ্ঞাবহ দাস রে আমার, আজ্ঞাবহ দাস।”

বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতাধরের সঙ্গে হাঁটার স্পৃহা ও সময় বিশেষে নিরপেক্ষ থাকার আড়ালে গা বাঁচানো মনোভাবটি নবারুণ আবার ফিরিয়ে আনেন স্বাক্ষরিত নির্বিষ সব বয়ান প্রকাশনার মধ্যে দিয়ে দায় সারার মানসিকতার সূত্রে।

“এ কথা কে না জানে কোথাও কোনো গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা কালবিলম্ব না করেই সদলবলে একটি ঘোষণাপত্র বা আবেদন বা একটি ফাঁকা থ্রেট প্রকাশ করে থাকেন যাতে বড় থেকে ছোট, শুডঢা থেকে কেঁচকি, লেখক শিল্পী, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র শিল্পী থেকে শুরু করে সকলেই সই দিয়ে নিজেরাও বাঁচেন অন্যদের বারটা বাজাবার রসদ যোগান। শুধু এই ধরনের আবেদনে বা প্রতিবাদপত্রে সই করেই অনেকে লেখক বলে নিজেদের পরিচিত করতে পেরেছেন। কেউই এই ধরনের ব্যাপারে সই দেওয়া থেকে বাদ পড়তে চান না। বাদ পড়ে গেলে খচে লাল হয়ে যান।”

Malsat of the poor

 

ফ্যাতাড়ু ও রাষ্ট্রশক্তির যুদ্ধের সময়ে তারা নাকি লিখেছিল “সংগ্রাম যেমন দরকার তেমন বিশ্রামেরও দরকার। শেষোক্ত প্রয়োজনটি আমাদের খুবই বেশি।”

উপন্যাস রচনার সমকালে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার শিল্পায়ন উন্নয়নের নতুন মডেলের কথা সোচ্চারে সামনে আনছিল। নবারুণ কিন্তু ‘ক্লাস লাইন’ থেকে সরেননি একটুকুও। শিল্পায়নের ঢক্কানিনাদ এর তলায় আসলে বহমান বি-শিল্পায়নের বাস্তব ছবিটা তুলে আনেন তিনি। উপন্যাসের সপ্তম পর্বে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এর সম্মেলন ও সেই সূত্রে ‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে নতুন জোয়ার আসছে’ এই সরকারী প্রচারকে নিয়ে রঙ্গ-তামাসা রয়েছে, রয়েছে উন্নয়নের সামগ্রিক মডেলটিকে নিয়েই তীব্র খেউড়। বস্তুতপক্ষে চাকতি ও ফ্যাতাড়ুদের দ্বারা সাবঅল্টার্ন সাবভার্সান এর ব্যাকড্রপ হিসেবে এই পলিটিকাল ক্রিটিকটাকেই ক্রমশ সামনে আনতে থাকেন নবারুণ।

“আজ চেয়ারম্যান (উক্ত ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের) শালা নার্সিংহোমে গেছে, এর পরে দেখবি কি হয়। কোনো ঢপবাজকে আমরা রেয়াত করব না। কম করে ৫০ হাজার ছোট বড় কারখানা হয় বন্ধ নয় হাঁপের টানে ধুঁকছে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই, বাড়া ডাউনস্ট্রিম মারাচ্ছে। ফরমুলা ওয়ান রেসিং! হোটেল! কার পার্কিং প্লাজা! সামলাও এবার চাকতি।”

বন্ধ কলকারখানার প্রসঙ্গ যেমন এখানে আসে, তেমনি আসে হকার উচ্ছেদ অভিযানের কথাও। আমাদের ভুলে যাবার নয় উপন্যাস রচনার কাছাকাছি সময়ে হকার উচ্ছেদ তথা ‘অপারেশন সানসাইন’ নিয়ে বিপুল আলোড়ন এর কথা।

অভিমুখ বদলের পেছনের কারণকে সামনে আনেন নবারুণ। স্পষ্টভাবেই। লেফট ফ্রন্ট সরকার নিও লিবারাল অর্থনৈতিক নীতিমালার সঙ্গে কীভাবে আস্তে আস্তে সমীকৃত হয়ে যাচ্ছে সেটা দেখান তিনি। ধরে দেন বদলে যাওয়া নেতৃত্বের চেহারাটিও। সি এম-এর মধ্যে যদি জ্যোতি বসুর ছায়া দেখি আমরা, তবে কমরেড আচার্য নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর আদলটিকে মনে করিয়ে দেয়। সমকালীন সিপিএম-এ ‘দু লাইন’-এর দ্বন্দ্বও এখানে এসেছে, এসেছে তার মধ্যে কমরেড আচার্যর দোদুল্যমান অবস্থানের কথা।

উপন্যাস রচনার সেই সময়টিতে সিপিএমের মধ্যে সমীর পুততুণ্ড, সৈফুদ্দিন চৌধুরীরা তখন প্রকাশ্যেই ‘বাধাহীন উন্নয়ন’-এর পক্ষে সওয়াল করছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলছেন। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক লাইন গ্রহণের প্রশ্নে কমরেড আচার্যর মতো অনেকেই তখন দোদুল্যমান। আসলে দক্ষিণমুখী অভিযাত্রার প্রবক্তাদের নিয়ে সাংগঠনিকভাবে কী করা হবে দ্বন্দ্ব এখানেই তো সীমিত ছিল না, পুঁজিবাদী উন্নয়নকে ব্যবহার করে নেওয়া যায় কিনা – সেই ভাবনায় কমরেড আচার্যরাও বেশ দ্বিধাগ্রস্থ তখন। পরবর্তী এক দশকের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে সে যাত্রায় দক্ষিণপন্থী অভিযাত্রীরা পার্টির বাইরে চলে গেলেও ক্রমশ উন্নততর বামফ্রন্টের নামে গোটা সরকার ও তার প্রধান নায়কেরা নিজেরাই সরবে দক্ষিণমুখী অভিযাত্রায় সামিল হয়েছেন। সে পর্ব অবশ্য উপন্যাসের আলোচ্য সীমা চোহদ্দির বাইরে। এখানে কমরেড স্ট্যালিনের সঙ্গে আধা তন্দ্রার ঘোরে থাকা কমরেড আচার্যর যে কল্প সংলাপ শুনিয়েছেন নবারুণ, তা আসলে বিপ্লবী বামপন্থা ও সংশোধনবাদী প্রবণতার মধ্যে চলমান দ্বিরালাপই।

“বিপ্লব করেছিস? কাকে বলে জানিস ? … করিস ত শালা ভোট। আর কিছু করতে পারবি বলেও ত শালা মনে হয় না। যেগুলো আলটু ফালটু গাঁইগুঁই করছে সেগুলোকে এত তোয়াজ করছিস কেন ? ...”
“গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা ওদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যেখানে দু মাস বরাদ্দ সেখানে তিন মাস ...”
“ওদের কথা বাদ দে। তর মনটা কোন দিকে? সেটা কি ঠিক করেছিস ?” ...
“কিছু তো ভেবে উঠতে পারছি না”।
“কুকুর যেভাবে বমির কাছে ফিরে যায় সেভাবেই ওরা বুর্জোয়া গলতায় গিয়ে ঢুকবে...”

কমরেড আচার্য তার দোদুল্যমানতা নিয়েও শেষমেষ সি এম-এর নির্দেশে প্রধান শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে হাজির থাকেন। ফ্যাতাড়ু চোক্তাররা তাদের কার্যকলাপ শুরু করতেই পুলিশ কমিশনারকে রাষ্ট্রযন্ত্রের যা করার তা করতে নির্দেশ দেন, কেবল মানবাধিকার কমিশনের সম্ভাব্য ফ্যাকড়াগুলি মাথায় রেখে।

নবারুণ আমাদের চেনা কথাটাই আর একবার মনে করিয়ে দেন – এই গোটা পরগাছা শ্রমজীবী ঠকানো আর্থিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখা হয় রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার প্রধান সশস্ত্র অঙ্গ পুলিশ/মিলিটারি দিয়ে। ফ্যাতাড়ু/চাকতিরা তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের কোলকাতার হেডকোয়ার্টার লালবাজার ও অন্যান্য থানাগুলির ওপর এবং তার কর্তাব্যক্তিদের ওপর ‘ওয়ার ডিক্লেয়ার’ করে। এই যুদ্ধের দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা নবারুণ বিভিন্ন পর্বে দিয়েছেন। বোমার বারুদের মশলার ভাগ থেকে ছোট পর্তুগীজ কামানের ব্যবহার, চাকতি ও ফ্যাতাড়ুদের ওড়ার ক্ষমতাকে বোমারু বিমানবাহিনী হিসেবে কাজে লাগানোর নিপুণ পরিকল্পনা, ম্যানহোলের ভেতর থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে শত্রুপক্ষকে চমকিত ও ঘায়েল করার কৌশলগুলি প্রায় গেরিলা ওয়ারফেয়ার ম্যানুয়াল থেকেই যেন নিয়ে এসে তাকে ফ্যান্টাসাইজ করেন নবারুণ।

নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের কথা এখানে আছে তার ফ্যান্টাসিধর্মিতা আমাদের চোখ এড়ায় না। কিন্তু ফ্যান্টাসি নির্মাণের মধ্যেও নবারুণ তার ‘ক্লাস লাইন’কে ধরে রাখেন। একদিকে সরকার পক্ষ থেকে যখন উন্নয়ন শিল্পায়ন-এর ফ্যান্টাসি রচনা করে মুক্ত পুঁজির লুঠেরা চরিত্রকে অবাধ বিচরণের জায়গা দেওয়া হয়, তখন তার বিপ্রতীপে নবারুণ রাষ্ট্রবিপ্লবের ফ্যান্টাসি নির্মাণ করেন নিম্নবর্গের মানুষগুলিকে তার সেনাবাহিনীর পুরোভাগে রেখে। দেখান তাদের আগ্রাসনের সামনে শেষপর্যন্ত রাষ্ট্র পিছু হটে এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে শেষমেষ আপোষরফায় বাধ্য হয়। ঘরে বাইরে পিছু হঠার বাস্তবিক সময়ে ফ্যান্টাসির জগতে হলেও রাষ্ট্রবিপ্লব পরিকল্পনার দুরন্ত বৈপ্লবিক স্পর্ধাই ‘কাঙাল মালসাট’কে বিশিষ্ট করে তোলে।

-- সৌভিক ঘোষাল 

খণ্ড-28
সংখ্যা-23