মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সেকাল ও একাল
economic freedom for girls

মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার ইতিহাস এদেশে বহু প্রাচীন। তার দৈহিক পরিশ্রম চিরকালই অর্থমূল্যহীন পারিবারিক সেবামাত্র। বিনিময়ে বাসস্থান-আহার-বস্ত্র ছাড়া তার আর অন্য দাবি থাকা অনুচিত। কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার চিরকালই কি এইরকমই ছিলো? নাকি বিবর্তনের চাকায় বাঁধা বলে দিন দিন আরো বেশি মজবুত হয়েছে এই রেওয়াজ? সমাজে পিতৃতন্ত্র যতো গেড়ে বসেছে, ততই কি মেয়েদের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে?

সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর একাধিক প্রবন্ধে অসীম যত্নে এই সবগুলো প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন ও আমাদের চোখের সামনে থেকে অনেক পরত পর্দা হটিয়ে দিয়েছেন। তবে সে প্রসঙ্গে যাবার আগে বর্তমানের আধুনিক ও সচেতন সমাজে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার কিরকম সেটা একটু জানার চেষ্টা করি। যদিও সব চেষ্টা সত্ত্বেও যেটুকু জানা যাবে তা হলো হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দলের কেস স্টাডি এবং থিসিস থেকে জানা যায় যে গ্রামের তুলনায় শহরে মেয়েদের কিছু কিছু অর্থনৈতিক অধিকার থাকলেও, ছেলে মেয়ের সম অবস্থানের এখনও ঢের দেরী। দোকান ঘরে এখনও মালিকের নামের পাশে এন্ড সন্স লিখে রাখাই দস্তুর। আর ফ্ল্যাটের মালিকানা, লকারের মালিকানা ইত্যাদির ক্ষেত্রে গৃহস্বামীর অধিকার একচেটিয়া। গ্রামে কন্যার নামে জমি কেনা বা বাড়ির দলিল বানানো খুবই বিরল। বিবাহের পর স্ত্রী চিরবশ্য থাকবে এটা ধরে নিয়ে অল্পস্বল্প সম্পত্তি তার নামে রাখা যায়, যদি জমিজমার পরিমাণ বেঁধে দেওয়া সিলিংয়ের ওপরে উঠে যায়। গ্রাম এবং শহর একটি ব্যাপারে একেবারেই একমত, সেটা হলো মেয়ের বিয়েতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, তারপর আর মেয়েকে সম্পত্তির মালিকানা না দিলেও চলে। বিশেষ করে পড়াশোনা শেখালে তো কথাই নেই। যেন ছেলের পড়াশোনায় কোনো অর্থব্যয় হয় না। তবে এটা ঠিক ছেলের বিয়ে মেয়ের বিয়ের থেকে আলাদা বলেই সমাজে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। কারণ পণপ্রথা। ধরেই নেওয়া হয় যেখানে মেয়ে পার করতে প্রচুর টাকা খসবে, সেখানে নব বিবাহিত ছেলে ঘরে কিছু মালকড়ি ঢোকাবে। এইভাবে মেয়েকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবার পক্ষে একটা যুক্তি সমাজে নিজে থেকেই গড়ে ওঠে। আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সে যুক্তির পূর্ণ সদব্যবহার করে।

এই অর্থমূল্যে চুকিয়ে দেবার মনোভাবের জন্যই বিবাহের পর থেকে সবার সঙ্গে মেয়েটিও নিজেকে পর ভাবতে শুরু করে, যেন বাবার বাড়ির সঙ্গে তার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হলো। শ্বশুরবাড়িতে নিগৃহীত হলেও সে ফিরে আসার কথা ভাবতে পারেনা, কারণ বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে সে যেন বাবার বাড়ির ওপর সমস্ত অধিকারই হারিয়েছে। কেউ যদি ফিরে আসেও তাকে বহিরাগতদের মতোই দেখা হয়। বাবা মাও মেয়েটিকে ফিরে যাবার জন্য ঝুলোঝুলি করতে থাকে। সামাজিক সম্মান, ভবিষ্যৎ, সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি, এইসবের অছিলায় মেয়েটিকে আবার ফেরত পাঠানো হয় শ্বশুর বাড়িতে। সেই সুযোগে ঘটে যায় অনেক অনাচার, অপমৃত্যু, বধূহত্যা।

আর সাংসারিক কাজের বিনিময়ে কোনো অর্থমূল্যের কথা ভাবাও পাপ। নারীর কল্যাণী মূর্তি নিজেকে বলি দিয়ে সংসারকে ধরে রেখেছে আবহমান কাল থেকে, রাখবেও মানব সভ্যতার অন্ত অব্দি৷ তার কোনো বিনিময় মূল্য হয়না।

বৈদিক যুগে এই রেওয়াজ কেমন ছিলো সে প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন যে বৈদিক সাহিত্য এব্যাপারে নীরব। তবে শাস্ত্র ইত্যাদিতে যা প্রমাণ আছে তাতে একেবারে শুরুতে কন্যাসন্তান মানেই আপদ, এইরকমই ভাবা হতো। অবশ্যই গৃহকর্ম তার এক্তিয়ারে ছিলো, কিন্তু তার কোনো অর্থনৈতিক হিসেব হতোনা। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে খুব স্পষ্ট ভাবে পুত্রকে দেবতার বর ও কন্যাকে অভিশাপ বলা হয়েছে। বিবাহের সময় দান করে দেবার আগে গৃহে কোনোমতে কন্যার উপস্থিতি সহ্য করা হতো। বিবাহের পর তার নিজের একটি পরিচয় হলেও, তার প্রতি অনেক নতুন রকম নির্মমতার শুরুও হয় ঐ সময় থেকেই। কন্যা থেকে স্ত্রীর পদে উত্তরণ তাকে আশাহীনতা এবং অপমান থেকে মুক্তি দেয় না।

যদি কোনো নারীর স্বামী দ্বিতীয় বার বিয়ে করে, তখন কেমন অবস্থা হবে প্রথমা স্ত্রীর অর্থনৈতিক অধিকারের? এপ্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ মনুর কী বিধান তা সুকুমারী আমাদের বলেন ‘প্রাচীন ভারতে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার’ প্রবন্ধে। যে নারীকে পুরুষটি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে যাচ্ছে তাকে যতটা পরিমাণ স্ত্রী ধন দেবে সে, তার সম পরিমাণ ধন দেবে প্রথমা স্ত্রীকে। যদি প্রথমাকে স্ত্রী ধন আগেই ফেরত দেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রীকে দেয় ধনের অর্ধভাগ দেবে প্রথম স্ত্রীকে। কিন্তু এই প্রথমা স্ত্রী যদি পুত্রহীন হয়, যে ছুতো আগে একাধিক বিয়ে করার সময় আকছার দেওয়া হতো, তাহলে কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দান করে দেওয়া সম্পত্তি আবার সবটাই স্বামীটির কাছেই ফেরত আসবে। প্রথমার পুত্র না থাকলেও কন্যা থাকতে পারে। কিন্তু থাকলেও সে ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না, এই ছিলো প্রাচীন রেওয়াজ।

এই স্ত্রীধন ব্যাপারটি কী? কতটা এর ব্যাপ্তি? শুনে কৌতুক বোধ হবে যে আট ধরনের বিবাহের বেশির ভাগেই বধূর পিতা বরের আত্মীয় স্বজনদের অর্থ বা পণ দিতো। কেবলমাত্র আসুর বিবাহে বর নিজের কামনা দ্রুত চরিতার্থ করতে বধূ এবং বধূর পিতাকে স্ত্রীধন দিতো। অর্থাৎ পণ বা স্ত্রীধন যাইই হোক না কেন, যে বধূ হতে যাচ্ছে সেই কন্যাকে হয় আরো অর্থ উপঢৌকন সহ বিক্রি করা হচ্ছে যেন সে একা সামগ্রী হিসেবে বিক্রিরও যোগ্য নয়। নয়তো সরাসরি পয়সার বিনিময়ে আসুর বিবাহের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। তাহলে বোঝা গেল নিজের সম্মানের বিনিময়ে এই স্ত্রীধন পাওয়াও সব মেয়ের কপালে জুটতো না, কেবলমাত্র আসুর বিবাহের বধূদের স্ত্রীধন দেবার রেওয়াজ ছিলো। তার ওপর আবার এতো শত নিয়ন্ত্রণ !

আসলে আইন থাকলে তার ফাঁকও আছে। এখনও আছে, তখনও ছিলো। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এক জায়গায় বলেছেন, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং নিজে কারারুদ্ধ থাকলে স্বামী স্ত্রীধন কাজে লাগাতে পারে। এখন যেমন কোভিডে দেশ ছেয়ে গেছে, সেইসময়ও রোগবালাই কিছু কম ছিলনা, স্বামী দেবতাটি এইরকম হলে চোখের পাতাটি না ফেলেই স্ত্রীধন আত্মসাৎ করতে পারতো। আর যেকোনো বিবাহেই নারী যদি নিঃসন্তান থাকে তাহলে তার যাবতীয় যা কিছু সব স্বামীর।

নারীর নিজস্ব সম্পত্তি থাকবে এটা তখন সমাজ মেনে নিতে পারতো না। এখনো তার কিন্তু কিন্তু ভাব যায়নি। নারীর সম্পত্তি থাকলেই সমাজ তার একজন অভিভাবক ঠিক করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগে, সে মহিলাটি প্যারিস হিলটন হন বা সাধারণ কোনো লটারি প্রাপিকা। আরও সোজাসাপটা ভাবে বলতে গেলে তখন এই ধারণাই ছিলো যে নারীর সম্পত্তিতে অধিকার থাকা উচিত নয়, তাই তা নেই। মনুসংহিতায় বলা আছে নারী যা উপার্জন করে তা তার স্বামীর। কাত্যায়ন কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, যা নারী শিল্পকর্ম করে উপার্জন করে এবং যা তাকে ভালবেসে দেওয়া হয়, সমস্তটাই তার স্বামীর অধীন। তার মানে নিজস্ব উপার্জনও তার নিজের নয়। এই পরম্পরাই মনে এবং কাজে বহন করে নিয়ে চলেছে একবিংশ শতকের বহু পুরুষ পুঙ্গব, যারা স্ত্রীর নিজের বাবা মায়ের জন্য কোনো অর্থব্যয় করা নিয়ে স্ত্রীদের তুমুল বাধা দেয়। আমাদের চারপাশে এই মানসিকতা এখনো বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে।

মনুর মতো চালাক লোক একাল বা সেকালে বিরল। সবসময় এক কাঠি ওপরে তার অবস্থান। মনুর মতে স্ত্রীকে গায়ের জোর খাটিয়ে বশে রাখা যায় না, তারজন্য অনেকগুলি কৌশল অবলম্বন করা দরকার। তাদের নিযুক্ত করতে হবে আয়ব্যয়ের হিসাব রাখার কাজে। শিক্ষাবঞ্চিত করে তার অর্থ উপার্জন করতে দেওয়ার পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হলো, শিল্পকর্ম করে যৎসামান্য আয় করলে তা কেড়ে নেওয়া হলো, তারপরে অন্যের উপার্জিত অর্থ কতো এলো, কতো গেল এই হিসাব সে রাখবে, যেন বধূ নয়, সে আসলে ভারবাহী গর্দভ!

এছাড়া নিজেদের দেহ, গৃহ, বিছানা, আসবাব, বস্ত্র, সব পরিষ্কার করবার কাজে তাকে লাগিয়ে দাও, যেন অন্য দিকে মন দেবার বিন্দুমাত্র সুযোগ সে না পায়।

The days of economic freedom for girls_0

 

এতো কাজের পাহাড় চাপানো কেন? যেহেতু গৃহে বন্দী থাকলে বা পুরুষ আত্মীয়ের কড়া পাহারায় থাকলেও দুষ্টা নারী যথেষ্ট রক্ষিত নয়, তাই তার মন যাতে অন্য দিকে না যায় সে কারণে চব্বিশ ঘন্টাই তাকে ব্যস্ত রাখা হোক। সুকুমারী বললেন, “তাহলে স্ত্রী’কে বশে রাখা, যা কিনা বৈধ পুত্রসন্তান লাভে আবশ্যিক, তার একটি উপায় হলো, তাকে নানারকম গৃহকর্মে নিযুক্ত রাখা, যেগুলি আর্থিক মূল্যে কখনোই রূপান্তরিত করা যায়না, যার ফলে সর্বদাই তার নিজেকে পরিবারের আর্থিক বোঝা বলে মনে হতো।”

তাহলে দেখা যাচ্ছে নারীকে কব্জায় রাখার জন্য এদেশের সমাজপতিরা প্রচুর মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়েও চর্চা করেছে। সবদিক থেকে মেয়েটিকে খাঁচায় বন্দী করে রাখাই ছিলো তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

কোনো মেয়ে যদি তার স্বামীকে হারায়, তাহলে সমাজ তাকে দেখতো আর্থিক বিপদ এবং ভার হিসেবে। তার কারণ, তখন সমাজ ছিলো কৃষিপ্রধান, পরিবার ছিলো যৌথ। কর্ষণযোগ্য ভূমি ভাগ হয়ে যাক, এটা কোনো পরিবারই চাইতো না। এখনো গাড়োয়ালের গ্রামেগঞ্জে অনেক জায়গায় স্বামী মারা গেলে এই কারণেই বিধবা বধূর সঙ্গে তার দেবরের বিবাহ দেওয়া হয়। বৈদিক যুগে যাতে স্বামীর মৃত্যুর পর ভূমি ভাগ না হয়, এবং মেয়েটি আবার বিয়ে করলে নতুন স্বামী জমির ভাগ না চাইতে পারে, সেজন্য দু’একজন বাদে বৈদিক স্মৃতিকাররা নিয়ম করলেন বিধবাকে স্বামীর শবদেহের সঙ্গে দাহ করা হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কু-আচারের শ্রেষ্ঠ যে সতীদাহ প্রথা তাও উদ্ভব হয়েছিলো মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নেবার জন্য। বঙ্গভূমিতেই ১৮১৫ থেকে ১৮৮০’র মধ্যে মোট ২,৩৬৬ জন বিধবাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো, শুধু কলকাতাতেই ১,৮৫৮টি সতীদাহ হয়। অর্থই দেখা যাচ্ছে সব অনর্থের মূল।

তাহলে কখন কোন মূল্যে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার নিঃশর্তে স্বীকার করে নিয়েছে? যখন তারা গণিকা হয়েছে। মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে শেষ না করে দিলে এই সমাজের কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবেনা। সুকুমারী দেখিয়েছেন কীভাবে ধম্মপদের টিকায় সালাবতীর কন্যা সিরিমার প্রতি রাত্রে ১,০০০ পণ উপার্জন করার বিবরণ আছে। তবে নিরাপত্তার বোধ তাদেরও ছিলোনা। কোনও পুরুষ গণিকার কন্যার ওপর বলাৎকার করলে তার মাত্র ৫৪ পণ দন্ড হতো। মায়ের প্রাপ্যের ১৬ গুণ দন্ড দেবার কথাও শোনা যায়। গৌতম ধর্মসূত্রে তো পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে ‘বেশ্যার হত্যা অপরাধ নয়’।

তাহলে যতই ছোটবেলা থেকে আমাদের মৈত্রেয়ী অমৃতার গল্প শোনানো হোক না কেন, দেখা যাচ্ছে প্রাচীন ভারতে সাধারণভাবে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার ছিলনা। ঘরের মেয়েদেরও সামাজিক সুরক্ষা ছিল না। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে পত্নীর সম্পত্তির উপরে কোনও অধিকার নেই, নিজের শরীরের ওপরেও না। যজ্ঞে লাঠি দিয়ে যেমন হবিকে (যজ্ঞের ঘি) পেটানো হয়, তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে পেটাবে যাতে তার শরীর বা সম্পত্তির ওপর অধিকারের সমস্ত বোধ অবলুপ্ত হয়ে যায়।

দ্রৌপদীকে যখন সবার সামনে অপমান করা হচ্ছিলো তখন তিনি দুঃশাসনকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমাকে বাজি রাখার আগে কি যুধিষ্ঠির জুয়াখেলায় নিজেকে বাজি রেখেছিলেন? তিনি আসলে বলতে চাইছিলেন যদি আগেই নিজেকে যুধিষ্ঠির বাজি রেখে থাকেন ও হেরে যান, তাহলে দ্রৌপদীকে বাজি রাখার কোনো অধিকার তার থাকে না। অর্থাৎ দ্রৌপদী কোনো না কোনোভাবে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তিনি তার স্বামীর সম্পত্তি। আগে থেকে হেরে গিয়ে না থাকলে স্ত্রীকে যুধিষ্ঠির বাজি রাখতে পারতেন। ঋগ্বেদের এক জুয়াড়িও স্ত্রীকে বাজি রেখেছিলো। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাজা থেকে প্রজা, অভিজাত থেকে জুয়াড়ি, সবাই স্ত্রী নামক সম্পত্তিটিকে কথায় কথায় বাজি রাখতো।

সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতো বিদগ্ধ পন্ডিতদের চুলচেরা বিশ্লেষণ না থাকলে আমরা হয়তো প্রাচীন ভারতের সবকিছুই ভালো, এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়তাম। আর যা কিছু ভালো হোক, মেয়েদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। গৃহে তারা যতই শ্রম দিক না কেন, তা উৎপাদনমূলক নয় বলেই ধরে নেওয়া হতো। তারা ছিল প্রজননের যন্ত্র, তাও সর্বত্র একতরফা পুত্রের মায়ের কথাই বলা হয়েছে। তারা যদি ক্ষেত্র হয়, তাহলে ফসল ছিলো বপনকারীর।

অনেক অনেক শতাব্দী ধরে সমাজ নারীর আত্মসম্মানকে খর্ব করে এসেছে। তাকে শিক্ষার অধিকার দেয়নি, সম্পত্তির অধিকার দেয়নি, গৃহে তাকে শুধু গৃহকর্ম ও প্রজননের নিশ্চেতন ভূমিকায় আবদ্ধ রেখেছে, যাতে তার সাধারণ বুদ্ধিও না থাকে এবং পুরুষ ঘোষণা করতে পারে যে, নারীর অর্থের প্রয়োজন নেই, অর্থ পেলেও তার ওপর কখনোই নির্ভর করা যায় না।

এই ট্র‍্যাডিশনের অনেকটাই কি আজও অটুট নেই?

- প্রতিভা সরকার

খণ্ড-28
সংখ্যা-27