ভারত এবং বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের আত্তিকরণের হিংস্র রাজনীতি
indigenous peoples

কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপে একটি আবাসিক স্কুলে ২১৫ জন আদিবাসী শিশুর গণকবর আবিষ্কার হওয়ার খবরে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত। শত-শত বছর ধরে উপনিবেশিক ভয়ানক অত্যাচার চলেছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন আদি জনজাতিদের উপর। এই ঘটনা যে কেবল সুদূর অতীতের তা নয় বরং কানাডার বর্তমান প্রজন্মের আদিবাসীদের ওপর তার কষ্টদায়ক স্মৃতির প্রভাব রয়েছে।

কানাডার ‘ভারতীয় আবাসিক স্কুল ব্যবস্থা’র মূল প্রোথিত রয়েছে দেশের উপনিবেশিক অতীতে পাশ হওয়া ‘ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট ১৮৭৬’ আইনটির মধ্যে। এই স্কুলগুলির ঘোষিত উদ্দেশ্য হল দেশের জনজাতিদের সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে ঐ শিশুদের ইউরোপীয়-কানাডিয় সমাজ সভ্যতায় অভ্যস্ত করে তোলা। ২০০৮ সালে গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন অফ কানাডা (টিআরসি), কানাডা সরকার ও প্রায় ৮৬,০০০ আদিবাসী মানুষ যাঁরা আবাসিক স্কুলে শৈশব অতিবাহিত করেছেন তাদের মধ্যে একটা চুক্তি সম্পন্ন করেন সত্যতা নিরুপণের জন্য। টিআরসি তার রিপোর্টে বলেছে, ঔপনিবেশিক শাসকরা এই ধারণা পোষণ করতেন যে, বুনো অসভ্য জনজাতি যারা নিজেরা কখনই সভ্য হয়ে উঠবেনা তাদের সভ্য বানানোর জন্য তাঁরা এই স্কুল ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন। তাদের এই ‘সভ্য বানানো’র উদ্দেশ্য মূলগতভাবে বর্ণবিদ্বেষ ও সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতার প্রকাশ মাত্র।

৭ থেকে ১৬ বছরের আদিবাসী শিশুদের এই আবাসিক স্কুলে জোর করে নিয়ে আসা হোত। তাদের পরিবারের সাথে শিশুরা যাতে কোনও সংস্পর্শে না আসে তাই স্কুল স্থাপন করা হোত আদিবাসীদের বাসস্থান থেকে বহুদূরে। শিশুরা মাতৃভাষায় কথা বললে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। বর্তমানে আদিবাসীরা ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন তাদের ওপর শারীরিক ও যৌন অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সোচ্চার হচ্ছেন শিশুদের ওপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর অভিযোগ নিয়ে। অভিযোগ করছেন তাদের প্রায়শই প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া হোতনা।

এই প্রথমবার মৃত্যুর এই ঘটনা জনসাধারণের সামনে আসছে এমন নয়। টিআরসি’র হিসাবে প্রায় ৪,১০০ শিশু এই আবাসিক স্কুলগুলির হেফাজতে মারা গেছে। যদিও টিআরসি মনে করে হয়তো মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশী হতে পারে। বহু স্কুল অচিহ্নিত জায়গায় শিশুদের কবর দিয়েছে এবং তাদের পরিবার ঐ শিশুদের কি ঘটেছে আজও জানে না। টিআরসি কানাডা সরকারের কাছে ১৫ লক্ষ ডলার অনুদান চেয়েছেন অচিহ্নিত কবর খোঁজার কাজ চালানোর জন্য। কিন্তু সরকার তা মঞ্জুর করেনি।

আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদীদের আদিবাসী সংস্কৃতিকে বিস্মৃত করার পরিকল্পনা

আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে, কানাডা এবং অন্যান্য দেশ যখন তাদের ভয়াবহ অতীতকে মিটমাট করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তখন আরএসএস এবং তার সহযোগীরা আজ দেশে আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আত্তীকরণের কার্যকলাপ চালাচ্ছে। ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী, জনজাতি শিশুদের প্রায়শই অপহরণ করে সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলে ‘শিক্ষিত’ করে তোলা হয়। এই স্কুলগুলি সচরাচর এনজিও-দের অর্থে পরিচালিত হয়। এইসমস্ত এনজিও সেইসব কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত যারা আদিবাসীদের বিতাড়িত করে তাদের জমির দখল চায়। আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে মুছে ফেলে তাদের হিন্দু বানানোর এই চক্রান্ত কানাডার আবাসিক স্কুলের পুরোনো ছকের থেকে আলাদা নয়।

১৯৫০ সালে আদিবাসীদের ‘খ্রিস্টান’ ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর ধুয়ো তুলে গড়ে তোলা হয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম — আদপে যা একটি হিন্দুত্ব’র কর্মসূচি। মূল উদ্দেশ্য হল — জনজাতিদের সুস্পষ্ট পরিচিতি মুছে ফেলে হিন্দুত্বে আত্তীকরণ (ভার্জিনিয়াস কাকা রিপোর্ট ২০১৪)। আত্তীকরণের এই পরিপ্রেক্ষিত ভারতের নৃতত্ত্ববিদ্যার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি যেমন জি এস ঘুরাই এবং এ ভি ঠাক্কর (ঠাক্কর বাপা) প্রমুখ ব্যক্তিরা উল্লেখ করেছেন। ঠাক্কর বাপা আশ্রমশালা-মডেল গড়ে তোলেন যা বেশ প্রভাব বিস্তার করে। অলিম্পিকে হকিতে স্বর্ণ পদক জয়ী জয়পাল সিং মুন্ডা যিনি ১৯৪৯ সালে সাংবিধানিক সভার সদস্য ছিলেন — তিনি ঠাক্কর বাপাকে সভায় চলা বিতর্কে প্রতিবাদ করে বলেন যে তাঁর স্কুলে জনজাতিরা তাদের নিজেদের ভাষা ব্যবহারে অসমর্থ।

মালবিকা গুপ্তা এবং ফেলিক্স প্যাডেল বলেছেন যে আদিবাসীদের পরিচিতি শুধু মোছা হচ্ছেনা, আরও একটি উদ্দেশ্য হল ঐ শিশুদের নিম্ন মজুরির শ্রমিক হিসাবে তৈরি করে তোলা। আদিবাসীদের জন্য ১৯৬০ সাল থেকে এই আবাসিক স্কুল দ্রুতই বেড়ে উঠেছে তাদের শিল্পীয় শ্রমিক, কর্মচারী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। ১৯৯০ সাল থেকে সরকার পরিচালিত নতুন স্কুল চালু হয় যেমন — কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়, একলব্য মডেল আবাসিক স্কুল ইত্যাদি। বেসরকারি স্কুলও চালু হয় ভুবনেশ্বরে — কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অফ সোস্যাল সায়েন্সেস (কেআইএসএস)। বেদান্ত এবং নালকো’র মতো কোম্পানিগুলো যারা আদিবাসীদের গ্রাম থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ ঘটিয়েছে তারা, কেআইএসএস-এর যে প্রকল্প — মাওবাদী অধ্যুষিত আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে আদিবাসী শিশুদের আবাসিক স্কুলে তুলে এনে ভর্তি করা — এই প্রকল্পকে সমর্থন করে। আদিবাসী পরিচিতিকে চেপে দিয়ে হিন্দু উৎসবগুলিতে উৎসাহ দেওয়ার ঘটনা লক্ষ্যণীয়। রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত স্কুলেও একই ঘটনা দেখা যায়। গোন্ডী, মারিয়া, হালবি, এবং ছত্তিশগড়ী যাদের মাতৃভাষা তাদের নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এইভাবে আদিবাসী শিশুরা তাদের মাতৃভাষা ভুলতে বসেছে।

কানাডার আবাসিক স্কুল এবং কর্পোরেট-হিন্দুত্ব পরিচালিত আবাসিক স্কুল সমান্তরালভাবে আদিবাসী শিশুদের ছুটির অবকাশে বা উৎসবের সময় তাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়া প্রতিহত করে। এর উদ্দেশ্য হল শিশুদের মনে আদিবাসী সংস্কৃতি সম্পর্কে লজ্জা বা ঘৃণার ধারণা গেঁথে দেওয়া। তাদের বোঝানো হয় আদিবাসী এবং হিন্দু সংস্কৃতির এই পার্থক্যর কারণ হল আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক জীবন যাপনের রুগ্নতা। এরফলে শিশুরা ক্রমশ তাদের নিজেদের সমাজ সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকার জন্য তাদের স্বনির্ভর জীবিকার যে অর্থনীতি তা ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা আপাত মুক্ত হয়ে নিম্ন মজুরির শ্রমিকে পরিণত হয় বড়ো বড়ো বহুজাতিক কর্পোরেশনের জন্য। বহু আবাসিক স্কুলের খরচের একটা ভালো অংশ আসে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আর্থিক কর্মসূচি থেকে। এই কর্মসূচি কতটা অকার্যকরি এবং নিজেদের লভ্যাংশ তোলার একটা হাতিয়ার মাত্র তা প্রমাণিত হয়।

উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির দরিদ্র পরিবার থেকে একইভাবে শিশুদের অপহরণ করে বিভিন্ন সংগঠন যেমন ‘সেবা ভারতী’ ভিন্ন রাজ্যে তাদের চালান করে ‘হিন্দুত্ব মূল্যবোধ’এর ধারণা মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য।

সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণকারী আরএসএস ও তার সহযোগীদের এবং রাষ্ট্রের এই সাংস্কৃতিক বিলুপ্তিকরণের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদের এই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।

- লিবারেশন, জুলাই ২০২১ সংখ্যা থেকে

খণ্ড-28
সংখ্যা-28