সরকারি বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণ: এর প্রতিরোধই সময়ের দাবি
government insurance companies

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের কথা বলেছিলেন। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রয়াস থেকে আপাতত হাত গুটিয়ে রাখলেও বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের পথে তিনি সক্রিয় পদক্ষেপ করেছেন। সাধারণ বিমা ব্যবসায় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের রয়েছে চারটে সংস্থা — ন্যাশনাল ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, নিউ ইণ্ডিয়া অ্যাসুয়েরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, ওরিয়েন্টাল ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এবং ইউনাইটেড ইণ্ডিয়া ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এগুলোর যে কোনো একটার বেসরকারিকরণ করতে গেলে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন আবশ্যক। কেননা, যে আইনের অধীনে এই কোম্পানিগুলো তৈরি হয়েছিল তাতে শর্ত ছিল — কোম্পানিতে সরকারি মালিকানা থাকবে কমপক্ষে ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ, কোম্পানি পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতেই। বেসরকারিকরণ করতে গেলে সরকারি মালিকানাকে নামিয়ে আনতে হবে ৫১ শতাংশের নীচে এবং আইনের সংশোধন করেই তার বাস্তবায়ন সম্ভব। বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে নির্মলা সীতারামণের পেশ করা সাধারণ বিমা ব্যবসা (জাতীয়করণ) আইনের সংশোধনী বিল লোকসভায় পাশ হয়ে গেল আগস্টের ২ তারিখে। ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও’র তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে ফোনে আড়িপাতাকাণ্ডের আলোচনার দাবিকে কেন্দ্র করে সংসদে যখন অচলাবস্থা চলেছে, তার সুযোগ নিয়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই লোকসভায় ধ্বনি ভোটে পাশ করানো হয়েছে এই সংশোধনী বিলকে। সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই অধিবেশনে মোদী সরকার সংসদে দেড় ডজনেরও বেশি বিল পাশ করিয়েছে, এবং প্রতিটা বিলের জন্য গড় সময় ব্যয় করা হয়েছে ছয় থেকে সাত মিনিট! কর্পোরেটস্বার্থের প্রতিভূ রূপে যে সরকার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সরকারি বিমা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়াটাই যে তার অগ্ৰাধিকার হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে কৃষকস্বার্থের পরিপন্থী তিনটে কৃষি বিল কোনো আলোচনা ছাড়াই যেভাবে সংসদে পাশ করানো হয়েছিল, বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করতে বিমা আইনের সংশোধনী বিল পাশে সেই পথেরই আশ্রয় নিল মোদী সরকার।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের যে বিমা সংস্থাটার বেসরকারিকরণ করবে বলে সরকার মনস্থ করেছে সেটা হল ইউনাইটেড ইণ্ডিয়া ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এই সংস্থায় বিমাকারীর সংখ্যা ১.৭৪ কোটি, কোম্পানির কর্মী সংখ্যা প্রায় ১৪,০০০ এবং জমা হওয়া প্রিমিয়ামের পরিমাণ সাড়ে ১৭,০০০ কোটি টাকার বেশি। বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেট সংস্থার হাতে গেলে নিয়ন্ত্রণকারী কর্পোরেট সংস্থা শুধু ঐ বিপুল পরিমাণ অর্থ ইচ্ছেমত ব্যবহারের অধিকারীই হবে না, ১৪,০০০ কর্মীর ভবিষ্যতও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। কর্পোরেট সংস্থা সমস্ত কর্মীকে বহাল নাও রাখতে পারে, এবং কর্মীরা তাদের ওপর ধার্য করা মাত্রাধিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে কর্পোরেট সংস্থা তাদের ছাঁটাই করার পথেও যেতে পারে। এছাড়া, বিমা সংস্থায় যাঁরা পলিসি করেছেন তাঁদের সুরক্ষাও যে সুনিশ্চিত থাকবে এমন নয়। বেসরকারি বিমা সংস্থা প্রিমিয়াম সংগ্ৰহে যতটা আগ্ৰহী, বিমাকারীদের পাওনাগণ্ডা মেটাতে তাদের উৎসাহ তেমন দেখা যায়না। সরকারি বিমা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বিমাকারীদের অভিযোগ যেখানে নগন্য, পাওনাগণ্ডা না পাওয়া নিয়ে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিমাকারীদের অভিযোগ কম নয়। বিমা শিল্পের কর্মীদের যৌথ মঞ্চ এআইআইইএ জানিয়েছে, ২০২০-২১ বর্ষে রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগের পরিমাণ যেখানে ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ, বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিমাকারীদের অভিযোগের পরিমাণ সেখানে ছিল একেবারে ৮২ শতাংশ। বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর তুলনায় সরকারি বিমা সংস্থাগুলোর ওপর জনগণের আস্থা ও ভরসা কেন অনেক বেশি তা যে কেউই উপলব্ধি করতে পারবেন।

কোনো বিশেষ কারণে নির্মলা সীতারামণ বিমা কোম্পানিতে সরকারি অংশিদারিত্বকে কমিয়ে আনার পদক্ষেপকে বেসরকারিকরণের উদ্যোগ বলে স্বীকার করতে চাইছেন না। তিনি বলছেন, আইন সংশোধন করে বিমা সংস্থায় সরকারি অংশিদারিত্বকে ৫১ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনার পদেক্ষেপের লক্ষ্য বেসরকারিকরণ নয়, সাধারণ মানুষ যাতে বিমা সংস্থার শেয়ার কিনে তাতে লগ্নি করতে উৎসাহী হন এবং শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংস্থার মূলধন যাতে বাড়ে সেই লক্ষ্যেই ঐ পদক্ষেপ। কিন্তু সীতারামণ নিজেই কি বিমাক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের কথা বলেন নি? বাজেট বক্তৃতায় তিনি কি বলেছিলেন তা স্মরণ করা যাক — “রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের দুটো বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং একটা সাধারণ বিমা কোম্পানির বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ গ্ৰহণের প্রস্তাব আমরা করছি। এরজন্য আইনের সংশোধনের প্রয়োজন হবে।” বাজেট বক্তৃতায় তিনি যা বলেছিলেন সে কথা কি তিনি বিস্মৃত হয়েছেন? তা সম্ভবত হওয়ার নয়। আসল ব্যাপারটা সম্ভবত হল, মোদী সরকার এবং আদানি-আম্বানিদের তথা কর্পোরেটদের স্বার্থ একাকার হয়ে জনগণের সামনে এসেছে। তাঁরা বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ নিচ্ছেন — এই কথাটা সংস্থার কর্মী, বিমাকারী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে মোদী সরকার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত এবং জনগণের মধ্যে সরকারের কর্পোরেট স্বার্থরক্ষাকারী ভাবমূর্তিই জোরালো হয়ে উঠত। এটাকে এড়ানোর লক্ষ্যেই সম্ভবত সীতারামণের ঐ সত্যের অস্বীকার।

সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সাধারণ বিমাক্ষেত্রের চারটে সংস্থার কর্মীরাই প্রতিবাদে নেমেছেন। তাঁরা বেসরকারিকরণের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, পাশ হওয়া বিল প্রত্যাহারের দাবিতে ৪ আগস্ট ২০২১ একদিনের ধর্মঘটের ডাক দেন। চারটে সংস্থার ৫২,০০০ কর্মী ও অফিসার ধর্মঘটে অংশ নিয়ে কাজ বনধের আহ্বানকে সফল করে তোলেন। বিমা কর্মীদের সারা ভারত সমন্বয় সমিতি এআইআইইএ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই পদক্ষেপের ফলে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের চারটে বিমা কোম্পানির বেসরকারিকরণেই সমর্থ হবে … এটা বেসরকারিকরণ নয়, বরং বড় আকারে বেসরকারি অংশগ্ৰহণের প্রচেষ্টা বলে অর্থমন্ত্রী যে যুক্তি দিচ্ছেন তা কিছুটা হাস্যকর বলেই শোনাচ্ছে।” তাঁরা আরও জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোই দেশে সামাজিক ন্যায়কে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থা ছাড়া দরিদ্র, নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগণ তাঁদের অধিকারের নাগাল পাবেন না। বিমা কর্মীদের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে ব্যাঙ্ক কর্মীদের সারা ভারত সমন্বয় সমিতি। তাঁরা জানিয়েছেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে বাঁচান, ভারতকে বাঁচান’ শ্লোগানকে তুলে ধরে তাঁরা বেসরকারিকরণ বিরোধী লড়াই চালিয়ে যাবেন।

১৯৯০’র দশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নামানো কাঠামোগত সংস্কারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে চালু হয় বেসরকারিকরণের ধারা। বেসরকারিকরণ শুধু কর্পোরেটতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলার পথকেই প্রশস্ত করেনি, তা প্রশাসনিক ক্ষেত্রের নৈতিকতার অধঃপতন ঘটিয়ে দুর্নীতিকেও বাড়বাড়ন্ত করে তোলে। উৎকোচের বিনিময়ে জমি, খনিজ ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক সম্পদকে যেমন নামমাত্র অর্থে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তেমনি খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চলের, বনজমিতে বাস করা জনগণের উচ্ছেদ ও তাদের ওপর কর্পোরেটদের দাপট ও জুলুমবাজিকেও বেড়ে চলতে দেওয়া হয়েছে। আর এতে সরকারের মদত যে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রোয়জন। রাডিয়া টেপ আমাদের জানিয়েছে, সরকারের নীতি, সিদ্ধান্তের নির্ধারণে কর্পোরেট লবিস্টদের ভূমিকা কতটা নির্ধারক হয়েছে, নির্দিষ্ট কোনো দপ্তরের মন্ত্রী কে হবেন তা ঠিক করতেও কর্পোরেটরা সফল হয়েছে। তবে, কর্পোরেট প্রীতির বিচারে এবং কর্পোরেট সাঙাততন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মোদী জমানা যে ইউপিএ জমানাকে অনেক ছাড়িয়ে গেছে তা এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করতে, তাতে অন্তর্ঘাত হানতে এদের লাগামহীন উৎসাহ। ভারতীয় জনগণের, শ্রমিক-কৃষকদের শ্রমে নির্মিত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোকে কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে তারা অনেক বেশি বেপরোয়া। শোনা যাচ্ছে, সাধারণ বিমা ব্যবসায় জড়িত সংস্থার বেসরকারিকরণের সাথে এলআইসি’র ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির অভিপ্রায়ও মোদী সরকারের রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের নিরাপত্তায় আস্থা রেখে কোটি-কোটি মানুষ সরকারি বিমা সংস্থাগুলোকে বেছে নিয়েছেন, এই সংস্থাগুলোর পলিসিকেই নিজেদের সঞ্চয়ের মাধ্যম করেছেন। আর বেসরকারিকরণের উদ্যোগ কোটি-কোটি মানুষের সঞ্চয়কে, তাদের নিরাপত্তাবোধকে বিপন্ন করে তুলেছে। বিমা কোম্পানির বেসরকারিকরণের উদ্যোগ সচল হওয়ায় নির্দিষ্ট কোনো বেসরকারি দেশি বা বিদেশী বিমা কোম্পানি পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছে কিনা তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে, বিলটাকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবিকে অগ্ৰাহ্য করে রাজ্যসভাকে মার্শাল পরিবৃত দূর্গ বানিয়ে বিলকে যেভাবে সেখানে পাশ করানো হল তাতে দোসর কোনো পুঁজিপতির হাতে সরকারি বিমা সংস্থাকে তুলে দেওয়ার বিজেপির অভিপ্রায় একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। আর তাই কোম্পানিরাজ প্রতিষ্ঠার অভিমুখে গৃহীত এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আশু প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা ভারতীয় জনগণের কাছে অপরিহার্য কর্তব্য রূপেই হাজির হয়েছে।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-28
সংখ্যা-31