খবরা-খবর
ভারত ছাড়ো দিবসে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ
Quit India Day

কর্পোরেট ভারত ছাড়ো! দেশী বিদেশী কর্পোরেটদের এজেন্ট মোদী সরকার গদি ছাড়ো! কোম্পানি রাজ হঠাও! কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও! ৯ আগস্ট এইসব শ্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে এই রাজ্যের সমস্ত জেলা সদর। মিছিল-বিক্ষোভ-প্রতিবাদী সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ৯ আগস্ট পালিত হল ‘ভারত ছাড়ো দিবস’। ১৯৪২’র আহ্বানের ৭৯ বছর পর যেন ইতিহাসের পাতা থেকে মূর্ত হয়ে উঠে এলো আজকের বাস্তবতায়। আজও সেই বণিকের মানদন্ড দেখা দিচ্ছে রাজদন্ড রূপে। সেদিন ছিল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন আর আজ আম্বানি-আদানিদের মুনাফার গ্রাসে দেশের কৃষি শিল্প সমস্ত কিছুই বিপন্ন। তাই দিল্লীর যন্তর-মন্তরে আয়োজিত কৃষক সংসদ থেকে শুরু করে এরাজ্যের পথে প্রান্তরে আওয়াজ উঠছে — এসো গড়ে তুলি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

বর্তমান সময়কালে অত্যন্ত সংকটের মধ্যে রয়েছে গ্রামবাংলা। একদিকে অতিবৃষ্টি-বন্যা পরিস্থিতি, অপর দিকে চাষের মরসুমে তুমুল কর্মব্যস্ত কৃষক সমাজ। এসব সত্বেও তাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির আহ্বানে এবং কিষাণ মহাসভা ও অন্যান্য বামপন্থী কৃষক সংগঠনের আয়োজনে জেলায় বা ব্লকের নানাবিধ বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলিতে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকে শুরু করে বন্যা বিধ্বস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে যে প্রধান বার্তা উঠে এলো, কৃষকের রক্ত জল করা শ্রমে উৎপাদিত ফসল নিয়ে মুনাফাখোরী, কালোবাজারি, মজুতদারীর স্বার্থে তৈরি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে দেশব্যাপী প্রতিরোধ। কেবল দিল্লীর বুকেই নয়, সমস্ত রাজ্যেই কৃষকরা দৃঢ়পণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, কিছুতেই নয়া কৃষি আইন চালু করতে দেওয়া হবে না। আট মাস হয়ে গেল লক্ষাধিক কৃষক দিল্লীর বর্ডারগুলির সড়ক দখল করে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, তোমরা চুক্তিচাষের আইন করে আমাদের কৃষি জমি দখল করতে চাইছো? এর পাল্টা আমরা তোমাদের রাজধানীর ঝাঁ চকচকে ছয় লেনের সড়ক দখল করে বসে থাকব। প্রয়োজনে ২০২৪ সালে লোকসভা ভোট পর্যন্ত থাকব। ভগৎ সিং-এর সেই গান যেন আজও কিষাণের সংগ্রামের প্রত্যয় তুলে ধরেছে “দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু কাতিল মে হ্যায়” আমরাও দেখে নেবো। সরকারের এতো অনমনীয়তা কেন? অন্নদাতাদের জীবন রক্ষার দায় সরকার নেবেনা কেন? মজুতদারীকে বৈধ করে জনজীবনে চাপিয়ে দেওয়া এই অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি কেন?

অতিমারী লকডাউনের এই সময়ে সবকিছুই বন্ধ হয়ে যেতে পারে, দেশের কৃষি কিন্তু থেমে নেই! কৃষি উৎপাদন কিছুটা পরিমাণে হলেও বেড়েছে — এই তথ্য তুলে ধরে মোদী সরকার এর কৃতিত্ব দাবি করছে। কিন্তু না, এর কৃতিত্ব দেশের কৃষক সমাজের। সরকার উল্টে চাষির ফসলের সরকারি ক্রয় বন্ধ করে দিয়ে, ডিজেল সার সহ কৃষি উপকরণের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি করে কৃষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাঁদের ঠেলে দিয়েছে চরম লোকসানের পথে। আর এখন কৃষক দরদী সাজার জন্য পিএম কিষাণের নামে যৎসামান্য খয়রাতি সাহায্য দিচ্ছে। সরকারপক্ষ কৃষক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার সময় ‘দেওয়া কথা’ রাখেনি। বিদ্যুৎ বিল সংশোধনী ২০২০ লোকসভায় পেশ করেছে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করে আগামীদিনে কৃষি সহ সর্বক্ষেত্রে বিপুল মাত্রায় মাশুল বৃদ্ধির পথ সুগম করে দিচ্ছে। বিএসএনএল বনাম জিও টেলিকমের মতো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেও সেই একই কিসসার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে।

প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্তের নানান স্তরের কৃষক ও মেহনতি মানুষ দিল্লীর আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। কেবল সংহতিই নয়, একে নিজের আন্দোলন বলে অনুভব করেই তারা পথে নামছেন। যেমন পশ্চিমবাংলার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এখানে ক্ষুদ্র কৃষি অর্থনীতিতে কৃষি উৎপাদন প্রধাণত ভোগের জন্য ব্যয়িত হলেও বেশ কিছু অংশ বাজারে যায়, বিশেষত অর্থকরী ফসলের চাষ উত্তরোত্তর বাড়ছে। এরাজ্যের চাষিরা পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো মান্ডিতে বিক্রি করতে পারে না, ফলে অভাবী বিক্রির সংকট তাঁরা দুর্বিষহ বোঝার মতো টের পায়। আলু, ধান, পাটচাষিরা দেখছেন তারা যে দামে ফসল বিক্রি করেন তার চার থেকে ছয় গুণ দামে ব্যবসায়ীরা সেটা বাজারে বিক্রি করে। এভাবে ছোট মাঝারি ফাটকা ব্যবসায়ীরা মুনাফার কারবার করে চলেছে। আগামীদিনে বড় বড় কর্পোরেট হাঙ্গর কুমীর বা রাঘব বোয়ালরা ফসল কেনার একচেটিয়া লাইসেন্স পেলে তার কুফল কি হতে পারে তা ভাবতে গেলে ঘুম ছুটে যায়। যেমন, এবার পাট গোড়ার দিকে ওঠার সময় বাজার দর ছিল ৮ হাজার টাকা কুইন্টাল। আর এখন যখন ব্যাপক পরিমাণে পাট উঠছে তখন দাম নেমে এলো ৫ হাজার টাকায়! ক্রমশ কমছে। চাষির মাথায় হাত, বিপুল লোকসান! অথচ কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের পাট কেনার বা চাষির স্বার্থে তাঁর দাম ধরে রাখার কোন ব্যবস্থাপনাই নেই। পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে ফাটকা ব্যবসায়ীরা! অপরদিকে সার বীজ ডিজেলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি চাষিদেরও চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। এছাড়া কৃষি আইন অনুযায়ী সরকার ফসল না কিনলে আগামীতে ওরা সরবরাহ বা গণবন্টণ ব্যবস্থাটাই ধাপে ধাপে তুলে দেবে। আধার সংযোগের নামে গরিবদের বাদ দেওয়া হচ্ছে, নগদ ভর্তুকির নামে অদুর ভবিষ্যতে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির মতো সেই ভর্তুকি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে। ১০০ দিনের প্রকল্পে জাতিগত শংসাপত্র চালু করে, বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে গরিবদের কাজের ছিটেফোঁটা যতটুকু সুযোগ আছে তাও কেড়ে নেবে। এরাজ্যের তৃণমূল সরকারও ফসলের সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রীষ্মে ধান সরকার কিনলোই না। কেন্দ্রের মতো সেই একই কায়দায় তারাও কিছু প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু তাতে গরিবদের বঞ্চিত করা, দুর্নীতি দলবাজি কায়েম করছে। এই বিষয়গুলি তুলে ধরে কিষাণ ও কৃষিমজুর সংগঠনের নেতৃবৃন্দ কর্মসূচিগুলিতে বক্তব্য রাখেন।

Protests on Quit India Day

 

বাঁকুড়া জেলায় যৌথভাবে বামপন্থী কিষাণ ও শ্রমিক সংগঠনগুলির এক দৃপ্ত মিছিল শহর পরিক্রমা করে জেলা শাসকের দপ্তরে আসে, ডেপুটেশন দেয়। বক্তব্য রাখেন আয়ারলা’র বাবলু ব্যানার্জী। ডেপুটেশনে ছিলেন এআইকেএম-এর বৈদ্যনাথ চিনা। মূল দাবিগুলির পাশাপাশি জেলায় নদী থেকে বৈধ ভাবে বালি তোলা বন্ধ করার বিরুদ্ধে, জেলায় সিমেন্ট কারখানা চালু করা, আদিবাসীদের বাস্তু জমির পাট্টা দেওয়া প্রভৃতি দাবিও তুলে ধরা হয়। বর্ধমান জেলায় কালনার বৈদ্যপুরে ১০০ দিনের কাজের দাবিতে, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে হস্তক্ষেপ ও জনগণের অংশগ্রহণ ঘটানোর মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে, সেখানে মিছিল ও প্রতিবাদসভা হয়। নেতৃত্ব দেন সফিকুল রহমান। পূর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া, ১নং ব্লকের ইসলামপুর ও মেমারী ২নং ব্লকের নিমোতে অনুরূপ কর্মসূচি হয়। নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলা’র সজল পাল, আনসারুল আমান মন্ডল, এআইকেএমের সলিল দত্ত, অশোক চৌধুরী, সমীর বসাক, জিয়াদুল সেখ, কুনাল বক্সী, সাধন কর্মকার প্রমুখ। জলপাইগুড়ি শহরে কদমতলা মোড়ে এক যৌথ প্রতিবাদসভা সংগঠিত হয়, ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সভা শেষে তিনটি কৃষি আইনের প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। নেতৃত্বে ছিলেন এআইকেএমের ভাস্কর দত্ত, আয়ারলা’র শ্যামল ভৌমিক। মেদিনীপুর শহরে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে বাম সংগঠনগুলি প্রতিবাদসভা করে, তারপরে মানববন্ধন করে, তাতে অংশগ্রহণ করেন আয়ারলার শৈলেন মাইতি, রাজু দাস। হাওড়া জেলার বাঙালপুরে বিক্ষোভসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন দিলীপ দে, নবীন সামন্ত, সনাতন মনি। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর কালেকটরি মোড়ে এক যৌথ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। বামপন্থী কৃষক ও কৃষিমজুর সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে আয়োজিত এই যৌথ অবস্থানে বিভিন্ন শ্রমিক ও কৃষক নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। অসংগঠিত ক্ষেত্র ও পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক সংখ্যক গরিব মানুষ অংশগ্রহণ করেন। শহরের নাগরিকরাও ভালো সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র জীবন কবিরাজ এবং এআইকেএমের পক্ষে এই প্রতিবেদক।

- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-28
সংখ্যা-30