আফগান জনতার পাশে দাঁড়ান
Stand with the People

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন শক্তির নিষ্ক্রমণ আর সাথে সাথে মার্কিন অভিভাবকত্বে চলা আশরাফ গনি সরকারের পতন ও তালিবানদের ক্ষমতা দখলকে প্রকৃতপক্ষে মার্কিন শক্তির বোঝাপড়ায় ক্ষমতার হস্তান্তর বলা যেতে পারে যা আফগানিস্তানের পরিস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্তরের জনতার ওপর তালিবানদের আক্রমণের ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ আফগানিস্তান ছেড়ে পালানোর মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাস বা ট্রেনের উপচে পড়া ভিড়ের মত মালবাহী উড়োজাহাজে শত শত মানুষের গাদাগাদি আর প্লেনের ডানা আঁকড়ে থাকা, এক ডাক্তার আর এক ফুটবলারের উড়ন্ত জাহাজ থেকে ঝরে পড়ে ভয়াল মৃত্যু — এসবই দেখিয়ে দেয় কতটা অনিশ্চিত ও আতঙ্কময় পরিবর্তন এখন আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ঘটে চলেছে। তালিবানরা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা মানুষের জীবনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। নারীর অধিকার বিলোপ করতে চায়। নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রতিবাদীদের সন্ত্রস্ত করতে চায়। এবং এমনকি আফগানিস্তানে সরকার নির্বাচনও নাকচ করে দিতে চায়।

আফগানিস্তানের বর্তমান ডামাডোল প্রথমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হল আর কত দিনই বা তারা আফগানিস্তানের দেখভাল করবে, এবং এখন তারা আফগানিস্তান ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আফগানদের অধিকারকে সম্মান জানাতে, যাতে আফগানরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই ঠিক করে নিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুক্তি চরম মিথ্যাচার, ঠিক যেমন এক সময় আফগানিস্তানে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও ছিল আরেক মিথ্যাচার। মার্কিন আগ্রাসন তো আফগানিস্তানকে নিদারুণ দুর্দশায় ফেলেছেই, সেই সাথে একথা ভুললেও চলবে না যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ঘটল তালিবানদের সাথে মার্কিনিদের বোঝাপড়া করা পরিকল্পনা অনুযায়ী। বোঝাপড়ার বেশিরভাগটাই যে পেছনের দরজা দিয়ে হয়েছে তা বলা বাহুল্য। কিছু কিছু অংশ জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে ২০২০’র মার্কিন-তালিবান চুক্তি হিসেবে। চুক্তিটি মার্কিন ছলচাতুরি ও কপটতার ক্লাসিক উদাহরণ।

২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি দোহা শহরে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার শিরোনাম, “আফগানিস্তানে শান্তি আনতে চুক্তি ‘আফগানিস্তান ইসলামিক আমিরশাহী’-র সাথে যাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তালিবান নামে পরিচিত”। চুক্তি ও তার আগের বোঝাপড়ার সমগ্র প্রক্রিয়া থেকে আফগানিস্তানের মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় চলা সরকারকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সহযোগিদের সম্পূর্ণত বাদ রাখা হয়। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও তালিবান বন্দিদের মুক্তির রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মার্কিনীরা আফগানিস্তান ত্যাগ করার সাথে সাথেই যে তালিবানিরা ক্ষমতা দখল করবে তা একরকম ঠিক করাই ছিল। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আলোচনা ভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তর হিসেবে বর্ণনা করা যায় যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তালিবানদেরই বিশ্বস্ত উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিয়েছে।

চুক্তিতে তালিবানদের কেবলমাত্র এই ‘অঙ্গীকার’ করতে বলা হয়েছে যে তারা যেন আফগান ভূমিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিদের বিরুদ্ধে কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হতে না দেয়। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যাথা কেবলমাত্র নিজের আর নিজের পার্টনারদের সুরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত যে তালিবান শাসন চলেছিল তা সেদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, নারী ও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস হামলা এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারের ওপর সুব্যবস্থিত আক্রমণের জন্য চরম কুখ্যাত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সঙ্গীরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে “ওয়েস্টার্ন স্ট্যাণ্ডার্ড” হিসেবে বর্ণনা করতেই অভ্যস্ত (যদিও তারা নির্লজ্জভাবে এই স্ট্যাণ্ডার্ডকে লঙ্ঘন করেই থাকে), সেনা অভিযান চালিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিন ও তার সঙ্গীদের দখলদারিকে নাম দেওয়া হয়েছিল “অপারেশন এন্ডিওরিং ফ্রিডম” অর্থাৎ স্থায়ী স্বাধীনতা কায়েমের কার্যক্রম। কিন্তু এইসব তথাকথিত ওয়েস্টার্ণ স্ট্যাণ্ডার্ড বা মূল্যবোধ চুক্তিপত্রে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল।

আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা নিয়ে মোদী সরকারেরও জবাবদিহি করতে হবে। বিগত বছরগুলো জুড়ে আমাদের ক্রমাগত বলা হয়েছে যে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে ভারত বড় ভূমিকা নিচ্ছে এবং আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতের অবদান আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করছে। আর এখন আফগানিস্তানের এই ঘটনাক্রম নিয়ে মোদী সরকার একেবারে চুপ মেরে গেছে এবং এমনকি কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসও বন্ধ করে দিয়েছে, যদিও বিজেপি নেতারা এখন দেশের প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে নতুন ধূয়ো বানিয়েছে “আফগানিস্তানে চলে যাও”। নারী, শিশু, মুসলমান, দলিত ও সাধারণ আইন মেনে-চলা শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতি যে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের শাসনের হীন কায়দা ভারতে চরম কুখ্যাতি অর্জন করেছে সেই যোগী আদিত্যনাথ আফগান নারী ও শিশুদের দুঃখে উত্তর প্রদেশ বিধানসভায় কেঁদে ভাসাচ্ছেন, ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও লাঞ্ছনার বিষাক্ত অভিযান চালাতে তালিবান শব্দটাকে কোড-নেম বানিয়েছেন।

তালিবানরা কি তাদের পূর্বতন শাসনামল থেকে ভিন্ন কিছু করবে বলা প্রত্যাশা করা যায়? আফগানিস্তানে কেবলই যে দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে তা থেকে তো সংশোধিত, পরিমার্জিত ও নিয়ন্ত্রিত তালিবান শাসনের কোনও ছবি আশা করার কোনও উৎসাহ জুটছে না। আফগান নারী ও শিশু এবং শ্রমিক ও কর্মচারীদের মুখচ্ছবিতে যে হতাশা ফুটে বেরোচ্ছে তাতে স্পষ্টতই এক ভয়াল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যেন প্রকট হয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলকে ন্যুনতম যেটুকু করতেই হবে তা হল আফগানিস্তানে সকলকে নিয়ে একটি মধ্যবর্তী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যেখানে অ-তালিবান শক্তিগুলিও জায়গা পাবে এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আফগানে অবিলম্বে সরকার নির্বাচন নিশ্চিত করে আফগান জনতাকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা নির্ধারণ করতে সহযোগিতা করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদের পেছনেই তাদের শক্তি নিয়োগ করে ফেলেছে। মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতাতেই তালিবানদের প্রাথমিক উত্থান ঘটেছিল। ফলত আফগানিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলি অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে আছে। তথাপি আমরা আফগানিস্তানে তালিবান সন্ত্রাস ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্রমশ বাড়তে দেখছি। গোটা দুনিয়ার স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা আফগান জনতার শান্তি সুরক্ষা মর্যাদা ন্যায় ও অধিকারের লড়াইয়ের পাশে থাকা দরকার, বিশেষত আফগান মহিলা এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশে।

আফগানিস্তানের মানুষের পাশে দ্রুত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ভারতে আমরা কী কী করতে পারি? ভারতে যেসব আফগান নাগরিকেরা পড়াশোনা করছেন তাঁদের ভিসা এক্সটেণ্ড করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না আফগানিস্তানে শান্তি ও সুস্থিরতা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের কাউকে জোর করে ফেরত পাঠান যাবে না। এইসব ছাত্রছাত্রীদের ফেলোশিপ প্রোগ্রাম বর্ধিত করতে হবে এবং/অথবা তাঁদের ভিসাকে ওয়ার্ক-ভিসায় পরিবর্তিত করে দিতে হবে যাতে তাঁরা কোনও কাজ খুঁজে নিয়ে টিকে থাকতে পারেন। যেসমস্ত আফগান নাগরিক ভারতে আশ্রয় নিতে আসবেন তাঁদের মধ্যে কোনও রকম বৈষম্য না করে সকলকে আশ্রয় দিতে হবে। এই পরিস্থিতি আরেকবার নতুন করে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনি আইন’-এর অদ্ভুত বৈষম্যমূলক চরিত্রকে প্রকাশ করেছে যেখানে আফগানিস্তান থেকে আসা অ-মুসলমান আবেদনকারিকে ভারতীয় নাগরিকত্বর জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এবং একই ধরনের বৈষম্য এখন কায়েম করা হচ্ছে আফগানিস্তান থেকে ভিসার আবেদনকারিদের মধ্যে। আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতায় ফেরাকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার জন্যও আসামে ইউএপিএ ধারায় কেস দেওয়া হয়েছে। ভারতে বসবাসকারী ভারতীয় বা আফগানদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের জন্য এভাবে উৎপীড়ন করা ভারতে ন্যায় ও মানবাধিকার নস্যাৎ করে দেওয়ার সামিল — এবং তা আরও সাংঘাতিক কারণ সেটা করা হচ্ছে তালিবানদের অত্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলেই।

উত্তরপ্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। সংঘ-বিজেপি বাহিনী আফগান সংকটকে ইসলাম-বিদ্বেষি ঘৃণা ও হিংসা অভিযান চরম রূপ দিতে ব্যবহার করার সবরকম চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি সরকার ভারতের ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসকে দেশভাগের ক্ষত নতুন করে বিষিয়ে তুলতে ব্যবহার করেছে বীভৎসতা স্মরণের নামে। আফগান সংকটকেও ওরা হিন্দু ও ভারত খত্রে মে হ্যায় ক্যাম্পেনের ইন্ধন হিসেবে যুক্ত করছে। ভারতের নারীর স্বায়ত্ততা ও অধিকারের প্রশ্নে সংঘ বাহিনীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী তো তালিবান মডেলের মতোই পশ্চাদমুখী। আর, বহুবিধ নিপীড়নমূলক আইন ও বিচার-বহির্ভূত সন্ত্রাসের সমন্বয়ে তাদের শাসন প্রণালিও তো কম অত্যাচারি নয়। তালিবানদের বিরুদ্ধে সংঘ পরিবারের প্রচারাভিযান নারী শিশু বা মানবাধিকারের প্রতি কোনওরকম সম্মান শ্রদ্ধা থেকে উদ্ভুত নয়। তাদের কাছে এ হল মুসলমানদের ভয়াল চেহারা দেওয়ার, হেয় প্রতিপন্ন করার আরেক সুযোগ মাত্র। আফগান জনতার শান্তি সুবিচার গণতন্ত্রের সন্ধানে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আফগানিস্তানের বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ি সমস্ত দুষ্কর্মের দোসর ও অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ভারত সহ সব সহযোগিদের ভূমিকা দৃঢ়তার সাথে উন্মোচিত করতে হবে এবং আফগান নারী ও শিশুদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানোর সমস্ত অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে হবে।

(এম এল আপডেট, সম্পাদকীয়, ২৪ আগস্ট ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-32