সুল্লি ডিল : সমাজমাধ্যমে নারী বিদ্বেষের উৎকট প্রদর্শন
Sulli Deal

গিটহাব নামের একটি ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্মে সুল্লি ডিল নামের একটি অ্যাপ্লিকেশন টুইটার নেটিজেনদের নজরে আসে ৪ জুলাই নাগাদ। মুহূর্তের মধ্যে নেট-দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেয় এই অ্যাপ্লিকেশনের বিষয়বস্তু। সাংবাদিকতা, বিমান-চালনা, সমাজসেবার কাজে যুক্ত প্রায় শতাধিক মহিলার ছবি বিপণনী সামগ্রী হিসাবে নিলামে প্রদর্শিত হচ্ছিল সুল্লি ডিল অ্যাপ্লিকেশনের পর্দায়। বিভিন্নক্ষেত্রে কর্মরত এই শতাধিক নারীর প্রত্যেকেই ঘটমান অন্যায়, বাস্তবিক বৈষম্য ও দেশের মসনদে বসে থাকা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সরব ব্যক্তিত্ব এবং এরা সকলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। শহুরে অভিধায় সুল্লি শব্দটি যৌন-হেনস্থামূলক। আগেও সামাজিক মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী রথী মহারথীদের সুল্লি শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে মুসলিম মহিলাদের হেনস্থা করতে দেখা গেছে। আমেরিকান কোম্পানি গিটহাবের সাহায্যে এই অ্যাপ্লিকেশন তৈরির পর পিতৃতান্ত্রিকতা ও ফ্যাসিবাদের এই ন্যক্কারজনক আস্ফালন রমরমিয়ে চলেছে ২০ দিন ধরে। নিজের বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে, হেনস্থার শিকার বেশ কিছু মহিলা সুল্লি ডিলের বিষয়টি জানতে পারেন ও দেশের রাজধানীর অধিবাসী হিসাবে দিল্লী পুলিশের দ্বারস্থ হন। ফ্যাসিবাদের তল্পিবাহক দিল্লী পুলিশ যথারীতি কাউকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি।

বছর শুরুর প্রথম ঈদের সময়, ভারতীয় ও পাকিস্তানি মুসলিম মহিলাদের ছবি একই কায়দায় ইউটিউব ও টুইটারের মতন সামাজিক মাধ্যমগুলিতে নিলামে তোলা হয়েছিল ‘লিবারাল ডজ’ নামের একটি একাউন্ট থেকে। ৭৭ পয়সার মূল্যে এই নিলামে যৌন-পণ্য হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছিলেন কংগ্রেস দলের সর্বভারতীয় আহ্বায়ক হাসিবা আমিনও। হাসিবা আমিন পুলিশি তদন্তে আস্থা রাখলেও, সাইবার দুনিয়ায় যৌন-হেনস্থা ও অপরাধকে আটকানোর দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় রিসোর্সের অভাবে হাসিবার অভিযোগের সুরাহা হয়নি আজ অবধি। প্রবল প্রতিবাদ ও জনরোষের মুখে পড়ে গিটহাব থেকে সুল্লি ডিল অ্যাপ্লিকেশনটি প্রত্যাহার করা হলেও, ‘গোড্যাডি’ নামের অন্য একটি প্ল্যাটফর্মে সুল্লি ডিল পুনরায় রেজিস্টার করা হয়েছে।

‘ফেমিনিজম ইন ইন্ডিয়া’য় এই বিষয় নিয়ে নিজেদের মতামত জানাতে গিয়ে, আফরিন ফাতিমা খান, (সুল্লি ডিলে হেনস্থা হওয়া মহিলাদের একজন) বলছেন, “এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আদর্শ হিন্দু-রাষ্ট্রে মুসলিম নারীদের যৌন-দাসে পরিণত করতে বাধ্য করা হবে।” এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির সময়, ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের কাশ্মীরের জমি দখলের সাথে, কাশ্মীরী মুসলিম মহিলাদের উপর দখলদারি পাবার আশায় উন্মত্ত আস্ফালন চাপা থাকেনি। বিজেপি শাসিত হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর ও উত্তর প্রদেশের বিজেপি মন্ত্রী বিক্রম সিং সাইনি প্রকাশ্যে বিজেপির কর্মী সমর্থকদের কাশ্মীরী মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করার জন্য উৎসাহ দেয়। এই ঘটনা, ভারতের ফ্যাসিস্ট শাসকদের কাশ্মীরের সাথে কাশ্মীরের মুসলিম মহিলাদের শরীর ও স্বায়ত্ততার উপর কব্জা চাওয়ার নিকৃষ্ট আকাঙ্খার উলঙ্গ প্রদর্শন। পাঠক মনে করুন মৌলবাদী নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করায় সাফুরা, গুলফিশাদের রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের পাশাপাশি কীভাবে সামাজিক মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী পিতৃতান্ত্রিক হিংসার শিকার হতে হয়েছিল। আজকেও সুল্লি ডিলের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা মুসলিম নারীদের কন্ঠরোধের প্রয়াস, সেই পরিচিত ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রসারকেই চিহ্নিত করে।

ভারতবর্ষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া মৌলবাদী নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারকে দিশা দেখিয়েছিলেন ভারতের মুসলিম নারীরা। শাহীনবাগ, পার্কসার্কাসের মতো সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রগুলির প্রাণশক্তি, মুসলিম নারীদের লক্ষ করে লিঙ্গ-ভিত্তিক হেনস্থামূলক পরিকল্পিত প্রচার চালিয়েছিল গোদী-মিডিয়া নামে পরিচিত বিভিন্ন মূলধারার খবরের মাধ্যম ও বিজেপির কুখ্যাত আইটি সেল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ভারতে মুসলিম মহিলা রাজনীতিবিদদের উপর নির্দেশিত হিংসা ও হেনস্থার প্রকৃতি অপেক্ষাকৃত গুরুতর ও তার প্রসারও বহুব্যাপ্ত। শতকরা ৫৫ শতাংশ আগ্রাসী হেনস্থা বা ট্রোলিং-এর লক্ষ্য মুসলিম মহিলা নেতৃত্ব ও রাজনীতিবিদরা। অন্যান্য ধর্মের মহিলাদের তুলনায় ৯৪.১ শতাংশ মুসলিম মহিলা ধর্ম-জাতি ভিত্তিক কটূক্তির শিকার হন।

রাষ্ট্র ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি ‘পাবলিক প্লেসে’ মহিলাদের গতিবিধি, মেলামেশার পরিধি নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় সামাজিক মাধ্যমের পিছনের নেটওয়ার্কের গঠন গোপনীয়তা ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের বিকল্প পরিধি তৈরি করে মহিলাদের জন্য। যার মাধ্যমে মেয়েরা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য, মতামত, পছন্দ ও সিদ্ধান্তগুলি অভ্যাস করার সুযোগ পান। সামাজিক মাধ্যমে মহিলাদের নিশানা করে নামানো আক্রমণের ফলে মহিলারা নিজেদের মতপ্রকাশের বিকল্প পরিধি থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন। প্ল্যান ইন্টারন্যাশন্যাল নামের একটি গ্লোবাল সার্ভের মতে, কোভিডের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে মহিলা ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের উপর হিংসার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বহুলভাবে কমিয়ে এনেছেন বা ছেড়ে দিয়েছেন। খোদ জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্য বলছে, কোভিড লকডাউনের পর থেকে সাইবার স্পেসে মহিলা ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের উপর হিংসা পাঁচগুণ বেড়েছে। অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, মাত্র ৩৩ শতাংশ ভারতীয় মহিলা সামাজিক মাধ্যমের সাথে যুক্ত। ভারতে ৫১ শতাংশ মহিলার হাতে ফোন আছে। মাত্র ১৪ শতাংশ মেয়ে অ্যান্ড্রয়েড প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। আমাদের দেশের ৫২ শতাংশ মহিলা সামাজিক মাধ্যমে হেনস্থা, হিংসা ও ট্রোলিং-এর ভয়ে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে চান না।

এমতাবস্থায়, সুল্লি ডিল বা অনুরূপ লিঙ্গ-জাতি-ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্যমূলক প্রতিটি অপপ্রয়াস ভারতীয় নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনকেই সূচিত করে। সামাজিক মাধ্যমে নারী ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সুরক্ষা ও গতিবিধি নিশ্চিত করার বদলে, শাহ-মোদীর মদতে সুল্লি ডিল, আইটি সেল ও গোদী-মিডিয়ার বিদ্বেষমূলক প্রচার, সার্বিকভাবে মহিলাদের সামাজিক অবস্থানকে কোণঠাসা করছে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্দেশে প্রকাশ্য বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোয় সিদ্ধহস্ত কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, পারভেশ বর্মার মতো বিজেপির নেতাদের সামাজিক মাধ্যমে অনুগামী আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

২০১৪ সালে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলিত ও মুসলিম সমাজের উপর হিংসার ঘটনা আরও তীব্র হয়েছে। এহেন মোদীর রাজনীতিতে প্রবেশ হিন্দুত্ববাদী আরএসএস’এর সক্রিয় কর্মী হিসাবে। দেশের শীর্ষাসনে বসে, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে হাতিয়ার করে মোদী আরএসএস প্রচারক হিসাবে কাজ করছেন। ভারতের বৈচিত্র‍্যের ইতিহাসকে মুছে হিন্দুরাষ্ট্রের আফিমে দেশকে রণক্ষেত্র করে তুলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরএসএস’এর জন্মলগ্ন থেকেই। হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী/মনুবাদী আদর্শের উপর ভিত্তি করে তৈরি আরএসএস রাজনীতি।

আরএসএস’এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ ও ‘হিন্দুত্ববাদ’এর ধারণার প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার বিভিন্ন লেখায়, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের কথা লিখে গেছেন। ‘সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোচ অফ হিস্ট্রি’ নামের বইতে সাভারকার পূণ্য বা গৌরব অর্জনের স্বার্থে মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের ন্যায্যতার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপর যৌন-হিংসাকে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন সাভারকার।

সম্প্রতি দিল্লীর যন্তর-মন্তরে জড়ো হওয়া ফ্যাসিবাদের দালাল বিজেপি আর ফ্যাসিবাদের সংগঠক আরএসএস নেতা-মন্ত্রীরা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে হিংসার আহ্বান রাখার পরেও তাদের গ্রেপ্তার করতে নারাজ স্বরাষ্ট্র-মন্ত্রকের আওতায় থাকা দিল্লী পুলিশ। ‘জয় শ্রীরাম’ না বললে টুকরো করে ফেলার হুমকি দিয়ে গজেন্দ্র চৌহানরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছে, অন্যদিকে এই হিংসা আর উস্কানির বিরোধিতা করায় সমাজকর্মী, ছাত্র, যুবদের গ্রেপ্তার হতে হচ্ছে দিল্লী পুলিশের হাতে। ভারতের বর্তমান শাসকদল জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে একের পর এক জনবিরোধী আইন লাগু করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ভারতের সংবিধানকে রক্ষা করার লড়াই চালাচ্ছে দেশের কৃষক, মজদুর, নারী, দলিত, আদবাসী, ছাত্র, যুবরা। সুল্লি ডিলের মাধ্যমে মুসলিম মহিলাদের পরিকল্পিত কণ্ঠরোধের প্রয়াসকে ব্যর্থ করে হেনস্থার শিকার মহিলারা সংঘবদ্ধ হয়ে, শাসকের চোখে চোখ রেখে বিচারের দাবি করছেন।

ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা সংবিধান হত্যাকারী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে এহেন প্রতিস্পর্ধাই আগামীর পাথেয়।

(সূত্র: লিবারেশন, আগস্ট ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হিমা ফতিমার নিবন্ধ “সুল্লি ডিলস: এ প্লেস ফর ‘অকশনি’’ অব মুসলিম উইমেন বাই হিন্দুত্ব প্যাট্রিয়ারকাল বাইগটস”)

- সম্প্রীতি মুখোপাধ্যায়

খণ্ড-28
সংখ্যা-31