প্রতিবেদন
সর্দার উধম : উগ্র জাতীয়তাবাদের গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এক ক্রান্তিকারীর জীবনী
Biography of a Revolutionary

বলিউডের মূলধারায় স্বাধীনতা ও দেশাত্মবোধকেন্দ্রীক সিনেমার অভাব নেই। ২০০২-এ মুক্তিপ্রাপ্ত লেজেণ্ড অফ ভগত সিং থেকে শুরু করে হালের শেরশাহ বা উরি, এই প্রত্যেকটি সিনেমার সারবস্তু দেশাত্মবোধ। লেজেন্ড অফ ভগত সিং-এর মতো ঐতিহাসিক ফিকশনে ভগত সিং, রাজগুরুকে দেখা গেছে অতিরঞ্জিত, ইতিহাসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্র হিসেবে। আর ২০১৪’র পরের সাত বছরের সিনেমায় দেশপ্রেম ঘুরপাক খেয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহসের অতিরঞ্জনকে কেন্দ্র করে। সুজিত সরকারের নির্দেশনায় উধম সিং এই প্রচলিত দেশপ্রেমের সংজ্ঞার বাইরে থেকে বলেছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রান্তিকারী ইতিহাস। উগ্র দেশপ্রেমের চিরাচরিত আখ্যানের বাইরে এই সিনেমায় উধম সিং-এর চরিত্রের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে তার সমাজবাদী আদর্শ।

সিনেমাটিকে ঘটনাক্রমে ভাগ করলে তিনটি প্রধান পর্ব পাওয়া যায়। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পূর্ববর্তী উধম সিং-এর জীবন, যেখানে তার ব্যক্তিজীবনের চাওয়াপাওয়া দিয়ে এক-একটি দৃশ্য সাজানো। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে শুরু হওয়া ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য লড়াইয়ের প্রত্যয় এবং সেই সূত্রে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেওয়া। সব শেষে এই হত্যাকাণ্ডের আয়োজক জেনেরাল ও’ডয়্যারকে লণ্ডনে হত্যা। রীতেশ শাহ ও শুভেন্দু ভট্টাচার্যের স্ক্রিনপ্লে এই তিনটি পর্বকে অদ্ভুত নৈপুণ্যের সাথে অরৈখিক সময়ক্রমে তুলে ধরেছে।

এই ধারার হিন্দী সিনেমায় আমরা বারবার দেশপ্রেমকে মহিমান্বিত হতে দেখেছি, দেশকে মায়ের সাথে তুলনায় যেতে দেখেছি সংলাপ বা গানের মাধ্যমে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভগত সিং ও ঊধম সিং-এর কথায় বারবার উঠে এসেছে এমন এক দেশের কথা, যেখানে ভেদাভেদের কোন জায়গা নেই। ক্রান্তিকারীর পরিচয়েও সেই একই আদর্শ প্রতিধ্বনিত হয়েছে, “ক্রান্তিকারীরা পক্ষপাতদুষ্ট, সাম্প্রদায়িক বা জাতিবাদী হতে পারে না। সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনও ভেদাভেদ থাকতে পারে না। সমতাই একমাত্র সত্য।” এমনকি স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়েও এই আদর্শ অনুরণিত হয়েছে, সাম্যবাদী আদর্শ ছাড়া স্বাধীনতা দাসত্বের থেকেও খারাপ হতে পারে। উধম নিজের নাম বলেছে ‘রাম মহম্মদ সিং আজাদ’, যা ভারতীয় স্বাধীনতা-ক্রান্তির ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। এই সিনেমায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে ভগত, উধমরা বন্ধু হিসেবে পেয়েছে কমিউনিস্ট রাশিয়াকে এবং ক্রাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তিকামী আয়ারল্যাণ্ড রিপাবলিকান আর্মীকে। ভগত-উধমদের ভারতের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কেন্দ্রেও থেকেছে শ্রমিক-মজদুর-কৃষক-ছাত্র ঐক্যের কথা।

এই ধারার চিরাচরিত সিনেমায় মহিলাদের ভূমিকা থাকে মা, প্রেমিকা বা বোন হিসেবে। ক্রান্তিকারীর ভূমিকায় সামান্য কিছু চরিত্র থাকলেও, সেই চরিত্র খুব ছোট ও অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এই সিনেমার মহিলারা এইচএসআরএ’র দপ্তরে ভগত-উধমদের সাথে লিফলেট লেখায় ব্যস্ত থাকেন। লণ্ডনে আইআরএ’র তরফে উধমের প্রধান সহকারী হন ঈলিন পামার। এমনকি উধমের প্রেমিকা, যে এক সাধারণ গ্রাম্য কিশোরী, সে ঊধমকে বলে জালিয়ানওয়ালাবাগে রাওলাট অ্যাক্ট-বিরোধী জমায়েতে যাওয়ার কথা।

এই সিনেমায় ব্রিটিশ শাসকের দমনপীড়ন প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে থাকে আজকের ভারতের শাসকের ভূমিকা। যেখানে জেনেরাল ও’ডয়্যার রাওলাট অ্যাক্ট বিরোধী পাঞ্জাবের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে যেকোন উপায়ে দমন করার নির্দেশ দেয়, কারণ এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলেও রাজনৈতিক। জাতীয় নেতাদের ও ছাত্রদের এর আগেই গ্রেপ্তার করা হয়। আর, জালিয়ানওলাবাগে গুলি চালানোর নির্দেশ শুধুমাত্র এই বিদ্রোহ দমনের জন্য নয়, মুক্তিকামীদের মনে আতঙ্ক তৈরির জন্য দেওয়া হয়। লণ্ডনে ও’ডয়্যারের হত্যার পরেও উধম সিংকে আতঙ্কবাদী, সামান্য হত্যাকারী বলা হয়, ক্রান্তিকারী নয়। ও’ডয়্যারের সংলাপে অনুরণিত হয় আজকের শাসকের উক্তি — ভারতীয়রা নিজের ভালো বোঝে না, তাদের ভালোর জন্যই ব্রিটিশ শাসন প্রয়োজন। এই হত্যার মামলা চলাকালীন ব্রিটিশ বিচারক সাংবাদিকদের নির্দেশ দেয় এর খবর না ছাপতে। ঊধম নিজের পছন্দের বইকে শপথ নেওয়ার জন্য চাইলে জাজ প্রশ্ন করেন সেই বই রাজদ্রোহী ধরনের কিনা। এমনকি জেলে বন্দী থাকার সময় উধম অনশন শুরু করলে ব্রিটিশ কর্তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন, যাতে ঊধম শহীদের মর্যাদা না পায়।

অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরায় যখন জালিয়ানওয়ালাবাগের বিদ্রোহ ধরা পড়ে, তারসাথে সরাসরি মিল খুঁজে পাওয়া যায় আজকের রাজধানীতে কৃষক বিদ্রোহের। এই সমাবেশের আগে ও পরের ১৪৪ ধারা পরিবেষ্টিত, সেনা-পুলিশ-ব্যারিকেডে ছয়লাপ জালিয়ানওয়ালাবাগের রাস্তার দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় আজকের কাশ্মীরের কথা। বিদ্রোহ তো দূর কথা, হতাহত পরিজনদের চিকিৎসা বা অন্ত্যেষ্টির কাজও হয়ে ওঠে দেশদ্রোহ।

এই সিনেমায় উধম ভারতের ঐতিহাসিক কালের ও সাম্প্রতিক সময়ের হাজার হাজার ক্রান্তিকারীর এক মূর্ত প্রতিবিম্ব হয়ে ধরা পড়ে। যে তার ইন্টারোগেটিং অফিসারের সাথে ব্যক্তিগত্য বৈরিতা দেখায় না, কারণ সে তার নিজের চাকরি করছে। অন্যদিকে আবার উধম এমন ভারতীয়দের মেরে নাক ফাটিয়ে দেয় যারা ব্রিটিশের গোলামীতেই অভ্যস্ত। সে মদ খেয়েও ফ্রী স্পীচের স্বপ্ন দেখে। আবার এই আদর্শের জোরেই একা লণ্ডনের অন্ধ কারাগারেও নিজের সহকর্মীদের নাম নেয়না, দাঁতে দাঁত চেপে শেষ অবধি লড়ে যায়। সে পুলিশী জেরার প্রচণ্ড চাপে শান্ত থাকে, কিন্তু কারখানায় কাজ করার সময় মালিকের জোর জবরদস্তির প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।

সব মিলিয়ে সর্দার উধম এমন একটি সিনেমা যা মূল ইতিহাসকে বিকৃত না করে, উধম সিং-এর একক ব্যক্তি থেকে ক্রান্তিকারী হয়ে ওঠার গল্প বলে সৃজনশীল কল্পনার আশ্রয়ে। তাঁর মূলগত সাম্যবাদী আদর্শ, তাঁর আন্তর্জাতিক শোষিত-ঐক্যের স্বপ্নের একটি দলিল পেশ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এমন একটি সিনেমা ভারতের সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে, আন্তর্জাতিক কর্পোরেট ‘আমাজন’ প্ল্যাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। ভগত সিং, উধম সিং-এর ভারতের স্বপ্নও তাই আপামর ভারতবাসীর নাগালের বাইরেই থেকে যায়।

- কৌশিকি ভট্টাচার্য

খণ্ড-28
সংখ্যা-37