টিকরি বর্ডারে দেখলাম হাতে হাত রেখে একসাথে বেঁচে থাকা
At Tikri Border

২৯-৩০ অক্টোবর দিল্লীর এমপি ক্লাব। অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়নস-এর সর্বভারতীয় অফিস বেয়ারার মিটিং ছিল। একদিন আগে পৌঁছে ২৮ অক্টোবর দিল্লীর ‘চারু ভবন’ সংলগ্ন লক্ষ্মীনগর মেট্রো স্টেশন থেকে অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু আর এই প্রতিবেদক টিকরি বর্ডারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পন্ডিত শ্রীরামশর্মা স্টেশন লাগোয়া রাস্তায় সারা ভারত কিষাণ মহাসভার তাঁবু পড়েছে।

তাঁবু নিয়ে আমি বরাবর স্মৃতিকাতর। একদম শিশুকালের ঘটনা মাঝে মাঝে মনের কোঠায় ফিরে আসে। আমার বাবা সেনাবাহিনীতে ঢুকে পড়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশ, বর্তমান সময়ের মতো সেনাবাহিনীর এতো রমরমা বাজার ছিল না। বাবা দিল্লী থেকে উত্তর প্রদেশের ঝাঁসির বোবিনায় বদলি হলেন। আর পুরো পরিবার নিয়ে আমি, দিদি এবং মাকে সঙ্গে নিয়ে বোবিনায় চলে এলেন। মুস্কিল হল কোয়ার্টার পাননি, অগত্যা মাঠের মাঝেই বিশাল তাঁবু তৈরি হল আমাদের আস্তানার জন্য। কাজ থেকে ফিরে বাবা প্রতিদিন তাঁবুর দড়ি টেনে টেনে শক্ত করতেন যাতে তা হাওয়ায় উড়ে না যায়। দিদি ও আমি দুজনেই এই কাজে হাত লাগাতাম। কিন্তু ঝড়ে তাঁবু মাঝে মধ্যেই কাত্ হয়ে পড়ে যেত আর আমরা খুব ভয় পেতাম। ভয়ের জন্যই এখনও স্মৃতিতে আছে। আর একবার তাঁবুর বিপদে পড়েছিলাম। ১৯৮২-র ২৪ এপ্রিল আইপিএফ’এর দিল্লীতে গঠন সম্মেলন হচ্ছিল তাঁবু টাঙিয়ে, হঠাৎ দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির তোড়ে প্রতিনিধিরা তাঁবুর তলায় চাপা পড়ে গেলেন। ঝড়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবারহ আগেই বন্ধ করা হয়েছিল, তাই বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। তাঁবুর কথা শুনলেই এই দুটি স্মৃতি চলে আসে।

টিকরিতে তাঁবু বলতে ভেবেছিলাম চারিদিকে সার্কাসের যেমন তাঁবু হয় সেরকমই হবে। ট্রেন থেকে নেমে হতাশ হলাম, কোথায় তাঁবু? একটু নজর দিতেই দেখলাম প্লাস্টিকে মোড়া ছোট ছোট বিভিন্ন মাপের ঘর, তাতে বিভিন্ন রঙের পতাকা, ফেস্টুন, নেতাদের ছবি। বিভিন্ন সংগঠনের নিজের নিজের টেন্টে নিজেদের পরিচিত নেতাদের ছবি। ৭৮২ নম্বর পিলারে সারা ভারত কিষাণ মহাসভার অস্থায়ী তাঁবু। সেখানেই ট্রলি সমাচারের কার্যালয় ও লাইব্রেরি আছে। কয়েকজন আন্দোলনকারী কমরেড চৌধুরী পাল সিং, গুরপাল সিং, বিকর সিংয়ের সাথে আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হল। ওনাদের কাছ থেকে শুনলাম মানসার ১৬৬ জন শহীদ হয়েছেন। হরিয়ানার নয়া গাঁও ফ্লাইওভার থেকে মানসার মহিলারা গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন সেই সময় একটা ট্রাক তিন জন মহিলাকে পিষে দিলে তিন জনেরই মৃত্যু হয়, কয়েকজন গুরুতর জখম হয়েছেন। প্রতিদিন বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে, সবারই ধারণা এগুলো পরিকল্পিতভাবেই হচ্ছে।

কিষাণ মহাসভার টেন্ট থেকে অটো করে স্থায়ী প্রতিবাদী মঞ্চে গিয়ে হাজির হলাম। মঞ্চের পিছনে দিল্লী পুলিশ বিশাল বিশাল কংক্রিটের স্ল্যাব ও কাঁটাতার দিয়ে হরিয়ানা বর্ডার সীল করে দিয়েছে। আন্দোলনকারীরাও মাথার উপর টিনের ছাউনিওলা পাকাপোক্ত স্থায়ী ধর্ণামঞ্চ বানিয়ে দিল্লী বর্ডার সীল করে দিয়েছেন। মিটিং চলছে। আমরা নিজেদের সংগঠনের পরিচয় দিলাম এবং বাসুদেব সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখলেন।

holding hands and living together

 

২২/২৩ কিলোমিটার লম্বা রাস্তার ধারে ধর্ণাস্থলে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি। সব তাঁবুগুলোই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, পানীয় জল এবং অন্য কাজের ব্যবহারের জন্যে আলাদা জলের ট্যাংক, এয়ারকুলার, ফ্রীজ সব কিছু আছে সেই তাঁবুগুলিতে। যেখানেই যাবেন, চা না খাইয়ে ছাড়বে না। সবার মধ্যেই এক ধরনের সরলতা ও দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ। লড়াই দীর্ঘদিন চলবে ধরে নিয়েই ওরা চলছেন। প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারার জন্য স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা পাচ্ছেন। হঠাৎ করে এতো মানুষ প্রায় এক বছরের মতো আছেন, কিন্তু কোনও দুর্গন্ধ-দূষণ পাবেন না। যত দেখছি অবাক হচ্ছি, এটাও কীভাবে সম্ভব! গ্রামগুলোই স্বেচ্ছাসেবকদের আসা এবং ফিরে যাওয়ার ব্যপারটা নিয়ন্ত্রণ করে। যারা অবস্থানে থাকেন তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা করা হয়। অনেকেই চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, তারা অনেকেই এই এক বছরের মধ্যে একদিনের জন্যও বাড়ি যাননি। আর আছেন বিদেশে কর্মরতরা, দু’হাত ভরে সাহায্য করে চলেছেন। টিকরি বর্ডারের ধর্ণায় প্রধানত থাকছেন পাঞ্জাবের কৃষকরাই।

ডাঃ সোয়াই মান সিং আমেরিকায় থাকতেন, পেশায় ডাক্তার। তিনি আমেরিকার পাট চুকিয়ে দিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। সারাদিন চিকিৎসা করে চলেছেন। দিনের নির্দিষ্ট সময় লঙ্গর চালু থাকে, যারা লঙ্গরে যান না, তাদের রেশনের কুপন দেওয়া হয়। নিজেরাই রান্না করেন। ‘পঞ্চ নদীর হৃদয়ে যে ইনকিলাবীর ঢেউ’ উঠেছে তা উদ্বেল করে তুলেছে সুদুর কালিফোর্নিয়া পিন্ড কৃষি আঞ্চলের শিখ কৃষকদেরও। তারা অনেকেই ধর্ণায় সামিল হয়েছেন।

বেলা তিনটে, নিত্যদিনকার মতো সভা শেষ হল। স্বেচ্ছাসেবকরা কয়েক মিনিটের মধ্যে সভার স্থল পরিষ্কার করে ফেললেন। কালান্তর পত্রিকার সাংবাদিক উৎপল দাস লাল জামা গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন, ওনার আফসোস বামেদের বিভাজন নিয়ে। ভাতিন্দা থেকে এসেছেন সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা, একটাই প্রশ্ন — বাংলায় বামেরা কেন দুর্বল হচ্ছে? লাল ঝান্ডা নিয়ে কয়েক জন যুবক যাচ্ছিলেন জিজ্ঞেস করতে জানালেন ওরা এনডি সংগঠনে যুক্ত আছেন, ভাতিন্দায় থাকেন। পথ চলছি। অনেকেই নিজেদের তাঁবুতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। বিকেইউ’র তাঁবুতে গেলাম, অনেক কথা হল, চা খাইয়ে তবে ছাড়লেন। প্রায় ৩০০ মতো সংগঠন, তাদের সবার রাজনৈতিক, সামাজিক নিজস্বতা নিয়েই আছেন, কিন্তু এখানে সবাই এক। আন্দোলনে যুক্ত সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে এক উচ্চ পর্যায়ের ঐক্য লক্ষণীয়, কারও মুখে অন্য কোন সংগঠন সম্পর্কে নিন্দামন্দ শুনিনি।

টিকরি বর্ডারের আন্দোলন পাঞ্জাবের কৃষকরা নিয়ন্ত্রণ করেন। সমগ্র পাঞ্জাবের মানুষ এই লড়াইয়ে আছেন। যার জন্য অর্থবল, লোকবল কোনও কিছুরই সমস্যা নেই। সবারই বক্তব্য কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা আপের উপস্থিতি ইত্যাদি সত্ত্বেও বিজেপি হারবে। বাংলার মানুষ সম্পর্কে পাঞ্জাবের মানুষ খুব সংবেদনশীল, স্বাধীনতা সংগ্রামে বংলার ভূমিকা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। বাংলায় বিজেপির হারে তারা খুশী, কিন্তু বামেদের করুণ পরিস্থিতিতে চিন্তিত। বিজেপি বিরোধী জনমানসে মমতা ব্যানার্জীর ছাপ স্পষ্ট, আবার এটাও আছে তারা বাংলায় বামকেই চান। খুব অল্প সময়ের পর্যবেক্ষণ। ধান কাটার মরশুম চলছে তুলনামূলকভাবে লোক সমাগম কম। জানুয়ারি থেকে লোকের ভীড় বাড়বে। তবে মোর্চার আহ্বান থাকলে, অল্প সময়েই কয়েক লক্ষ মানুষ জড়ো হয়ে যান। প্রস্তুতি চলছে ২৬ নভেম্বর আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তি পালন করার। সার দেশেই এই আন্দোলনের সংহতি পালন হবে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো গত ২৬ নভেম্বর ভারত বন্ধ ডেকেছিল। এআইসিসিটিইউ এবার ঐ দিন সারা দেশে আন্দোলনের বর্ষপূর্তি দিবস পালন করবে।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-38