প্রতিবেদন
ধর্মের নামে মোহ এসে যারে ধরে
name of religion

(বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক আক্রমণের ঘটনার পর যে সমস্ত তরুণ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা দ্রুত প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল হন, গল্পকার মোজাফ্ফর তাঁদের অন্যতম। এই লেখাটিতে তিনি সমস্যাটিকে বোঝবার চেষ্টা করেছেন সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এই লেখাটি আমরা পুনঃপ্রকাশ করছি। শিরোনাম আমাদের সংযোজন। - দেশব্রতী সম্পাদকমণ্ডলী)

হিন্দু মুসলিম সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক ফাঁক সেটা ভারতবর্ষে ধর্মের ভেতর থেকে আসেনি। এই উপমহাদেশের বৃহত্তর নিরক্ষর বা অল্পশিক্ষিত জনগণ নিজেদের ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারে না। অধিকাংশ শিক্ষিত জনগণও ধর্মগ্রন্থসমূহ পড়ে দেখে না। ফলে ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে যে উন্মাদনা সেটা বাইরে থেকে আসে। সমাজ, রাজনীতি এবং ধর্ম ব্যবসায়ীরা সেটা নির্ধারণ করে দেয়। যখন যে ক্ষমতায় আসে, তার হাতে সবচেয়ে সচল হয় ধর্মের ট্রামকার্ড। ভারতবর্ষে ধর্ম একটা রাজনৈতিক গুটি। এদেশে ধর্ম অবমাননার ‘অভিযোগে’ রুটিন করে যে মন্দিরে বা হিন্দুপাড়ায় আগুন দেওয়া হয়, দেখা যাবে যারা জড়িত বা সমর্থক তারা হয়ত জানেও না কিভাবে ইসলামকে অবমাননা করা হয়েছে। কিন্তু তারা জানে তাদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে, এটা প্রতিহত করতে হবে। তারা এও জানে, প্রতিহত করতে গিয়ে মন্দির লুটপাট ভাঙচুর, হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের মতো নৃশংস ঘটনারও ধর্মীয় অনুমোদন আছে। এবং এইটা করেই বরঞ্চ ইসলামকে সবচেয়ে বড়ো অবমাননাটা তারা করছে। কিন্তু টক ধর্মব্যবসায়ী মামুনুলকে ‘কটাক্ষ’ করে জেলে যায় ঝুমন দাস, এবং সহজে জামিন পায়না। অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, গত ন’বছরে হিন্দুদের উপর ৩,৭০০টির মতো হামলার ঘটনা ঘটেছে — হামলাকারীদের বিচারের দৃষ্টান্ত নেই। এটাই দাবার চাল।

এখন ‘ধর্মানুভূতি’ দিয়ে হয়ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিভক্ত হচ্ছেনা, কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে, বাংলার আদি সম্পদ লোকধর্ম ও বহুত্ববাদ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। প্রতিবেশি প্রতিবেশির শত্রু হচ্ছে। দেখা যাবে আমার পূর্বপুরুষ কোনো কালে হিন্দু বা লোকায়ত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। তাহলে আমি কার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি? আফগান, সিরিয়া, মিয়ানমারের নির্যাতিত মুসলমানের জন্য আমাদের মন কাঁদে, যাদের আমরা চিনি না, তারাও আমাদের চেনে না, অথচ আমার স্বদেশি স্বভাষী আত্মীয় প্রতিবেশিরা নির্যাতনের শিকার হলে মন কাঁদে না শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার কারণে। এইটা কোনো ধর্মের শিক্ষা হতে পারে?

মনে রাখবেন, ভারত যারা নিজের স্বার্থে ভাগ করেছিল তারা কিন্তু আজ বেঁচে নেই কিন্তু ক্ষতটা ক্রমেই আরো দগদগে হয়েছে। আজ বাংলাদেশে যারা (গোপনে মন্দিরে কুরআন চালিয়ে, ফেসবুকে ফেইক আইডি থেকে পোস্ট দিয়ে, ইত্যাদি করে) ‘ধর্মানুভুতি’ নিয়ে ক্ষমতা ও বিদ্বেষের খেলাটা খেলে যাচ্ছে, অহিংস সরল সাধারণ কৃষক থেকে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে ধর্মানুভূতির নামে হিংসা বিদ্বেষের বীজ রোপণ করছে, তারাও বেশিদিন বেঁচে থাকবে না। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার সেটা হয়ে যাবে আগামী দিনের জন্য। বাংলাদেশ পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের মতো হয়ে যাবে। অলরেডি সে পথে আছে কিনা আপনারা ভালো বলতে পারবেন। আজ হয়ত মন্দিরে হিন্দুপরিবারে আগুন দিলে আপনি সংখ্যাগুরু মুসলমান হিসেবে চুপ থাকেন, আদিবাসীদের জমি দখল হলে সংখ্যাগুরু বাঙালি হিসেবে কথা বলেন না। কিংবা ঠিক হচ্ছে না বলে ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। হামলাকারীরা কিন্তু টুপি মাথায় দিয়ে মাঠে।

এভাবে চলতে দিলে ভাবছেন আপনার লাভ হবে? একদিন বাংলাদেশ নিরানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ হবে, একশো ভাগ বাঙালির দেশ হবে — এই তো লাভের হিসাব?

লিখে রাখেন, তখন খুনোখুনি আরো বেশি হবে, সামান্য কারণেও মুসলমান মুসলমানকে মারবে। মাজহাবে মাজহাবে, তরিকায় তরিকায় বাধবে প্রতিদিন। আজ মনে করছেন ‘হিন্দু’ মার খাচ্ছে, কাল মার খাবে আপনার পরিবার। কারণ অসহিষ্ণুতা ও সমাজের বৈচিত্রহীনতা আপনারাই চরিত্রের প্রধান দিক করে তুলছেন। শেষ নবী বা পবিত্র আল কুরআন নিয়ে কেউ কিছু বললে (ধরুন কটুক্তি) ইসলাম ধর্ম হুমকির মুখে পড়ে না, কারণ তাঁর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন; কুরআন বাইরের জিনিস না, আল্লাহর অস্তিত্বেরই অংশ। এই বোধটুকু আপনার ভেতরে জন্ম না নিলে আল্লাহর প্রতি আপনার বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কেউ যদি আল্লাহ ও নবীর সম্মান রক্ষা করার নামে কোনো অসহায় পরিবারকে নিঃস্ব করে, কোনো ব্যক্তিকে জ্বালিয়ে মারে, কোনো শিশুকে এতিম করে, কারো উপর জুলুম করে তাহলে সেই বরঞ্চ আল্লাহ ও তাঁর শেষ নবীর অবমাননা করল। তাকেই প্রতিহত করুন, ইসলামের সম্মান কমবেনা, বাড়বে। কারণ ইসলামকে অশান্তি ও অসহিষ্ণুতার ধর্ম বললে আপনারই বাধবে। আপনাকে খুনি বলা হলে আপনি খুন করে তার প্রতিবাদ করতে পারেন না। এটা একটা ট্র্যাপ, বলা হলো ইসলাম জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের ধর্ম আর আপনি সেই মোতাবেক আচরণ করতে শুরু করলেন।

আপনার বিশ্বাস যেন এতটা বিবেচনাহীন না হয় যে, একটা লোক আপনাকে ব্যবহার করে আরেকজনের জমি দখল করে৷ অন্যের প্রতিহিংসার আগুনের আপনি লাকড়ি হবেন কেন? বিশ্বরাজনীতি আপনাকে নিয়ে খেলছে। ক্ষমতা ও বিভেদের রাজনীতি চায় আপনার বোধহীন নৃশংস উন্মাদনা, আপনি মানুষকে ভালোবেসে তার প্রতিউত্তর দেন, ধর্মের বাইরের ডাকে নয়, ভেতরের ডাকে সাড়া দেন। ‘জ্বালাও পোড়াও বর্জন’ আপনার ধর্মানুভুতির ভাষা না, ওটা নষ্ট রাজনীতির ভাষা। কিন্তু আপনার মুখে (এবং হাতেও) এই ভাষা তুলে দিয়ে লাভটা হচ্ছে কার?

- মোজাফ্ফর হোসেন

খণ্ড-28
সংখ্যা-38