ব‍্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ এক বিপর্যয়কর পদক্ষেপ — স্তব্ধ হও
Bank Privatisation

কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষি আইন প্রত‍্যাহারের প্রশ্নে নতিস্বীকার করতে বাধ‍্য হলেও মোদী সরকার এখন অন‍্য আরেকটি বুনিয়াদি ক্ষেত্র, ব‍্যাঙ্ক ব‍্যবস্থার, জাতীয়করণের ধারাকে উল্টে দেওয়ার আগ্রাসী উদ‍্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ব‍্যাঙ্ক জাতীয়করণের ঐতিহাসিক পদক্ষেপের পাঁচ দশক পর এখন সরকারি ব‍্যাঙ্কে সরকারের ন‍্যূনতম ৫১ শতাংশ মালিকানাকে ২৬ শতাংশে নামিয়ে আনার মরিয়া প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এছাড়া নির্দিষ্ট কয়েকটি সরকারি ব‍্যাঙ্ককে সরাসরি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার উদ‍্যোগ তো আছেই। সরকার অবশ‍্য ভালো করেই বোঝে যে এই পাঁচ দশকে সরকারি ব‍্যাঙ্কগুলি নিরাপদ ও সুস্থায়ি হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে আর বেসরকারি ব‍্যাঙ্কগুলি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই জনমানসে প্রতিভাত হয়। বেসরকারিকরণের আগে তাই সরকার “আমানতকারির অগ্রাধিকার”-এর নতুন বুলি আওড়াতে শুরু করেছে, আমানতকারিদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে ব‍্যাঙ্ক ফেল করলে নব্বই দিনের মধ‍্যে ৫ লাখ টাকা (সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে যা বেড়ে ১ লাখ টাকা হয়েছিল) ফেরত পাওয়া যাবে।

ব‍্যাঙ্কে সর্বমোট জমার পরিমাণ ব‍্যাঙ্ক জাতীয়করণের বিগত পাঁচ দশকে ধারাবাহিকভাবে এবং সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দ্রুত হারে বেড়েছে। গত এক দশকে জমার পরিমাণ তিনগুণ হয়েছে, ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৫০ ট্রিলিয়ন, ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে হয় ১০০ ট্রিলিয়ন এবং ২০২১-এর মার্চ মাসে এসে তা দাঁড়ায় ১৫০ ট্রিলিয়ন। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে ক্রমবর্ধমান হারে তোল্লাই দেওয়া সত্ত্বেও ভারতের সর্বমোট আমানতের তিন ভাগের দুই ভাগই জমা আছে সরকারি ব‍্যাঙ্কগুলিতে। বিমুদ্রাকরণ কালো টাকার ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি, কিন্তু আরও বেশি সংখ‍্যক মানুষকে ব‍্যাঙ্কমুখী হতে বাধ‍্য করেছিল এবং ডিজিটাল লেনদেনের বৃদ্ধিও সাম্প্রতিক সময়ে ব‍্যাঙ্কিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। ব‍্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করার প্রথম উদ্দেশ‍্য হল জনসাধারণের সঞ্চয়ের মধ‍্যে দিয়ে গড়ে ওঠা এই বিপুল আর্থিক সম্পদের ওপর প্রাইভেট কোম্পানিগুলির প্রত‍্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা।

ব‍্যাঙ্ক শিল্পে ঘনীভূত সংকটের সমাধান হিসেবে ব‍্যাঙ্ককে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ‍্যোগ হাজির করা হচ্ছে। অথচ এই সংকটের সবচেয়ে বড় কারণ তো যাকে বলে এনপিএ বা নন পারফর্মিং অ‍্যাসেট। ব‍্যাঙ্ক ঋণ দেয় একথা ধরে নিয়েই যে কিছু ক্ষেত্রে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি থাকবেই। কিন্তু, ব‍্যবসা ও রাজনীতির আঁতাত ও স‍্যাঙাতি পুঁজির স্বার্থরক্ষার বাধ‍্যবাধকতায় ব‍্যাঙ্ক পরিচালনার ন‍্যূনতম বিচক্ষণতা জলাঞ্জলি দেওয়ার আগে পর্যন্ত ব‍্যাঙ্ক শিল্পের অন্তর্গত এই অবশ‍্যম্ভাবি ঝুঁকি এরকম এনপিএ-সংকটের মাত্রায় কোনদিন পৌঁছয়নি। ব‍্যাঙ্ক পরিচালনার নিয়মনীতির উদারিকরণ এই অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, ইচ্ছে করে ডিফল্টার হওয়া পুঁজিপতিদের ঢালাও ছাড় দেওয়া পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গীণ করে তুলেছে।

সংকট কতটা গভীর তা এই সংখ‍্যাগুলি থেকে সহজেই বোঝা যেতে পারে : ১১,৬৮,০৯৫ কোটি টাকা বা প্রায় ১১.৭ ট্রিলিয়ন টাকা মূল‍্যের খারাপ ঋণ গত দশ বছরে মকুব লিখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যার মধ‍্যে ১০.৭ ট্রিলিয়ন ছাড়া হয়েছে মোদী জমানায় ২০১৪-১৫ থেকে। টেকনিক‍্যালি দেখলে এই মকুব লিখে দেওয়া ঋণও পুনরায় আদায় করা সম্ভব হয়। কিন্তু এরকম আদায়ও ১৫ শতাংশের বেশি হয়নি। ইতমধ‍্যে এনপিএ বেড়েই চলেছে মাঝেমধ‍্যেই মকুব লিখে ছাড় দিয়ে চলা সত্ত্বেও। গত দশ বছরে ১২ ট্রিলিয়ন টাকা মকুব করার পরও এনপিএ’র অর্থমূল‍্য দাঁড়ায় বিপুল, ৬ ট্রিলিয়নেরও বেশি!

যখন ব‍্যাঙ্ক জাতীয়করণের সঙ্গে এসেছিল অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার ওপর জোর — কৃষি, মাঝারি ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উৎপাদন ক্ষেত্র, গৃহ নির্মাণ, শিক্ষা, সামাজিক পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প ইত‍্যাদি ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া। এনপিএ'র অধিকাংশটাই অবশ‍্য অন‍্য ক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত — প্রধানত কর্পোরেট ক্ষেত্রে। বেসরকারিকরণের ফলে অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ব‍্যাঙ্কিংকে ঠেলে দেওয়া হবে শেয়ার মার্কেট ও অন‍্যান‍্য স্বল্প সময়ে দ্রত মুনাফা লাভের বিনিয়োগের দিকে। একথা নজরে আনা দরকার যে ব‍্যাঙ্ক শিল্পে সংস্কারের সাথে সাথে সমান্তরাল ভাবে চলছে পেনশন সংস্কার, যেখানে পেনশন ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগের ভাগ ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করা হচ্ছে। পেনশন ফাণ্ডকে শেয়ার মার্কেটের তুরন্ত্ মুনাফার দিকেও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এটা হল ভারতের লগ্নিক্ষেত্রকে অস্থির করে দেওয়ার আদর্শ ব‍্যবস্থাপনা। বিগত বছরগুলি ধরে ভারত বৈশ্বিক লগ্নী সংকটের স্পর্শ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের লগ্নীক্ষেত্রের এই স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা ধ্বংস করে এবার ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও সংকটের দিকে যাত্রা শুরু হবে।

সাধারণ মানুষ কেবলমাত্র নিজেদের আমানতের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত নয়। তাঁরা ব‍্যাঙ্ক ব‍্যবস্থার সামগ্রিক দিশা ও পারদর্শিতা সম্পর্কেও সমান উদ্বিগ্ন। ব‍্যাঙ্ককে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা শুনিয়ে মোদীর বহুবিধ বাচন নিয়ে বললে বলতে হয়, সাধারণ মানুষের জন‍্য ব‍্যাঙ্ক ব‍্যবস্থা ক্রমাগত ব‍্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, ব‍্যাঙ্কে নিজের টাকা জমা রাখতেও ইউজার চার্জ দিতে হচ্ছে। বৃহৎ কর্পোরেট খাতকেরা ইচ্ছে করে ডিফল্টার হয়েও ছাড় পেয়ে যায় কিন্তু কৃষকেরা, ক্ষুদ্র লগ্নিকারী ঋণগ্রহিতারা বা ছাত্রছাত্রী, কর্মপ্রার্থী ও ব‍্যবসায়ী সহ ছোট ঋণ গ্রহিতারা চরম হয়রানির শিকার হন, সময় মতো ঋণ শোধ করতে না পারায় কখনও কখনও এমনকি আত্মহত‍্যা করতেও বাধ‍্য হন। পেনশন প্রাপকেরা এবং মধ‍্যবিত্ত গ্রাহকেরা যারা তাঁদের সঞ্চয় থেকে স্থায়ী আয় পেতে ব‍্যাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল তাঁরা ব‍্যাঙ্কের ক্রমহ্রাসমান সুদের ফলে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন।

কেবলমাত্র ব‍্যাঙ্ক ফেল করলেই আমানতকারীদের স্বার্থে আঘাত পড়ে তা তো নয়, সাধারণ মানুষের কাছে ব‍্যাঙ্ক লেনদেন অ-নিরাপদ ও ব‍্যয়বহুল হয়ে পড়লে এবং কঠোর যৌথ শ্রমে গড়ে ওঠা সম্পদ ব‍্যক্তি মুনাফার স্বার্থে ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিলে আমানতকারীদের স্বার্থে সমানভাবেই আঘাত পড়ে। সকল সাধারণ মানুষকে তাই ব‍্যাঙ্ক কর্মচারীদের সাথে অভিন্ন এক তাগিদে ঐক‍্যবদ্ধ হয়ে ব‍্যাঙ্ক বেসরকারিকরণকে প্রতিরোধ করতে হবে। যেভাবে কৃষকেরা নিজেদের ঐক‍্যবদ্ধ সংগ্রাম ও জনতার সমর্থনের মধ‍্যে দিয়ে বিজয় লাভ করেছে, তেমনই ব‍্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ প্রতিহত করে ব‍্যাঙ্ক ব‍্যবস্থা ও লগ্নীক্ষেত্রকে বাঁচানোর সংগ্রামে ব‍্যাঙ্ক কর্মচারিদেরও সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রাপ‍্য।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৪ ডিসেম্বর ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-45