প্রতিবেদন
‘মাতৃগর্ভ আর কবরেই শুধু নিরাপদ মেয়েরা’। যৌনহেনস্থার পর লিখলেন আত্মঘাতী ছাত্রী
Only safe girls in the womb

১৮ ডিসেম্বর, ২০২১। চেন্নাইতে নিজের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তিনবার যৌনহেনস্থার শিকার হয়ে আত্মহত্যার রূঢ় পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে মেয়েটি। রেখে গেছে একটি সুইসাইড নোট। তাতে স্পষ্ট ক’রে লেখা, “মাতৃগর্ভ আর কবরেই শুধু মেয়েরা নিরাপদ। … যৌনহেনস্থা বন্ধ হোক। প্রত্যেক মা-বাবা ছেলেকে শেখান, মেয়েদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়!” – এই জবানবন্দী আসলে বাস্তব থেকে উঠে আসা সমস্ত মেয়ের কথা; যারা নিত্যদিন নানাভাবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দাঁড়িয়ে নির্যাতনের শিকার হয়। মহিলাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা যেন এ’দেশে সোনার পাথর বাটি! চেন্নাইয়ের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতে লিঙ্গ বৈষম্য, মহিলাদের বিরুদ্ধে সামাজিক কু-প্রথা, যৌননিগ্রহের ঘটনা নিরন্তর ঘটছে। আর যদি নির্যাতিতা দেহ-মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, তখন তার আশেপাশে চলতে থাকে ভিক্টিম ব্লেমিং, ভিক্টিম শেমিং ইত্যাদি, প্রভৃতি।

এবার আসা যাক কিছু দ্বিচারিতার প্রশ্নে। দ্বিচারিতা কারা করছে, কেন করছে, কীভাবে করছে? আসুন জেনে নিই।

সম্প্রতি মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা হয়েছে। ক্যাবিনেটে পাশ হয়েছে অনুমোদন। পুরুষের ক্ষেত্রেও বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১। সুতরাং, এভাবেই জেন্ডার ইকুয়ালিটি অর্থাৎ নারী-পুরুষের সমানাধিকারকে স্পষ্ট করতে চাইছে রাষ্ট্র তথা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। কিন্তু প্রশ্ন উঠে আসে, এভাবে আদৌ কি কেবলমাত্র বিয়ের বয়স সমান করে সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার বহাল রাখা সম্ভব? লকডাউনে অভাবের দরুন বহু পরিবারে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পড়াশোনা ছেড়ে মেয়েরা সংসার গড়তে এগিয়ে গেছে। এই স্কুলছুট মেয়েদের দায় কার? ভারতে নাগরিকদের ভোটাধিকার দেওয়া হয় ১৮ বছর বয়স থেকে। তাহলে ধরে নেওয়াই যায়, দেশের ছেলে-মেয়ে উভয়েরই ১৮ বছর বয়সের মধ্যে সমস্তরকম মানসিক বিকাশ ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক। নিয়মানুযায়ী, একজন সাবালক এবং একজন সাবালিকা নিজেদের ইচ্ছে ও পরস্পরের সম্মতিতে ১৮ বছর বয়সেই বিয়ে করতে পারে। আর সেই কারণে তাদের পুলিশী হেনস্থা করা রাষ্ট্রের কাজ হতে পারেনা। অর্থাৎ, নতুন আইন ভিত্তিহীন। আপাদমস্তক যুক্তিহীনতায় মোড়া এক-একটা আইন বিজেপি সরকার পাশ করিয়ে চলেছে। উপর-উপর ভারতীয় সমাজকে প্রগতিশীল দেখানোর চেষ্টা বিজেপি জারি রেখেছে।

২০১৫ সালে মহা সমারোহে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লিঙ্গবৈষম্যের সমস্যা সমাধান ও কন্যাভ্রূণ হত্যার হার কমাতে এই প্রকল্পের সূচনা হয়। ঢাকবাদ্যি পিটিয়ে প্রকল্পের প্রচার করে কেন্দ্রীয় সরকার। সংসদে পেশ হওয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় দিনে দিনে এই প্রকল্পের প্রচারের জন্য বরাদ্দ অর্থ বাড়তে থাকে। বিজ্ঞাপনের খাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৭৮.৯১ শতাংশ টাকা। এরপরেও বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে পাঁচ বছরের নীচে শিশুকন্যার মৃত্যুর হার ৫৩ শতাংশ, যোগীরাজ্য উত্তরপ্রদেশে ৪৮ শতাংশ এবং অসমে ৫১ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গোটা দেশে মহিলাদের নিরাপত্তার বেহাল দশা। এনসিআরবি-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে ভারতে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই বছরে মোট ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ২৮ হাজার ৪৬টি। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের রেকর্ড হয়েছে ৩৭ লাখ ১ হাজার ৫০৩টি।

২০১৮ সালে জম্মু কাশ্মীরের কাঠুয়ায় গণধর্ষণের শিকার হয় আট বছরের নাবালিকা আসিফা বানু। এর আগে ইতিহাসে আমরা ধর্ষকের সপক্ষে মিছিল বের করতে দেখিনি। বিজেপি কাঠুয়ায় ধর্ষকের সপক্ষে ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে মিছিল করেছে। উত্তরাঞ্চলে ধর্ষণ মামলার শুনানির জন্য আদালতে যাওয়ার সময় ২৩ বছরের মেয়েকে জলজ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ধর্ষিত হয়েছিল। ভারতের রাজধানী দিল্লীতে নির্ভয়ার ঘটনার পরেও একাধিক ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা নিত্য তিনশো দিনের খবর। দিল্লীতে নয় বছরের দলিত মেয়েকে শ্মশানঘাটে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা হয়। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে বিজেপির নেতা কুলদীপ সিং ১৭ বছর বয়সী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত তরুণীর ওপর চরম যৌন অত্যাচার চালায় চারজন উচ্চ বর্ণের যুবক। এরপর তার জিভ কেটে নেওয়া হয় যাতে সে নিজের বয়ানটুকু না দিতে পারে! সবশেষে পুলিশের সহায়তায় নির্যাতিতার পরিবারকে না জানিয়ে মেয়েটির মরদেহ পেট্রোল ঢেলে রাতারাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ প্রশাসনের সাহায্যে প্রমাণ লোপাটের বড়সড় দৃষ্টান্ত বোধহয় এই ঘটনা। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে দলিত নারী সম্পর্কে বলেছিলেন, “দলিত নারী ধর্ষণ করা পাপ নয়, কারণ তার শরীর অপবিত্র হলেও যোনি অপবিত্র নয়।” বলাবাহুল্য, এদের হাতে দেশটা তুলে দিলে মহিলাদের অবস্থাটা যেমন হওয়ার, তেমনটাই হয়েছে।

দলিত ও আদিবাসী মহিলাদের ওপর ভারতে নিপীড়নের হার অনেক বেশি। গ্রামের এধরণের ঘটনা অতখানি সামনে আসেনা। হাথরাসের ঘটনায় মিডিয়া হস্তক্ষেপ করতে চাইলে বহু সাংবাদিকদের ওপর মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও গুজরাত দাঙ্গা, মুজাফফর নগর দাঙ্গায় বহু মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়, তাদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে দীর্ঘ দিন ধরে যৌন অত্যাচার চালানো হয়।

চেন্নাইয়ের ঘটনা খুব বেশি ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। একুশ শতকে ভারতবর্ষে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মহিলাদের সমাজে অগ্রগতির বদলে মহিলাদের নিয়ন্ত্রণের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীকারের প্রশ্নই হোক, কিংবা সমাজ থেকে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের প্রশ্নই হোক–এই সবকিছুকেই বারংবার গুরত্ব না দিয়ে রাষ্ট্রের কিছু নিয়মনীতি কাগজে-কলমে দেশের সমস্ত মহিলাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ফলাফল মিলছে পরিসংখ্যানে।

নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার তালিকায় এ’দেশে নাম ফুরোনোর সময় আসেনি। সুতরাং, গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার এটাই সঠিক সময়। চেন্নাইয়ের নির্যাতিতার মতো জম্মু, উন্নাও, হাথরাসের মেয়েদের আর্তনাদ শুনতে হবে। যারা শুনবে না, তাদের জোর করে শোনাতে হবে। এতগুলো মেয়ের গোঙানির শব্দ স্পষ্টভাবে কানে বাজবে। তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হবে সেই আওয়াজ। যুগ যুগ ধরে নেমে আসা সমস্ত অত্যাচারের বদলা নেবে আগল ভেঙে বেরিয়ে আসা মেয়ের দল। নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় থাকবে। শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদে সামিল হবে নতুন মুখ, নতুন আলো, নতুন দিশা। এই কঠিন সময় পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা আরও কঠিন। তবে লড়াইটা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যেতে হবে। শেষদিন অবধি। শেষ রক্তবিন্দু অবধি। আমরা হারি না, হারতে পারি না।

- ত্রিয়াশা লাহিড়ী

খণ্ড-28
সংখ্যা-46