দিল্লীর কৃষক আন্দোলন কৃষকের জমি ও জীবন-জীবিকার অধিকার রক্ষায় বড় মাত্রায় জয় ছিনিয়ে এনেছে। একই সাথে সেটা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের শক্তিশালী প্রতিরোধ রূপে সামনে এসেছে। পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরেই ফসলের এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পেয়ে থাকে। নয়া কৃষি আইনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা তুলে দিয়ে কৃষিজীবী মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত কিষাণ আন্দোলন রুখে দিয়েছে। সারাদেশে কৃষক আন্দোলনের ময়দানে জন্ম নিয়েছে নতুন উদ্দীপনা, একতা। কিন্তু এমএসপি গ্যারান্টি আইন চালু করার দাবি পূরণ হয়নি। এর ফল ভুগতে হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকদের। ফসলের অভাবী বিক্রি যেন তাদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ত্রিমুখী কৃষি-সংকটের মধ্যে রয়েছেন। ধানের সরকারি দর থেকে তারা বঞ্চিত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ক্ষতিপূরণ তারা পায়নি। অপরদিকে সার-বীজের কালোবাজারি মজুতদারী পরবর্তী চাষের খরচ বিপূল পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলা’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলার ব্লকে ব্লকে প্রচার ও বিক্ষোভ ডেপুটেশনের কর্মসূচি সংগঠিত হয়। গত ১৫ ডিসেম্বর পালিত হয় প্রতিবাদ দিবস।
হুগলী জেলায় পান্ডুয়া কৃষি দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন কর্মসূচি সংগঠিত হয়। কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে সমস্ত কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। উপস্থিত এআইকেএম নেতা মুকুল কুমার বলেন, পরপর নিম্নচাপ ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষিক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে। হুগলী ও বর্ধমান জেলায় আলু চাষের অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। নানাভাবে ঋণ করে, শেষ বৃষ্টির আগে চাষিরা সার কিনতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছেন। সারের যোগান কম থাকায় অস্বাভাবিক বেশি দরে সার কিনতে হয়েছে। এক শ্রেণীর ব্যবসাদার চড়া দামে সার বিক্রির সাথে সাথে, সুযোগ বুঝে চাষির ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য অপ্রয়োজনীয় জিনিসও গছিয়ে দিয়েছেন। বহু কষ্ট করে চাষিরা জমিতে যে আলু পুঁতেছিলেন, বৃষ্টিতে সে সবই ষোলো আনা নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে আবার চাষ করার মতো চাষির সম্বল কোথায়? ঘরের বীজ, কেনা বীজ সবই তো শেষ। আলুবীজের জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। এত ক্ষতি পূরণ হবে কীভাবে? যাঁরা সমবায় বা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেছিলেন তাঁরা শস্যবীমার আওতায় হয়ত কিছু ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু সেতো বীমা-রাশির ২৫ শতাংশ মাত্র। আর ওই টাকা পেতেও কত সময় লাগবে কে জানে! দেনা শোধ করতে না পেরে কৃষকদের পথে বসতে হবে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটাই উপায়। সর্বত্র কৃষকদের একজোট হয়ে বলতে হবে সমস্ত কৃষিঋণ মকুব কর।
শুধু তো আলু নয়। ধানেরও ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আইন বলছে, ধানচাষে ৭০ শতাংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় বাকিদের কোনও ক্ষতিপূরণ মিলবে না। এই তুঘলকি আইন বদলাতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত ধানচাষিদেরও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ঋণের দায়ে কৃষক আর আত্মহত্যা করবেনা। সমস্ত কষিঋণ মকুব এবং আলু ও ধান সহ সব ফসলের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ছোট-বড় সমস্ত কৃষককে একতাবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলতে হবে আন্দোলন।
বাঁকুড়া জেলার ওন্দায় বিডিও, বিএলএলআরও এবং এডিও’কে ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয়। দাবি তোলা হয়, জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী আদিবাদী ও অন্যান্য বনবাসী মানুষের পাট্টা দিতে হবে ও পাট্টা রেকর্ড করতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে পাট্টা পাওয়া সত্ত্বেও আজও পরচা না পাওয়ার ফলে গরিব আদিবাসীরা সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত। তাই দ্রুত পরচার ব্যবস্থা করতে হবে। অকাল বৃষ্টিজনিত কারণে ধান, আলু সহ অন্যান্য ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে। গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে ১,৯৬০ টাকা দরে ভাগচাষি, লিজচাষিদের থেকেও ধান কিনতে হবে। ওন্দা ব্লকের সান্তোর থেকে নিকুঞ্জপুর হয়ে মাঝডিহা পর্যন্ত দ্বারকেশ্বর নদীতে বেআইনিভাবে বালি তোলার ফলে যে ব্যাপক চড়া তৈরি হয়েছে তার দরুণ নদীর গতিপথ ঘুরে যেতে বসেছে। এই ক্ষতির দ্বারা প্রভাবিত হবে ১৫টির অধিক গ্রাম। দ্রুত মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে এই ভাঙন রোধ করতে হবে। ওন্দা ব্লকের কল্যাণী অঞ্চল ও নিকুঞ্জপুর, এলাটি মৌজাতে পাকা রাস্তা তৈরি করতে হবে। এই কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন বৈদনাথ চীনা, আদিত্য ধবল ও রবিদাস মুর্ম্মু।
নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া, ধুবুলিয়া ও চাপড়া ব্লকে বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। অংশগ্রহণ করেন এআইকেএম নেতা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলি, কৃষ্ণ প্রামানিক, ইনসান সেখ, সেলিম সেখ, জয়তু দেশমুখ প্রমূখ। নেতৃবৃন্দ বলেন, এরাজ্যের তৃণমূল সরকার ধান উৎপাদনের তিন বা চারভাগের একভাগ কেনার কথা বলে থাকে। কাগজে কলমে কেনা হয়। কিন্তু গরিব মাঝারি চাষিরা সেই দর পায় না। বর্তমানে কোনও কোনও মহল থেকে এমএসপি তুলে দেওয়ার ওকালতি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ধানের বাজারদরে যদি কোনও প্রভাব না পড়ে তাহলে এমএসপি’র পরিমাণ বাড়িয়ে লাভ কি? কিন্তু এটা বাস্তব সত্য যে আংশিকভাবে হলেও এমএসপি’র একটা উপযোগিতা রয়েছে। সরকার নির্ধারিত দর থাকলে চাষিদের ফসল বিক্রির দাম একেবারে নীচে নেমে যায় না। এমএসপি আছে এবং নেই এমন কৃষিপণ্যর দামের তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যায় ধানের সরকারি দর ঘোষিত বলেই বাজার দর একেবারে কম হয়ে যায় না। অথচ আলু বা অন্য সবজির ক্ষেত্রে দেখা যায় উৎপাদক দাম পাচ্ছে কিলো পিছু ২ টাকা। আর বাজারে ১০ গুণ দামে সেটা বিক্রি হচ্ছে। নদীয়ার ধুবুলিয়ায় বিক্ষোভ ডেপুটেশনে দেখা গেল তৃণমূলের রাজত্বে প্রশাসনিক নির্দেশিকা নয়, শেষকথা বলে কায়েমী স্বার্থান্বেষী দলতন্ত্র! পড়ে পড়ে মার খায় ভুক্তভোগী গরিব মানুষ। যেমন কৃষ্ণনগর ২নং (ধুবুলিয়া) ব্লকের বিডিও জানালেন, গ্রামে ক্যাম্প করে ধান কেনার অর্ডার তিনি করেছিলেন, কিন্তু সেটা ফুড ডিপার্টমেন্ট এবং অন্যান্যরা নাকচ করে দেয়। একদা দলীয় ধামাধরা অধুনা ‘অপমানিত’ এই আমলার ইঙ্গিত শাসকদলের বিধায়ক মন্ত্রী ও তার গোষ্ঠীর দিকে। আমন ধানের এই মরসুমে আড়তদার-ব্যবসায়ীরা যে চাষির থেকে কম দামে ধান কিনে মুনাফার যে অবৈধ কারবার চালাচ্ছে, তার মদতদাতা কারা — এ ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
বিডিও দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশনে যাওয়া কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলা’র প্রতিনিধিরা জানালেন, এবার খাদ্য দপ্তরের বিরুদ্ধে কৃষকরা আন্দোলনে নামবে। গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে ধান কেনার দাবিতে, মধ্যস্বত্বভোগী দালাল চক্রের ফাটকাবাজির বিরুদ্ধে। এরপর জানা গেল ব্লকের ধান উৎপাদনের বড় একটা গ্রাম পঞ্চায়েতে নথিভুক্তির কাজ নাকি শুরু হয়েছে। বিডিও অফিসের গেটে তখন শুরু হয়েছে তুমুল বিক্ষোভ। এবছর এলাকায় একশো দিনের কাজ হয়েছে মাত্র ৬ দিন। অথচ জানা গেল টাকার নাকি কোনও অভাব নেই। এ যেন আর এক ‘পাইপলাইন’! দুর্নীতির চক্রে চালান হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ মজুরের প্রাপ্য টাকা। বিক্ষোভসভা থেকে পঞ্চায়েতের ঘুঘুর বাসার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানালেন নওপাড়া এলাকার নেতা আনসারুল হক। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ঠান্ডু সেখ, সন্তু ভট্টাচার্য, কলম বিশ্বাস প্রমুখ। নাকাশিপাড়া ব্লক উন্নয়ন আধিকারিককে সরাসরি ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ভাগচাষি লিজ চাষিদের ক্ষতিপূরণ ও ধান বিক্রি করার অধিকার নিয়ে তিনি একমত হন, এব্যাপারে দু’একজনের আবেদন গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু ব্যাপকভাবে করা সম্ভব নয় বলে জানান। সহায়ক মূল্যে ধান কেনার ব্যাপারে কারা দুর্নীতি করছে, তার তথ্য জানতে চান। তখন দুয়ারে ধান কেনার দাবি জানানো হয়। তিনি বলেন এটা সরকারের পলিসি। তিনি কিছু করতে পারবেন না। বিএলআরও দপ্তরে দুর্নীতির কথা তিনি শুনেছেন এবং তা নিয়ে তার পক্ষ থেকে যেটা করার তিনি করবেন। এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে এক-দেড় বছর ধরে অনেকেই টাকা পাচ্ছেন না স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য উপরের থেকে টাকা না আসলে তারা কিছু করতে পারছেন না। যে সমস্ত কৃষি মজুররা ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ করতে চান তাদের আবেদন অঞ্চল গ্রহণ না করলে ব্লক করবে, ৪ক আবেদন করলে কাজ পাওয়া যাবে। রাজীব উদ্দিন মন্ডল, কমরেড ইয়াদ আলি শেখ সহ মোট পাঁচজন ডেপুটেশনে অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় বেথুয়াডহরী হাট এলাকায়, স্ট্যাচুর মোড়ে, কৃষি আধিকারিকের দপ্তরের সামনে, বিডিও দপ্তরের সামনে বিএলআরও দপ্তরের সামনে বক্তব্য রাখা, লিফলেট বিলি করা হয়। চাপড়া ব্লকের লাগোয়া কয়েকটি গ্রামে এবং ব্লকের সামনে বিক্ষোভসভা সংগঠিত হয়।