আবেদন
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৈপ্লবিক উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে চলুন!
India's Freedom Movement

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

মোদী সরকার ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীকে ভারতের ইতিহাস পাল্টে লেখা তথা হাইজ্যাক করার এক বিশাল মহড়ায় পরিণত করে ফেলেছে। আজকের বিজেপি’র মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক পূর্বসূরীদের ভারতের ঔপনিবেশিক-বিরোধী জাতীয় গণজাগরণে প্রায় কোনও ভূমিকাই ছিল না, কারণ তারা তখন ঔপনিবেশিক শাসকদের সহযোগী হয়ে, তাদের ‘ভাগ করে শাসন কর’ কৌশলের বাস্তবায়নে সহায়তা করতে ব্যস্ত ছিল। আর একাজে তাদের হাতিয়ার ছিল তাদের হিন্দুত্ব বা হিন্দু আধিপত্যবাদী সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের রাজনীতি যাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বিভক্ত ও বিপথগামী করতে তারা সচেষ্ট ছিল। আজ, তাদের উত্তরসূরীরাও সেই একই ভয়ানক পথে ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখন এবং ভারতকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যস্ত।

মোদী সরকার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীকে ভারতের স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব হিসাবে উদযাপন করছে, বা বলা ভাল ‘অমৃতের’ নামে আসলে মিথ্যা ও ঘৃণার বেসাতি ছড়িয়ে বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে। ঐ অনুষ্ঠানের ঘোষিত লক্ষ্য হল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উপেক্ষিত নায়কদের, শ্রদ্ধা-স্মরণ উদযাপনের মাধ্যমে জনমানসে তুলে ধরা। এই উল্লিখিত উদ্দেশ্য নিয়ে খুব আপত্তির কিছু থাকতে পারে না, কিন্তু বিজেপি’র স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ উপেক্ষিত নায়ক’ হিসাবে হিন্দুত্বের প্রথম তাত্ত্বিক নেতা ভি ডি সাভারকরকে তুলে ধরায় অবশ্যই আপত্তি আছে, যিনি ভারতের বিপর্যয়কর দেশভাগের মতাদর্শগত ভিত তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয় ঔপনিবেশিক প্রভুদের কাছে ‘অবিমৃশ্যকারী পুত্র’ হিসাবে নিজের মুক্তির জন্য দয়া ভিক্ষা করে এবং তাদের স্বার্থরক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারংবার তাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গৌরবময় ঐতিহ্যকেও কলঙ্কিত করেছিলেন। সঙ্ঘ পরিবারের অনেকেই প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী নাথুরাম গডসের ‘উত্তরাধিকার’ও উদযাপন করেন, যিনি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন!

সংঘ পরিবারের আইকনদের তথাকথিত ‘উপেক্ষিত নায়ক’ হিসাবে পুনর্বাসিত করা ও সঙ্ঘ পরিবারকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘উপেক্ষিত ধারা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সংগ্রামের বিভিন্ন পর্বকে এবং কিংবদন্তীপ্রতীম বীরদের বিকৃত ও অপব্যবহার করা — ইতিহাস নিয়ে বিজেপি’র এই ধ্বস্তাধ্বস্তির আসল উদ্দেশ্য স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্য ও অর্জনগুলির অবমূল্যায়ন ও অসম্মান করা এবং স্বাধীনতাকে কার্যত ‘দেশভাগের ভয়াবহতায়’য় পর্যবসিত করা। যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণভাবে, সরকার এবার ১৪ আগস্ট, পাকিস্তান গঠনের দিনটিকে ‘দেশভাগের ভয়াবহতা স্মরণ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের ‘দুর্বৃত্ত’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যারা নাকি ভারতের কিছু অংশকে তাদের ‘নিজস্ব ভূমি’ হিসাবে নিয়ে চলে গেছে; আর কেবল হিন্দুদেরই দেশভাগের যন্ত্রণার শিকার হিসাবে দেখানো হয়েছে। দু’পারের সম্প্রদায়গুলিই যে সেই যন্ত্রণার শিকার, যে যন্ত্রণা দেশভাগকে চিরচিহ্নিত করে রেখেছে — এইভাবে তাকে অস্বীকার করা হয়েছে।

ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকী উদযাপনে আমাদের অবশ্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রধান ঘটনা, সন্ধিক্ষণ এবং অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকে ফিরে দেখতে হবে, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। বরং তার মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং ধারণাগত ক্রমবিকাশকেও উপলব্ধি করতে হবে, আঁকড়ে ধরতে হবে, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন; যা তার বৈপ্লবিক উত্তরাধিকার গড়ে তুলেছে যা স্বাধীনতার সাতটি দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও, আজও আমাদের শিহরিত করে, অনুরণন জাগায়। মোদী সরকার আমাদের প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পদদলিত করে চলেছে এবং পূর্বতন ঔপনিবেশিক শাসকদের উত্তরসূরীর মতো শাসন করছে, ভগৎ সিং যাদের ‘ভুরে আংরেজ’ বা বাদামি সাহেবদের শাসন বলে সতর্ক করে গেছেন, সেই ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির চলমান লড়াইকে জারি রাখার জন্য আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৈপ্লবিক উত্তরাধিকারকে আহ্বান জানাতে হবে।

ঔপনিবেশিক যুগে স্বাধীনতার অর্থ ছিল সর্বপ্রথম ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি। এটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, এবং জাতীয় মুক্তির এই রূপকল্পটির উপর সারা ভারতের মানুষ ‘জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা’ হিসাবে আস্থা রেখেছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব গ্রহণের অনেক আগেই, ভারতে ঔপনিবেশিক-বিরোধী যোদ্ধারা স্বাধীনতা এবং লোক(গ্রাহ্য) সার্বভৌমত্বের ধারণাটিকে স্পষ্ট রূপ দিতে শুরু করেছিলেন। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমবেত সঙ্গীতে ভারতের জনগণকে ‘দেশের মালিক’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, “হাম হ্যায় ইস্কে মালিক, হিন্দুস্তান হামারা” (আমরা এই জমির মালিক, হিন্দুস্তান/ভারত আমাদের)। বিরসা মুণ্ডার উলগুলান জনতার উদ্দেশে উদ্দীপ্ত আহ্বান রেখেছিল “আবুয়া দিশুম, আবুয়া রাজ” (আমাদের রাজ্য, আমাদের শাসন)। লোক সার্বভৌমত্ব বা মানুষের হাতে ক্ষমতার এই আবেগদীপ্ত চেতনা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল সংবিধানের প্রস্তাবনায়, “আমরা, ভারতের জনগণ” কর্তৃক ভারতকে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র রূপে গঠন করার সশ্রদ্ধ আন্তরিক অঙ্গীকার ঘোষণায়। এইভাবেই ভারত এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন জনগণ।

ভারতের মানুষ সবসময়ই বৈচিত্র্যময়। জাতিগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় — এই বৈচিত্র্যই ভারতের ঐক্যের ভিত্তিগত মূলসূত্র। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং চলাচল বৃদ্ধি অবশ্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধন এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যেকে সম্ভব করেছিল, তবে এই ঐক্যকে ‘অভিন্নতা’ বা ‘একজাতীয়তার’ সন্ধান বলে ভুল করা উচিত নয়। অভিন্নতা বা একজাতীয়তা চাপানোর প্রচেষ্টা সর্বদাই ঐক্যকে দুর্বল করেছে এবং বিরূপ প্রভাবিত অঞ্চল বা সম্প্রদায়গুলি দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক সেই চরম দেশভাগ বৈচিত্র্যকে কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু দেশভাগ-পরবর্তী ভারত এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ। স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের বৈচিত্র্যের প্রতি একটি সুস্থ বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতির মনোভাবের বিকাশ ঘটিয়েছিল, এক এবং একমাত্র যেটি ভারতের জাতীয় ঐক্যের সহনশীল প্রাণোচ্ছলতা এবং শত শত রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যের (হিন্দু ও মুসলিম শাসকদের অধীনে থাকা) ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত মিলে যাওয়াকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

সংবিধান আমাদের বৈষম্যহীন এবং সমান নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি রাষ্ট্রকে তুলনামূলকভাবে/ আপেক্ষিকভাবে ধর্ম থেকে মুক্ত রেখেছে। আর যদিও এটি ভারতকে সুস্পষ্টভাবে একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও রাজ্যগুলির অনেক বিষয়েই স্বশাসনের ক্ষমতা ছিল। প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন এবং ভারতের অপরিহার্য বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদের বৃহত্তর স্বীকৃতির প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু মোদীর অধীনে বিজেপি সরকার ঠিক তার বিপরীত অভিমুখে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে — সিএএ নাগরিকদের মধ্যে এবং অভিবাসী, যাদের ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হচ্ছে, তাদের মধ্যে বৈষম্যের সূচনা করেছে; রাষ্ট্র ক্রমশ একটি হিন্দুরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে; কেন্দ্র নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাজ্যগুলিকে কার্যত বড়সড় পৌরসভার সমপর্যায়ে নামিয়ে এনেছে; বহুত্ববাদকে ক্রমাগত কলঙ্কিত এবং অভিন্নতার অধীন করা হচ্ছে।

আজাদী বা স্বাধীনতা ছাড়াও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্য মূল শব্দটি ছিল ‘ইনকিলাব’ বা বিপ্লব, যা ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ শ্লোগানে অমর হয়ে আছে। উর্দু কবি ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মৌলানা হাসরাত মোহানি কর্তৃক উদগীত এবং ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডদের দ্বারা অমর হয়ে থাকা এই শ্লোগানটি স্বাধীনতার বৈপ্লবিক তাৎপর্য, এবং প্রগতিশীল পরিবর্তন, অধিকারের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম এবং সদা সতর্কতার কেন্দ্রিকতার (গুরুত্বের) দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আর এই বিপ্লব, নিজেকে একটি আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণজাগরণের অংশ হিসেবেই দেখেছে।

বস্তুত, ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত কেন্দ্রীয় পরিষদে (সেন্ট্রাল অ্যাসেম্ব্লি) অন্য যে শ্লোগানটি তুলেছিলেন তা ছিল ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে একটি বিচ্ছিন্ন এবং স্বতন্ত্র লড়াই ছিল না, এটি আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিরোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বেড়ে ওঠে। আর ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর যখন ইউরোপ ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়ার উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রগতিশীল ধারা ইউরোপে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধকে সমর্থন করেছিল। ছয় ভারতীয় — লেখক মুলক রাজ আনন্দ, সাংবাদিক গোপাল মুকুন্দ হুদ্দার, ডাক্তার অটল মোহনলাল, ডাঃ আইয়ুব আহমেদ খান নকশবন্দি ও ডাঃ ম্যানুয়েল পিন্টো এবং ছাত্র রামাসামি বীরপান — জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দিয়েছিলেন। লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয়রা তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন; জওহরলাল নেহরু ১৯৩৮ সালে স্পেনে সংহতি সফর করেছিলেন। ভারতে বসে আরএসএস যখন মুসোলিনি এবং হিটলার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল, তখন ভারতের প্রগতিশীল স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইউরোপে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধে সামিল হয়েছিলেন।

স্বাধীনতা আন্দোলন শুধুমাত্র ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্যই নয়, একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ভারত গড়াও তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। আদিবাসী এবং অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায় যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় গণভিত্তি গঠন করেছিলেন, তারা জমিদার ও মহাজনদের হাত থেকে মুক্তির জন্য নিরলসভাবে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। আদিবাসী বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন নিজের শক্তিকে সুদৃঢ় ও সুসংহত করেছিল কেবল সামরিক নিয়ন্ত্রণ এবং দমনমূলক আইনের মাধ্যমে নয়, বরং ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এবং অন্যান্য রাজস্ব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণীর মাধ্যমে সামন্ত শক্তিকে শক্তিশালী করে, দেশীয় রাজ্যের ক্ষমতার স্থায়ীকরণ এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন ও শাসনের নীতির কঠোর প্রয়োগ করে। সেই সময়ের একজন ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ সামরিক আধিকারিকের ফাঁস হয়ে যাওয়া কথায়, “আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত সর্বশক্তিতে (আমাদের জন্য সৌভাগ্যের) বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে বিদ্যমান বিভেদকে বিচ্ছেদে পরিণত করা .... ভারত সরকারের নীতি হওয়া উচিত ভাগ করো, শাসন করো” (লে. কর্নেল কোকার, মোরাদাবাদের কমান্ড্যান্ট; ইন্ডিয়া টুডে, ১৯৪০-এ রজনী পাম দত্ত দ্বারা উদ্ধৃত)। কিছু সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া, ভূস্বামী ও দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যগুলির পুতুল শাসকরা ঔপনিবেশিক শাসনের সামাজিক ভিত্তি তৈরি করেছিল। আর তাই ঔপনিবেশিক-বিরোধী সংগ্রাম জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রাম থেকে শক্তি পেয়েছিল।

ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক আন্দোলনে ভূস্বামী ও মহাজনী ব্যবস্থার উচ্ছেদ কেন্দ্রীয় শ্লোগান হিসেবে উঠে আসে। গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহ আন্দোলন এই মূল এজেন্ডাকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় এবং জঙ্গী কৃষক আন্দোলনের সমস্ত সংস্পর্শ থেকে সন্তর্পণে দূরে সরে যাওয়ায়, কৃষক আন্দোলন ‘নিখিল ভারত কিষাণ সভা’ নামে তাদের নিজস্ব সংগ্রামী মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে। অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীকে এর প্রথম সভাপতি হিসাবে নিয়ে গঠিত হয়েছিল এবং এটি জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং গ্রামীণ ঋণ বাতিলের দাবিতে ১৯৩৬ সালের আগস্টে একটি ‘কিষাণ ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছিল। শক্তিশালী কৃষক সংগ্রাম গ্রামীণ ভারতে শুধু সামন্তী-ঔপনিবেশিক শক্তিকেই দুর্বল করেনি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও হিংসার বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ ভাষ্য এবং প্রতিরোধ শক্তিও তৈরি করেছে। স্বাধীনতার পর, জমিদারির পুরানো রূপটি আইনত বিলুপ্ত হয়েছিল, কিন্তু তারপরে ভূমি সংস্কারের কাজ অনেকাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যায়; আর এখন আমরা ভূমি সংস্কারের বিপরীত প্রক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি। ঔপনিবেশিকের জায়গায় কর্পোরেটকে রাখুন, তাহলেই আমরা দেখতে পাব কর্পোরেট জমিদারি এবং ঋণ সংকটের নতুন হুমকির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন কীভাবে লড়ছে!

সংগঠন করার এবং কাজের পরিবেশ ও জীবনযাত্রার উন্নত মানের জন্য লড়াইয়ের অধিকার সহ শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৈপ্লবিক উত্তরাধিকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ গঠন করেছে। এই সংগ্রামের ফলে ঔপনিবেশিক আমলেই শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত বেশ কিছু আইন পাশ হয়েছিল। ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট এবং ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, ১৯২৬ থেকে পেমেন্ট অফ ওয়েজেস অ্যাক্ট এবং ন্যূনতম মজুরি আইন পর্যন্ত ভারতের অনেক মূল শ্রম আইন স্বাধীনতার আগেই পাশ হয়েছিল। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং ১৯২০ সাল থেকে সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলন ছাড়াও, ১৯৩৬ সালে ডঃ আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টিও ঔপনিবেশিক ভারতে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য বিরাট অবদান রেখেছিল। আইএলপি, যা ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং পুঁজিবাদ — উভয়কেই শ্রমিক শ্রেণীর শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হিসাবে উঠে এসেছিল, বড় নির্বাচনী জয় পেয়েছিল এবং বিধানসভা নির্বাচনী পরিসরের পাশাপাশি বৃহত্তর শ্রমিক-কৃষক সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

সত্যি ১৯৩৬ সালটা ছিল এমন একটি বছর, যে বছরটি দু’টি সংগ্রামী আহ্বানের জন্ম দিয়েছে। একদিকে কিষাণ সভা জমিদারী অবসানের ডাক দিয়েছিল, অন্যদিকে আম্বেদকর জাতিপ্রথা নির্মূলের দৃপ্ত আহ্বান নিয়ে জনপরিসরে এসেছিলেন। বর্ণব্যবস্থার অবলুপ্তির আহ্বান খুব কার্যকরীভাবে সামাজিক ন্যায়বিচারের এজেন্ডাকে সামাজিক রূপান্তরের উচ্চতর মঞ্চে তুলে ধরেছিল। অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের সীমিত গান্ধীবাদী ভাবনা থেকে সরে এসে, আম্বেদকর গোটা জাতিভেদ প্রথাটাকেই দূর করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শ্রম বিভাজনের নামে জাতপাতকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে, আম্বেদকর উন্মোচিত করেছিলেন কীভাবে জাতিভেদ প্রথা শ্রমিকদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। উত্তরটি স্পষ্টতই নিহিত রয়েছে জাতপাত-বিরোধী ভিত্তিতে শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যসাধনে, যেখানে বর্ণ শ্রেণীতে বিলীন হয়ে যাবে। এইসব প্রাগ্রসর ভাবনার এক বিন্দুতে এসে মিলে যাওয়া — জমিদারির বিলুপ্তি, জাতপাতের অবলুপ্তি এবং শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্যসাধন — শ্রেণী ঐক্য ও শ্রেণী সংগ্রামকে অনেক বড় পরিসরে এবং উচ্চতর স্তরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সন্ধিক্ষণে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ঠিক এখানেই আমাদের আজকের ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই অপূর্ণ সম্ভাবনা এবং উত্তরাধিকারকে খুঁজে পেতে হবে, অনুসন্ধান করতে হবে।

Legacy of India's Freedom Movement

স্বাধীনতা আন্দোলনকে অবশ্যই বুঝতে হবে আরও এক অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে — গণবিক্ষোভে নারীদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, যার ফলশ্রুতিতে পিতৃতান্ত্রিক অনুশীলন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে এবং নারীর সমান অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। নারীদের অংশগ্রহণ শুধুমাত্র কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না — সাঁওতাল হুল এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযান এবং তেভাগা ও তেলেঙ্গানার মতো জঙ্গী কৃষক বিদ্রোহ — প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই সংগ্রামের প্রধান পর্যায় এবং ধরনগুলিতে মহিলারা অগ্রণী ছিলেন। কম আলোচিত মণিপুরের নুপি ল্যান সংগ্রামের (১৯০৪ এবং ১৯৩৯) মতো কয়েকটি লড়াইয়ে নারীরা নেতৃত্বও দিয়েছেন। মণিপুরীতে নুপি ল্যানের আক্ষরিক অর্থ হল ‘নারী বাহিনীর যুদ্ধ’ এবং নুপি ল্যান সংগ্রামে মণিপুরের মহিলারা স্থানীয় রাজা এবং ধনী ব্যবসায়ী আর সেইসঙ্গে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সমাজে নিজেদের তুলনামূলকভাবে উচ্চ মর্যাদা রক্ষায় লড়াই করেছিলেন, পিতৃতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক শক্তি যে মর্যাদা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। এই যুদ্ধ মণিপুরের পুরুষ শ্রমিকদেরও দাসত্ব ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি নিশ্চিত করেছিল। প্রকৃত অর্থেই এটি ছিল আজকের শাহীনবাগের বৈষম্য ও বিভাজনমূলক সিএএ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আফস্পা এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মণিপুর ও কাশ্মীর উপত্যকায় মহিলাদের শক্তিশালী প্রতিবাদের অগ্রদূত।

বিজেপি’র জন্য, জাতীয়তাবাদ মানে হিন্দুত্ব, এবং আজাদীর অমৃত মহোৎসব উদযাপন হল সঙ্ঘ বাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে একটি ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অসমাপ্ত প্রকল্পটি সফল করার উদ্দেশ্যে ইতিহাস ছিনতাইয়ের মহড়া। আমাদের জন্য, স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার হল — সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং টিঁকে থাকা ঔপনিবেশিক উপাদানগুলোর বিপদগুলির বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ সতর্কবাণী, কাজে না লাগানো সম্ভাবনাগুলিকে আয়ত্তে আনা এবং “আমরা, ভারতের জনগণ”এর সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক ভারত গঠনের লক্ষ্যে অভিযাত্রার অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি পূরণের এক স্থায়ী অনুপ্রেরণা। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারায় ভারতবাসী ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করেছিলেন, স্বাধীনতার সাত দশক পরে আবারও তারা ফ্যাসিবাদী চক্রান্তকে পরাস্ত করবে!

খণ্ড-29
সংখ্যা-1