একটি মুহূর্ত
A moment_0

একটা মুহূর্ত। স্তব্ধ হয়ে থাকার! স্মৃতির গভীরে অবগাহনের! হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে অনুরণিত সুরঝর্ণায় স্নাত হওয়ার!

আজ তিনি চিরঘুমে শায়িত। তাঁর শেষ বিদায়ের ক্ষণটিতে আমজনতাও বিষণ্ণ, স্মৃতিমেদুর। তিনি যে তাদেরও- দশকের পর দশক ধরে! আজকের উবের চালক তরুণটি থেকে শুরু করে তার জুটমিল-শ্রমিক বাবা, তার এককালের হাত-টানা রিকশার চালক ঠাকুর্দা পর্যন্ত — সবার! নির্মাণ শ্রমিকটি রোজ কাজে যাবার আগে বৌকে একপ্রস্থ বকাবকি করে নিজের মনের ক্লেদ ঝাড়ে। ঠিকাদারের প্রতারণা, বড় মিস্ত্রির সঙ্গে খুচরো ঝামেলা, পাড়ার দোকানির বাকির খাতায় বেড়ে চলা অঙ্ক, মেয়ের ইশকুলে হেড মাস্টারনীর বকুনি — কত গ্লানি তার! বৌও রোজ রোজ কারণে অকারণে গালি শুনে শুনে ক্লান্ত বিরক্ত। নিত্য অশান্তির জের বয়ে সেও পরের বাড়ি খুন্তি নাড়তে যায়। সেদিন রেগে গিয়ে নতুন কেনা মোবাইলে গান চালিয়ে রুটি সেঁকতে থাকে। তার প্রিয় শিল্পীর গান। উচ্ছে আলু ভাজি দিয়ে রুটি খেতে খেতে ক্ষণিক গানে তন্ময় হয়ে যায় তার বর। “আহা! কী গলা! কী সব গান!” জল খেয়ে প্রকাণ্ড এক ঢেঁকুর তুলে গুন গুন করতে করতে সে কাজে চলে যায়। ভুলেই যায় বৌ ছেঁড়া বোতামটা আজও সেলাই করেনি।

ঐযে সত্তরোর্ধ মানুষটি অবেলার জীর্ণ অবসরে দোকানের রেডিওতে গান শুনতে শুনতে কাগজে অন্যমনস্ক ভাবে চোখ বোলাচ্ছেন, তারও কি বহুদিন আগের কথা মনে পড়ে যায়নি? বা মরা রোদে বড়ি দিতে দিতে ‘ঠাকুমার’ কি মনে পড়ে না ম্যাটিনি শো-তে দল বেঁধে সিনেমা দেখার কথা? বই পাড়ার মুটিয়া মজদুর বয়স্ক মানুষটি, ক্লান্ত শরীরটা জিরিয়ে নিতে ভাঙা চোরা ফুটপাতের পাঁজর ফাটানো চিকণ সবুজের দিকে তাকিয়ে খৈনি ডলছেন; গান শুনতে শুনতে তার কি দেশ-গাঁও, ক্ষেতি-জমীন, বহুকাল আগে গত মা বা বাল্যসঙ্গিনীর কথা মনে পড়ছে না?

এইভাবেই তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন আরও বহু দিন-মানুষের দিন গুজরানে, শোকে দুঃখে, ভালোবাসায়-প্রেমে, অনুশোচনায়, স্বপ্ন দেখায়, ঘর বাঁধায়! তাঁর অনন্য কণ্ঠমাধুর্য আর সুরের ইন্দ্রধনু নিয়ে! বাসে বাসে, স্টেশন চত্বরে রুক্ষু চুলের যে বালিকাটি গান শুনিয়ে শীর্ণ হাতটি পাতে, তারও ভুখা কচি গলার আপ্রাণ চেষ্টায় সেই ‘তিনি’ই! মাইনাস ডিগ্রির বরফ রাজ্যে, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী জওয়ানদেরও বিরল দুর্লভ অবসরের সঙ্গী ‘তিনি’ (তাঁর গান)। শুধু আসমুদ্রহিমাচল নয়, তাঁর সুরের প্লাবনে ভেসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত। উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ এসব বিতর্ককে একপাশে রেখে।

তিনি সুরসম্রাজ্ঞী ‘লতাজী’ — লতা মঙ্গেশকর — ‘ভারতের বুলবুল’। যাঁর গানকে দেশ কাল ধর্ম বর্ণ ভাষা সম্প্রদায়ের কাঁটাতার অবরুদ্ধ করতে পারেনি। যাঁর গানের ভুবনে চল্লিশটি ভাষায় স্বচ্ছন্দ বিচরণে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব এক সম্ভার — যে ডালিতে শুধু হিন্দি গানের সংখ্যাই পনেরো হাজারেরও বেশি। যিনি তাঁর অনন্য গায়কীতে ধরে রেখেছেন ভারতীয় মার্গ সংগীতের ঐতিহাসিক পরম্পরাকে। যিনি বিভিন্ন প্রজন্মের সুরকার, গীতিকার, গায়কের সঙ্গে কাজ করেও নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেননি। অথচ যিনি যুগবদলের চিহ্নকে সাদরে স্বাগত জানিয়ে নিজের সৃজনভাণ্ডারকে ঋদ্ধতর করে গেছেন অনবরত!

এই মানুষটির শেষ বিদায়ের সেই পরম ক্ষণটিকেও কালিমালিপ্ত করল হিন্দুতূবাদীরা! শিবাজী পার্কে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। এসেছিলেন বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খানও। সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর হিন্দু ম্যানেজার পূজা দাদলানি। তাঁরা নিজ ধর্মীয় রীতি মেনে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। সেই ছবি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের এক সুন্দর মুহূর্ত উপহার দিয়েছিল দেশবাসীকে। কিন্তু জাতি-বিদ্বেষের চরম কলঙ্ক লেপে দেওয়া হল সেই ছবিতে! হরিয়ানার বিজেপি সভাপতি অরুণ যাদব এক টুইটারে দাবি করেন শাহরুখ নাকি সুরসম্রাজ্ঞীর উদ্দেশে থুতু ছিটিয়েছেন! উত্তর প্রদেশের বিজেপি মুখপাত্র প্রশান্ত উমরাও তাকে সমর্থন জানান। বিজেপির আইটি সেল তাকে হাতিয়ার করে কুৎসিত প্রচারে নামে। হিটলার মুসোলিনির এই উত্তরসূরীরা শুধু ঘৃণা ছিটিয়ে সব কিছুর দখলদারি চায়। যে মানুষটির বিদায় ঘিরে এই কুৎসিত অপপ্রয়াস, তিনি কিন্তু তার শিল্পী জীবনে বহু মুসলিম গীতিকার গায়ক বাদক সুরকারের সান্নিধ্যে এসেছেন, স্বভাবসিদ্ধ নম্রতায় তাঁদের থেকে শিখেছেন, অন্তরের উষ্ণতায় তাঁদের বন্ধুত্বকে বরণ করে নিয়েছেন, বয়োকনিষ্ঠদের প্রাণ ঢেলে শিখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হসরত জয়পুরী, সাহির লুধিয়ানভী, মজরুহ সুলতানপুরী, উস্তাদ আমানত আলি, গোলাম হায়দার, বিসমিল্লা খাঁ, বড়ে গোলাম আলি, আমজাদ আলি, নৌশাদ, রশিদ খান, এ আর রহমান প্রমুখ। মনুষ্যত্বহীন ঐ জাতি বিদ্বেষীরা জানে না, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে!

নিজের ৯২তম জন্মদিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশে ক্রমাগত বেড়ে চলা বিদ্বেষ-বিভাজন এবং তিক্ততার বাতাবরণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন “আমি হিন্দু, ও মুসলমান” এই ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে একজন ‘ভারতীয়’ বলে ভাবতে শিখুন। ধর্মের জন্য পরস্পর হানাহানি বন্ধ হোক। এটা ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনের পরিপন্থী। এইসব আরও অনেক আগে বন্ধ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আজও তা আছে এবং ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তিনি আরও বলেছেন, ফিরে জন্ম নেওয়ার সুযোগ থাকলে, এই ভারতের মাটিতেই তিনি জন্ম নিতে চান কারণ এই মাটিতেই রামকৃষ্ণ পরমহংস থেকে স্বামী বিবেকানন্দের মত জ্ঞানী চিন্তকরা জন্মেছিলেন, সমৃদ্ধ করে গেছেন তাদের জ্ঞানভাণ্ডারে।

একজন ‘ভারতীয়’ হিসাবে যে মননের পরিচয় দিয়েছেন, যে সম্পদ রেখে গেলেন, দেশবাসীর কাছে তা গর্ব, অহংকার, প্রেরণা হয়ে থাকবে।

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-6