পশ্চিমবঙ্গে পুলিশী স্বেচ্ছাচারিতা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিপদ সংকেত
Political Terror in West Bengal

কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও সিএএ বিরোধী প্রতিবাদের পরিচিত মুখ আনিস খানকে যেভাবে হাওড়া জেলার আমতায় তাঁর নিজের তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ভয়ানকভাবে হত্যা করা হল তা যথোচিতভাবেই পশ্চিমবঙ্গে বিপুল গণক্রোধের সৃষ্টি করেছে। তাঁর বাবা বলেছেন, ১৮ ফেব্রুয়ারির মাঝরাতে পুলিশের পোশাকে একটি দল তাঁদের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পরে এবং যখন তাদের মধ্যে একজন তাঁকে বন্দুক ঠেকিয়ে আটকে রাখে তখন অন্যরা উপরে উঠে আনিসকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। যখন আহত আনিস আঘাতের ফলে মারা যায়, ওই বাহিনী আনিসের পরিবারকে আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

এই জঘন্য খুন বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছে। জেলা পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় থানা সরকারিভাবে ওই ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকা অস্বীকার করেছে। তাহলে কি গুন্ডারা পুলিশের পোশাক পরে খুন করেছিল? নাকি এটি স্থানীয় পুলিশের একটি অংশের অননুমোদিত অংশগ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় একটি যৌথ আক্রমণ ছিল? হত্যাকারীরা কি শাসক টিএমসি’র স্থানীয় সংগঠনের সহায়তা পেয়েছিল? অঞ্চলে টিএমসি’র তুলনামূলকভাবে খারাপ নির্বাচনী ফলের জন্য তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে উত্যক্ত করার বিরুদ্ধে ২০২১’র ২৪ মে আমতা থানায় আনিসের করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্টভাবে এই প্রশ্নটির জন্ম। ওই অভিযোগপত্রের বয়ান অনুসারে নিজের নিরাপত্তার জন্য আনিসকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।

আমতা থানা ওই চিঠির ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানা যায়নি। আনিসের ভয়ানকতম আশঙ্কাটি সত্যি হল। আনিস খানের খুন থেকে ওঠা প্রশ্নগুলি দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি করছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যখন স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বে, তখন সরকারকে সর্বোচ্চস্তরে এব্যাপারে মুখ খুলতে হবে। এই জঘন্য খুনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পক্ষে একটি বিশ্বাসযোগ্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দ্রুত বিচার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় পুলিশের যোগসাজশ ও গাফিলতিরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করতে হবে এবং প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আমতার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও পুলিশী স্বেচ্ছাচারিতার পুনর্নবীকৃত নকশার একটি উদাহরণ। এই জঘন্য খুনের কিছুদিন আগেই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার নরেন্দ্রপুর থানায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার কর্মীদের উপরে থানা হাজতে হাড় হিম করা অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ। সামাজিক মাধ্যমে লেখার জন্য একজন দলিত লেখককে থানায় উত্যক্ত করার প্রতিবাদে থানার সামনে জড়ো হওয়া এআইএসএ, এআইপিডব্লিউএ ও এপিডিআর কর্মী ও ছাত্রদের কয়েক ঘন্টা ধরে বর্বরভাবে আঘাত ও দুর্ব্যবহার করা হয়। ৩ জন মহিলাসহ অন্ততপক্ষে ১১ জন কর্মীর উপরে বর্বর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়। একজন পরীক্ষার্থী ছাত্রী সমেত ছাত্রদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য এমনকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আবেদনকেও পুলিশ রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ওই কর্মীদের আদালতে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।

Alarming Signs of Police Highhandedness

বীরভূম জেলা আরেকটি সন্ত্রাসের নাট্যশালা হিসেবে উদিত হয়েছে যেখানে ক্রমবর্ধমান জনবিরোধিতা সত্ত্বেও একটি কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গা এলাকায়, ভারতের সর্ববৃহৎ কয়লার ব্লক হিসেবে বিজ্ঞাপিত কয়লাখনি প্রকল্প বিপুল সংখ্যক স্থানীয় অধিবাসীকে উচ্ছিন্ন করবে, যাদের অর্ধেক হল আদিবাসী, এবং পরিবেশের বিপুল মাত্রায় ক্ষতি করবে। অনুরূপ বিপুলাকার প্রকল্পের জন্য আইন অনুসারে সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের সমীক্ষা এবং জনশুনানি ও জনআলোচনা আবশ্যিক। কিন্তু দেউচা-পাঁচামী’তে এপর্যন্ত প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে ও সেবিষয়ে তথ্যানুগ জনমতের সুব্যবস্থিত কণ্ঠরোধ করে চলেছে।

আশঙ্কা ও বিরোধিতা প্রদর্শনকারী আদিবাসীরা বীরভূমের টিএমসি’র পেশীপ্রদর্শক অনুব্রত মন্ডলের অনুগত গুন্ডা ও পুলিশের সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত এবং অধিবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য এলাকায় পরিদর্শনে যাওয়া নাগরিক সমাজের কর্মীরা নিয়মিত হুমকি ও মারধরের সম্মুখীন হচ্ছেন। অতি সম্প্রতি ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জে একটি শান্তিপূর্ণ জনসভার পরে জমি, জীবিকা এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য তৈরি হওয়া একটি মঞ্চের বেশ কয়েকজন কর্মী ও স্থানীয় অধিবাসীদের আটক করা হয় ও ভুয়ো মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখাতে ব্যস্ত আদানি গোষ্ঠির এই লোভনীয় কয়লা খনি প্রকল্পের উপর দৃষ্টি পড়েছে।

গত এপ্রিল-মে ২০২১-তে রাজ্যে বিজেপি’র ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে বিফল করতে পশ্চিমবঙ্গ সজোরে ভোট দিয়েছিল। এই বিজেপি বিরোধী রায়ের সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করেছিল টিএমসি এবং বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্টতা ও ভোট শতাংশ নিয়ে পরপর তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরেছিল। টিএমসি’র এই জয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক যাত্রাকে বিপরীতমুখী করেছিল — যেসব দলবদলুরা নির্বাচনের আগে বিজেপি’তে যাওয়ার জন্য লাইন দিয়েছিল তারা এখন পালে পালে টিএমসি’তে ফিরছে। রাজনৈতিক হিংসা ও পুলিশী স্বেচ্ছাচারিতার নতুন নকশা ইঙ্গিত করছে যে আত্মতুষ্ট শাসকদল জনগণকে পাত্তাই দিতে চাইছে না।

যদি এই ধারা চলতে থাকে তাহলে পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন বিপন্ন হবে এবং রাজ্য অনাচার, সন্ত্রাস এবং পুলিশী স্বেচ্ছাচরিতার রাজত্বে নিমজ্জিত হবে। সেটাই হবে ২০২১’র নির্বাচনী রায়ের সর্বাধিক উপহাস। বিজেপি যাতে জল ঘুলিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে না পারে সেইজন্য প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকেই গণতন্ত্রের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে ও জনগণের ক্রোধ ও আকাঙ্খাকে ইতিবাচক অভিমুখে নিয়ে যেতে এগিয়ে আসতে ও উদ্যোগ বাড়িয়ে তুলতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের অলিগলিতে রাজপথে জনগণের উদ্দীপ্ত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উত্থানই কেবল রাজ্যে দানা বাঁধতে থাকা সঙ্কটের প্রত্যুত্তর দিতে পারে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-8