হাজার হাজার নারীবাদী, গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী, সংগঠন, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী এবং সমাজের বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিত্বরা — মুসলমান ছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাঁদের বর্জনের যে অপচেষ্টা চলছে তাকে ধিক্কার জানিয়েছেন একসুরে। তাঁরা জোরের সঙ্গে বলেছেন, হিজাব একটা অজুহাত মাত্র, আসলে মুসলিম মহিলাদের ওপর পৃথকীকরণ (অ্যাপাটাইড) চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর এটা করা হচ্ছে হিন্দু আধিপত্যবাদীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।
একটি বিবৃতি যাতে হাজার হাজার ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছেন এবং বিবৃতির বয়ানে বলা হয়েছে তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সংবিধান অনুযায়ী স্কুল ও কলেজে বহুত্ববাদের শিক্ষাই দেওয়া হয়। অভিন্নতা কখনই নয়।
এই বিবৃতিটি স্বাক্ষর করেছেন ১৫টি রাজ্যের ১৩০টির বেশি সংগঠন। এদের মধ্যে রয়েছে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন, বেবাক কালেকটিভ, সহেলী উইমেনস রিসোর্স সেন্টার, আওয়াজ-ই-নিজওয়ান, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্টস, ফোরাম এগেইন্সট অপ্রেশন অফ উইমেন, পিইউসিএল, দলিত উইমেন্স কালেক্টিভ, ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ দলিত উইমেন, উইমেন এগেইনস্ট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যান্ড স্টেট রিপ্রেশন এবং ফেমিনিস্ট ইন রেসিস্ট্যান্স।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন, কবিতা কৃষ্ণাণ, মরিয়ম ধাওয়ালে, অ্যানি রাজা, অরুণা রায়, রাধিকা ভেমুলা, মানুজা প্রদীপ, সফুরা জারগার, হাসিনা খান, অজিতা রাও, খালিদা পরভীন, উমা চক্রবর্তী, সুজাথা সুরেপল্লী, বৃন্দা গ্রোভার, ভার্জিনিয়া সালদানহা, সতনাম কৌর, সাধনা আর্য, চয়নিকা শাহ, পৌষালি বসাক, নিবেদিতা মেনন, সুসী থারু, প্রভাত পট্টনায়ক, রাধিকা সিংহ, অমৃতা চাছি এবং অন্যান্যরা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মুসলিম ছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হিজাব পরিধান এবং তাঁদের পৃথকীকরণ সম্পর্কে নারীবাদী, গণতান্ত্রিক সংগঠন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য হল
১) কর্ণাটকের উপকূল অঞ্চলের শিক্ষালয়ে ক্লাসে ও ক্যাম্পাসে হিজাব নিষিদ্ধ করা এবং অন্যান্য রাজ্যেও তা নিষিদ্ধ করার হুমকি একটি ঘৃণ্য অপরাধ। হিন্দু আধিপত্যবাদীরা মুসলিমদের গণপেটাই, পৃথকীকরণ, বয়কট করছে নানা অছিলায় — যেমন, গোমাংস খাওয়া, তাদের যৌথ প্রার্থনা, আজান দেওয়া, টুপি পরা, উর্দু ভাষা ইত্যাদির জন্য। এরসঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরিধান, তাঁদের অনলাইনে নিলামে তোলা এবং যৌন ও প্রজননদাসী হিসাবে কুপ্রচার চালানো।
২) কর্ণাটকের মান্ড্যতে গেরুয়াধারীরা একজন হিজাব পরিহিতা মহিলাকে ঘিরে ধরে হেনস্থা করছে এই ভিডিওটি একটি সতর্কতামূলক নিদর্শন এই কারণে যে হিজাবকে অজুহাত করে কত সহজে মুসলিম মহিলাদের ওপর আক্রমণ নামানো যায়।
৩) আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সংবিধান অনুযায়ী স্কুল ও কলেজে বহুত্ববাদের শিক্ষাই দেওয়া হয়। অভিন্নতা কখনই নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ইউনিফর্ম’এর মাধ্যমে ছাত্রীছাত্রদের শ্রেণী পার্থক্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্যতার লঘুকরণ করা হয়। আমাদের দেশ বহুত্ববাদী এবং এখানে ইউনিফর্ম কখনই অভিন্ন সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়। এই কারণে শিখদের ক্লাসে পাগড়ি পরার অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে পুলিশে ও সেনাবাহিনীতেও পাগড়ি পরার অনুমতি দেওয়া হয়। এইজন্য হিন্দু ছাত্রীছাত্ররা বিন্দি/পোট্টু/তিলক/বিভূতি পরেন তাঁদের স্কুল বা কলেজের ইউনিফর্মের সাথে কোন মন্তব্য বা বিতর্ক ছাড়া। একইভাবে মুসলিম ছাত্রীরা তাঁদের ইউনিফর্মের সাথে হিজাব অবশ্যই পরবেন।
৪) উদুপি’র অন্তত একটি কলেজের রুলবুকে মুসলিম মহিলাদের তাঁদের ইউনিফর্মের সাথে খাপ খায় এরকম রংয়ের হিজাব পরার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শুধু হিজাবের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নিয়ে গন্ডগোল হচ্ছে তা নয়। হিন্দু আধিপত্যবাদীরা গেরুয়া পরে প্রদর্শন করছে যাতে হিজাবকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু গেরুয়া কাপড় বা হিজাবকে নিষিদ্ধ করাটা সঠিক সমাধান নয় কারণ কিছু মুসলিম মহিলা হিজাব পরেন তাই গেরুয়া কাপড় পরে হিন্দুত্ববাদীরা হিজাব নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে সমস্ত মুসলিম মহিলাদের হুমকির বার্তা দিতে চেয়েছে।
৫) হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের আলাদা ক্লাসরুমে বসানো বা তাঁদের পছন্দমতো অন্য কলেজে বা মুসলিম পরিচালিত কলেজে চলে যাওয়ার জন্য আদেশ করা ‘পৃথকীকরণ’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। ২০০৮ থেকে হিন্দু আধিপত্যবাদীরা কর্ণাটকের উপকূল অঞ্চলে পৃথকীকরণ কায়েমের জন্য হিংস্রতার আশ্রয় নিয়েছে। তারা হিন্দু এবং মুসলিম ছাত্রীছাত্রদের বন্ধুত্ব, ভালোবাসার বিরোধিতা করছে। স্মরণ করুন এই আক্রমণের সাথে সাথে তারা হিন্দু মহিলাদের — যাঁরা পাবে যান, পশ্চিমী পোশাক পরেন, মুসলিম ছেলেদের সাথে প্রেম, বিবাহ করেন তাঁদের ওপরেও হিংস্র আক্রমণ করে। এই হিন্দু আধিপত্যবাদী অপরাধীদের রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী ঘৃণা যার সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মহিলাদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক ঘৃণা।
৬) আমরা আতঙ্কিত এই কারণে যে, কর্ণাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিজাব পরিহিতা মুসলিম মহিলার ফোন রেকর্ড তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন — কোনও সন্ত্রাসবাদী দলের সাথে তাঁর যোগাযোগ আছে কিনা। মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদী ও চক্রান্তকারী হিসাবে সহজেই অপরাধী বানিয়ে অভিযুক্ত করা হয় কেবলমাত্র পক্ষপাতমূলক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বা অন্য কোনও পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে। আর এখন মুসলিম মহিলারা হিজাব পরলে চক্রান্তকারী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে — যেখানে দেশে অগণিত হিন্দু, শিখ সমাজের মহিলারা একইভাবে, একই কারণে মাথা ঢাকেন এবং দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি তাঁদের মাথা ঢাকতেন কোনও মন্তব্য বা বিতর্ক ছাড়া।
৭) বালিকা এবং তরুণী ছাত্রীরা পোশাকের জন্য যেন হেনস্থা বা শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে শিক্ষা অর্জন করতে পারে। শিক্ষালয়গুলি যেন ছাত্রীছাত্রদের পোশাকের দিকে নজর না দিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির দিকে নজর দেন। কোনও ছাত্রীকে হিজাব, জিনস্ বা খাটো পোশাকের জন্য কলেজে ঢুকতে না দিলে আমরা তাদের পাশে থাকবো।
৮) মুসলিম মহিলারা হিজাব পরুন বা নাই পরুন আমরা তাঁদের বিস্তৃত অধিকারসহ মর্যাদা দেব ও সংহতি জানাব। কর্ণাটকের মুসলিম ছাত্রীরা তাঁদের সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে হিজাব পরেন তাই এই প্রতিনিধিত্বকারীতাকে সম্মান জানানো উচিত।
৯) মহিলারা কি পরবেন, তা কতটা খোলামেলা হবে এটা নির্ভর করছে তাঁদের পছন্দের ওপর। এটা শালীনতা বা অশালীনতার মাপকাঠি কখনই হতে পারে না। এটা সমস্ত ধরণের ধর্মীয় অনুশীলনে পিতৃতান্ত্রিকতার চাপানো ফরমান। মহিলাদের সম্মান রক্ষার্থে কোন পোশাক পরা উচিত তার ফরমান না দিয়ে বরং তাঁরা যাই পরুন না কেন তাঁদের সম্মান দেখানো উচিত। আপনি যদি মনে করেন কোনও মহিলা নিজেকে যেন বেশি উন্মুক্ত করছেন বা হিন্দু/মুসলিম/খ্রিস্টান/শিখ ধর্মমত অনুযায়ী পোশাক পরেননি তাহলে সমস্যাটা আপনার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর এবং সঠিক জ্ঞানের অভাব। নারীবাদী ও গণতান্ত্রিক নীতির মধ্যেই নিহিত থাকে প্রত্যেক মহিলাদের প্রতি সম্মান জানানো কারণ প্রত্যেক মহিলা পুরুষতান্ত্রিকতাকে কিভাবে মোকাবিলা করবেন তা নিজেই ঠিক করেন এবং তাঁর বিশ্বাসের সাথে যে অনুশীলন খাপ খায় তা গ্রহণ করেন এবং বাকিগুলি বর্জন করেন।
১০) মান্ড্যতে একজন মুসলিম মহিলাকে যে সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গরা হেনস্থা করেছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ দাবি করছি। হিজাব পরিহিতা মহিলাদের হুমকি দেওয়ার প্রচেষ্টা বন্ধ করার জন্য আমরা সারাদেশের রাজ্য সরকারগুলির প্রতি আবেদন করছি তাঁরা যেন পুলিশ ও জনগণকে এব্যাপারে সতর্ক করেন। আমরা কর্ণাটকের মুসলিম ছাত্রীদের সাহসকে সেলাম জানাই যাঁরা তাদের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট হিন্দু আধিপত্যবাদী গুন্ডাদের হুমকি উপেক্ষা করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এই ছাত্রীদের থেকে শুনে আনন্দিত হয়েছি যে তাঁদের অনেক হিন্দু এবং খ্রিস্টান বন্ধু-বান্ধবী এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। আমরা বলছি, সারা দেশের ছাত্রীছাত্রদের এবং মহিলাদের ওপর নারীবিদ্বেষী ও ইসলামবিদ্বেষী ‘পোশাক বিধি’ জোর করে চাপানোর যে কোন চেষ্টার বিরোধিতা করুন।