৭ ফেব্রুয়ারি নরেন্দ্রপুর থানার সেই বীভৎস নির্যাতনের রাত
Narendrapur police station

(থানা হেফাজত-জেল হেফাজত থেকে ফিরে লিখলেন সৌমী জানা)

রাত তখন কত হবে — সাড়ে আটটা। থানার বিল্ডিং’এ পেল্লাই একটা বিয়েবাড়ি। চকমকে জামাকাপড় পরে ঘুরছে, উঠছে, নামছে। তাদের সামনে আমাদের বেধড়ক পেটানোর সময় পুলিশকে চরম অশ্রাব্য ভাষায় বলতে শুনেছি ৮৫,০০০ টাকা দিয়ে লোকে বিয়েবাড়ি ভাড়া করবে আর এই ‘....’ বুদ্ধিজীবীরা বাইরে হিজড়াগিরি করবে (হিজরাগিরি মানে আমাদের গান, স্লোগান)। ওদিকে আমাদের ৬ জন সাথী বাকস্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে একদফা চরম নির্যাতিত হয়ে থানায় প্রহর গুনছে। আর আমরা ততোধিক চিন্তায় বাইরে অপেক্ষা করছি কখন বেরোবে, কখন দেখব ওদের, বুকে জড়িয়ে ধরব। চায়ের দোকানে প্রত্যেকের কয়েকবার ঢুঁ মারা হয়ে গেছে, তখনও বুঝিনি ওখানেও নিজেদের লোক ছেড়ে রেখেছে নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ, আমরা কি বলছি কি করছি সব নখদর্পণে রাখার জন্য। বাড়ছিল রাত।

সাথীরা উপরে বসেছিলেন। ডিটেইন করা সাথীদের মুক্তির কাজ চলছিল। উপরে খোঁজ নিতে যেতেই কনস্টেবল খুব খারাপভাবে বললেন কতজন আসতে হবে, আছে তো লোক, বললাম এভাবে কথা বলছেন কেন! আমরা তো ঢুকিনি, আপনাদের কথামত ৩ জনই তো গেছেন। তখনও একদফা খারাপ ব্যবহার করল আবার, কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে এলাম বাকিরা।

এরপর অনেক টালবাহানা করে ছাড়া হয় সাথীদের পিআর বন্ডে। ওরা নিচে নামতে তাদের স্বাগত জানিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি আমরা। স্লোগান দেওয়া হয় ‘কমরেড লাল সেলাম’। এতেই নাকি বিয়ে বাড়ির বিশাল অসুবিধা হয়ে যায়! জামিন পাওয়ার পর ওসি আমাদের নির্যাতনের সাফাই দিতে এই একটাই ‘যুক্তি’ দেখাতে পেরেছে — আর বলেছে আমরা নাকি পুলিশকে মেরে রাস্তায় শুইয়ে দিয়েছি। যাই হোক, হঠাৎ করে পুলিশ ফোর্স নেমে আসে, মুক্তি পাওয়া সাথীদের বুকে ধাক্কা দেওয়া শুরু করে, তুই-তোকারি শুরু করে। আমরা জিজ্ঞেস করি, গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন, এভাবে কথা বলছেন কেন? থানার সেকেন্ড অফিসার (‘মেজো বাবু’) হঠাৎ করে বলে ওঠেন, দেখবি কী করতে পারি! এই মার সবকটাকে, পেটা পেটা। তখনি আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। চোখের সামনে নিজেদের সাথীদের রক্তাক্ত হতে দেখি, জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করি, বেধড়ক পেটানো শুরু করে কতগুলো জানোয়ার পুরুষ পুলিশ, আমার একটা পা টেনে ধরে নির্দেশ দেওয়া হয় মাঝখানে মানে যৌনাঙ্গে মারতে। বারংবার বিভিন্নভাবে মহিলা সাথীদের প্রতি এই নির্দেশই দেওয়া চলে, সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজ, যা লেখা যায় না, মেয়েদেরকে শরীর, যৌনাঙ্গ নিয়ে অশ্রাব্য লেখার অযোগ্য ভাষায় চলে আক্রমণ। ওই অবস্থাতেও আমরা বারবার জিজ্ঞেস করি, মহিলা পুলিশ কোথায়? আমাদের মাটিতে ফেলে আরও পেটাতে পেটাতে এক পুলিশ কর্মী বলেন, “একি, ছেলে না মেয়ে, কোথায় মারব বুকে না নীচে”! এক সাথীর মাথা গাড়ির চাকার নিচে ঠেসে ধরা হয়, পেছন থেকে ঠেলতে থাকেন দু’জন পুলিশ, তাকে বাঁচাতে গেলে চলে নির্যাতন, মারের মধ্যেই চোখের সামনে দেখি আকাশ, রুদ্র, মুজতবা সহ সাথীদের সিঁড়ি দিয়ে ঘষতে ঘষতে উপরে তিনতলায় তুলছে, তাদের জাত গায়ের রং নিয়ে চলছে আক্রমণ, চলছে মহিলা বিরোধী অশ্রাব্য গালিগালাজ। একজনকে ক্রমাগত পেটে বুকে ফেলে মারা হচ্ছিল যার সুগার, লিভারের অসুখ, চুল ধরে ঘষতে ঘষতে তোলে তাকেও, রাস্তার মধ্যেই বুট দিয়ে চেপে ধরা হয় সাথীদের মাথা। আমরা ধরতে গেলে ক্রমাগত লাথি ও লাঠি দিয়ে পেটানো চলে আমাদের, সব করে পুরুষ পুলিশ। এরমধ্যেই নামে দুজন মহিলা অফিসার, তারা আসতে আর একদফা আমাদের মহিলাদের মারধর চলে, একইভাবে ঘষতে ঘষতে তিনতলায় তোলা হয়। আমরা বারবার একটাই কথা জিজ্ঞেস করেছি — কী অপরাধ আমাদের? কেন মারা হচ্ছে? উত্তর পাইনি আমরা, বদলে শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ছিল উর্দি পরা একদল হায় না।

February 7 is the night of that horrible torture

মনে পড়ছে সেদিন লকআপে অত্যাচারের কথা। মেরে মেরে প্রায় মৃত করে দেওয়া হয়েছিল। দেওয়া হয়নি ওষুধ, জল, স্যানিটারি ন্যাপকিন। চারিদিক নিঝুম হয়ে আসছিল, আর ততোধিক ক্ষত তৈরি হচ্ছিল আমাদের শরীরে, কান্নার স্বর যেন আর বেরোচ্ছিল না। আর একটা পর্যায়ে, মনে হচ্ছিল মৃত্যু আসুক, ঘুমাই একটু, আক্ষেপ হচ্ছিল শুধু কমরেডদের যদি একবার বলতে পারতাম — লড়াই যেন না থামে। আর ছিল মাথা উঁচু করে থাকার দৃঢ়তা।

খুব আক্ষেপ হচ্ছিল সেদিন কেন পারছি না আমার সাথীদের বাঁচাতে, রাগ হচ্ছিল আধো হুঁশেও। ঘষতে ঘষতে তুলেছিল তিন তলায়। তুলেই বয়স্ক সাথী মলয়কে ক্রমাগত পেটানো হয়, ধরে আটকাতে গেলে শুরু হয় আমাদের উপর নির্যাতন, পুরুষ পুলিশদের। তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় একপ্রকার আমাদের উপর, ক্রমাগত লাঠি-লাথি চলতে থাকে। রাতের নিস্তব্ধতায় যেন আঁচড় কেটে যাচ্ছিল অত্যাচারের সেই নৃশংসতা। পাশের ঘরে ‘মেজবাবু’র ক্রমাগত নির্দেশ মার না থামানোর। আর সঙ্গে চলছিল পুরুষ পুলিশদের জামা তুলে আমাদের দিকে যৌনগন্ধী মর্ষকামী ইঙ্গিত। ওই অবস্থাতেও প্রশ্ন করেছিলাম একবার তো বলুন কেন মারছেন? আমার ইউটিআই’এর ট্রিটমেন্ট চলছিল, তাই বলি পেটে বুকে আর যৌনাঙ্গে প্লিজ মারবেন না, আমার ট্রিটমেন্ট চলছে। তারপর থেকে যতগুলো মার মেরেছে সব মুখ বুক পেট আর যৌনাঙ্গের দিকে। আর সঙ্গে বারংবার একই উক্তি — মাথা নিচু করবি কিনা বল, চুপ করবি কিনা বল, গুলি করে দেব। সাথীরা একই উত্তর দিয়েছে, সোচ্চারে বলেছে করুন গুলি, মারুন কত মারবেন। চাওয়া হয়েছিল ফোনের পাসওয়ার্ড। দেয়নি কেউ। এটা বলেই যে ফোন আমাদের ব্যক্তিগত। এরপর আমার উপর আরও বাড়ে নির্যাতন। ক্রমাগত লাথি মারা হয় বুকে, পেটে, পুরুষ ও মহিলা পুলিশ সবাই। টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় মহিলা সেলে, যেখানে সিসি টিভি লাগানো। মহিলা সাথীরা প্রস্রাব করতে চাইলে তাদের বাধ্য করা হয় ওই সেলে সিসিটিভি আওতার মধ্যেই তা করতে। সারারাত ওভাবেই মানুষ থাকার অযোগ্য একটা সেলে ফেলে রাখা হয় আমাদের। বাইরে থানার মধ্যে চলতে থাকে আসর, দুই একজন ছাড়া সবাই দেখি হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে ফেলেছে, একজন যিনি চা ইত্যাদি দেন তিনি ছাড়া কোনও মহিলা নেই, আইটেম সং চলছে জোরে। মোটামুটি পিকনিক পরিবেশ। জানি না কোথায় ছিলেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত থাকা মহিলা পুলিশ অফিসার। মাঝরাতে এই তীব্র অত্যাচারের দরুণ শুরু হয় আমার তীব্র যন্ত্রণা, বাড়ে ইউটিআই। সেই অবস্থায় ফুটবল খেলার ভঙ্গিতে পুরুষ পুলিশরা এসে সার্কাস দেখার মতো দেখতে শুরু করে, ইউটিআই হয়েছে বলার পরও কেউ বলে আমি নেশা করি, নেশার জিনিস পাচ্ছি না বলে এরকম হচ্ছে, কেউ বলে ওকে গ্যাসের ওষুধ দে, নাটক করছে পালিয়ে যাবে বলে। শেষে চোখ দাঁড়িয়ে যাবার অবস্থায় একজন পুরুষ পুলিশ কর্মী আমায় সেল থেকে টেনে বের করে, জিজ্ঞেস করে কী নেশা করি, তখন সেল থেকে সাথী বর্ষা চেঁচিয়ে ওদের বোঝাতে থাকে ইউটিআই কী। অত বড় থানায় কেউ জানে না কী ইউটিআই। আবার ঘষতে ঘষতে নামানো হয় নিচে, নির্দেশ দেওয়া হয় আমায় শুতে না দিতে, ধরে রাখতে। জুতো পরতে চাইলে বলে ক্রিমিনালরা জুতো পরে না। হসপিটালের সামনে গাড়ি নামিয়ে টানতে টানতে ঢোকানো হয় কোভিড ওয়ার্ডে, খুলে নেওয়া হয় মাস্ক। প্রশ্ন করি এটা তো কোভিড ওয়ার্ড, বদলে আবার চড় বসানো হয় গালে। অবাক হই সত্যি, প্রায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও খানিক হেসেই ফেলি, বলি এতদিন ধরে মেডিকেল কেস করছেন জানেন না কোনটা কোভিড আর কোনটা ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড। জানতাম মারবে আবার, কিন্তু কী করি এটাই যে শিক্ষা লড়ে যাওয়ার। হসপিটালে ওষুধ না থাকায় একইভাবে টেনে টেনে নিয়ে যায় বারুইপুর হসপিটালে। একই জিনিস করে সেখানেও।

এতক্ষণে এসে পৌঁছায় আমাদের দায়িত্বে থাকা মহিলা পুলিশ। এসে নার্সকে একপ্রকার জোর করে, অতো ভালো করে কিছু করার দরকার নেই। এরপর যেভাবে ইনজেকশন দেওয়া হয় আর চ্যানেল করা হয় মনে হচ্ছিল মৃত্যু আসুক এবার। কিন্তু মাথা নোয়ায়নি কেউ তখনও। বারবার একই কথা খালি বলা হচ্ছিল — এই তো আরও মারছি, কী করতে পারবি আমাদের। মাথা উঁচু করেই হেসেছিলাম আমরা। মানুষ হয়ে আজ্ঞাবহ যন্ত্রে যারা পরিণত হয় তাদের জন্য করুণাই হয় আমার। ক্যাথিটার করার কথা বলেছিল ডাক্তার, ধমকানি খেয়ে আর বোধহয় সাহস করেনি আমার চিকিৎসা করার। আমার সামনেই ডাক্তারকে লিখতে বলা হয় যে লিখুন ও ‘ফিট’। প্রসঙ্গত বলি, যেসব মেডিকেল রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে তার প্রতিটা ফেক। আমাদের কোনও মেডিকেলই করা হয়নি। থানা লকআপে ফিরে এসে দেখি সেলে কুঁকড়ে শুয়ে আছে বর্ষা। আসতেই কোলে এসে মাথা রাখল — সৌমিদি খুব ভয় করছিল, এরা যেভাবে কথা বলছিল তুমি যাওয়ার পর ওরা রেপ করতে পারে জানো। ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মনে পড়ছিল কত কথা। বোধহয় ব্যাথায় যন্ত্রনায় ঘোর লেগেছিল, দেখছিলাম লাল টকটকে একটা সূর্য। আর ধর্মনিরপেক্ষ থানায় সকাল বেলা চলতে থাকে গীতা, হনুমান চালিশা। হ্যাঁ, নরেন্দ্রপুর থানাতেই।

- সৌমী জানা

খণ্ড-29
সংখ্যা-8