সুরজিত সেনগুপ্ত স্মরণে
Surjit Sengupta

“আমি যখন কিশোর তখন আমার বাড়ির দরজার গোড়ায় প্রায় চোখের সামনে খুন হয়ে যান স্বপ্ন দেখা এক বিপ্লবী বামপন্থী কর্মী। গোটা জীবন জুড়ে সেই রক্তের স্রোত মিশে গিয়েছিল আমার ফুটবলে, আমার জীবন চেতনায়”, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ফুটবলার সুরজিত সেনগুপ্ত। বিক্ষুব্ধ সময়ের অভিঘাত এইভাবেই বুঝি ছড়িয়ে যায়। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ে যে ময়দানে গোপনে হত্যা করা হয়েছে সিন্ধু-চেতনায় বলীয়ান বর্ষীয়ান বিপ্লবী সরোজ দত্তকে, প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে তরুণ নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তকে, সেই ময়দানে সেই রক্তস্রোত আর চেতনায় জারিত এক ফুটবলার ফুটবল শিল্পে মুগ্ধ করছে এমন এক প্রজন্মকে, যাঁদের মনে দেশ ছেড়ে আসার দগদগে স্মৃতি, অনেকে ঘর ছেড়েছে দেশকে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে, কেউ বেকার, কেউ বা ভবঘুরে বা অন্যকিছু।

শুধু বাঙালিরাই নয়, সারা দেশের মানুষ দু’চোখের মুগ্ধতা নিয়ে দেখেছে ডান প্রান্ত দিয়ে ছুটে চলা, তারপর সেন্টার, যা থেকে কখনও শ্যাম থাপার পা, কখনও রঞ্জিত মুখার্জির মাথা ছুঁয়ে বল চলেছে জালের দিকে, আর সাত-আনা দশ-আনার গ্যালারিতে জীবনের নানা ক্ষেত্রে অপমানিত, অত্যাচারীত মানুষগুলো জয়ের স্বপ্ন দেখছে, সমস্বরে আওয়াজ তুলছে ... গো-ও-ও-ল !

মহসিন কলেজে পড়ার সময় থেকেই বিশুর (সুরজিতের ডাক নাম) ফুটবলে নামডাক হওয়া শুরু, টেনিস বলের ক্রিকেট টুর্নামেন্টেও ব্যাটার হিসেবে বিলক্ষণ সুখ্যাতি ছিল তার। পরবর্তীকালে কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিরুদ্ধে কর্ণার থেকে বাঁক নেওয়া শটের সরাসরি গোলে ঢুকে যাওয়া কিংবা সন্তোষ ট্রফিতে পরপর দু’দিন বাংলার লড়ে জয়লাভতো ফুটবলের গল্পকথায় স্থায়ী আসন লাভ করেছে। কিন্তু ফুটবল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সুরজিত সেনগুপ্ত নিজে যাঁর কথা বহুবার বলেছেন তিনি হলেন ভোলাদা (অশ্বিনী বরাট)। ব্রাঞ্চ স্কুলের মাঠে তাঁরই কোচিং থেকে উঠে এসেছেন সুরজিত সেনগুপ্ত, ভোলাদার প্রিয়তম শিষ্য ছিলেন সুরজিত। স্থায়ীভাবে কলকাতায় আসার পরও যখনই হুগলিতে আসতেন তখন ভোলাদার সাথে দেখা করতে আসাটা ছিল আবশ্যিক আর সাথে থাকত কোচিং-এর দুঃস্থ ছেলেদের জন্য বুট কিংবা অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। যখন খেলার পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছেন তখন ভোলাদার কিংবা মফস্বলের অন্যান্য কোচিং-এর দুঃস্থ কিন্তু প্রতিভাবান ফুটবলারদের কথা লিখেছেন। হুগলির ফুটবল জগতে পরিচিত মৎসজীবী পরিবারের ছেলে শান্তনু বলছিল, “আমার কিংবা চর্মকারের ছেলে বাবুলালের কথা লেখার সময় আমাদের আর্থিক দুরবস্থার কথাও লিখেছিলেন তিনি, যাতে আমাদের সাহায্যের জন্য মানুষ এগিয়ে আসেন”। এহেন মানুষ ফুটবলারদের স্বার্থরক্ষার জন্য ফুটবলার ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন গড়ে তোলার মূল কারিগরই হবেন। কর্মকর্তাদের বিরোধিতা করে একঝাঁক ফুটবলারকে নিয়ে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব ছেড়ে ফুটবল মাঠে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন সুরজিত সেনগুপ্ত। নাগরিকের অধিকার হরণের প্রতিবাদে সহমন চেয়ে আবেদন জানালে যুবচেতনাকে নিরাশ করতেন না।

ব্যক্তি মানুষ যেমন আকাশে, আলোতে, ধূলায়, ঘাসে মুক্তি অনুভব করেন তেমনি সমষ্টিগতভাবে মুক্তির জন্য চলে এক অবিরাম লড়াই। সেই লড়াইয়ের খেলা গড়িয়ে চলে অতিরিক্ত সময়ে। লড়াইয়েও থাকে স্বপ্ন, থাকে স্মৃতি। সেই স্মৃতির সত্তরে সুরজিত সেনগুপ্ত, সুভাষ ভৌমিকরা থাকেন। স্মৃতির আকাশে উলগানাথনের সাথে জায়গা বদল করা সুরজিত বাম প্রান্ত থেকে ভাসিয়ে দেন বল, উদ্বেলিত গ্যালারি, উদ্বেলিত জনতা। ফুটবল আর জীবন কোথাও মিশে যায়। মিশিয়ে দেন, মিশে থাকেন, মিশে থাকবেন সুরজিত সেনগুপ্ত!

- ভিয়েত

খণ্ড-29
সংখ্যা-8