প্রতিবেদন
অসাম্য, বেকারি বাড়ানোর ‘ডিজিটাল’ বাজেট
Idigital budget

ক্ষিদে পেয়েছে — চোপ! এদেশ এখন ডিজিটাল হয়েছে
চাকুরি পাচ্ছেন না — কোনো কথা নয়, দেশ ডিজিটাল হচ্ছে
রোজগার কমে গেছে — তাতে কী হয়েছে? আমরা ডিজিটাল হয়েছি
দেশজোড়া অসাম্য — বলার দরকার নেই, সকলের জন্য সর্বত্র ডাটার বন্দোবস্ত করছি
গত দু’বছর ধরে বিদ্যালয় বন্ধ — কুছ পরোয়া নেই, ই-লার্নিং’এর বন্দোবস্ত পাকা

হাসপাতালে জায়গা নেই, অক্সিজেনের অভাবে প্রিয়জন মারা গেছে — মন খারাপ করবেন না, ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পরামর্শের বন্দোবস্ত হয়েছে এমনটাই মনে হয় অর্থমন্ত্রীর (থুড়ি প্রধানমন্ত্রীর) ভাবনা। কাগজহীন বাজেট, কাগজহীন করের রিটার্ণ এগুলিকে তিনি আক্ষরিক অর্থে এতটাই গ্রহণ করেছেন যে, দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য ডিজিটাল সমাধানের বটিকা হাজির করেছেন। তাই এই অতিমারীর সময়ে প্রিয়জন হারানো, রুজি হারানো, মিড-ডে-মিল হারানো, শ্রেণীকক্ষ হারানো, কাজ হারানো, সম্পদ হারানো দেশবাসীকে আগামী ২৫ বছরের অমৃতকালের ধোঁকা দিতে তাঁর একটুও বাধেনি। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার, সকলের জন্য ঘর বানানোর, ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বানানোর, সব কালো টাকা ফেরত আনার, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকুরির বিবিধ প্রতিশ্রুতি জলাঞ্জলি দিয়ে ২৫ বছরের নয়া দীর্ঘকালীন সময়সীমা ধার্য করেছেন দেশকে ও তাদের জনসাধারণকে অমৃতলোকে পাঠানোর জন্য।

ভেবে দেখুন ২৫ বছর বাদে শত বছরের ভারতবর্ষের কথা যেখানে টিভি’র চ্যানেল দিয়েই শিক্ষালাভ হবে। ডিজিটাল শিক্ষকরা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদান করবেন। কৃষকরা তাদের শস্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন কিষাণ ড্রোনের মাধ্যমে। তাইতো অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “শস্য মূল্যায়নে, জমির রেকর্ডে, কীটনাশক ছড়ানোতে কিষাণ ড্রোনের ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ঢেউ তুলবে।” তাই কৃষিক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর তেমন দরকার পড়েনি। এমনকি ৩ বছর আগে শুরু করা গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে কৃষকদের ভোট বাগানোর পিএম কিষাণ প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ বাড়ানো হযনি। যদিও গত তিনবছরে মূল্যবৃদ্ধিতে কোনো ফাঁক পড়েনি, ফলে টাকার দাম কমেছে।

ডিজিটালের দুনিয়ায় গরিব মানুষ ডিজিটাল টাকায় ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং পরিষেবা গ্রহণ করবে, ডিজিটাল খরচ করে ডিজিটাল সম্পদ গড়বে। জাতীয় টেলি-মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দারিদ্রকে অনায়াসে মানিয়ে নিয়ে খিদে ভুলিয়ে রাম-কৃষ্ণ-শিব মন্দিরে আচ্ছন্ন করে দরিদ্র জনতার মানসিক স্বাস্থ্যকে সবল করে তুলবে; তাছাড়া সর্বব্যাপী ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে।

এই ডিজিটাল কালে দেশজুড়ে অসাম্য ও বৈষম্য বিরাজ করলেও তাকে অমৃত হিসেবে গলাধঃকরণ করতে হবে। ভুলে যেতে হবে যে দেশে চরম অসাম্য তৈরি হয়েছে। তাই বাজেট বক্তৃতার কোথাও ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। অর্থমন্ত্রীর ভাবনার চৌহদ্দিতে অসাম্যের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।

যদিও অর্থনৈতিক অসাম্য কেবল ন্যায় ও সমতার বিষয় নয়, উন্নয়ন ও বৃদ্ধির জন্যও তা যথেষ্ট সমস্যার বিষয়। দেশে যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে তা সরকার এবং জনগণের পক্ষে উদ্বেগের বিষয় হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অবশ্য অসাম্যের এই বাড়বাড়ন্তের কারণ হল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ধরণ — কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধি। এবিষয়ে বহুল পরিমাণ আলোচনা সত্ত্বেও বৃদ্ধির দায়িত্ব ডিজিটাল অর্থনীতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে সঁপে দেওয়ার ভাবনায় মশগুল দেশের ‘চিন্তানায়করা’। আদতে এই বন্দোবস্তকে পাল্টাতে গেলে প্রয়োজন অর্থনীতির সম্পূর্ণ পরিমার্জন যেখানে উপযুক্ত কর্মসংস্থানকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে পরিগণিত করতে হবে। এই বাজেট কর্মসংস্থানকে কেবল মুখের কথায় পর্যবসিত করেছে। কোন কোন উৎপাদন ক্ষেত্রে কী পরিমাণ কর্মসংস্থান হতে পারে তা কোথাও বলা হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় ৬ বার নিয়োগ (এমপ্লয়মেন্ট) ও ৩ বার কাজ (জব) শব্দদুটির উল্লেখ আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে একবার। ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থান সেই ‘আত্মনির্ভর ভারত’ বাগাড়ম্বরের ক্ষেত্রগুলিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কতদিনে হবে তার উল্লেখ নেই। ২০১৪ সালের বিজেপি’র নির্বাচনী ইশতেহারের সেই বছরে ২ কোটি চাকুরির কোনো টুকরোও বাজেটে নেই, যদিও গত ৭ বছরের গুণকীর্তনের কল্পকথা বাজেটে ছলকে ছলকে পড়েছে।

বাজেট অবশ্যই ভোগব্যয় বাড়াতে সক্ষম এমন খরচ বাড়াতে পারত, ও অত্যাবশ্যক গণপরিষেবার ব্যাপ্তি ঘটাতে পারত যা অপরদিকে কর্মসংস্থান বাড়াত। তা না করে যোগানের দিক থেকে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে। মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে বিপুল পরিমাণে, যদিও যে পরিমাণ বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে আদতে তাতে কারচুপিও রয়েছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রকল্প এমএনআরইজিএ’র জন্য বাজেট বরাদ্দ সংশোধিত (২০২১-২২) বরাদ্দের তুলনায় অনেকটাই কমানো হয়েছে, এমন একটা সময়ে যখন কোভিড ও তজ্জনিত ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের অত্যাচার বজায় রয়েছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজের চাহিদা রয়েছে।

কয়েকটি সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের দিকে একটু দৃষ্টি দিয়ে দেখা যাক বাজেট ২০২২ কী চাইছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ২০২১-২২ সালের বাজেট বরাদ্দের (৯৩,২২৪ কোটি টাকা) তুলনায় সংশোধিত বরাদ্দ, ৮৮,০০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ২০২১-২২ সালে শিক্ষাখাতে ব্যয় না করে সরকার ৫,২২২ কোটি টাকা বাঁচিয়েছে। বর্তমান বাজেটে অবশ্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ১,০৪,২৭৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। গতবারের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ১১,০০০ কোটি টাকার এই বরাদ্দ বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির সুবাদে বেশ খানিকটা কম। তার উপরে ওই ডিজিটাল শিক্ষা পরিকাঠামোর জন্যই এর বেশির ভাগটা ব্যয়িত হবে। যখন দরকার ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখি করে তুলে গত দু’বছরে যে লাখো লাখো ছাত্রীছাত্র শিক্ষাঙ্গনের বাইরে চলে গেছে তাদের বিদ্যালয়মুখি করে তোলার, তখন ডিজিটাল শিক্ষার উপরে জোর দিয়ে তাদের আরো বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। ই-বিদ্যার জন্য ২০০ টিভি চ্যানেল, ৭৫০ ভার্চুয়াল ল্যাব, ৭৫ ই-ল্যাবের ঢক্কানিনাদ কতটা কার্যকরী হবে জানা নেই। কিন্তু তা অধিকাংশ বিদ্যালয় ছুটদের যে বিদ্যালয়ের বাইরেই রেখে দেবে তাই নয় ডিজিট্যাল-বিভক্ত সমাজে শিক্ষাক্ষেত্রে আরো বেশি অসাম্য সৃষ্টি করবে। যেখানে দেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে ডিজিটাল পরিকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ বা পয়সা নেই সেখানে এর মানে কী? আদতে এর মাধ্যমে শিক্ষাকে আরো বেশি করে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়াই উদ্দেশ্য। সেই জন্যই যে ১১ লক্ষ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে সে ব্যাপারে বাজেটে কোনো উল্লেখই নেই। সেই লক্ষ্যেই পূর্বের মিড-ডে-মিল প্রকল্পে, বর্তমানে যার গালভরা নাম হল পিএম পোষণ শক্তি নির্মাণ, টাকার বরাদ্দ গত কয়েক বছর ধরেই কমছে, এবারো কমানো হয়েছে। গতবছরের ১১,৫০০ কোটির থেকে ১,৩০০ কোটি কমিয়ে ১০,২০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। যা ২০২০-২১ বাজেটের (১২,৯০০ কোটি) তুলনায় ২,৭০০ কোটি টাকা কম। সরকারের যদি বিদ্যালয়ছুট ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়ে আসার সদিচ্ছা থাকত তাহলে বরাদ্দ বাড়ত, কমত না।

১০০ দিনের কাজের জন্য বাজেটে ৭৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যদিও গতবছরের সংশোধিত বরাদ্দের পরিমাণ ৯৮,০০০ কোটি টাকা। ওই পরিমাণ বরাদ্দ সত্ত্বেও ২০২২’র ১ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুসারে ৭৭ লক্ষ পরিবারের কাজের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ৭,০০০ কোটি টাকার বেশি সংশোধিত বরাদ্দের থেকে বেশি খরচ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে ওই বকেয়া মিটিয়ে থাকবে ৬৬,০০০ কোটি টাকার মতো, যা ২০২১-২২’র সামগ্রিক খরচ ১,০৫,০০০ কোটি টাকার তুলনায় ৪০ শতাংশ কম। গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও সরকার বাজেট বরাদ্দ (১,৩৮,২০৩ কোটি) গতবছরের সংশোধিত খরচের (১,৫৫,০৪২ কোটি) তুলনায় কমিয়েছে প্রায় ১৭,০০০ কোটি টাকা।

গতবছরের বাজেটের তুলনায় সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণে অধিক ব্যয় করেছিল। ফলে সংশোধিত খরচ হয়েছিল ৮৬,০০০ কোটি টাকা। এবছর, অতিমারীর সময়ে ও পরে যখন স্বাস্থ্যের প্রয়োজন সর্বাধিক তখন টাকার অঙ্কে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। বছরে ৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ধরলে যা গতবছরের ব্যয়ের তুলনায় ৫,০০০ কোটি টাকা কম। গতবছর বাজেটে পিএম আত্মনির্ভর স্বাস্থ্য ভারত যোজনার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। তারমধ্যে বহুকিছুর সাথে ছিল ব্লকস্তরে ১১টি রাজ্যে জনস্বাস্থ্য ল্যাব তৈরি, ৬০২টি জেলায় ক্রিটিকাল কেয়ার ব্লক তৈরি, ১৫টি জরুরি স্বাস্থ্য অপারেশন কেন্দ্র, দু’টি মোবাইল হাসপাতাল প্রভৃতি। রূপায়ণের যে খতিয়ান দাখিল করা হয়েছে সেখানে এগুলির কোনো উল্লেখ নেই।

অতিমারীর অমৃতকালে খাদ্যে ভর্তুকিও কমছে গতবছরের সংশোধিত বরাদ্দ ২,৯৯,৩৫৫ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২,০৭,২৯১ কোটি টাকা, ৯২,০৬৪ কোটি টাকা কম। যদি ৬ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ধরা হয়, তাহলে হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াবে ১,১০,০০০ কোটি টাকায়। অসাম্য ও দারিদ্রের ফলে যখন খাদ্যের পরিমাণ সর্বোচ্চ তখন খাদ্যে ভর্তুকি কমানোর ভাবনাই পাপ। ঠিক এই দিক দিয়েই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিষয়টিকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি বাজেটে। যদিও অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, “সকলের জন্য উন্নয়ন সরকারের অগ্রাধিকার যারমধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১ কোটি কৃষকের জন্য লাভজনক গম, ধান, খরিফ ও রবিশস্যের সংগ্রহ”। তিনি এও বলেন যে, ১৬৩ লক্ষ কৃষকের কাছ থেকে ১,২০৮ লাখ মেট্রিক টন গম ও ধান কেনা হবে। তাদের খাতায় সরাসরি ২.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হবে। কিন্তু বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ১,৩২,৫১৪ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে যা গতবছরের বরাদ্দ ১,৩১,৫৩১ কোটির তুলনায় মাত্র ৯৮২ কোটি টাকা বেশি। এক্ষেত্রেও যদি মুদ্রাস্ফীতিকে ধরা হয় তাহলে বরাদ্দ প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা কম।

এই বাজেট অধিকাধিক বেসরকারিকরণের দিক দেখাচ্ছে। মূলধনী ব্যয়ের মাধ্যমে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে খরচ বাড়িয়ে সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রকে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার তত্ত্বই বাজেটে প্রচ্ছন্ন। তাই মধ্যবিত্ত বা নিচের দিকে থাকা বেতনভোগীদেরও কোনোরকম করের সুবিধে দেওয়ার কথা নেই। অর্থাৎ ভোগব্যয় বাড়ানোর জন্য সাধারণ করদাতাদের জন্য কোনো উৎসাহ দেওয়ার নামগন্ধ নেই বাজেটে। কিন্তু কর্পোরেটদের জন্য কিছু সুবিধে দেওয়া হয়েছে। তেলা মাথায় তেল দিয়ে একদিকে অর্থনীতিতে অসাম্য বাড়ানো অপরদিকে শাসক বিজেপি’র তহবিল বাড়ানোর কৌশল চলতেই থাকছে।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-6