কর্ণাটক হিজাব-হাঙ্গামা : বিজেপি’র দক্ষিণী গবেষণাগার থেকে হুঁশিয়ারি
Karnataka Hijab Row

উত্তরপ্রদেশ এবং অন্য চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে, বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করে তোলার পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হরিদ্বারে আমরা দেখেছি ‘ধর্ম সংসদের’ ছদ্ম-আবরণে এক বিদ্বেষ-জমায়েত থেকে প্রকাশ্যে গণহত্যার আওয়াজ তোলা হয়েছে। সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি প্রকাশ্য সভায়। ইতিমধ্যে, সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনীর দক্ষিণী গবেষণাগার কর্ণাটক, মুসলিম মহিলাদের পরিধেয় হিজাবে এক শক্তিশালী হাতিয়ার আবিষ্কার করে ফেলেছে! উদুপি’র একটি কলেজ থেকে শুরু হয়ে এখন হিজাব-পরা কার্যত নিষিদ্ধ হল কর্ণাটকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। কারণ হাইকোর্ট সরকারি আদেশনামার উপর স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেছে। আর অন্যদিকে কর্ণাটক জুড়ে উচ্ছৃঙ্খল ভীড়-তাণ্ডব হিজাব-পরিহিতা মহিলাদের পিছু ধাওয়া করে উত্যক্ত করে চলেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরার অধিকার অস্বীকার করাকে ইতিমধ্যেই ‘হিজাব জিহাদ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, ঠিক যেমনটা ভিন্নধর্মের মধ্যে বিয়েকে ‘লাভ জিহাদ’ আখ্যা দিয়ে তার অপরাধীকরণ করা হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর উত্তরপ্রদেশের এক বিজেপি এমএলএ তো মুসলিমদের টুপি পরা বন্ধ করে তাদের কপালে ফোঁটা তিলক কাটিয়ে ছাড়বেন বলে ভোট চাইছেন! এথেকেই অত্যন্ত পরিষ্কার যে, এই হিজাব-হাঙ্গামা ভোট-মুখী রাজ্যগুলিতে বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারকে ‘উৎসাহিত’ করার জন্যই খুব ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব কষে শুরু করা হয়েছে। হিজাব ও টুপি মুসলিম-পরিচিতির বিশিষ্টতম চিহ্নগুলোর অন্যতম। তাই ‘অভিন্ন দেওয়ানীবিধি’ নিয়ে বিজেপি’র এই হৈচৈয়ের মূল উদ্দেশ্য মুসলিম-পরিচিতির এই স্বাতন্ত্র্য চিহ্নগুলিকে অদৃশ্য করে দেওয়া এবং এইভাবে বৈচিত্র্যময় ‘ভারতীয়’ পরিচয়কে মুছে দিয়ে আরএসএস-নির্দেশিত এক অভিন্ন পরিচিতি সবার জন্য সবক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়া।

হিজাব-নিষেধাজ্ঞা বেশ কয়েকটি প্রশ্নে সংবিধান-সুরক্ষিত মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে। এক্ষেত্রে খুব স্পষ্টভাবেই একজন মহিলার নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরার মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। স্কুল এবং কলেজ ইউনিফর্ম সবসময়ই সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র, পাগড়ি এবং হিজাব সহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য চিহ্নগুলো মেনে নিয়েছে। কিন্তু মহিলাদের পোশাক বিধিনির্দেশ করে দেওয়ার প্রবণতা সাম্প্রতিককালে স্পষ্টভাবে বাড়ছে। এই হিজাব-নিষেধাজ্ঞা ঠিক একইভাবে মেয়েদের পছন্দমত পোশাক পরার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। যেমনটা জিনস পরিহিতা মেয়েদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই শুনতে পাওয়া যায় খাপ পঞ্চায়েতের ফতোয়া। হিজাব ধর্মীয় বিশ্বাস ও পরিচিতির সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কিত, শিখ পুরুষদের ক্ষেত্রে যেমন পাগড়ি। এই নিষেধাজ্ঞা তাই ধর্মীয় স্বাধীনতারও লঙ্ঘন।

Southern Laboratory of bjp

কর্ণাটক সরকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করেছে। কলেজে হিজাব পরে আসা মেয়েরা কখনও শান্তি শৃঙ্খলার কোনও সমস্যা সৃষ্টি করেনি। এবিভিপি এবং সঙ্ঘ বাহিনীর অন্যান্য সংগঠনের উচ্ছৃঙ্খল ভীড়-তাণ্ডব মানবাধিকার এবং ক্যাম্পাসের শান্তি — উভয়কেই বিপন্ন করেছে। একলা মেয়ে মুস্কান খানকে গেরুয়া চাদর উড়িয়ে হেনস্থা করতে করতে তাড়া করে চলেছে এক দঙ্গল পুরুষ — এই ভিডিও অত্যন্ত প্রকট করে তুলেছে এই বাস্তবতাকে গোটা পৃথিবীর সামনে। তবুও কর্ণাটক হাইকোর্ট তার অন্তর্বর্তী আদেশে এই নির্লজ্জ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছে এবং কার্যত রাজ্য সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, যদিও বিভিন্ন আদালতের বেশ কয়েকটি রায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের হিজাব পরার অধিকারকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

ধর্ম এবং শিক্ষা অথবা স্বাধীনতা ও তারজন্য শিক্ষা — এই দু’টির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করা — এক চরম নিষ্ঠুরতা। আর সেটাই করে কর্ণাটক হাইকোর্ট নারীর শিক্ষার প্রশ্নে এক ক্ষতিকারক অবস্থান নিয়েছে। তারফলে ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি, পড়ুয়ারা ক্লাসরুম, পরীক্ষা ছেড়ে বেরিয়ে আসাটাকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশের আপাত নিরপেক্ষতা এক মিথ্যা সমতুল্যতার উপর ভিত্তিশীল। হিজাব মুসলিম মহিলাদের প্রথাগত পরিচ্ছদের অংশ। আর গেরুয়া উত্তরীয় প্রদর্শিত হয়েছিল প্রতিবাদের নামে আক্রমণাত্মক হওয়া বা ভীতিপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। আমরা কলেজ প্রাঙ্গণে গেরুয়া পতাকা তোলার ঘটনাও দেখেছি। স্পষ্টতই গেরুয়া উত্তরীয় বা গেরুয়া পতাকার প্ররোচনা এসেছে আরএসএস মতাদর্শ থেকে, কোনো ঐতিহ্য বা প্রথাগত অভ্যাস থেকে নয়! বৈষম্য এবং অবমাননার শিকার মুসলিম মহিলাদের প্রতি সংহতি জানাতে, কিছু ছাত্র নীল উত্তরীয় পরে ‘জয় ভীম’ শ্লোগান দিচ্ছিলেন। কর্ণাটক হাইকোর্ট আলাদা বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে সব কিছুকে একই বন্ধনীর মধ্যে নিয়ে এসে, শুধু হেনস্থাকারীদের উৎসাহিত করেছে আর বলা বাহুল্য, হিজাব-হেনস্থার শিকার যারা, তদের হতাশ করেছে।

বিভ্রান্ত একটি উদারপন্থী ভাবনা হিজাব হাঙ্গামার গোটা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতকে এড়িয়ে গিয়ে, এই নিষেধাজ্ঞাকে মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়নের পথে এক-পা এগিয়ে যাওয়া বলে স্বাগত জানাচ্ছে। সত্যকে অনুধাবন করতে হবে। ভারতে মুসলিম মহিলারা হিজাব-পরা নিয়ে কোনো তালিবানি ফতোয়ার সম্মুখীন নন। তবে তালিবান-সদৃশ কোন আক্রমণ যদি এক্ষেত্রে ঘটে থাকে, তা হল হিজাব-পরা মহিলাদের উপর রাজ্যের আরোপিত চাপ এবং রাস্তায় উচ্ছৃঙ্খল ভীড়ের হেনস্থা-তাণ্ডব। এমনকি এক হিন্দু আইনজীবী যিনি হিজাব পরার অধিকারের সমর্থনে আবেদনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তাকে সামাজিক মাধ্যমে ‘হিন্দু আদর্শের’ শত্রু বলে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আর বিজেপি, মুসলিম আবেদনকারীদের ভয় দেখানো, এমনকি আক্রমণের মুখে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে, তাদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এই পরিস্থিতিতে মুসলিম মহিলাদের উপর পরিবার ও ঐ সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল অংশ থেকে আরও বড় পাল্টা চাপ আসবে সম্প্রদায়ের মর্যাদা এবং বিধান মেনে চলার জন্য।

ইসলাম-ভীতি ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সঙ্ঘ-বিজেপি পরিবারের চাই নানা হাতিয়ার, চাই বহুমুখী সংঘাত-সংঘর্ষ চালানোর নানা অস্ত। আর সেসব তৈরির পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য, ঠিক গুজরাট আর উত্তরপ্রদেশের মতো, কর্ণাটককেও তারা বিশেষ গবেষণাগার হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এই অশুভ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশক্তির পুরো মদত পাওয়ার জন্য বিজেপি প্রথমে রাজ্যের অ-বিজেপি সরকারকে ফেলে দেয়। তারপর নিচুতলায় এক ভয়ঙ্কর উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি সমাবেশের মাধ্যমে পুরোমাত্রায় ফ্যাসিবাদী আক্রমণ শানানোর জন্য দু’বছরের মাথায় শীর্ষে পরিবর্তন ঘটায়। আইন পাল্টানো হচ্ছে। নতুন নিয়ম তৈরি হচ্ছে। আর মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করা ও প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য নির্ভেজাল সন্ত্রাসের এক রাজত্ব কায়েম করে। এম এম কালবুর্গী এবং গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পর, হিজাব-হাঙ্গামা সঙ্ঘী-বিজেপি’র দক্ষিণী গবেষণাগার থেকে জেগে ওঠার আরেকটি হুঁশিয়ারি!

কুড়ি বছর আগে গুজরাট গবেষণাগার এক গণহত্যার জন্ম দিয়েছিল, আর তারপরেই, তৈরি হয়েছিল মারাত্মক দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত এক পুলিশ রাষ্ট্র। উত্তরপ্রদেশ গবেষণাগার আমাদের সামনে আরেকটা পুলিশ রাষ্ট্র আর সবচেয়ে নিষ্ঠুর নির্মম এক শাসন হাজির করেছে। কর্ণাটক থেকে আসা হুঁশিয়ারিতে ভারতকে জেগে উঠতেই হবে।
আর কাল-বিলম্ব নয়!

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-8